নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২৬ তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২৬ তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২৬ তম পর্ব


আল্লাহর সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ ( সা ) তাঁর বিরল পরিচালনা শক্তি দিয়ে সমাজে যে ন্যায়-নীতি ও শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠা করেছেন,তা অন্যদের জন্যেও ছিল অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় ৷ নবীজী তাদের জন্যে ব্যক্তিগত আচরণের মাধ্যমে একটা পরিপূর্ণ আদর্শ প্রদর্শন করেছেন৷ গত পর্বেও গৃহাভ্যন্তরে নবীজীর আচার-ব্যবহারের সৌন্দর্য সম্পর্কে কথা বলেছি আমরা ৷ শিশুদের সাথে রাসূলে খোদার ব্যবহার সম্পর্কেও আমরা যখন কথা বলবো,তখন দেখবো যেন এমন একজন বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীর মুখোমুখি হয়েছি যিনি তাঁর পুরো জীবনটাকেই মানবাত্মার খেদমতে কাটিয়েছেন৷ এই বৈশিষ্ট্যগুলো নবীজীকে মানব সমাজে ব্যতিক্রমধর্মী একজন ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে৷ ফ্রান্সের বিখ্যাত মনীষী সিদুয়া বলেছেন,'শিশুদের প্রতি তাঁর ছিল ব্যাপক অনুগ্রহ৷ তিনি তাদের প্রশান্তি চিন্তা করতেন সবসময়৷ বিশেষ করে ইয়াতিম শিশুদের নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতেন তিনি৷ শিশুদের আদর-স্নেহ করতে ভালবাসতেন ৷ মুহাম্মাদ কন্যাশিশুদের জীবিত কবর দেওয়াকে সম্পূর্ণ হারাম বলে ঘোষণা দেন৷ পিতা-মাতা এবং শিশুদের ভালোবাসার ব্যাপারে নবীজীর বক্তব্য কতো সুন্দর এবং অমায়িক ৷
নবীজী একদিন তাঁর এক সন্তানকে হাঁটুর ওপর বসিয়ে আদর করতে করতে বলছিলেন-'শিশুদের ঘ্রাণটা বেহেশতি ৷ তোমাদের সন্তানদের বেশি বেশি চুমু দেবে, তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমার জন্যে বেহেশতে উত্তম একটি স্থান দান করবেন ৷'
এমন সময় জাহেলি সমাজের একজন অভিজাত ব্যক্তি রাসূলের কাছে এলো ৷ শিশুদের প্রতি রাসূলে খোদার স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার প্রকাশ দেখে বিস্মিত হয়ে গেলো ৷ সে বললো-'আমার দশটা ছেলে আছে ৷ এখন পর্যন্ত তাদের কাউকেই একটিবারও আমি চুমু দেই নাই ৷' নবীজীর চেহারার রঙ পরিবর্তন হয়ে গেল ৷ বিরক্তির সাথে তিনি বললেন,"অপরের জন্যে যার কোনো দয়ামায়া নেই,আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও তার জন্যে সদয় হবেন না ৷ আমি কী করতে পারি,আল্লাহ তোমার অন্তর থেকে দয়ামায়া তুলে নিয়েছেন ৷"
কোনো এক ঈদের নামায পড়ার জন্যে নবীজী ঘর থেকে বের হলেন৷ রাস্তায় কয়েকটি শিশু আনন্দের সাথে খেলাধুলায় মত্ত ছিল৷ হঠাত্‍ তাঁর দৃষ্টি পড়লো দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোণো জামা-কাপড় পরা কান্নারত একটি শিশুর ওপর ৷ নবীজীর অন্তরটা কেঁদে উঠলো৷ তিনি সদয় হৃদয়ে শিশুটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,"তুমি কেন ওদের সাথে খেলছো না ?" আক্রোশের সাথে ছেলেটি বললো,'আমার বাবা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন ৷ তাই আমি যেহেতু অন্য বাচ্চাদের মতো নই সেহেতু আমি তো তাদের কাতারে মিশতে পারবো না ৷' নবীজী তার হাতটা ধরে অত্যন্ত দয়ার্দ্র কণ্ঠে বললেন,"আচ্ছা , আমি যদি তোমার বাবা হই আর আমার মেয়ে ফাতেমা যদি তোমার বোন হয়, আলী যদি তোমার চাচা হয় এবং হাসান-হোসাইন যদি তোমার ভাই হয়,তুমি কি সন্তুষ্ট হবে ?" শিশুটি সেই মুহূর্তে নবীজীকে চিনতে পারলো ৷ সে ভীষণ খুশি হয়ে গেল ৷ অনেক অনেক আশা এবং বিশ্বাস তার বুকে আসন গেড়ে বসলো ৷ ঠোঁটে-মুখে তার হাসির রেখা ফুটে উঠলো ৷ নবীজী শিশুটিকে ঘরে নিয়ে গিয়ে নতুন জামা পরালেন,খেতে দিলেন এবং ইয়াতিম চিন্তাটি তার মন থেকে মুছে দিলেন ৷ শিশুটি এবার প্রশান্ত হৃদয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শিশুদের সাথে খেলতে শুরু করে দিল ৷ এই শিশুটির ব্যাপারে নবীজী এরপরেও কোনোদিন উদাসীন হন নি ৷
শিশুদের জন্যে তাদের বাবা-মায়ের দিক-নির্দেশনা খুবই প্রয়োজন ৷ তাদের মৌলিক ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে পারিবারিক পরিসরে৷ সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাবা-মায়ের রুচিবোধ যতো উন্নত হবে , তাদের সন্তানও ততোটাই উন্নতভাবে লালিত পালিত হবে ৷ উন্নত রুচিবোধসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ লোকজন সমৃদ্ধ কোনো একটি সমাজ সেইসব পরিবারের কাছে ঋণী যারা তাদের সন্তানদের যথার্থ প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যে সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়েছে ৷ মহানবী ( সা ) বলেছেন, যদি কেউ তার সন্তানকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিংবা তাদের বেড়ে ওঠা তথা লালন-পালন করার ক্ষেত্রে তোমাকে অনুসরণ করে , তাহলে তা তোমার জন্যে প্রতিদিন দান-সদকা করা থেকে উত্তম ৷
শিশুদের কচিমনের প্রতি নবীজী ছিলেন ভীষণ মনোযোগী ৷ তিনি শিশুদের ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার জন্যে তাদের সামনে গিয়ে সালাম করতেন এবং তাদের ভুলগুলো পরিহার করতেন ৷ তিনি বলেন,'যেসব অভিভাবক তাদের সন্তানদেরকে ভালো কাজ করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে,আল্লাহর রহমত তাদের ওপর বর্ষিত হোক ৷'
একব্যক্তি নবীজীকে জিজ্ঞেস করলেন,'নিজের সন্তানদেরকে কীভাবে সহযোগিতা করবো?' নবীজী বললেন'তোমার শক্তি-সামর্থ অনুযায়ী তাদের বরণ করো,তারা যতোই ধৈর্যভঙ্গকারী কাজ করুক না কেন,উপেক্ষা করো ৷' একদিন এক মা তার সন্তানকে নবীজীর কোলে বসালেন,অমনি শিশুটি নবীজীর জামা-কাপড় নষ্ট করে দিল ৷ শিশুটির মা অস্থির হয়ে রাসূলে খোদার কোল থেকে শিশুটিকে নিয়ে নিতে চাইলো ৷ অথচ নবীজী অত্যন্ত শান্তমনে শিশুটির মাকে ইঙ্গিতে বললেন, তাকে যেন শান্ত থাকতে দেয় ৷
মূলত শিশুদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী হওয়া দরকার৷ অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানীই বিশ্বাস করেন যে,শিশুরা ছয় বছর বয়সে স্থান-কাল এবং কোন্ কাজের কী পরিনতি তা বুঝতে সক্ষম ৷ নবীজী তাই বলেছেন,এ বয়সেই যেন শিশুদেরকে দ্বীনী আদর্শ ও শিক্ষাগুলো মিষ্টিভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয় ৷ তিনি বলেছেন,'যখন তোমাদের সন্তান ছয় বছর বয়সে পৌঁছে,তখন তাদেরকে রুকু এবং সেজদা শেখাও ৷ সাত বছর বয়সে ওজু করার জন্যে তাকে প্রস্তুত করাও এবং তাকে নামায পড়তে উত্সা হিত করো ৷ শিশুদেরকে আল্লাহর নাম শেখানো হলে আল্লাহ শিক্ষক এবং বাবা-মায়ের আযাব মাফ করে দেন ৷'
শিশুদের অধিকার রক্ষার ওপর রাসূলে খোদা ভীষণ গুরুত্বারোপ করেছেন ৷ শিশুর জন্যে সুন্দর একটি নাম নির্বাচন করাও তার অধিকারভুক্ত বলে তিনি উল্লেখ করেন ৷ সেইসাথে শিশুদের মাঝে সমানাধিকার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ওপরও নবীজী গুরুত্ব দিয়েছেন ৷ এক ব্যক্তি তার দুই সন্তানের মাঝে একটিকে আদর করে চুমু খেলো অপরটিকে খেলো না-এই দৃশ্য দেখে নবীজী তাকে রাগের সাথে বললেন,কেন তুমি তোমার সন্তানদের মাঝে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করছো না ৷ নোমান ইবনে বাশীর নামের এক ব্যক্তি বলেন,আমার বাবা একদিন আমাকে একটা উপহার দিলেন,কিন্তু আমার অন্য ভাই-বোনদের কিছুই দিলেন না ৷ এ ঘটনায় আমার মা,বাবার ওপর রাগ করলেন এবং বাবাকে বললেন,আমি এই বৈষম্য পছন্দ করি না , যদি না রাসূল তোমার এই কাজকে সঠিক বলে অনুমোদন করেন ৷ এরপর আমার বাবা নবীজীর কাছে গিয়ে বললেন, হে রাসূলে খোদা ! আমি আমার সন্তানকে একটা উপহার দিয়েছি ৷ এখন আমার স্ত্রী এ ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চেয়েছেন৷ নবীজী জিজ্ঞেস করলেন,'তুমি কি তোমার সকল সন্তানকে উপহার দিয়েছো?' আমার বাবা বললেন,না ৷ নবীজী বললেন-'আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমার সন্তানদের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করো ৷ আমি কখনোই এই অন্যায় আচরণকে অনুমোদন করবো না ৷'
শিশুরা টেপ-রেকর্ডার কিংবা ক্যামেরার মতো তাদের বাবা-মায়ের আচরণগুলোকে নিজেদের অজান্তেই নিজেদের স্মৃতিতে রেকর্ড করে রাখে বা চিত্রায়িত করে রাখে এবং তাদের আচরণে সেরকম চিত্র আঁকার চেষ্টা করে ৷ রাসূলে খোদার দৃষ্টিতে ছেলেমেয়েদের আচার-ব্যবহার সরাসরি তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া ৷ তাই তিনি সবসময় বাবা-মাকে তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে সত্য কথা বলা, তাদেরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা এবং তাদের যথার্থ সম্মান করার কথা বলতেন ৷ তিনি বলেন,'যখনই তোমার সন্তানদের স্মরণ করবে এবং তাদের নাম নেবে,অবশ্যই সম্মানের সাথে করবে ৷ মজলিসে তাদের জন্যে বসার আসন রেখে দেবে এবং তাদের সাথে সহাস্য মুখে ব্যবহার করবে ৷'
নবীজী সবসময় শিশুদেরকে সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানাতেন এমনকি তিনি তাঁর আসন থেকে দাঁড়িয়ে যেতেন , সহাস্যমুখে তাদের স্বাগত জানাতেন৷ তিনি জানতেন যে, শিশুদের পৃথিবীটা হাসি-আনন্দ আর খেলাধূলাপূর্ণ৷ তাই তিনি যতোক্ষণ শিশুদের সানি্নধ্যে কাটাতেন,ততোক্ষণ তাদের সাথে শিশুসুলভ অর্থাত্‍ তাদের মতোই আচরণ করতেন৷ শিশুদের সাথে শিশুদের ভাষায় কথা বলতেন৷ রাস্তায় যখন শিশুরা আবদার করতো তাদের খেলা দেখার জন্যে রাসূল তখন তাদের খুশির জন্যে কিছুটা সময় দিতেন ৷ শিশুদের সাথে নবীজীর আচরণের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন বহু চিন্তাবিদ ৷ এমিল ডরমিংহাম নামের ফরাশি এক মধ্যপ্রাচ্যবিদ রাসূলে খোদার ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন-'মুহাম্মাদ শিশুদেরকে ভালবাসতেন ৷ তাঁর দুই নাতি হাসান এবং হোসাইনকে নামাযের সময় তাঁর পিঠে চড়তে দিয়েছেন এবং বক্তৃতা দেওয়ার সময় মিম্বারের ওপর খেলতে দিয়েছেন ৷

একদিন হলুদ জামা পরা ছোট্ট একটি শিশুকন্যাকে রাসূলের কাছে আনা হলো ৷ শিশুটি খেলতে শুরু করলো ৷ তার মা চাচ্ছিলো দুষ্টুমিতে মগ্ন শিশুটিকে রাসূলের কাছ থেকে নিয়ে নিতে ৷ কিন্তু নবীজী দিলেন না ৷ তিনি ইয়াতিম কন্যাশিশুদের উপহার সামগ্রী বা গলার চেইন দিতেন ৷ রাসূল ( সা ) আশ্চর্য হয়ে যেতেন এইভেবে যে,আরবরা কেন তাদের কন্যাদের আদর করতো না....মানবতার মুক্তির দূত এরকমই ছিলেন ৷ তাঁর প্রাণবন্ত কথাবার্তা যে-ই শুনতো , তারই অন্তর প্রশান্তিতে ভরে যেত ৷'
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন