নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩৭তম পর্ব
নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩৭তম পর্ব
মানব জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র ব্যক্তিত্ব গবেষকরা বিভিন্ন মূল্যবান বই বা গ্রন্থ লিখে গেছেন৷ এ বইগুলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের কারণে প্রশংসনীয়৷ কিন্তু যখন পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলছেন, হে মুহাম্মাদ, আপনি বলুন যে, আমি তোমাদর মতোই একজন মানুষ, তখন এটাই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে মুহাম্মাদ (সাঃ)কে তোমরা নিজ সম্প্রদায় তথা মানবজাতির মধ্যকার এমন একজন হিসেবে বিবেচনা কর যিনি একইসাথে আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী৷
পবিত্র কোরআনের আলোকে বলা যায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ছিলেন মানব জাতির জন্যে দয়া ও রহমত৷ মানবজাতির জন্যে তিনি চিরন্তন আদর্শ এবং সব নবী-রাসূলের সত্যতার সাক্ষী৷ মহান আল্লাহ তাঁকে রাউফ ও রাহীম তথা দয়াদ্র ও দরদী বলে অভিহিত করেছেন৷ আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম বান্দা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র নামকে বার বার তাঁর নামের পাশে উল্লেখ করেছেন৷ যেমন, পবিত্র কোরআনের সূরা মুনাফেকীন, নিসা ও আনফালে এসেছে- ‘‘ সম্মান তো কেবল আল্লাহ ও রাসূলের৷'' ‘‘আল্লাহ ও রাসূলের অনুসরণ কর৷'' ‘‘ আল্লাহ ও রাসূলের আহবানে সাড়া দাও ৷" সূরা আহযাবের ৪৫ ও ৪৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, হে নবী! আমরা নিশ্চয়ই তোমাকে পাঠিয়েছি একজন সাক্ষী, একজন সুসংবাদদাতা ও একজন সতর্ককারীরূপে, আর আল্লাহর অনুমতিক্রমে মানুষকে তাঁর দিকে আহবায়করূপে, আর একটি উজ্জ্বল প্রদীপরূপে৷ পবিত্র কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী দয়ার নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মানুষের জন্যে তাঁর অন্তরে এতো দয়া ও গভীর ভালোবাসা অনুভব করতেন যে অনেক সময় মনে হতো যে মানুষের জন্যে চিন্তা ও উদ্বেগে তিনি হয়তো প্রাণত্যাগ করবেন৷
একবার এক আরব বেদুইন রাসূল (সাঃ)'র কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে তিনি তাকে কিছু দিয়ে প্রশ্ন করলেন এতে সে সন্তুষ্ট হয়েছে কিনা৷ উত্তরে ঐ অকৃতজ্ঞ লোক বললো, না, আপনি ভালো কাজ করেন নি৷ উপস্থিত সাহাবাদের মধ্যে কেউ কেউ তার এই অপছন্দনীয় আচরণের কঠোর জবাব দিতে চাইলনে৷ কিন্তু দয়ার নবী তাদের বাধা দিলেন৷ রাসূল (সাঃ) পরে তাকে আবার ডেকে পাঠান এবং তাকে আরো কিছু জিনিষ উপহার দেন৷ পরদিন ঐ বেদুইন মসজিদে এসে রাসূল (সাঃ)'র উদ্দেশ্যে বলল, আল্লাহ আপনাকে আপনার পরিবার ও জাতির মাধ্যমে কল্যাণ দান করুন৷ এ সময় রাসূলে পাক (সাঃ) জনতার দিকে ফিরে বললেন, আমার ও এই ব্যক্তির গল্প সেই ব্যক্তির ঘটনার মতো যার উট ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে৷ কিন্তু মানুষ ভাবলো, উটের মালিককে সাহায্য করার দরকার৷ তাই তারা উট ধরার জন্যে ছুটে গেলো৷ ওদিকে মানুষের দৌড় ও চিৎকারের ফলে উট আরো বেশী দূরে পালিয়ে গেল৷ এরপর উটের মালিক বললো,‘‘ তার ও উটের আশপাশ যেন খালি রাখা হয়৷ আমি জানি কিভাবে এ উটকে বশ করতে হবে এবং এই উটের ব্যাপারে আমার দয়া মায়া অন্যদের চেয়ে বেশী ৷'' এরপর মানুষ চলে গেলে উটের মালিক ধীরে ধীরে উটের কাছে গিয়ে তার লাগাম ধরে৷ ঠিক আমিও গতকাল যদি তোমাদেরকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিতাম এবং তোমরা ক্রুদ্ধ হয়ে এই লোকটিকে মেরে ফেলতে, তাহলে সে কাফের বা অবিশ্বাসী হিসেবে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিত৷ কিন্তু নমনীয়তা ও দয়ার মাধ্যমে তাকে শান্ত ও খুশী করা সম্ভব হলো ৷
পবিত্র কোরআনে রাসূলর (সাঃ) বিভিন্ন নাম ও উপাধি দেখা যায়৷ আর এসব নামই বিশ্বনবী (সাঃ)'র শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার নিদর্শন৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র সবচেয়ে প্রসিদ্ধ নাম মুহাম্মাদ ও আহমাদ৷ এর অর্থ প্রশংসিত৷ শেষ নবী (সাঃ) পৃথিবীতে মুহাম্মাদ ও উর্দ্ধলোকে আহমাদ হিসেবে অভিহিত হন৷ পবিত্র কোরআনে রাসূলে পাক (সাঃ)কে আবদুল্লাহ বা আল্লাহর দাস, খাতামান্নাবিয়িন বা সর্বশেষ নবী, রাহমাতুললিল আলামিন বা বিশ্বজগতের জন্যে আল্লাহর অনুগ্রহ বা রহমত ও আরো কয়েকটি নামে অভিহিত করা হয়েছে৷ লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলে মহান আল্লাহ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)কে ইয়া আইয়ুহাররাসূল বা হে (প্রিয়) রাসূল! ও ইয়া আইয়ুহান্নাবী বা হে (প্রিয়) নবী! বলার মাধ্যমে তাঁকে উচ্চতর সম্মান দেখিয়েছেন৷ আল্লাহর বান্দা বা দাস হওয়া মানুষের জন্যে সর্বোচচ মর্যাদার বিষয়৷ কারণ আল্লাহর বন্দেগী বা দাসত্ব করার মাধ্যমে মানুষ আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা অর্জন করে ৷
বিশ্বনবী (সাঃ) আল্লাহর এবাদতের প্রতি এত বেশী অনুরক্ত ছিলেন যে কখনও কখনও তিনি এবাদতে আত্মহারা হয়ে যেতেন এবং অত্যধিক নামাজ আদায় করতে গিয়ে তাঁর পবিত্র পা-যুগল ফুলে যেতো ৷ পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাঁর এই অত্যধিক এবাদতের প্রশংসা করে বলেছেন, নিজেকে এভাবে কষ্ট দেয়ার জন্যে আমরা কোরআন নাজেল করিনি৷ পবিত্র কোরআন মহান আল্লাহর সর্বশেষ রাসূল (সাঃ)কে বিভিন্ন অপবাদ ও তাঁর নিন্দার মোকাবেলা করে এবং তাঁর পবিত্রতার সাক্ষ্য দিয়েছে৷ সেই সূদূর অতীতকাল থেকে ইসলাম ও সত্য বিরোধী মহল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র আলোকোজ্জ্বল চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করার অপচেষ্টা চালিয়ে এসেছে যাতে বিশ্বের মানুষের কাছে তাঁর ও ইসলাম ধর্মের নজিরবিহীন প্রভাব ক্ষুন্ন বাধাগ্রস্ত করা যায়৷ কিন্তু মহান আল্লাহ তাদের বিরোধীতার জবাব দিয়েছেন৷ যেমন, ইসলাম বিরোধী কোনো কোনো মহল বলে, নবী (মুহাম্মাদ-সাঃ) যা বলেছেন তা জ্ঞানীদের কাছ থেকে শিখেছেন অথবা নিজের মন থেকে বানিয়ে বলেছেন বা নিজের খেয়ালী প্রবৃত্তি থেকে সেগুলো বলেছেন৷ কিন্তু পবিত্র কোরআন সূরা নজমে এসব ভিত্তিহীন দাবীর জবাব নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, সে কখনও মনগড়া কথা বলে না৷ কোরআন তো ওহী বা প্রত্যাদেশ যা তার ওপর নাজেল হয়েছে৷ তাকে শিখিয়েছেন বিরাট শক্তিমান৷
ইসলামের কোনো কোনো শত্রু রাসূল (সাঃ)কে কবি বলে অভিহিত করেছে৷ পবিত্র কোরআনের সূরা ইয়াসিনের ৬৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ এর জবাবে বলেছেন, আমরা কখনও তাকে কবিতা শিক্ষা দেইনি৷ তা তার জন্যে শোভনীয়ও নয়৷ এতো এক উপদেশ ও সুস্পষ্ট কোরআন৷ বিশ্বনবীকে কেউ কেউ যাদুকর, গনক বা অপ্রকৃতস্হ বলে যেসব অপবাদ দিয়েছে পবিত্র কোরআনের অন্য আয়াতে আল্লাহ তার যুক্তিগ্রাহ্য ও শক্ত জবাব দিয়েছেন এবং তিনি সঠিক সরল পথে আছেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন৷
একবার রাসূল (সাঃ)'র কোনো এক স্ত্রীর কাছে কোনো এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেন যে নূরনবী (সাঃ)'র চরিত্র কেমন ছিল? উত্তরে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, তুমি কি কোরআন পড়েছ? ঐ ব্যক্তি জবাব দিল, হ্যা পড়েছি৷ তখন রাসূল (সাঃ)'র স্ত্রী বললেন, তিনি নিজেই তো কোরআন৷ নূরনবী (সাঃ)'র জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তাঁর আচার আচরণ ও কর্মতৎপরতা ছিল পবিত্র কোরআনের উচ্চতর শিক্ষার জীবন্ত নমুনা৷ পবিত্র কোরআনের ভাষায় বিশ্বনবী (সাঃ) ছিলেন গোটা মানব জাতির জন্যে সতর্ককারী, যেমনটি পবিত্র কোরআন নিজেই সতর্ককারী৷ পবিত্র কোরআন মানুষের জন্যে রহমত বা আল্লাহর মহাঅনুগ্রহ, তেমনি নূরনবী (সাঃ)ও পবিত্র কোরআনের মতো মানুষকে অজ্ঞতার অাঁধার থেকে মুক্ত করে তাদের জন্যে রহমত হিসেবে নিয়োজিত হয়েছেন৷ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বিশ্বনবী (সাঃ)কে সিরাজুম মুনিরা বা প্রদীপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন৷ অথচ এখানে অন্য কোনো উপমা যেমন সূর্য বা নক্ষত্র বলা যেতো৷ কিন্তু তা না বলে তাঁকে প্রদীপ বলা হয়েছে৷ এর তাৎপর্য সম্ভবতঃ এটাই যে এক প্রদীপের আলো থেকে লক্ষ কোটি প্রদীপ বা বাতি জ্বালানো যায়৷ হেদায়াতের আলো এভাবে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে বলে বিশ্বনবী (সাঃ)কে মহান আল্লাহ এই বিশেষ অভিধায় অভিহিত করে তাঁর উচ্চতম মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়েছেন৷
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন