আজ কার্যকর হয়েছিল সাদ্দামের ফাঁসি
আজ কার্যকর হয়েছিল সাদ্দামের ফাঁসি
ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাদ্দামকে সহায়তা দিতে বাগদাদে সাদ্দামের সঙ্গে রামসফিল্ডের সাক্ষাত। ডানে-অন্তরঙ্গ মুহূর্তে সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রামসফিল্ড ও ইরাকের সাদ্দাম
আজ থেকে সাত সৌর বছর আগে ২০০৬ সালের এই দিনে ইরাকের ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক ও একনায়ক সাদ্দামের ফাঁসি কার্যকর করে দেশটির বিচার বিভাগ।
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে তাকে এই শাস্তি দেয়া হয়। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হামলার পর সাদ্দাম পালিয়ে যায়। কিন্তু তার আত্মগোপনের স্থান প্রকাশ হয়ে পড়ে ও তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নেয়া হয়। ইরাকের সুন্নি কুর্দি সম্প্রদায়ের ও শিয়া মুসলমানদের ওপর বহু গণহত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয় সাদ্দামকে।
সাদ্দামের পিতৃ-পরিচয় অস্পষ্ট বা সন্দেহজনক। তার জন্ম হয়েছিল তিকরিত অঞ্চলের আল-আওজা গ্রামে। বাগদাদ থেকে তিকরিতের দূরত্ব ১৪০ কিলোমিটার।
সাদ্দাম যুব বয়সেই হত্যাকাণ্ডসহ সামাজিক নানা অপরাধে জড়িত একজন দুর্বৃত্ত হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করে। ২০ বছর বয়সে সে যোগ দিয়েছিল বাথ পার্টিতে। বাথিস্টরা ১৯৬৮ সালে জেনারেল আহমাদ হাসান আল বাকরের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়।
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের মাত্র কয়েক মাস পর মার্কিন ও ব্রিটিশ প্রভুরা বাকরকে সরিয়ে দিয়ে সাদ্দামকে ক্ষমতায় বসায়। ইরাকের মুসলমানরা ইরানের বিপ্লবী মুসলমানদের অনুসরণ করে যাতে এই দেশটিতেও ইসলামী বিপ্লব না ঘটায় বা দেশটিকে স্বাধীনভাবে পরিচালিত করতে না পারে সেই দুরভিসন্ধি নিয়ে ইরাকি বিপ্লবী মুসলমানদের দমনের লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদীরা ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে বর্বর ও নৃশংস প্রকৃতির সাদ্দামকে এই দেশটির ক্ষমতায় বসায়।
সাদ্দাম ক্ষমতায় এসে শীর্ষস্থানীয় আলেম আয়াতুল্লাহ 'সাইয়্যেদ বাক্বির আস সাদর'-সহ ইরাকের সংখ্যাগুরু শিয়া মুসলিম সমাজের হাজার হাজার সদস্যকে শহীদ করে। এরপর পশ্চিমা প্রভুদের ইঙ্গিতে সাদ্দাম নবগঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে হামলা চালায়। সাদ্দাম অনেক বিখ্যাত সুন্নি আলেমকেও হত্যা করেছিল।
৮০'র দশকের শুরুর দিকে সাদ্দাম ইরানের শাহের শাসনামলে সম্পাদিত আলজিয়ার্স সীমান্ত চুক্তির দলিল প্রকাশ্যেই ছিঁড়ে ফেলে টেলিভিশনে হাজির হয়ে। এরপর তার বাহিনী হামলা চালায় ইরানে।
ইরানের একটি সীমান্তবর্তী শহর দখলের পর গর্বিত সাদ্দাম সাংবাদিকদের বলে: আমি এরপর তেহরানে আপনাদের সঙ্গে কথা বলব! কিন্তু গোটা ইরান দখল করা তো দূরের কথা সাদ্দাম বাহিনী ইরানের এক ইঞ্চি জমিও দখলে রাখতে পারেনি, বরং ইরানের মুজাহিদরা ইরাকের বহু গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হয়েছিল।
৮ বছর স্থায়ী এই যুদ্ধে সাদ্দামকে সহায়তা যুগিয়েছিল সিরিয়া ও লিবিয়া ছাড়া প্রায় গোটা আরব বিশ্ব এবং সাম্রাজ্যবাদী প্রাচ্য (ততকালীন সোভিয়েত ব্লক) ও পাশ্চাত্যসহ তাদের সহযোগী বিশ্বের প্রায় সব দেশ। পশ্চিমা শক্তিগুলো সাদ্দামকে রাসায়নিক অস্ত্র সরবরাহ করলে সাদ্দাম তা ইরানের সেনা ও জনগণ ছাড়াও ইরাকি কুর্দি মুসলমানদের ওপরও ব্যাপক মাত্রায় ব্যবহার করে।
জাতিসংঘ ইরাকের সাদ্দামকে আগ্রাসনের সূচনাকারী বলে ঘোষণা দেয়। ফলে ক্ষতিপূরণ পাবার আইনি পথ প্রশস্ত হওয়ায় ইরান যুদ্ধ-বিরতিতে সম্মত হয়।
সাদ্দাম আলজিয়ার্স চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য ক্ষমা চেয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাশেমি রাফসানজানির কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল।
১৯৮৮ সালে (আগস্ট মাসে) এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার দুই বছর পর সাদ্দাম তার সাবেক সাহায্যকারী কুয়েতে হামলা চালিয়ে তেল-সমৃদ্ধ ক্ষুদ্র এই আরব দেশটি দখল করে নেয়।
ফলে সাদ্দামের বিরুদ্ধে তার সাবেক প্রভুরা গড়ে তোলে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ-জোট। এই জোটের হামলায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সাদ্দাম বাহিনী কুয়েত থেকে পিছু হটে। এ অবস্থায় মার্কিন প্রভুর ইঙ্গিতে সাদ্দামের বাহিনী আবারও ইরাকের কয়েক লাখ বিপ্লবী শিয়া মুসলমানকে হত্যা করে। সাদ্দাম বাহিনী পবিত্র কারবালা ও নাজাফ শহরে বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ও আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র মাজারে হামলা চালিয়ে এইসব পবিত্র স্থানের অবমাননা করে।
অবশেষে ২০০৩ সালে সাদ্দামের মার্কিন ও ব্রিটিশ প্রভুরা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পালিয়ে গিয়েও রক্তপিপাসু এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের অন্যতম বড় কসাই সাদ্দাম শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন রক্ষা করতে পারেনি। সাদ্দাম ইরান ও ইরাকের কয়েক মিলিয়ন অর্থাত অন্তত বিশ- ত্রিশ লাখ নাগরিকের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইরাকে মার্কিন হামলা না হলে গণ-বিদ্রোহে সাদ্দামের পতন ঘটত। কিন্তু ১৯৯০ সালের গণ-বিদ্রোহ দমনে সাদ্দামকে সহায়তা করে খোদ মার্কিন সরকার। এরপর ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি নিজেই সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ইরাকে হামলা চালায়। এর উদ্দেশ্য ছিল একদিকে ইরাকিদের মন জয়ের চেষ্টা করা এবং সেখানে আরো এক ক্রীড়ণক বা সেবাদাস সরকারকে ক্ষমতায় বসানো। কিন্তু ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির এই লক্ষ ব্যর্থ হয়েছে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন