সূরা হাজ্জ; আয়াত ১৭-২১
সূরা হাজ্জ; আয়াত ১৭-২১
সূরা হাজ্জের ১৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا وَالَّذِينَ هَادُوا وَالصَّابِئِينَ وَالنَّصَارَى وَالْمَجُوسَ وَالَّذِينَ أَشْرَكُوا إِنَّ اللَّهَ يَفْصِلُ بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ (17)
"নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, ইহুদী হয়েছে, যারা নক্ষত্র-পূজারী, খ্রিস্টান, অগ্নি-উপাসক এবং যারা অংশীবাদী হয়েছে অবশ্যই আল্লাহ তাদের মধ্যে কিয়ামত দিবসে ফয়সালা করে দেবেন; নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত কিছুর ওপর সাক্ষী।" (২২:১৭)
'ইয়াওমুল ফাসল্৭' কিয়ামত বা পুনরুত্থান দিবসের অন্যতম নাম। এর অর্থ এই দিনে আল্লাহ সত্যকে মিথ্যা থেকে আলাদা করবেন এবং এই দিনে নানা ধর্ম ও মাজহাব বা ফের্কাগুলোর মতভেদ বা বিবাদের অবসান ঘটবে। এই আয়াতে ধর্মীয় গ্রন্থধারী চারটি দল বা ধর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই দলগুলো হল: ইহুদি, খ্রিস্টান, সাবেয়ি বা নক্ষত্র পূজারি ও অগ্নি উপাসক। প্রথম দুটি দল সবার কাছেই পরিচিত। সাবেয়িদের কথা সূরা বাকারার ৬২ নাম্বার আয়াতেও এসেছে। এরা নিজেদেরকে হযরত ইয়াহিয়া (আ.)'র অনুসারী বলে দাবি করত। তাদের ধর্ম বিশ্বাস ছিল ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্ম-বিশ্বাসের মিশ্রিত রূপ। সাবেয়িরা বড় বড় খালের পাশে বসবাস করত এবং প্রবাহমান পানিকে তারা বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
মাজুসদের কথা পবিত্র কুরআনে একবারই এসেছে। এরা হচ্ছে জরাথ্রুস্ত-এর অনুসারী। জরাথ্রুস্ত ছিলেন হযরত ঈসা (আ.)'র জন্মের কয়েক শত বছর আগের মনীষী। তার ধর্মগ্রন্থের নাম ছিল আভেস্তা। এ ধর্মগ্রন্থের কিছু অংশ এখনও টিকে আছে। জরাথ্রুস্ত ধর্মের অনুসারীরা মঙ্গল ও অমঙ্গলের দুই পৃথক স্রস্টায় বিশ্বাসী এবং তারা চারটি উপাদান বিশেষ করে আগুনকে বেশ গুরুত্ব দেয়। তাদের উপাসনালয়ে সব সময়ই জ্বলন্ত আগুন রাখা হয়।
এই আয়াতের শিক্ষা হল:
১. মুমিনদের হিসেব-নিকেশ মুশরিক এবং অন্য ধর্মগুলোর চেয়ে পৃথক। কিয়ামত বা বিচার দিবসে এই তিন দল তথা মুমিন, মুশরিক ও ধর্মীয় গ্রন্থের অধিকারী তথা ইহুদি-খ্রিস্টানদের হিসেব নেয়া হবে পৃথকভাবে।
২. ধর্ম ও মাজহাবগুলোর মধ্যে মতভেদ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আমাদের দায়িত্ব হল অন্যদের ইসলামের দিকে আহ্বান জানাব এবং এমনটি আশা করা ঠিক হবে না যে সবাইই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে।
সূরা হাজ্জের ১৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يَسْجُدُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ وَالنُّجُومُ وَالْجِبَالُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ وَكَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ وَكَثِيرٌ حَقَّ عَلَيْهِ الْعَذَابُ وَمَنْ يُهِنِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُكْرِمٍ إِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يَشَاءُ (18)
"তুমি কি লক্ষ্য করনি যে, যা কিছু আকাশমণ্ডলীতে আছে এবং যা কিছু ভূমণ্ডলে আছে এবং সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রপুঞ্জ, পর্বতমালা, বৃক্ষাদি, জীব-জন্তু ও মানুষের মধ্যে বহু সংখ্যক আল্লাহকেই সিজদা করে? এবং (তাদের মধ্যে) বহু সংখ্যকের ওপর শাস্তি অবশ্যম্ভাবী হয়েছে। আল্লাহ যাকে অপদস্থ করেন তার জন্য কোন সম্মানদাতা নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা ইচ্ছা তা-ই করেন।" (২২:১৮)
অস্তিত্ব জগতের সব কিছুই যে মহান আল্লাহর কাছে আনত ও বিনম্র তা এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়টিকেই পবিত্র কুরআনের অন্য অনেক স্থানে সব সৃষ্টিকুলের মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা বা তাসবিহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহর অশেষ কৌশলী ও প্রজ্ঞাপূর্ণ বিধি-বিধান বা ব্যবস্থাপনার কাছে সবাই নতজানু এবং আনুগত্যশীল। অন্য কথায় এটাই হচ্ছে সৃষ্টিগত বা প্রকৃতিগত সিজদা। অনুভূতিহীন ও অনুভূতির অধিকারী সব অস্তিত্ব বা বস্তুই এবং এমনকি কাফিররাও খোদায়ী বিধি-বিধান মেনে চলতে বাধ্য। অবশ্য মানুষ ও ফেরেশতাকুলের মত চেতনা বা অনুভূতির অধিকারী অস্তিত্বগুলো আল্লাহর উদ্দেশে বিধানগত সিজদাও আদায় করে থাকেন। মানুষকে কাজ ও চিন্তার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে বলে তারা শরিয়ত বা বিধানের বিপরীত কাজও করতে সক্ষম তথা খোদার বিধান বা নির্দেশ অমান্য করতে সক্ষম। আর এ ধরনের নাফরমানির জন্য মানুষকে ইহকাল ও পরকালে শাস্তি এবং লাঞ্ছনা ভোগ করতে হবে।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর আনুগত্য করে সব ধরনের অস্তিত্ব। তাই আমরা মানুষ যেন এই সমতার শৃঙ্খলায় ব্যাঘাত সৃষ্টি না করি।
২. সম্মান ও অসম্মানের মালিক হলেন মহান আল্লাহ। অর্থাত কেউ সম্মানিত ও অসম্মানিত হয় তাঁরই ইচ্ছায়। তাঁর ইচ্ছার মোকাবেলা করার ক্ষমতা কারো নেই।
সূরার ১৯ থেকে ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
هَذَانِ خَصْمَانِ اخْتَصَمُوا فِي رَبِّهِمْ فَالَّذِينَ كَفَرُوا قُطِّعَتْ لَهُمْ ثِيَابٌ مِنْ نَارٍ يُصَبُّ مِنْ فَوْقِ رُءُوسِهِمُ الْحَمِيمُ (19) يُصْهَرُ بِهِ مَا فِي بُطُونِهِمْ وَالْجُلُودُ (20) وَلَهُمْ مَقَامِعُ مِنْ حَدِيدٍ (21)
"এরা উভয়ে (বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী) দুটি প্রতিপক্ষ, পরস্পর নিজ নিজ প্রতিপালকের ব্যাপারে বিবাদ করে; তবে যারা অবিশ্বাস করে তাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে আগুনের পোশাক; তাদের মাথার ওপর ফুটন্ত পানি ঢালা হবে।" (২২:১৯)
"ফলে তাদের পেটে যা কিছু আছে তা এবং তাদের চামড়াও গলে যাবে।" (২২:২০)
"এবং তাদের জন্য তৈরি থাকবে লোহার হাতুড়ি বা মুগুরসমূহ।" (২২:২১)
ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে, বদরের যুদ্ধের সময় ইসলামের তিনজন খ্যাতনামা মুজাহিদ তিন বিখ্যাত কাফির যোদ্ধাকে হত্যা করতে সক্ষম হন। এই আয়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসা কাফিরদের কঠিন পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। অবশ্য এই আয়াতের অর্থ সব মুমিন ও কাফিরের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের জন্য প্রযোজ্য। মহান আল্লাহ বলছেন: কাফিররা যুদ্ধের যে পোশাক পরেছে তা আগুনের পোশাকে পরিণত হবে এবং তা তাদের শরীরের চামড়া ও এর নীচের সব কিছু জ্বালিয়ে দেবে। মুসলমানদেরকে হত্যার জন্য উদ্যত কাফিরদের হাতের তলোয়ারগুলো পরিণত হবে অত্যন্ত ভারী ও শক্ত লোহার মুগুরে। এগুলো তাদেরই ওপর নেমে আসবে এবং ফলে টুকরো টুকরো হয়ে নির্মূল হয়ে যাবে কাফিরদের শরীর। জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে তাদেরকে দেয়া হবে না কোনো সুপেয় বা স্বাভাবিক পানি, বরং তাদের গায়ে ঢেলে দেয়া হবে এমন ফুটন্ত গরম পানি যে তা অবিশ্বাসীদের কষ্টকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেবে।
এ আয়াতের দুটি শিক্ষা হল:
১. মুমিনরা আল্লাহ ও ধর্মীয় বিধানের ব্যাপারে কখনও কাফিরদের সঙ্গে আপোষ করেন না। এ ব্যাপারে কাফির ও মুমিনদের দ্বন্দ্ব সব সময়ই থাকবে।
২. দোযখ বা জাহান্নামের শাস্তি খুবই কঠিন। এই শাস্তি মোকাবেলার ক্ষমতা কোনো মানুষের নেই।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন