নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩৩তম পর্ব
নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩৩তম পর্ব
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ছিলেন একাধারে নতুন জাতি, রাষ্ট্র ও নতুন সভ্যতার রূপকার৷ সম্পূর্ন প্রতিকূল পরিবেশে বা স্রোতের সম্পূর্ণ বিপরীতে তৎকালীন আরব সমাজের জাহেলী প্রথা ও রীতি এবং বৈষম্যমূলক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোগুলোকে ভেঙ্গে-চুরে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কল্যাণকর সংস্কার সাধন করে আদর্শ সভ্যতার বুনিয়াদ গড়ে তোলা ছিল এক অবিশ্বাস্য সাফল্য৷ সময়োপযোগী ও দূরদর্শী পদক্ষেপ এবং বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনা বা নেতৃত্বের মাধ্যমে নেতিবাচক পরিবেশকে ইতিবাচক ও উন্নত পরিবেশে রূপান্তরিত করার অনন্য সাফল্য ছিল আদর্শ মহাপুরুষ হিসেবে বিশ্বনবী (সাঃ)'র শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম দিক৷
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বিভিন্ন গোত্রের সাথে লিখিত চুক্তির ভিত্তিতে মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে তোলার পর বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন৷ এসব সমস্যার কোনো কোনোটি ছিল রাজনৈতিক, আবার কোনো কোনো সমস্যা ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক৷ রাসূল (সাঃ)'র পরামর্শে ও তাঁর উৎসাহ পেয়েই মক্কার মুসলমানরা মদীনায় হিজরত করেছিলেন৷ কিন্তু তারা মদিনায় জীবন-উপকরণ ও জীবিকার সমস্যায় পড়েন৷ কারণ, তারা ঘর-বাড়ী ছেড়ে এসেছিলেন এবং এর ফলে নতুন জায়গায় চাকরী বা আয় উপার্জনের সুযোগ তাদের ছিল না৷ এ অবস্থায় মহানবী (সাঃ)'র পরামর্শে মদীনার আনসারদের প্রত্যেকেই একটি করে মুহাজির পরিবারের আর্থিক চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন৷ এরপর মুহাজিররাও বিভিন্ন কাজ ও উৎপাদনমূলক তৎপরতা শুরু করেন৷ কিন্তু বেশীরভাগ সম্পদ ও অর্থ কতিপয় বিশেষ ব্যক্তির মালিকানাধীন হওয়ায় অন্যরা যতই কাজ করুক না কেন, তারা কখনও অর্থ-সম্পদ সঞ্চয় করতে পারছিলেন না ৷
এ অবস্থায় ইসলাম-পূর্ব যুগ থেকে প্রচলিত অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা বা বৈষম্য অব্যাহত থাকায় আয়-উপার্জনের উৎস বা পুঁজি তখনও পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হচিছল না এবং উৎপাদনের ব্যাপক ক্ষেত্র তখনও অব্যবহৃত থেকে যাচিছল৷ আরবের জাহেলী সমাজে দূর্বল ও বঞ্চিত শ্রেণীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বলতে কিছুই ছিল না৷ তারা সর্দার বা জমিদার শ্রেণীর মানুষের জন্যে বেগার খাটতো বা বিনা মজুরীতে শুধু ক্ষুধা মেটানোর বিনিময়ে কাজ করতো৷ অনেক শ্রমিক তাদের শ্রমের ফসল গোত্রের সর্দারের কাছে দিয়ে দিতে বাধ্য ছিল৷ অর্থ উপার্জনের কোনো পরিকল্পিত সামাজিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় মানুষ বিভিন্ন পন্থায় বা একেক সময় একেক পন্থায় পরস্পরের অর্থ-সম্পদ দখল করতো৷
বিশ্বনবী (সাঃ) এইসব কঠিন অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্যে প্রথমে জনগণের কাছে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন৷ তিনি ইসলামের এ মূলনীতি তুলে ধরেন যে প্রত্যেকেই ঠিক ততটুকু অর্থ-সম্পদের মালিক যা সে নিজের প্রচেষ্টায় অর্জন করেছে৷ তবে এক্ষত্রে শর্ত হলো, কাজটি হতে হবে কল্যাণকর বা লাভজনক এবং দ্বিতীয় শর্ত হলো কর্মপন্থা হতে হবে বৈধ৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মানুষকে কাজের জন্যে উৎসাহ দিতেন এবং তাদের কাজের পরিবেশ বা ক্ষেত্রও গড়ে দিতেন৷ যেমন, তিনি অনেক সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাওয়া গনীমতের সম্পদের একটি অংশ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতেন৷ তিনি বেকার থাকার তীব্র বিরোধীতা করতেন৷ আল্লাহর সর্বশেষ রাসূল (সাঃ) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, যারা নিজ জীবনের বোঝা মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় তারা আল্লাহর রহমত পাবে না এবং যারা নিজ পরিবারের সদস্যদের ব্যায়ভার নির্বাহ না করে তাদের জীবনকে ধবংস করে তারা অভিশপ্ত৷
বেলচা ও রশি দিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র সাহাবী সা'দ আনসারী (রাঃ)'র হাত খুবই অমসৃন বা খসখসে হয়ে গিয়েছিল৷ একদিন রাসূল (সাঃ) তা জানতে পেরে সা'দের হাতে চুমু খেয়ে বলেছিলেন, জাহান্নামের আগুন এই হাতকে পোড়াতে পারবে না৷
বিশ্বনবী (সাঃ) নিজেও রাষ্ট্রীয় তৎপরতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক তৎপরতায়ও লিপ্ত থাকতেন৷ তিনি নিজে কাজ করে একটি বাগান গড়ে তুলেছিলেন৷ মদীনায় ঘর ও মসজিদ নির্মাণের সময় অন্য মুসলমানদের মতো তিনি নিজেও বড় বড় পাথর বহন করতেন৷ এমনকি তিনি বন্যার ফলে নস্ট হয়ে যাওয়া রাস্তাগুলো পাথর বিছিয়ে মেরামত করতেন৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বাগান করা ও কৃষিকাজকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন৷ তিনি কৃষকদের অধিকার ক্ষুন্ন করার ব্যাপারে সতর্কবানী রেখে গেছেন৷ একবার তিনি হযরত আলী (আঃ)কে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, হে আলী! সাবধান! কখনও যেন কৃষকদের ওপর জুলুম করা না হয়৷ (বাজনা)
একদিন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র একদল সাহাবী তাঁর পাশে বসে আলোচনায় মশগুল ছিলেন৷ মসজিদের ভেতরে এ আলোচনা চলছিল৷ মসজিদের বাইরে সূঠামদেহী এক যুবক সকাল থেকে কাজ করে যাচিছল৷ তাঁর কাজ ছিল খুবই পরিশ্রমের৷ আল্লাহর রাসূলের পবিত্র দৃষ্টি ঐ যুবকের ওপর নিবদ্ধ হলো৷ সেই মুহূর্তে মহানবীর পাশে বসা একজন সাহাবী মহানবী(সাঃ)'র এ বিশেষ দৃষ্টি লক্ষ্য করে বললেনঃ
এ যুবক তার কাজে এতো ব্যস্ত যে সে তার চারপাশের অবস্থা সম্পর্কেও অচেতন৷ সে তার শক্তিকে আল্লাহর পথে ব্যয় করছে না৷ এটা কি খুব দুঃখজনক বিষয় নয়? সে যদি আল্লাহর জন্যে কাজ করতো, তাহলে সে প্রশংসা পাবার যোগ্য হতো৷ বিশ্বনবী তাঁর একজন সাহাবীর কাছ থেকে একথা শুনে কিছুক্ষণ নীরব রইলেন৷ এরপর নীরবতা ভেঙ্গে তিনি বললেন, এ রকম কথা বলো না৷ কয়েকটি কারণে এ যুবকের কাজ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে৷ সে যদি জীবিকা অর্জনের জন্যে কাজ করে থাকে, তাহলে জেনে রাখ, সে আল্লাহর পথেই দৃঢ়ভাবে কাজ করছে৷ যদি সে তার বাবা-মা বা নিজ সন্তানের জীবিকা অর্জনের জন্যে কাজ করে থাকে, তাহলেও সে আল্লাহর পথেই কাজ করছে৷ কিন্তু যদি সে শুধু নিজের সম্পদ বাড়ানোর জন্যে অথবা শুধু গরীবদের কাছে অহংকার প্রদর্শনের জন্যে কাজ করে থাকে, তাহলে জেনে রাখ যে, সে শয়তানের পথ ধরেছে এবং সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে৷ বিশ্বনবী (সাঃ)'র প্রজ্ঞাপূর্ণ এ কথাগুলো শুনে যুবকটি সম্পর্কে যে সাহাবী অবিবেচনাসূলভ ও তড়িঘড়ি মন্তব্য করেছিলেন তিনি অনুতপ্ত হলেন৷ এরপর পরই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) জামাতে নামাজ আদায় করার জন্যে প্রস্তুত হলেন৷ সাহাবীগণের কেউ কেউ সেই কর্মঠ যুবকটিকে তার কাজ শেষ করতে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে গেলেন, যাতে দ্রুত কাজ সেরে সেই যুবকটিও নামাজের জামাতে শামিল হতে পারে৷
বিশ্বনবী (সাঃ) সমাজে সম্পদের সুষম বন্টণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং এ জন্যে উপযুক্ত পদক্ষেপও নিয়েছিলেন৷ আরবের জাহেলী যুগে এক গোত্রের লোকেরা অন্য গোত্রের কোনো লোককে অপহরণ করে তাকে দাস বানিয়ে রাখতো৷ সেসময় গরীব লোকেরা ঋণের সুদ পরিশোধ করতে না পেরে পাওনাদারের কাছে নিজেকে দাস হিসেবে সমর্পন করতো৷ আল্লাহর সর্বশেষ রাসূল (সাঃ) এই প্রথাকে অন্যায্য বলে ঘোষণা দেন এবং বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করা নিষিদ্ধ করেন৷ অর্থনৈতিক চুক্তি বা লেনদেনগুলো উভয় পক্ষের স্বাধীন ইচেছ ও সন্তুষ্টির ভিত্তিতে হতে হবে বলে তিনি ঘোষণা করেন৷ এ ছাড়াও বিশ্বনবী (সাঃ) অর্থনৈতিক শোষনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার সুদ প্রথাও রহিত করেন৷ সুদ প্রথার ফলে আরবের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্র বিভিন্ন সংকটে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল৷ শ্রোতা-ভাইবোনেরা আগামী অনুষ্ঠানে আমরা বিশ্বনবী (সাঃ)'র অন্যান্য অর্থনৈতিক পদক্ষেপ বা সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করবো৷ আশা করি তখনও আমাদের সঙ্গ দিতে ভুলবেন না৷
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন