সূরা হাজ্জ; আয়াত ২৬-২৯
সূরা হাজ্জ; আয়াত ২৬-২৯
সূরা হাজ্জের ২৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَنْ لَا تُشْرِكْ بِي شَيْئًا وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ (26)
"(সে সময়কে স্মরণ কর) যখন আমরা ইবরাহীমের জন্য (কাবা) গৃহের স্থান নির্দিষ্ট করেছিলাম (এবং তাকে বলেছিলাম,) আমার সাথে কোন অংশী সাব্যস্ত কর না এবং আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, (নামাযে) দণ্ডায়মান, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ।" (২২:২৬)
আগের আলোচনায় আমরা মুসলমানদের কাছে মক্কার পবিত্র কাবাঘর বা মসজিদুল হারামের মর্যাদা এবং মুসলমানদেরকে আল্লাহর ঘর জিয়ারত করতে না দেয়ার জন্য কাফিরদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কিছু কথা শুনেছিলাম।
এই আয়াতে কাবা ঘর ও এর মসজিদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। কাবার মসজিদের ঠিক মাঝখানে রয়েছে কাবাঘর। মহান আল্লাহ বলছেন: নতুন করে কাবাঘর পুনঃনির্মাণ বা সংস্কার করেছেন হযরত ইব্রাহিম (আ.) আমার তথা আল্লাহরই নির্দেশে।
ইসলামী বর্ণনা বা ইতিহাসে এসেছে, কাবা ঘর প্রথমবার নির্মাণ করেছিলেন হযরত আদম (আ.)। কিন্তু ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় এই ঘর ধ্বংস হয়ে গেলে মহান আল্লাহ ইব্রাহিম (আ.)-কে এর ঘর পুননির্মাণের দায়িত্ব দেন। তিনি শাম বা সিরিয়া অঞ্চল থেকে মক্কা অঞ্চলে আসেন এবং আবার গড়ে তোলেন এই পবিত্র গৃহ। অবশ্য এই পবিত্র ঘরের কিছু চিহ্ন বা ভিত্তি তখনও টিকে ছিল।
ইব্রাহিম (আ.) নিজের ছেলে হযরত ঈসমাইল (আ.)'র সহায়তা নিয়ে কাবা ঘর পুননির্মাণ করেন এবং এর চারপাশেও ইবাদতের জন্য প্রশস্ত জায়গা বা বারান্দা গড়ে তোলেন ও এইসব এলাকাও পবিত্র করেন যাতে এখানে জিয়ারত করতে আসা মানুষেরা এই ঘরের চারপাশ প্রদক্ষিণ করতে পারে কিংবা চাইলে নামাজও আদায় করতে পারে।
এই আয়াতের দু'টি শিক্ষা হল:
১. ইবাদতের ঘর বা স্থানগুলোতে প্রবেশের জন্য সব ধরনের শির্ক বা অংশীবাদিতা ঝেড়ে ফেলতে হবে মন থেকে। এভাবে পবিত্র অন্তর ও একনিষ্ঠ মন নিয়ে ইবাদত-কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হবে।
২. মসজিদকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র রাখা ইব্রাহিমি মিশন বা দায়িত্বের সমতুল্য।
সূরা হাজ্জের ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ (27)
"এবং মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা করে দাও, যেন তারা তোমার কাছে পায়ে হেঁটে এবং সব রকমের শীর্ণকায় (উটে চড়ে) বাহনে করে দূর-দূরান্ত হতে (গভীর উপত্যকা অতিক্রম করে) আসে।" (২২:২৭)
হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে দিয়ে কাবা ঘর পুনঃনির্মাণ এবং আশপাশের এলাকাও পবিত্র করার পর মহান আল্লাহ এবার এই মহান নবীকে নির্দেশ দিলেন, হে ইব্রাহিম, মানুষকে এই ঘর জিয়ারতের ও প্রদক্ষিণ করা আহ্বান জানাও। কেবল মক্কার অধিবাসীদেরকেই নয়, সকল একত্ববাদীকে ও আল্লাহর ইবাদতকারীদেরকে কাছের এবং দূরের সব অঞ্চল থেকে এই শহরে আসতে বল ও এখানে একত্ববাদী ইবাদত ও অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করতে বল।
ইতিহাসে দেখা যায়, হযরত ইব্রাহিম (আ.)'র যুগ থেকেই পবিত্র কাবা ছিল সব ধর্মের অনুসারীদের ও এমনকি মুশরিকদেরও আকর্ষণের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এমনকি ইসলামের আবির্ভাবের যুগেও মুশরিকরা এই ঘরের চারদিক প্রদক্ষিণ করত ও হজ্জের অনুষ্ঠানাদি পালন করত। অবশ্য মুশরিকদের এইসব অনুষ্ঠান ছিল বিকৃত ও পবিত্রতা থেকে বিচ্যুত।
এই আয়াতের দু'টি শিক্ষা হল:
১. হজ্জে যাওয়ার অর্থ হল ইব্রাহিম (আ.)'র আহ্বানে সাড়া দেয়া। হাজার হাজার বছর পরও মক্কার পাহাড়গুলো থেকে ইব্রাহিম (আ.)'র সেই আহ্বান যেন মানুষের কানে বাজছে।
২. একত্ববাদী ইবাদত ও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অবহেলা বা শৈথিল্য কাম্য নয়। তাই পায়ে হেঁটে বা যে কোনো যানবাহনে চড়ে এ ধরনের দায়িত্ব পালনের পদক্ষেপ নিতে হবে।
সূরা হাজ্জের ২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ (28)
"যাতে তারা (হজ অনুষ্ঠানের মধ্যে) তাদের কল্যাণ প্রত্যক্ষ করে এবং যাতে তারা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে (বিশেষ করে পশু কুরবানির সময়) সেই গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণীদের ওপর- যেগুলো আল্লাহ জীবিকাস্বরূপ তাদের দান করেছেন- আল্লাহর নাম স্মরণ করে; অতএব, তোমরা তা হতে আহার কর এবং দুর্গত-অভাবগ্রস্তকেও আহার করাও।"
আগের আয়াতে মানুষকে হজ অনুষ্ঠানের আহ্বান জানানোর পর এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন, কাবা ঘরের পাশে মুসলমানদের সমাবেশের মধ্যে রয়েছে অনেক কল্যাণ। হজযাত্রীরা এখানে উপস্থিত হয়ে সেইসব কল্যাণ প্রত্যক্ষ করেন। এইসব কল্যাণের মধ্যে কোনো কোনোটি বস্তুগত ও কোনো কোনোটি হল আধ্যাত্মিক বরকত।
হজ সমাবেশ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি আর সহমর্মিতা সৃষ্টি করে। তারা জানতে পারেন নানা অঞ্চলের সুযোগ-সুবিধা এবং পরস্পরের সুখ-দুঃখের দিকগুলো। ফলে তারা একে-অপরের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন। এ ছাড়াও হজ-সমাবেশ বিশ্বে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের মত সামাজিক কল্যাণেরও মাধ্যম।
অন্যদিকে হজ ব্যক্তি পর্যায়ে অহঙ্কার ও দুনিয়া-পূজা থেকে মানুষের মনকে পবিত্র করার শিক্ষা দেয় এবং মানুষের মনকে পরকাল ও আধ্যাত্মিকতার দিকে নিবিষ্ট করে।
হজ মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য-সম্পর্ক জোরদারেরও এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। অথচ এই দিকটির ওপর খুব কমই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। হজ্জের অর্থনৈতিক দিকটিকে এই মহান ইবাদতের চেতনার বিরোধী বলে মনে করাও ঠিক নয়। কারণ, ইসলামী নানা বর্ণনায় হজ্জের অর্থনৈতিক কল্যাণের কথাও এই মহান ইবাদতের অন্যতম কল্যাণ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।
এই আয়াতের পরবর্তী অংশে পুণ্যভূমি মিনায় কুরবানি অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। মুশরিকরা পশু উতসর্গ করার সময় তাদের নানা মূর্তির নাম উচ্চারণ করত। আর এই আয়াতে পশু কুরবানির সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যাতে এই অনুষ্ঠান শির্ক বা শির্কযুক্ত আচরণের যে কোনো পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত থাকে। এ ছাড়াও এই আয়াতে কুরবানির কিছু গোশত দরিদ্রদের দান করতে বলা হয়েছে। কারণ, হজ্জের চেতনাই হল ধন-সম্পদের মোহ ত্যাগ করা এবং অন্যদের ও বিশেষ করে দরিদ্রদের কল্যাণের জন্য নিজের স্বার্থত্যাগ বা আত্মত্যাগে ব্রতী হওয়া।
শুধু কুরবানির সময়ই আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা যথেষ্ট নয়। হজ্জ্বের নানা পর্বে এবং বিশেষ করে, মিনায় উপস্থিতির সময় প্রত্যেক নামাজের পর বিশেষ কিছু শব্দ বা বাক্য আল্লাহর স্মরণ বা জিকর হিসেবে উচ্চারণ করা হয়।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষা হল:
১. হজ ব্যক্তিকেন্দ্রীক কোনো অনুষ্ঠান বা ইবাদত নয়, বরং এটি বড় ধরনের সামাজিক ইবাদত। এই ইবাদতে শামিল হন সারা বিশ্বের নানা দিক থেকে আসা লাখ লাখ মুসলমান। ইসলামের সুরক্ষা ও মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধিতে এই অনুষ্ঠানের রয়েছে ব্যাপক প্রভাব এবং ভূমিকা।
২. আল্লাহর স্মরণ জোরদার করা ও মনকে আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছু থেকে পবিত্র করা হজসহ অন্যান্য ইবাদতের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য।
৩. কাবা ঘরের পাশে মুসলমানদের মহাসমাবেশকে মুসলমানদের দারিদ্র দূর করার কাজেও ব্যবহার করা উচিত।
সূরা হাজ্জের ২৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
ثُمَّ لْيَقْضُوا تَفَثَهُمْ وَلْيُوفُوا نُذُورَهُمْ وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ (29)
"অতঃপর (মিনায় কুরবানি অনুষ্ঠানের পর) তারা যেন নিজ নিজ দৈহিক অপরিচ্ছন্নতা দূর করে ও তাদের মানত পূর্ণ করে এবং প্রাচীন গৃহের (কাবাগৃহের) তাওয়াফ (প্রদক্ষিণ) করে।"
কুরবানি করার পর হজযাত্রীরা মাথার চুল ছোট করেন বা কামিয়ে ফেলেন কিংবা নখ কাটেন যাতে শারীরিক পবিত্রতা অর্জিত হয়। এরপর তারা ইহরামের পোশাক খুলে ফেলেন এবং মক্কায় গিয়ে আবার তাওয়াফ করেন। যারা হজ করার সৌভাগ্য অর্জনের জন্য পশু কুরবানির করার মানত করেন বা সদকা দেয়ার মানত করেন তাদেরকে হজ্জের পরপরই তা দ্রুত সম্পন্ন করতে এই আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এই আয়াতের শিক্ষা হল:
১. ইসলামের অন্য অনেক ইবাদতের মত হজ করার জন্যও শারীরিক পবিত্রতা অর্জন জরুরি। আর এ থেকে পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যগত দিকের প্রতি ইসলামের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে।
২. কাবা ঘর প্রাচীনতম ইবাদত-কেন্দ্র ও আল্লাহর ঘর। এই ঘর মানুষের মালিকানা থেকে মুক্ত।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন