সূরা হাজ্জ; আয়াত ১-৬

সূরা হাজ্জ; আয়াত ১-৬


সূরা হাজ্জ মদীনায় নাজিল হয়েছে। এতে রয়েছে ৭৮টি আয়াত ও ১০টি রুকু। এই সূরার প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ (1) يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللَّهِ شَدِيدٌ (2)
"হে মানবজাতি! তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর তথা তাঁর শাস্তি থেকে নিজেদের রক্ষা কর, নিঃসন্দেহে নির্ধারিত সময়ের তথা কিয়ামতের ভূমিকম্প এক গুরুতর বিষয়।" (২২:১)
"যেদিন তোমরা প্রত্যক্ষ করবে সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী মাতা তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করবে, আর লোকদের নেশাগ্রস্ত মনে হবে, অথচ তারা নেশাগ্রস্ত নয়; বরং আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত কঠোর ও তীব্র।" (২২:২)

এ সূরায় কিয়ামত বা পুণরুত্থান দিবস তথা বিচার দিবসের অনিবার্যতা সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে। তাই পার্থিব জীবন ও ধন-সম্পদসহ বস্তুগত নানা বিষয়ের প্রতি মানুষের প্রবল আকর্ষণের বিরুদ্ধে তাদের সতর্ক করে দিয়ে মহান আল্লাহ বলছেন: এক প্রবল ভূমিকম্পের মধ্য দিয়ে শুরু হবে কিয়ামত বা পুণরুত্থান। ওই প্রবল ভূমিকম্প সারা বিশ্বের মানুষকে করবে আতঙ্কিত ও ভীত-সন্ত্রস্ত। তারা ভয় ও আতঙ্কে এত বেশি বিচলিত বা অস্থির হয়ে পড়বে যে তাদের আচরণ হয়ে পড়বে অস্বাভাবিক ঠিক যেভাবে কোনো মাতাল বা নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি অস্থির হয়ে সব দিকে যেতে চায়। আসলে মাতাল না হওয়া সত্ত্বেও খোদায়ী শাস্তির নমুনা দেখেই মানুষের এই হবে অবস্থা।

এই আয়াত থেকে বোঝা যায়- একদিন এই দুনিয়া বা পার্থিব জগতের অবসান ঘটবে। ধ্বংস হয়ে যাবে পার্থিব ব্যবস্থাপনা। এখানে মহান আল্লাহ কিয়ামত বা মহাপ্রলয়ের ভয়াবহতা তুলে ধরার জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে বলছেন যে, সে সময় যদি দুধের শিশুর অস্তিত্ব থাকে তাহলে তার মা এই প্রাণপ্রিয় দুধের শিশুর কথাও ভুলে যাবেন এবং কোনো নারী গর্ভবতী হয়ে থাকলে সেই নারীও আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে তার গর্ভের সন্তান নষ্ট করে ফেলবেন! তাই আমাদের মনে রাখা দরকার:

১. কিয়ামতের দিন মুক্তি লাভের ও সৌভাগ্য অর্জনের একমাত্র পথ হল পার্থিব এই জীবনে পবিত্র থাকা ও হালাল-হারামের বিধান মেনে চলা।
২. কিয়ামত বা পুনরুত্থানের প্রতি বিশ্বাসই যথেষ্ট নয়, বরং সব সময়ই সেই অনিবার্য দিনের কঠোরতার কথা মনে রেখে দুনিয়ার মোহ ও লোভ-লালসা থেকে আমাদের মুক্ত থাকতে হবে।
৩. কিয়ামত দিবসের কঠোরতা ও কষ্টগুলো এত ভয়াবহ বা তীব্র যে মানুষের তীব্রতম অনুরাগের দিকগুলো যেমন, সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসাও ছিন্ন হয়ে যাবে এবং সেইসব ভয়াবহ ঘটনা মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে অচল করে দেবে।

সূরা হাজ্জের ৩ ও ৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّبِعُ كُلَّ شَيْطَانٍ مَرِيدٍ (3) كُتِبَ عَلَيْهِ أَنَّهُ مَنْ تَوَلَّاهُ فَأَنَّهُ يُضِلُّهُ وَيَهْدِيهِ إِلَى عَذَابِ السَّعِيرِ (4)
"এবং কিছু সংখ্যক মানুষ এমনও আছে যারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহর ব্যাপারে বিবাদে লিপ্ত হয় এবং প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তানের অনুগামী হয়ে থাকে।" (২২:৩)
"তার তথা শয়তানের জন্য নির্ধারিত হয়েছে যে, যে কেউ তার সাথে বন্ধুত্ব করবে, নিশ্চয় সে তাকে পথভ্রষ্ট করবে এবং তাকে প্রজ্বলিত আগুন বা জাহান্নামের দিকে পথনির্দেশ করবে।" (২২:৪)

কিয়ামত সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়ার পর এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন: বিপুল সংখ্যক মানুষ অন্ধ-বিদ্বেষ বা গোঁড়ামি কিংবা অজ্ঞতার কারণে সত্য-বিরোধী অবস্থান নেয় এবং কোনো যুক্তি-প্রমাণ ছাড়াই কখনও আল্লাহ কিংবা কখনও পরকালকে অস্বীকার করে। আসলে এইসব মানুষ নিজ খেয়ালীপনার ও শয়তানের দাস। এরা বিবেক ও জ্ঞানের অনুসরণ করে না। নিঃসন্দেহে যারা শয়তানের কথামত চলে তারা কখনও সৌভাগ্যের পথ খুঁজে পায় না, বরং সত্য ও সৌভাগ্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়। আর জাহান্নামই খোদাদ্রোহীদের পরিণতি।

এ দুই আয়াতের শিক্ষা হল:
১. আলোচনা ও বিতর্ক যদি যুক্তি এবং দলিলভিত্তিক হয়ে থাকে তাহলে তা গ্রহণযোগ্য, কিন্তু আলোচনা ও বিতর্ক যদি গোঁড়ামি, বিদ্বেষ এবং অহঙ্কারভিত্তিক হয়ে থাকে তাহলে সেইসব বিতর্ক থেকে কোনো ফল অর্জন করা সম্ভব নয়।
২. অনেক কুফুরি ও অকৃতজ্ঞতার উতস হল অজ্ঞতা ও অসচেতনতা যা অন্ধ বিদ্বেষ ও অন্ধ অনুকরণের জন্ম দেয় এবং সত্য থেকে মানুষকে দূরে রাখে।
৩. যে শয়তানের বন্ধুত্ব ও অভিভাবকত্ব মেনে নেয় সে তাকে পথহারা করে। যারা শয়তানের বন্ধুত্ব ও অভিভাবকত্ব মেনে নেয় না তারা পথহারা হয় না।

সূরা হাজ্জের ৫ ও ৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِنَ الْبَعْثِ فَإِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِنْ مُضْغَةٍ مُخَلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ لِنُبَيِّنَ لَكُمْ وَنُقِرُّ فِي الْأَرْحَامِ مَا نَشَاءُ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى ثُمَّ نُخْرِجُكُمْ طِفْلًا ثُمَّ لِتَبْلُغُوا أَشُدَّكُمْ وَمِنْكُمْ مَنْ يُتَوَفَّى وَمِنْكُمْ مَنْ يُرَدُّ إِلَى أَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَيْلَا يَعْلَمَ مِنْ بَعْدِ عِلْمٍ شَيْئًا وَتَرَى الْأَرْضَ هَامِدَةً فَإِذَا أَنْزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَاءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ وَأَنْبَتَتْ مِنْ كُلِّ زَوْجٍ بَهِيجٍ (5) ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّهُ يُحْيِي الْمَوْتَى وَأَنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (6)
"হে মানবজাতি! যদি পুনরুত্থান সম্পর্কে তোমাদের সন্দেহ থেকে থাকে, তবে জেনে রাখ, আমরা তোমাদের প্রথমে মাটি হতে সৃষ্টি করেছি, পরে শুক্র হতে, তারপর ঘনীভূত রক্ত হতে, অতঃপর পূর্ণাকৃতি প্রাপ্ত এবং অপূর্ণাকৃতি মাংসপিণ্ড হতে; যাতে তোমাদের জন্য স্পষ্ট করে দিই (যে, আমরা তোমাদের পুনরুত্থিত করতে সক্ষম)। এবং যাকে আমরা ইচ্ছা করি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাতৃগর্ভে রেখে দিই, অতঃপর আমরা তোমাদের শিশুরূপে বের করি; পরে (তোমাদের জীবিত রাখি) যাতে তোমরা পরিণত বয়সে উপনীত হও। এবং তোমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যককে মৃত্যুদান করা হয় এবং কিছু সংখ্যককে এমন জরাগ্রস্ত বার্ধক্যে উপনীত করা হয় যে, তারা যা জানতো তার সবই ভুলে যায়। এবং তুমি ভূমিকে শুস্ক বা মৃতবৎ দেখে থাক, অতঃপর যখন আমরা তার ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করি তখন তা আন্দোলিত ও বর্ধিত হতে থাকে এবং সব ধরনের দৃষ্টিনন্দন (উদ্ভিদ) উদ্গত করে।" (২২:৫)
"এটা এজন্য যে, একমাত্র আল্লাহই সত্য এবং তিনিই মৃতদের জীবন দান করেন, আর কেবল তিনিই সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান।" (২২:৬)

কিয়ামত বা পুনরুত্থান দিবস সম্পর্কে কাফিরদের অবিশ্বাস বা সন্দেহ সম্পর্কিত আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে পুনরুত্থান বা বিচার দিবসের জন্য উত্থাপনের বিষয়ে দু'টি দলিল বা প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে। একটি প্রমাণ বা যুক্তি হল মাতৃগর্ভে ভ্রুণের নানা পরিবর্তন। আর দ্বিতীয় পরিবর্তনটি হল, ভূপৃষ্ঠে গাছপালার বিকাশ বা প্রবৃদ্ধি। এ দু'টি ব্যাপার প্রত্যেক মানুষের কাছেই স্পষ্ট। বেশীরভাগ মানুষই জীবনে এ দুটি পরিবর্তন বহুবার দেখার সুযোগ পায়।

৫ নম্বর আয়াতে মানব শিশুর জন্ম পর্যন্ত ভ্রুণের নানা পর্যায়ের বিকাশের কথা তুলে ধরা হয়েছে। আর এই আয়াতটি পবিত্র কুরআনের বৈজ্ঞানিক অলৌকিকত্বের অন্যতম বড় প্রমাণ। কারণ, পবিত্র কুরআন নাজিল হওয়ার যুগে মাতৃগর্ভে নয় মাস পর্যন্ত মানব ভ্রুণের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে দেখার বা জানার কোনো যন্ত্রপাতিই সে যুগে ছিল না। তাই কুরআনের এ সম্পর্কিত তথ্যগুলো ছিল সে যুগ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নতুন ও অভিনব। এরপর থেকে গত ১৪০০ বছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অসাধারণ অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও পবিত্র কুরআন মাতৃগর্ভে ভ্রুণের নানা পর্যায় ও বিকাশ সম্পর্কে যেসব তথ্য দিয়েছে বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলোর সঙ্গে সেসবের কোনো অমিল নেই। তাই ভ্রুণ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞরা কুরআনের এইসব তথ্যকে অলৌকিক বলে স্বীকার করেছেন।

এ আয়াতে আল্লাহ আরো বলছেন, মানব শিশু জন্মের পর হতে পরিণত হতে থাকে ও এক সময় নেতিবাচক বিকাশের মাধ্যমে বার্ধক্যে উপনীত হয়ে আবারও শিশুর মত দুর্বল হয়ে যায় এবং মৃত্যুবরণ করে। অর্থাত মানুষ আবার তার সূচনা-বিন্দুতে ফিরে যায়। অর্থাত আল্লাহর অক্ষয়-অশেষ ক্ষমতা মানুষের পুনর্জীবনসহ সব কিছুকে ঘিরে আছে। মৃত বা শুকনো ভূমিতে বৃষ্টির মাধ্যমে আবারো সবুজ উদ্ভিদের জন্ম পুনরুত্থান বা কিয়ামতের প্রতীক।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হল:
১. পরকাল ও পুনরুত্থান অস্বীকার করার কোনো যুক্তি নেই। কারণ, আল্লাহর শক্তি অসীম।
২. দুনিয়ার জীবনেই পুনরুত্থানের নানা নিদর্শন রয়েছে এবং অচেতন বা জ্ঞানপাপী ছাড়া কেউই সেসব অস্বীকার করতে সক্ষম নয়।
৩. বার্ধক্যজনিত বিস্মৃতি মানুষের জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট পর্যায়, আর জ্ঞান ও সচেতনতা অর্জনের পর্যায় সর্বোত্তম পর্যায়।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন