নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২৯ তম পর্ব
নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২৯ তম পর্ব
পাঠক! আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে, ইসলামের ইতিহাসে মক্কা থেকে মদীনায় নবীজীর হিজরতের ঘটনাকে একটি সন্ধিক্ষণ হিসেবে মনে করা হয় ৷ মদীনায় নবীজীর প্রবেশের মধ্য দিয়ে এবং সেখানে তাঁর অবস্থান করার মধ্য দিয়ে ঐ সমাজে অভিনব এক পরিবর্তনের সূচনা হয় ৷ নবীজীর ধর্মে অর্থাৎ ইসলামে মানব সংস্কৃতি ও চিন্তার উন্নয়নের জন্যে ব্যাপক ঐশী পরিকল্পনা ও কর্মসূচি ছিল ৷ এইসব পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজন ছিল গণসংহতি ও লিখিত গঠনতন্ত্রের ৷ নবীজীর যদি বুদ্ধিমত্তা , মনোযোগ কিংবা সুষ্ঠু কর্মকৌশল না থাকতো,তাহলো হয়তো ইসলামী হুকুমাত কাঙিক্ষত মানে বাস্তবায়িত হতো না ৷ নবীজীর সামনে সবচে বড়ো যে বাধাটি তখন বিদ্যমান ছিল তাহলো সেই সমাজে ঐক্য বা সংহতি বলতে কিছু ছিল না ৷ প্রত্যেক গোত্র বা সম্প্রদায়েরই ছিল নিজস্ব রীতিনীতি ও সংস্কৃতি ৷ এক সম্প্রদায়ের সাথে অন্য সম্প্রদায়ের মতপার্থক্য ও বৈপরীত্য ছিল ব্যাপক ৷ এমতাবস্থায় নবীজী অত্যন্ত সুচিন্তিত ও যথার্থ একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে ‘মুসলমান ভাইদের মুসলিম নীতি'র প্রবর্তন করেন ৷ তিনি সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে সম্প্রদায় বা গোত্রগত সীমারেখা তুলে দেন ৷ নবীজীর এই চমৎকার পরিকল্পনা সেই যুগের সমাজের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল ৷
মদীনা শহরের লোকজন অর্থাৎ আনসারগণ মক্কার মুহাজিরদের হাতে আন্তরিকতার সাথে হাত মেলালেন ৷ তাদের এই আন্তরিকতা এমন এক পর্যায়ে গিয়েছিল যে, মদীনার লোকজন নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে আসা মুহাজিরদেরকে আর্থিকভাবেও সাহায্য করেছিলেন ৷ জাতীয় এই সমন্বয়ের পর রাসূলে খোদা মদীনা শহরে একটি মসজিদ তৈরির উদ্যোগ নেন ৷ এই মসজিদটি ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে মৌলিক ভূমিকা রেখেছিল ৷ এই মসজিদ তৈরিতে সকল মুসলমান এমনকি স্বয়ং রাসুলে কারীম ( সা ) ও অংশ নিয়েছিলেন ৷ বলা যেতে পারে যে,মসজিদুন্নবী প্রতিষ্ঠার সময় সকলের সামগ্রিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা ছিল ইসলামী সমাজে জনগণের সমষ্টিগত অংশগ্রহণের প্রাথমিক দৃষ্টান্ত ৷ নবীজীর পরিকল্পনায় সৃষ্ট এই মসজিদ জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল ৷ এই মসজিদ একদিকে যেমন আধ্যাত্মিকতার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল,তেমনি সামাজিক-মানবিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ৷ নবীজীর এই মানবকল্যাণকামী মৌলিক পদক্ষেপ জনগণের মাঝে ইসলামী শাসনব্যবস্থা ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেতে সহযোগিতা করেছিল৷ ইতিহাসের ভাষ্য অনুযায়ীঃ একদিন সৌদিআরবের সবচে দূরে অবস্থানকারী এক আরব মদীনা শহরে এসেছিল ৷ নবীজীর সামনে এসে ঠাণ্ডা মাথায় তাঁর সমালোচনা করে বললো-‘হে মুহাম্মাদ ! ন্যায়নিষ্ঠ হও ৷' সে স্বাধীনভাবে নবীজীর সাথে কথা বললো ৷ নবীজীর সঙ্গীসাথীদের অনেকেই বিরক্ত হচিছল কিন্তু নবীজী তাদেরকে শান্ত হবার জন্যে এবং সদাচারী হবার জন্যে বললেন ৷ এমনকি নবীজী ঐ লোকটিকে উপহার পর্যন্ত দিলেন ৷
মুসলিম উম্মাতের নেতার সামনে মত প্রকাশের এই স্বাধীনতার ঘটনা ইসলামের ব্যাপারে সমাজের সাধারণ জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস বাড়িয়ে দিলো ৷ নবীজী ছিলেন জনগণের পৃষ্ঠপোষক৷ তাঁর এই আন্তরিকতা ইসলামী শাসনের ভিত্তিকে মজবুত করেছিল৷ বলা যেতে পারে, জনগণ যে নবীজী এবং তাঁর হুকুমাতের নজীরবিহীন আনুগত্য করলো , তার কারণ হলো, নবীজী সমাজে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং জনগণের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার চেষ্টা করেছিলেন ৷ নবীজী এই কর্মকৌশলের মাধ্যমে জনগণ এবং হুকুমাতের মাঝে এমন একটা সুন্দর ও সুষ্ঠু সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন,যার ফলে একটি আস্থাশীল,বিশ্বাসপূর্ণ এবং সুস্থ ও শান্তিময় পরিবেশের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল৷ রাসূল ( সা ) ইসলামী হুকুমাতের ঐ সুন্দর পরিবেশে সবাইকে অংশ গ্রহণ করার আহবান জানান এবং নিজেদের ভাগ্য নিজেদেরকেই রচনা করতে বলেন ৷ নবীজী সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, কেবল সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই নয় বরং সমাজ এবং রাষ্ট্রের ব্যাপারে সকলকেই সতর্ক ও যত্নবান হতে হবে ৷ এরফলে জনগণের মাঝে একটু একটু করে দায়িত্বানুভূতি জেগে উঠেছিল ৷
জনগণের অংশগ্রহণ এবং তাদের মতামতকে কাজে লাগানো অর্থাৎ মানুষকে মূল্যায়ন করার বিষয়টি ছিল নবীজীর সমকালীন সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক একটি দিক ৷ নবীজী চাইতেন মানুষ যেন ঐক্যের ছায়াতলে এসে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ৷ মানুষের রয়েছে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার-এই বাণী প্রচার করে নবী করীম ( সা ) মানব জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতির পথ সুগম করে দিয়েছেন ৷ কেননা প্রকৃতিতে মানুষের উন্নতি অগ্রগতির জন্যে প্রয়োজনীয় সকল উপকরণই দেওয়া আছে ৷ সেইসব উপাদান থেকে উপকৃত হবার জন্যে মানুষকে পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন ৷ এই সহযোগিতার ক্ষেত্রে কোনোরকম সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয় নি ৷ যদি না তা সমাজ কিংবা অন্যদের জন্যে কোনোরকম ক্ষতির কারণ না হয় ৷ এই ঘোষণার ফলে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, মদীনার ইহুদী এবং অন্যান্য অমুসলিমরা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে আশ্রয় নেয় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা রাসূলে খোদার সাথে সহযোগিতাও করে ৷
জনগণের এই ব্যাপক অংশগ্রহণ রাসূলে খোদার জন্যে বিভিন্ন দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ প্রথমত নবীজী এই পরিকল্পনার মাধ্যমে জনগণকে তাঁর অনুসারীদের ব্যাপারে সংবেদনশীল করে তোলেন এবং তাদের আত্মবিশ্বাসকে আরো শক্তিশালী করে তোলেন ৷ এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে মানুষ নিজেদেরকে আর সঙ্কুচিত ভাবলো না ৷ নিজেদের জীবনকে নিরর্থক মনে করলোনা ৷
দ্বিতীয়ত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে মূল্যায়ন করার ফলে নবীজী তাদের মধ্য থেকে কে অভিজ্ঞ , সচেতন আর উপযুক্ত তা যাচাই করতে পারতেন এবং উপযুক্ত লোককে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত করার জন্যে নির্বাচন করতে পারতেন ৷ এই ঘটনা সমাজ এবং ইসলামী হুকুমাতের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ককে আরো বেশি শক্তিশালী করেছে ৷
নবীজী ছিলেন সমাজের সবচে অগ্রসর চিন্তাশীল ব্যক্তি ৷ তিনি সর্বজনগ্রাহ্য যেসব পরামর্শ দিতেন সেগুলো মূলত আল্লাহই তাঁকে বাতলে দিতেন ৷ কোরআনের আয়াতেও সেসবের কথা অনেক সময় এসেছে৷ কোরআনে এই পরামর্শের বিষয়টিকে মানুষের একটি উন্নত গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে৷ রাসূলে খোদার পবিত্র জীবনে লক্ষ্য করা গেছে যে তিনি বেশি বেশি পরামর্শ করতেন ৷ তবে আল্লাহ-রাসূল এবং দ্বীন সম্পর্কিত যেসব বিষয়-আশয় বা হুকুম-আহকাম সুস্পষ্ট ছিল সেসব ব্যাপারে পরামর্শ করার প্রয়োজন ছিল না ৷ পরামর্শের প্রয়োজন ছিল সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাসহ উম্মাত এবং ইসলামী সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নবী করীম ( সা ) কোনো একটি এলাকায় ইসলামের দাওয়াতী কাজের উদ্দেশ্যে কাকে পাঠাবেন বা কার ওপর দায়িত্বভার অর্পন করবেন সে ব্যাপারে অন্যদের সাথে পরামর্শ করতেন ৷
উল্লেখ্য যে, বদর যুদ্ধ শুরু হবার আগে শহরের বাইরে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে আনসার তথা মদীনাবাসীদের অনুমোদন অর্থাৎ রাজি হবার অপেক্ষায় ছিলেন ৷ কারণ মদীনার অধিবাসীদের সাথে যে চুক্তি হয়েছিল , সে অনুযায়ী তারা রাসূল এবং তাঁর দ্বীনের হেফাজতের দায়িত্ব নেবেন শহরের অভ্যন্তরে , শহরের বাইরে নয় ৷ কিন্তু উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শহরের বাইরে প্রতিরক্ষার বিষয়টি অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল ৷ এ কারণেই রাসূলে খোদা ( সা ) যুদ্ধ যাবার আগে আনসারদের মতামতের অপেক্ষায় ছিলেন ৷ অবশেষে সা'দ ইবনে মোয়াযের কন্ঠে যখন আনসারদের ইতিবাচক দৃষ্টির কথা শুনলেন, নবীজীর চেহারা তখন আনন্দে স্ফীত হয়ে উঠেছিল ৷
তো শহর থেকে বেরুবার জন্যে এবং শহরের বাইরেও প্রতিরক্ষার জন্যে বদর কূপের পাশে যেহেতু এই ঘটনার উদ্রেক হলো , তাই নবীজী বললেনঃ ‘তোমাদের জন্যে সুসংবাদ! আল্লাহ রাববুল আলামীন বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ৷'
এই যুদ্ধে রাসূলে খোদা এমনকি শরণার্থী শিবির স্থাপন করার ব্যাপারেও তাঁর সঙ্গীদের সাথে পরামর্শ করেছেন এবং ঐ অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে যার ভালো জানা আছে তার দৃষ্টিভঙ্গিও জানতে চেয়েছেন ৷ বিজয় লাভ করার পরও তিনি বন্দীদের ব্যাপারসহ অন্যান্য বিষয়ে তাঁর সাহাবীদের মতামত চেয়েছেন৷ খন্দক যুদ্ধের সময়ও মদীনা শহর প্রতিরক্ষার কৌশল নিয়ে সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেছিলেন৷ সালমান শত্রুদের হামলার আগে বা যুদ্ধ শুরু করার আগে মদীনা শহরের দূর-দূরান্তে গর্ত খোঁড়ার প্রস্তাব করেছিলেন ৷ পরামর্শ বৈঠকে সালমানের প্রস্তাব গৃহীত হলো ৷ এটা নবীজীর দূরদর্শী ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ নেতৃত্ব এবং সঠিক পরিচালনা নীতি প্রয়োগের দৃষ্টান্ত ৷
নবীজী তাঁর সমগ্র জীবনে তাঁর আচার-ব্যবহারের মধ্য দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, সংকটপূর্ণ অবস্থার মাঝেও পরামর্শের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা খুব ভালোভাবেই নিরসন করা যায় ৷ ইতিহাস সাক্ষ্য দিচেছ যে, অসম্ভব শক্তিমত্তার অধিকারী শাসকরাও তাদের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের কারণে ধবংস হয়ে গেছে , কারণ তারা জনবিচিছন্ন হয়ে গিয়েছিল ৷ এ সম্পর্কে রাসূলে খোদার একটি হাদীস উল্লেখ করা যেতে পারে ৷ ‘যেখানেই তোমাদের রাষ্ট্রনায়ক বা শাসকরা সৎ,সাহসী ও শক্তিমত্তার অধিকারী হয় এবং সকল কাজ পরামর্শের ভিত্তিতে আঞ্জাম দেয়, সেই ভূখণ্ডটি তোমাদের জন্যে বসবাসযোগ্য সর্বোত্তম স্থান ৷ কিন্তু তারা যদি কৃপণদের মধ্য থেকে আসে এবং কাজগুলোকে যদি পরামর্শের ভিত্তিতে না করে তাহলে ঐ ভূখণ্ড জীবনযাপনের অযোগ্য ৷
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন