নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২১ তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২১ তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২১ তম পর্ব


ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, মহান আল্লাহ সূরা আহজাবের ৪৬ নম্বর আয়াতে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ)'কে সিরাজুম মুনীরা বলে অভিহিত করেছেন ৷ সিরাজুম মুনীরা শব্দের অর্থ হলো, আলো বিস্তারী বা আলো বিকিরণকারী প্রদীপ ৷ কেউ পছন্দ করুক বা না করুক, উজ্জ্বল প্রদীপ যে কোনো স্থানে তার চারপাশে আলো ছড়িয়ে দেয়৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ) মসজিদ, ঘর, মহল্লার গলি বা অন্য যেখানেই থাকতেন তাঁর সুন্দর আচার-আচরণ ও উন্নত মানের কাজের মাধ্যমে এবং তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে সেখানকার পরিবেশকে আলোকিত করে তুলতেন৷ ফলে অন্ধকার ও অজ্ঞতার পর্দা দূর হয়ে যেত৷ রাসূল (সাঃ)'র আলোকোজ্জ্বল চিন্তা ও কর্ম যুগে যুগে চিন্তাবিদদের হৃদয় জয় করেছে এবং সেই একই আলোর ঝর্ণাধারা আজো সমুজ্জ্বল৷ আর এসব-ই সম্ভব হয়েছে এ কারণে যে বিশ্বনবী (সাঃ)'র সমস্ত তত্পসরতা, ও কথা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ও তাঁরই সেবায় নিবেদিত ছিল ৷
আধুনিক যুগের অজ্ঞ ব্যক্তিরা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ)'র আলোকোজ্জ্বল ব্যক্তিত্বকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করেছেন৷ কিন্তু দেখা গেছে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও যুক্তির দিকে মানুষ যতই অগ্রসর হচ্ছে ততই তারা বিশ্বনবী (সাঃ)'র প্রতি বেশী শ্রদ্ধাশীল হচ্ছেন৷ রাসূল (সাঃ)'র আধ্যাত্মিকতার উজ্জ্বল দীপ্তি বড় বড় চিন্তাবিদ ও গবেষকদের অভিভুত করছে৷ ইসলাম ধর্ম বিস্তারে বিশ্বনবী (সাঃ)'র সাফল্যের কিছু কারণ আজ আমরা তুলে ধরবো৷
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ) ছিলেন আল্লাহর সবচেয়ে নৈকট্যপ্রাপ্ত ও অনুগত বান্দা৷ মহান আল্লাহর সবচেয়ে নিবেদিত-প্রাণ দাস ছিলেন বলেই তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ আচার-আচরণ, সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাধারা ও সর্বশ্রেষ্ঠ গুণাবলী অর্জন করতে পেরেছেন৷ আর এজন্যেই মুসলমানরা সব সময়ই নামাজে তাশাহুদ পড়ার সময় এ মহাসত্যের স্বীকৃতি দেন যে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ) অন্য সব কিছুর আগে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ও প্রকৃত বান্দা বা দাস৷ আর এরপরই মুসলমানরা নামাজে বলেন, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ) আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল৷
মহান আল্লাহর প্রতি রাসূল (সাঃ)'র ভালোবাসা ছিল সবচেয়ে গভীর ও সর্বোচ্চ ৷ মহান আল্লাহর প্রতি তাঁর এই গভীরতম ভালবাসা ও আস্থায় কখনও বিন্দুমাত্র চিড় ধরে নি৷ ইসলাম যখন আরবের সর্বোচ্চ শক্তিতে পরিণত হয়, তখনও তাঁর খোদাপ্রেম ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ছিল সর্বোচ্চ এবং যখন মক্কায় মুসলমানরা ছিল সবচেয়ে নিপীড়িত তখনও তাঁর খোদাপ্রেম ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ছিল সর্বোচ্চ৷ সর্বাবস্থায় তিনি আল্লাহকে সর্বোত্তম সহায় ও বন্ধু মনে করতেন৷ মোটকথা প্রিয় নবীজী (সাঃ) এক মুহূর্তের জন্যেও আল্লাহকে ভুলে থাকতেন না এবং আল্লাহর জন্যে সর্বোচ্চ ত্যাগস্বীকারে সর্বদা প্রস্তুত থাকতেন৷ মহান আল্লাহর প্রতি গভীর প্রেমের কারণেই বিশ্বনবী (সাঃ) রাতের অধিকাংশ সময়ই এবাদত বন্দেগী এবং আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি ও কাকুতি মিনতিতে কাটিয়ে দিতেন৷ এভাবে তিনি মহান আল্লাহর সাহায্য চাইতেন এবং আল্লাহর নেয়ামতের জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন৷ বিশ্বনবী (সাঃ)'র গভীর ঈমান সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে রাসূল তা বিশ্বাস করে৷
বিশ্বনবী (সাঃ)'র স্ত্রী উম্মে সালমা (সাঃ আঃ) একবার গভীর রাতে জেগে ওঠে দেখেন, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এবাদত ও কান্নাকাটিতে মশগুল৷ তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! মহান আল্লাহ আপনাকে এতো ভালোবাসেন, তবুও আপনি কেন এভাবে কাঁদছেন? জবাবে প্রিয় নবী বললেন,আল্লাহ সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়লে কে আমাকে রক্ষা করবে? রাসূলে খোদা (সাঃ) আরো বলেছেন, যে আল্লাহ আমাকে এতো নেয়ামত দিলেন, আমি কি সে জন্যে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হব না? এভাবে তিনি খোদাপ্রেমের মাধুর্য তুলে ধরেছেন৷ তিনি সাহাবীদের বলতেন, বিপদ-আপদে মুক্তির ওসিলা সম্পর্কে তোমরা কি জানতে চাও? মুক্তির মাধ্যম বা ওসিলা হলো আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর কাছে কাকুতি-মিনতি করা৷ এ জন্যেই দেখা গেছে, জিহাদসহ বিভিন্ন সময়ে, দূরদর্শী পরিকল্পনা ও দক্ষ পরিচালনার পাশাপাশি আল্লাহর রাসূল (সাঃ) প্রার্থনার হাত উঁচু করে মহান আল্লাহর মহত্ত্বের ও একত্বের গভীর প্রশংসায় মগ্ন হয়ে তাঁর সাহায্য ভিক্ষা করতেন৷ মহান আল্লাহও তাঁকে কঠিনতম বিপদে সহায়তা করতেন৷
মক্কায় রাসূল (সাঃ)'র সবচেয়ে বড় সহায়তাকারী চাচা আবু তালেবের মৃত্যুর পর আবুল লাহাব বনী হাশেম বংশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন৷ তিনি ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ)'র কঠোর শত্রু৷ তার অত্যাচার উত্পীীড়ন সহ্য করতে না পেরে তিনি ও তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী তায়েফে যান৷ তায়েফের জনগণ তাকে ঠাট্রা-বিদ্রুপ করে এবং পাথর মেরে শহর থেকে তাড়িয়ে দেয়৷ ব্যথিত নবী শহরের কাছে একটি বাগানে আশ্রয় নেন৷ সেখানে তিনি একটি গাছের নীচে বসে প্রার্থনা করছিলেন, হে দয়ালুদের মধ্যে সর্বোত্তম দয়ালু! তোমার পথে যে কোনো কষ্ট সয়ে নেব, কিন্তু হে মহান প্রতিপালক, তোমার সাহায্য আমার জন্যে বেশী প্রিয়৷ হে আল্লাহ! তোমার কাছেই আশ্রয় চাইছি, তোমার আলো সমস্ত অন্ধকার নিমূর্ল করে৷
বাগানের মালিকরা রাসূলের অবস্থা বুঝতে পেরে অদাস নামের এক খৃষ্টান গোলামের মাধ্যমে তাঁর জন্যে এক ঝুড়ি আঙ্গুর পাঠিয়ে দিল৷ রাসূল (সাঃ) আঙ্গুর উঠিয়ে মুখের কাছে নেয়ার সময় বলললেন, (ইকো) বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম৷ অর্থাত্‍ পরম করুনাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি৷ বিস্মিত অদাস বললো, এই শহরের লোকেরা তো এ ধরনের কথা বলে না! আপনি কি লাত ও ওজ্জা নামের মূর্তির নাম নিয়ে কাজ শুরু করেন না? বিশ্বনবী মোস্তফা (সাঃ) বললেন, সব কিছুর মালিক সেই প্রভু যিনি প্রতিপালক ও দয়ালু৷ বিশ্বনবী প্রশ্ন করলেন, আপনি কোন্ অঞ্চলের অধিবাসী? অদাস বললোঃ আমি নিনেভার অধিবাসী৷ হযরত ইউনুস (আঃ)ও ছিলেন ঐ অঞ্চলের অধিবাসী৷ মহানবী (সাঃ) বললেন, আমার ভাই ইউনুস (আঃ) আল্লাহর নবী ছিলেন যেমনিভাবে আমি নিজে আল্লাহর নবী৷ এরপর তিনি হযরত ইউনুস (আঃ) পবিত্র কোরআনের আয়াতের কিছু অংশ তেলাওয়াত করেন৷
অদাসকে রাসূল (সাঃ)'র সাথে কথাবার্তায় মশগুল দেখে বাগান মালিকরা তার ওপর মহানবী (সাঃ)'র সম্ভাব্য প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হলেন৷ তারা হস্তক্ষেপ করতে চাইলেন৷ কিন্তু ততক্ষণে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ)'র বাণী অদাসের অন্তরে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে৷ পরিবর্তিত ও অভিভূত অদাস রাসূল (সাঃ)কে বললেন, আপনিই তো সেই নবী যাঁর আবির্ভাবের সুসংবাদ হযরত ঈসা (আঃ) দিয়ে গেছেন৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ) ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে কত যে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করেছেন তার একটা দৃষ্টান্ত এই ঘটনা থেকে ফুটে উঠেছে৷ ইসলামী আদর্শ প্রচারের জন্যে রাসূল (সাঃ)'র ত্যাগ ও ধৈর্য ছিল নজীরবিহীন৷ আর এটাই ছিল ইসলাম প্রচারে তাঁর সাফল্যের অন্যতম রহস্য৷ ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে চারদিক থেকে শত্রুদের অসহনীয় চাপের মুখে রাসূলের কোনো কোনো সাহাবা শত্রুদের সাথে আপোস করতে রাসূল (সাঃ)কে পরামর্শ দিতেন৷
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ) মক্কায় ১৩ বছর ধরে ইসলাম প্রচারের কারণে যারপরনাই দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন৷ এজন্যেই কয়েক বছর ধরে তাঁকে অর্থনৈতিক অবরোধ সহ্য করতে হয়েছে৷ প্রাণঘাতি শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যে মরুভূমিতে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়েছে৷ তাঁর সাহাবীগণও নির্যাতিত হয়েছেন৷ রাসূলের ঘরে আশ্রয় গ্রহণকারী 'আসহাবে সুফফা' নামে পরিচিত সাহাবীরা এতই অভাবের মধ্যে ছিলেন যে তাঁরা কখনও কখনও নিজের পোশাক-পরিচ্ছদ একে অপরকে ধার দিতেন৷ তাঁরা কখনও কখনও একটি মাত্র খেজুর চুষে বিভিন্ন জিহাদে অংশ নিয়েছেন৷ ওহোদের যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে রাসূল (সাঃ)'র কয়েকটি দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিল৷ এ দৃশ্য তাঁর অনেক সাহাবীকে ব্যথিত ও যন্ত্রণাক্লিষ্ট করেছে৷ তখন কোনো কোনো সাহাবী নবী (সাঃ)কে বলেছেন, হে রাসূল! আপনি শত্রুদের অভিশাপ দিন৷ কিন্তু রহমত ও দয়ার অতুল মহামানব রাসূল(সাঃ) বললেন, আমি মানুষকে অভিশাপ দিতে আসিনি, আমি মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানানোর জন্যেই নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছি৷
এরপর তিনি মহান আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বললেন, হে আল্লাহ! আমার জাতিকে হেদায়াত করুন, তারা বুঝতে পারছে না৷
এভাবেই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ) সত্য প্রচারের ময়দানে সবসময় দৃঢ়চিত্ত ছিলেন এবং কখনও মহুর্তের জন্যেও হতাশ হন নি৷ এভাবেই তিনি বিশ্বের সবচেয়ে অনগ্রসর সমাজে শ্রেষ্ঠ সভ্যতার পতাকা উঁচু করতে সক্ষম হয়েছিলেন৷ মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূল (সাঃ)কে বলেছেন, তুমি যেভাবে আদিষ্ট হয়েছো তাতে স্থির বা অটল থাকো এবং তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তারাও স্থির থাকুক৷ আসলে মানুষকে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ পথ দেখানোই ছিল রাসূল (সাঃ)'র নবুওতি মিশনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য৷ মানুষ নিজের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন৷ এ অবস্থায় সঠিক পথে অটল থাকার জন্যে বিশ্বনবী (সাঃ) মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন৷ এসব নির্দেশনার আলোকে তিনি আদর্শ সমাজও গড়ে তুলেছিলেন৷ তাঁর ঐ সমাজের ভিত্তি ছিল ন্যায়বিচার ও একত্ববাদ৷ আর ন্যায়বিচার ও একত্ববাদ ভিত্তিক ইসলাম ধর্ম কিভাবে প্রচার করতে হয় এবং কিভাবে এ পথে ত্যাগ তীতিক্ষার মাধ্যমে অটল থাকতে হয় তাও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ) মানবজাতিকে দেখিয়ে গেছেন৷
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন