সূরা হাজ্জ; আয়াত ২২-২৫
সূরা হাজ্জ; আয়াত ২২-২৫
সূরা হাজ্জের ২২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
كُلَّمَا أَرَادُوا أَنْ يَخْرُجُوا مِنْهَا مِنْ غَمٍّ أُعِيدُوا فِيهَا وَذُوقُوا عَذَابَ الْحَرِيقِ (22)
"যখনই তারা জাহান্নামের দুঃখ ও অবমাননা হতে বের হতে চাইবে তখনই তাদের সেখানে ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং (বলা হবে), দগ্ধকারী শাস্তি আস্বাদন কর।" (২২:২২)
আগের আলোচনায় আমরা জেনেছি, যারা বিশ্বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে তাদেরকে আল্লাহ কঠোর শাস্তি দেবেন। এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, দোযখ বা জাহান্নাম অত্যন্ত অনুতাপ ও দুঃখের স্থান। এখানে পাপীরা অতীতের ভুল ও কুফরির জন্য অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হবে। অবশ্য এইসব অনুশোচনা বা আফসোসের কোনো প্রভাব বা মূল্য নেই। কারণ, এই অনুতাপ ক্ষমা বা শাস্তি হ্রাসে কোনো ভূমিকা রাখবে না। আসলে কেবল ইহকালীন জীবনই হল আত্ম-সংশোধনের জীবন ও কর্ম বা আমলের জীবন। পরকাল হল কেবলই শাস্তি বা পুরস্কার লাভের জীবন।
এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. দোযখে শারীরিক শাস্তির চেয়েও বড় শাস্তি হল মানসিক শাস্তি।
২. যারা সত্য ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধর্মের বিরোধিতা অব্যাহত রেখেছে তাদেরকে চিরকাল জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে।
সূরা হাজ্জের ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنَّ اللَّهَ يُدْخِلُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِنْ ذَهَبٍ وَلُؤْلُؤًا وَلِبَاسُهُمْ فِيهَا حَرِيرٌ (23)
"যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে, নিশ্চয় আল্লাহ তাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত থাকবে। সেখানে তাদের সোনার ও মুক্তার চুড়ি দিয়ে অলঙ্কৃত করা হবে এবং সেখানে তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ হবে রেশমের।" (২২:২৩)
আল্লাহকে অস্বীকার ও অবিশ্বাসের কারণে এবং বিশ্বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করার কারণে দোযখীরা আল্লাহর ক্রোধসহ যেসব কঠোর শাস্তির শিকার হবে তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে আগের আয়াতে। এই আয়াতে বেহেশত বা জান্নাতে মুমিন বা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ও সতকর্মশীলদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের কথা তুলে ধরে মহান আল্লাহ বলছেন: কাফিররা এই দুনিয়াতে যা পাওয়ার জন্য সচেষ্ট ছিল আল্লাহ আখিরাতে তার সবই দেবেন ঈমানদারদের। সবচেয়ে সুন্দর ও উন্নত বাগান, সবচেয়ে উন্নত পোশাক এবং সর্বোত্তম অলঙ্কারসহ যা যা দুনিয়া-পূজারিদের আকাঙ্ক্ষা তার সবই সেখানে ঈমানদারদের দেয়া হবে ন্যুনতম বা সামান্যতম পুরস্কার হিসেবে।
পুরুষ মুমিন মুসলমানরা যাতে অহঙ্কারী হয়ে না পড়েন এবং আল্লাহর প্রতি নতজানুতার ক্ষেত্রে উদাসীন না হন সেজন্য তিনি এই পার্থিব জীবনে তাদের জন্য স্বর্ণ-অলঙ্কার ব্যবহার ও রেশমের পোশাক পরা নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু পরকালে আল্লাহ তাদের জন্য এই সীমাবদ্ধতা তুলে নেবেন এবং তাদেরকে দুনিয়ার পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলঙ্কারের চেয়ে অনেক উন্নত পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলঙ্কার দান করবেন।
অবশ্য পার্থিব জীবনেও অল্প বা মুষ্টিমেয় সংখ্যক মানুষ উন্নত বস্ত্র, অর্থ-বিত্ত ও অলঙ্কারের অধিকারী হবেন। তবে বেশিরভাগ মানুষই তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হবে না। বরং তারা দুনিয়া ও আখিরাত এ উভয় জগতেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. সবুজ-শ্যামল বাগ-বাগিচা মানুষের জন্য সবচেয়ে উন্নত শারীরিক ও মানসিক আনন্দের মাধ্যম। তাই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সতকর্মশীল মুমিনদের জন্য পরকালে এটাই হবে প্রথম পুরস্কার।
২. কুরআনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থায় আশা ও ভয় এবং সতর্ককরণ ও সুসংবাদ দেয়ার মধ্যে ভারসাম্য ও মিল রয়েছে। তাই আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রেও এই ভারসাম্য বজায় রাখা উচিত।
সূরা হাজ্জের ২৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَهُدُوا إِلَى الطَّيِّبِ مِنَ الْقَوْلِ وَهُدُوا إِلَى صِرَاطِ الْحَمِيدِ (24)
"তাদের পবিত্র কথার দিকে পথনির্দেশ করা হবে এবং তাদেরকে (ইবাদতের জন্য একমাত্র উপযুক্ত সত্তা তথা আল্লাহর) প্রশংসিত পথে পরিচালিত করা হবে।" (২২:২৪)
আগের আয়াতে বেহেশতের বস্তুগত ও শারীরিক নেয়ামতগুলোর কথা তুলে ধরা হয়েছে। আর এই আয়াতে বেহেশতের আধ্যাত্মিক নেয়ামতগুলোর কথা বলা হচ্ছে। মহান আল্লাহ বলছেন: বেহেশতবাসীদের মধ্যে প্রাণজুড়ানো আলোচনা তাদের জন্য অতি উন্নত মানের আনন্দ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হচ্ছে সর্বোত্তম আনন্দ। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন দুনিয়া ও আখিরাতে মুমিনদের সর্বোত্তম আকাঙ্ক্ষা যা আল্লাহর পথে সাধনার মাধ্যমে অর্জিত হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর আধ্যাত্মিক নৈকট্য পেতে সক্ষম হবে এবং এটাই উচ্চতর মানবীয় পূর্ণতা অর্জনের পথ।
এই আয়াতের শিক্ষা হল:
১. বেহেশত কেবল শারীরিক আনন্দের স্থান নয়, আল্লাহ সেখানে আধ্যাত্মিক ও আত্মিক আনন্দের ব্যবস্থাও রেখেছেন।
২. সুপরিণাম ও সৌভাগ্য কেবল তাদের জন্যই অপেক্ষা করছে যারা পার্থিব জীবনে আল্লাহর পথে অবিচল থাকার চেষ্টা করেছেন।
সূরা হাজ্জের ২৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ الَّذِي جَعَلْنَاهُ لِلنَّاسِ سَوَاءً الْعَاكِفُ فِيهِ وَالْبَادِ وَمَنْ يُرِدْ فِيهِ بِإِلْحَادٍ بِظُلْمٍ نُذِقْهُ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ (25)
"নিশ্চয়ই যারা অবিশ্বাস করে এবং মানুষকে আল্লাহর পথ হতে ও সম্মানিত মসজিদ তথা কাবাগৃহ হতে হতে নিবৃত্ত করে (তারা কঠোর শাস্তির যোগ্য) – যদিও এই মসজিদকে আমরা মানবজাতির সবার জন্য, হোক তারা সেখানে অবস্থানকারী বা মক্কাবাসী অথবা মুসাফির তাদের সবার জন্য সমান করেছি এবং যে কেউ এই অঞ্চলে (মসজিদে) সত্য হতে বিচ্যুত হতে চাইবে ও জুলুম করবে- তাকে আমরা মর্মান্তিক শাস্তি আস্বাদন করাব।" (২২:২৫)
মুমিনদের সঙ্গে লড়াইকারী কাফিরদের পরিণতি তুলে ধরার পর মহান আল্লাহ এই আয়াতে তাদের পরিণতি তুলে ধরছেন যারা মানুষকে হজে ও কাবা ঘরে যেতে বা হজ্ব অনুষ্ঠান পালনে কোনো না কোনোভাবে বাধা দেয়। পবিত্র মক্কা ও মসজিদুল হারাম সব মুসলমানের সাধারণ সম্পদ। এখানে কেউ অন্যদের তুলনায় বিশেষ সুবিধা ভোগের অধিকার রাখে না। এমনকি যারা এই শহরের অধিবাসী বা মূল বাসিন্দা তারাও বিশেষ সুবিধা পাওয়ার ও কারো হজযাত্রায় বাধা দেয়ার কিংবা মুসাফিরদের উত্যক্ত করার কোনো অধিকার রাখে না।
এই আয়াতের শিক্ষা হল:
১. ধর্মীয় স্থানগুলোর সম্মান ও পবিত্রতা বজায় রাখতে হবে এবং ইবাদতকারীদের সঙ্গে কোনো দুর্ব্যবহার করা যাবে না।
২. মক্কা খোদায়ী নির্দেশ অনুযায়ী নিরাপদ শহর। কোনো বিশেষ গ্রুপ বা ব্যক্তি এই শহরের মালিক নয়। আল্লাহর ঘর কোনো মানুষ বা শাসক ও সরকার বা রাষ্ট্রের আওতাধীন নয়। এই পবিত্র স্থানকে বিশেষ কোনো মাজহাবের নিজস্ব রুচি বা দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতে হবে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন