হজরত ইমাম রেযা (আ) এর শাহাদাত
হজরত ইমাম রেযা (আ) এর শাহাদাত
ইরানের মাশহাদে অবস্থিত ইমাম রেযা (আ) এর মাযার শরিফ এখন লোকে লোকারণ্য। সবার মুখেই দোয়া-দরুদের মিষ্টি ও আন্তরিক গুঞ্জন। মাযারের কবুতরগুলোও কেমন যেন পাখা নাড়ছে। চারদিকে শোকগাঁথা আবৃত্তির ধ্বনি কানে বাজে। কেননা ৩০ শে সফর মহান এই ইমামের শাহাদাত বার্ষিকী। তাঁর স্মরণে তাই শ্রদ্ধাবনত চিত্ত সবাই। কেউ তাঁর শাহাদাতের ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করছে। কেউ তাঁর আধ্যাত্মিক ফযীলত ও বরকতে সমৃদ্ধ হবার চেষ্টায় দোয়া করছে। সারা বছর জুড়েই অবশ্য এই ধারা প্রবহমান থাকে। কিন্তু তাঁর শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাঁর ভক্ত অনুরক্তদের মাঝে দোয়া-দরুদ পাঠের প্রবণতা ব্যাপক বেড়ে যায়।
সেদিন ইমাম রেযা ( আঃ ) সকালের নামায আদায় করলেন। নতুন জামা পরে তিনি মেহরাবে বসলেন। মনে হচ্ছিল যেন তিনি জানতেন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। তাঁর চেহারা অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি উজ্জল দেখাচ্ছিল। ইমান আর প্রেমের পৃথিবী যেন তাঁর চোখগুলোতে তরঙ্গায়িত হচ্ছিল। হঠাৎ মামুনের দূত তাঁর ঘরে এসে বললো-খলিফা মামুন আবাল হাসান বা ইমাম রেযা (আ) কে তার কাছে ডেকে পাঠিয়েছেন। ইমাম তখনি দূতের সাথে রওনা হলেন। মামুন আনন্দের সাথে ইমামকে স্বাগত জানালো। মামুন বহুভাবে জনগণের কাছে ইমামের জনপ্রিয়তা খর্ব করতে এবং ইমামের গ্রহণযোগ্যতা কমাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেসব কোনো কাজেই আসে নি। মামুন ভালোভাবেই জানতো যে যতোদিন ইমামের অস্তিত্ব জনগণের সামনে সূর্যের মতো দেদীপ্যমান থাকবে,ততোদিন জনগণের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে সূর্যের সামনে মোমের আলোর মতো নিস্প্রভ। এ বিষয়টি মামুনকে সবসময় ভাবিয়ে তুলতো।
মামুন একটু হাঁটলো। মুখে কোনো কিছু বললো না। বড়ো একটা ফলের ঝুড়ি থেকে এক গুচ্ছ আঙ্গুর তুলে নিয়ে কটা খেল। তারপর ইমামের সামনে গিয়ে তাঁর দু'চোখের ঠিক মাঝখানটায় চুমু খেল। ইমামের হাতে আঙ্গুরের আরেকটি গুচ্ছ দিয়ে বললো-হে রাসূলের সন্তান!এর চেয়ে ভালো আঙ্গুর আর দেখি নি। ইমাম বাক-নৈপুণ্যের সাথে জবাব দিলেন-কিন্তু বেহেশতের আঙ্গুর এরচেয়েও সুস্বাদু এবং মজার। মামুন সৌজন্য দেখিয়ে ইমামকে ঐ আঙ্গুর খেতে বললো। ইমাম খেতে চাইলেন না। কিন্তু মামুন আঙ্গুর খাওয়ার জন্যে ইমামকে খুবই পীড়াপীড়ি করলো। জোর করে সে ইমামকে ঐ আঙ্গুর খাওয়ালো। বিষাক্ত ঐ আঙ্গুর খাবার পর ইমামের ঠোঁটের কোণে তিক্ততার হাসি ফুটে উঠলো। হঠাৎ তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটলো। আঙ্গুরের গুচ্ছকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পা বাড়ালেন।
আবাসালত ছিলেন ইমাম রেযা (আ) এর ঘনিষ্ঠদের একজন। তিনি ইমামকে আনন্দিত হলেন। কেননা নবী পরিবারের সন্তান ছিলেন ইমাম। আর ইমামের মহান ব্যক্তিত্বের আলোয় তিনি আলোকিত হতে পারবেন-এরকম চিন্তা ছিল তার। তার দৃষ্টিতে ইমাম সবার অন্তরকে আলোকিত করতেন। ইমামকে স্মরণ করে তিনি বলেছেন-âইমাম এবং নেতা, যমিনে আল্লাহর বান্দাদের ওপর তাঁর বিশ্বস্ত বান্দা ও হুজ্জাত...আল্লাহর পথে আহ্বানকারী এবং তাঁর আদেশ-নিষেধের সীমারেখা রক্ষাকারী। ইমাম গুনাহ থেকে মুক্ত এবং দোষ-ত্র"টি থেকে দূরে ছিলেন। জ্ঞানের আলোয় সমৃদ্ধ ছিলেন তিনি এবং ছিলেন অপরিসীম সহনশীল। ইমাম ছিলেন মুসলমানদের মান-মর্যাদা,গর্ব ও সম্মান এবং দ্বীনের সুরক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী ।
আবা সালত এইসব চিন্তা করছিলেন। সেজন্যে ইমামের অবস্থাটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইমাম শাহাদাতবরণ করলেন। সেই দিনটি ছিল ২০৩ হিজরীর সফর মাসের শেষ দিন।
ইমাম রেযা (আ) ছিলেন পূত-পবিত্র চরিত্রের অধিকারী। আল্লাহর প্রতি গভীর ঈমান ছিল তার। তিনি জনগণের ব্যাপারে ছিলেন দায়িত্ব সচেতন। এইসব বৈশিষ্ট্য তাঁকে অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তিনি আধ্যাত্মিক ব্যাপারে ছিলেন গভীরভাবে মনোযোগী।ইবাদাত-বন্দেগিতেই অধিকাংশ সময় কাটানোর চেষ্টা করতেন তিনি। মুসলমানদের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সংশ্লিষ্টতা ছিল। তাছাড়া আপামর জনগণের চাওয়া-পাওয়া মেটানোর চেষ্টা করতেন তিনি। রোগীদের দেখাশোনা করতেন। আর মেহমান বা অতিথি পরায়নতার ব্যাপারে ছিলেন ভীষণ উদার। তাঁর মহান ব্যক্তিত্বের কথা শুনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু চিন্তাবিদ ও মনীষী তাঁর সাথে দেখা করতে আসতেন। ইমাম রেযা (আ) তাঁর ইমামতির সময় বহু বিদ্যার্থীকে জ্ঞান দান করেন এবং তাফসিরে কোরআন, হাদীস,নীতি-নৈতিকতা এমনকি ইসলামী চিকিৎসা সম্পর্কে মূল্যবান বহু গ্রন্থও রচনা করেন। এসবের বাইরে ইমামের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিলো রাজনৈতিক সংগ্রাম।
খেলাফতের শুরু থেকেই আহলে বাইতের মহান ইমামগণ সর্বপ্রকার বিচ্যুতি ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। ইমাম রেযা (আ) ও তাঁর সময়ে সকল প্রকার জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন। কিন্তু ইমাম রেযা (আ) এর সময়ে রাজনৈতিক অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁর সময়ে এমন এক রকম রাজনৈতিক শীতল যুদ্ধ চলছিল যে জয়-পরাজয় তখন মুসলমানদের ভাগ্য নির্ধারণী ব্যাপার ছিল। একদিন মামুন ইমামের জ্ঞান-গুণ,আধ্যাত্মিকতা,ইবাদাত,নেতৃত্ব সবদিক থেকেই তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বে মহিমায় মহিমান্বিত করে কথা বললো। ইমাম তার কথার জবাবে বললেন- আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে গর্বিত। তাকওয়ার মাধ্যমে এবং আল্লাহর অশেষ রহমতে আল্লাহর দরবারে সম্মানজনক একটি অবস্থানের আশা করছি।
মামুন বললো-আমি চাচ্ছি যে, খেলাফতের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেব এবং এই দায়িত্ব আপনার ওপর ন্যস্ত করবো। ইমাম জবাবে বললেন,"মহান আল্লাহ যদি খিলাফত তোমার জন্যে নির্ধারিত করে থাকেন , তাহলে তা অন্যকে দান করা উচিত হবে না। আর যদি তুমি আল্লাহর পক্ষ থেকে খেলাফতের অধিকারি না হয়ে থাক, তাহলে আল্লাহর খেলাফতের দায়িত্ব কারো উপর ন্যস্ত করার কোনো অধিকার তোমার নেই। তুমি নিজেই জানো কে এজন্যে সবার চেয়ে বেশি উপযুক্ত।" এরকম কঠিন সত্য কথা মামুনের জন্যে অসহনীয় ছিল। তারপরও সে চেষ্টা করেছে তার রাগটাকে লুকিয়ে রাখতে। তারপর বললো-হে নবীর সন্তান! তাহলে নিশ্চয়ই যুবরাজ তথা সিংহাসনের উত্তরাধিকারের প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন! ইমাম বললেন,অবশ্যই আমি এই কাজটা নিজের ইচ্ছায় করবো না। মামুন বললো,হে নবীর সন্তান! তুমি বুঝি চাচ্ছো যুবরাজ হবার প্রস্তাবের বাইরে থেকে জনগণকে এটা বোঝাতে যে আলী ইবনে মুসা আররেযা পার্থিব এই পৃথিবী সম্পর্কে উদাসীন!ইমাম বললেন,আমি তোমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানি। তুমি চাচ্ছো জনগণ যাতে বলে যে,আলী ইবনে মুসা রেযা (আ) পার্থিব জগতের ব্যাপারে নির্মোহ ছিলেন না,খেলাফতের স্বাদ গ্রহণ করার জন্যে তিনি যুবরাজ হবার প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন।
যাই হোক,শেষ পর্যন্ত মামুন ইমামকে তার সিংহাসনের উত্তরাধিকার তথা যুবরাজ হবার প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য করলো। তবে এই শর্তে যে,হুকুমাতের কোনো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ থাকবে না।-এভাবে ইমাম অত্যন্ত সচেতনভাবে জনগণকে বোঝালেন যে তিনি মামুনের রাজনীতির ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং হুকুমাতের কোনো দায়িত্ব তিনি পালন করবেন না। এভাবে ইমামের আধ্যাত্মিক মর্যাদা আরো বেড়ে গেল। তিনি কেন এ ধরনের শর্তারোপ করেছিলেন , তার কারণ দায়িত্ব গ্রহণকালে প্রদত্ত তাঁর মুনাজাত থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি মুনাজাতে বলেছিলেন,হে খোদা! তুমি ভালো করেই জানো , আমি বাধ্য হয়ে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। সুতরাং আমাকে এজন্যে পাকড়াও করো না। যেমনিভাবে তুমি ইউসূফ ও দানিয়েল (আ) কে পাকড়াও করো নি। হে আল্লাহ ! তোমার পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্ব ও কর্তব্য ব্যতিত আর কোনো কর্তৃত্ব হতে পারে না। আমি যেন তোমার দ্বীনকে সমুন্নত রাখতে পারি, তোমার নবীর সুন্নাতকে যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি। "
ইমাম রেযা (আ) শাহাদাতের পেয়ালা পান করে চলে গেছেন তাঁর প্রিয় প্রভুর সান্নিধ্যে। আমাদের জন্যে রেখে গেছেন তাঁর আদর্শ। আমরা যদি তাঁর আদর্শকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে নিজেদের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারি-তবেই আমাদের জীবন হবে সার্থক সমুজ্জ্বল।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন