নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৬ষ্ঠ পর্ব
নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৬ষ্ঠ পর্ব
খাদীজা ভোরে আশ্চর্য এক স্বপ্ন দেখলেন। তিনি স্বপ্নরাজ্যে দেখলেন যে, অন্ধকারাচ্ছন্ন শহরের আকাশের এক প্রান্তে উজ্জ্বল একটি চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। ঐ চিহ্নটি ধীরে ধীরে ভূপৃষ্ঠের দিকে নেমে আসছিল। তার আলো সূর্যের মতো উজ্জ্বল মনে হলো। স্বপ্নিল ঐ সূর্যটা নীচে আসতে আসতে মক্কার আকাশকে আলোকিত করে তুললো। খাদিজা বিস্ময়করভাবে ঐ নূরে আলোকিত হয়ে গেল এবং হঠাৎ দেখতে পেলো সূর্যটা তার মাথার ওপর এসে দাঁড়িয়েছে। সূর্যটা তারপর নীচে এলো এবং খাদীজার ঘরকে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করে তুললো। খাদীজার ঘুম ভেঙ্গে গেল। অভূতপূর্ব এক অজানা আনন্দে তার মনটা ভরে গেল। খাদীজার এই মধুর স্বপ্ন তাকে আত্মনিমগ্ন করে তুললো। স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্যে সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। সে বুঝতে পেরেছিল যে, একটা বড়ো সৌভাগ্য তার জন্যে অপেক্ষা করছে, তবে সৌভাগ্যটা যে কী, তা বুঝতে পারে নি।
ক'দিন হলো খাদীজার বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া থেকে ফিরে এসেছে এবং মুহাম্মাদ (সা) ব্যাপক লাভ বা মুনাফা এনে দিতে সক্ষম হয়েছে। খাদীজা মনে মনে ভাবতে লাগলো, সম্ভবত আমার সৌভাগ্যটা হলো এই মুনাফা যা âমুহাম্মাদ আমীন' সিরিয়া থেকে এনে দিয়েছে। আবার নিজে নিজেই বলতে লাগলো-কিন্তু, এ ধরনের স্বপ্নের ব্যাখ্যা কেবল বস্তুগত সাফল্যের মধ্যে সীমিত থাকতে পারে না। এই স্বপ্নের অর্থ ক্ষণস্থায়ী জীবন সংক্রান্ত বিষয়াবলীর অনেক উর্ধ্বে। খুব ভোরে খাদীজা তার বয়স্ক এক চাচাতো ভাইয়ের কাছে গেল। এই চাচাতো ভাইটির নাম ছিল ওরাকা ইবনে নাওফাল। আরবের মধ্যে তিনি ছিলেন বেশ জ্ঞানী একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা খুব ভালো জানতেন। খাদীজা তাঁর কাছে বিস্ময়কর ঐ স্বপ্নের ঘটনাটা বলে ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। ওরাকা স্বপ্নের ঘটনাটা অত্যন্ত মনোযোগের সাথে শুনলেন এবং বললেন : "খাদীজা ! এই স্বপ্নটা তোমার জন্যে বিরাট একটা সুসংবাদ। তুমি খুব দ্রুত এই পৃথিবীর সবচে'মহান ও বিখ্যাত ব্যক্তিকে বিয়ে করবে।"
খাদীজার খাদেম মেইসারা সিরিয়ায় বাণিজ্যিক সফরের পর মুহাম্মাদের ব্যাপক প্রশংসা করেছিল। মেইসারা মুহাম্মাদের চারিত্র্যিক, আত্মিক এবং আধ্যাত্মিকতার ভূয়সী প্রশংসা করে এবং আসা-যাওয়ার পথে যা যা ঘটেছিল, খাদীজার কাছে তার বর্ণনা দেয়। এইসব বর্ণনা শোনার পর মুহাম্মাদের মর্যাদা খাদীজার কাছে আগের চেয়ে আরো বেড়ে যায়। খাদীজা মুহাম্মাদকে অত্যন্ত সম্মানীয় ও সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব বলে মনে করতো। সিরিয়ায় বাণিজ্যিক সফরের কয়েকদিন পর মুহাম্মাদ তাঁর পারিশ্রমিক নেওয়ার জন্যে খাদীজার কাছে এলেন।
খাদীজা বললো : হে আমীন ! এই সফরে তুমি প্রচুর মুনাফা এনে দিয়েছো,এই মুনাফায় তোমারও অংশ আছে। এখন বলো তুমি কী চাও !'
মুহাম্মাদ বললেন : "এই সফর থেকে তোমার যা লাভ হয়েছে,তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়েছে,এর মাঝে আমি কেবল ওসিলামাত্র ছিলাম।"
খাদীজা বললো : ঠিক আছে,আমি নিজেই তোমাকে মুনাফা দিতে চাই। এখন তুমি বলো, এই টাকা দিয়ে তুমি কী করবে !'
মুহাম্মাদ খানিক বিরতির পর বললেন : আমার ওপর চাচা আবু তালেবের ব্যাপক অধিকার রয়েছে। ঐ অধিকারের সামান্য অংশ আদায় করার জন্যে আমি আমার পারিশ্রমিকের পুরো টাকাটাই তাঁকে দিয়ে দিতে চাই। বিষয়টা চাচার কাছে উত্থাপন করেছিলাম কিন্তু তিনি রাজি হলেন না।' খাদীজার কাছে মুহাম্মাদ (সা) এর মর্যাদা ও গাম্ভীর্য আরো বেড়ে যায়। খাদীজা চেয়েছিল মুহাম্মাদকে পুরস্কার স্বরূপ কিছু টাকা দিতে, কিন্তু মুহাম্মাদ নিলেন না, তিনি শুধু পারিশ্রমিকের টাকাটাই গ্রহণ করলেন।
খাদীজা ছিলো অত্যন্ত পূত-পবিত্র ও সতী-সাধ্বী এক রমনী। মুহাম্মাদের বিশ্বাস এবং তার অমায়িক ভদ্রতার তিনি প্রশংসা করতেন। মুহাম্মাদের মহান ব্যক্তিত্ব এবং আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্য খাদীজার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তাই মনে মনে ভাবলো : সম্ভবত স্বপ্নে দেখা ঐ সূর্য এই মুহাম্মাদেরই পবিত্র ও সুমহান অস্তিত্ব। কুরাইশদের মধ্য থেকে অনেক সম্পদশালী লোক এবং বড়ো বড়ো ব্যক্তিত্ব খাদীজাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু মুহাম্মাদ ছিলেন এক দরিদ্র যুবক। খাদীজা খুব ভালো করেই জানতো যে, সে যেহেতু কুরাইশদের মাঝে সবচে ধনী মহিলা, সেহেতু দারিদ্র্যের কারণে মুহাম্মাদ তাকে বিয়ে করার প্রস্তব দেবে না। তাই স্বপ্নের ঘটনায় সে সিদ্ধান্ত নেয় যে নিজেই মুহাম্মাদের কাছে নিজের বিয়ের প্রস্তাব দেবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক খাদীজা এই কাজের জন্যে তার এক বান্ধবী নাফিসা'র সহযোগিতা কামনা করে। নাফিসা বান্ধবীর আহ্বানে সাড়া দেয়। সে মুহাম্মাদের কাছে যায়। মুহাম্মাদ (সা.) নাফিসাকে চিনতেন। সেও ছিল মক্কার একজন নামকরা রমনী। নাফিসা মুহাম্মাদের উদ্দেশ্যে বললো: হে আমীন ! তোমার সততা, পবিত্রতা এবং আমানতদারীর কথা সর্বত্র শোনা যায়। মক্কার সকল মেয়েই তোমার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়। তোমার বয়স এখন ২৫ বছর। কেন তুমি বিয়ে করে নিজের জীবন সাজাচ্ছো না ?'
কিছুদিন থেকে অবশ্য মুহাম্মাদ (সা.) নিজেও বিয়ের কথা ভাবছিলেন এবং ঈমানদার ও পূত-পবিত্র একজন রমনীকে স্ত্রী হিসেবে বরণ করার কথা ভাবছিলেন। তাই নাফিসার কথা শোনার পর মাথা নিচু করে একটু ভাবলেন। নাফিসা বলতে লাগলো : আচ্ছা, আমি যদি তোমাকে এমন এক রমনীর সন্ধান দেই, যে কিনা রূপে-গুণে, ব্যক্তিত্বের মহিমায়, অর্থ-সম্পদে এবং পবিত্রতায় মক্কার মধ্যে বিখ্যাত,তাকে তুমি বিয়ে করবে ?'
মুহাম্মাদ জিজ্ঞেস করলেন : তুমি কার কথা বলছো !'
নাফিসা বললো : আমি সেই নারীর কথা বলছি যাকে মক্কার সকল সম্পদশালী ব্যক্তিই বিয়ে করতে চায়। কিন্তু বিয়ের ক্ষেত্রে তার মানদণ্ড অর্থ-সম্পদ নয়, তার মানদণ্ড হলো মর্যাদা,সম্মান ও ব্যক্তিত্ব যা আজকাল কম লোকের মাঝেই দেখা যায়। এরপর নাফিসা বললো-মুহাম্মাদ ! আমি খাদীজার কথা বলছি। তুমি তো তার পূত-পবিত্রতার খ্যাতির কথা জানোই। খাদীজাও তোমার মতোই, মূর্তিপূজা করে না এবং এই কাজকে মিথ্যা বা অন্যায় বলে মনে করে। সে-ও চিরসত্যের অনুসারী। আভ্যন্তরীণ কোনো এক বোধশক্তি তাকে অন্যায় বা নোংরা কাজ থেকে বিরত রাখে।'
মুহাম্মাদ নাফিসার কথা শুনে খানিকটা চিন্তা করলেন যে, তাঁর পক্ষে তো মূর্তিপূজক কোনো নারীকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। তাই তিনি নাফিসাকে বললেন :
খাদীজা মক্কার একজন সম্মানিত ও সম্পদশালী মহিলা ! সে কি আমার মতো এক দরিদ্র যুবককে বিয়ে করবে ?'
নাফিসা মুহাম্মাদের কথা শুনে আনন্দিত হয়ে বললো : বিয়ে করবে কি করবে না,সে দায়িত্ব তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও !'-এই বলে নাফিসা খাদীজার ঘরের দিকে চলে গেল।
এর ক'দিন পর মুহাম্মাদ নাফিসাকে নিয়ে খাদীজার ঘরে গেল। এটা ছিল তাঁদের দু'জনের মাঝে বিয়ের প্রাথমিক সাক্ষাৎ। মুহাম্মাদ সবসময়ের মতোই শান্ত এবং বিনত মস্তক ছিলেন। ভাগ্য নির্ধারণী এ মুহূর্তে দু'জনই দু'জনের কথা শোনার জন্যে উদগ্রীব ছিলেন। খাদীজা কথা শুরু করলেন এভাবে:
"হে মুহাম্মাদ ! আরবের মধ্যে বংশ-মর্যাদার দিক থেকে তোমার চেয়ে উচ্চস্থানীয় কেউ নেই। তুমি নিশ্চয়ই জানো যে, বহু সম্পদশালী লোক আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু আমি তোমার সম্পর্কে অনেক শুনেছি। নিজেও তোমার বহু মাহাত্ম্য বা অলৌকিক কর্মকাণ্ড দেখেছি। তোমার সততা,আমানতদারী এবং পবিত্রতায় মুগ্ধ হয়ে আমি তোমার স্ত্রী হবার বাসনা পোষণ করছি। আমিও যে তোমার সততার ব্যাপারে আস্থাবান তুমি সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকো।"
কে জানে, পবিত্র ঐ মুহূর্তে মুহাম্মাদের মনের ভেতর কেমন করছিল। কিন্তু মুহাম্মাদ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বিনয় ও ভদ্রতার সাথে বললেন : এ ব্যাপারে আমার চাচার সাথে পরামর্শ করা প্রয়োজন। এরপর দু'পক্ষীয় অভিভাবকদের মাঝে একটা বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা ধার্য হলো।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খাদীজার বাসায় একটা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। আসরে সর্বপ্রথম মুখ খুললেন আবু তালেব। আল্লাহর নাম নিয়ে তিনি তাঁর ভাতিজাকে সবার সামনে পরিচিত করালেন এভাবে :
"আমার ভাতিজা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ কুরাইশ যুবকদের সবার মধ্যে শ্রেষ্ঠস্থানীয়। সে অবশ্য অর্থ-সম্পদের দিক থেকে বঞ্চিত। তবে একথা জেনে রেখো, সম্পদ হলো ছায়ার মতো,ছায়া একসময় বিলীন-বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু সম্মান-মর্যাদা এবং বিশ্বাসের মতো মৌলিক জিনিসগুলো থেকে যায়।"
আবু তালিবের কথা শেষ হবার পর খাদীজার চাচাতো ভাই ওরাকা ইবনে নাওফাল দাঁড়িয়ে বললেন : কুরাইশদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তোমাদের সম্মান-মর্যাদার কথা অস্বীকার করে। আমরাও আন্তরিকভাবেই তোমাদের এই সম্মান মর্যাদায় গর্বিত। আমরা তাই তোমাদের সাথে আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ হতে চাই। এরপর বিয়ের মোহরানা ধার্য হলো এবং তাদের দু'জনের মাঝে বিয়ের আকদ হলো। এভাবেই পৃথিবীর দুই বিখ্যাত নর-নারী স্বামী-স্ত্রীর মহান সম্পর্কে আবদ্ধ হলো। কয়েক মুহূর্ত পর খাদীজা (সা.) তাঁর স্বামী মুহাম্মাদ (সা.) এর চেহারার প্রতি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন। তিনি তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তাঁর এবং মুহাম্মাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে তাকালেন এবং তাঁদের বিয়ের বরকতপূর্ণতা দেখতে পেলেন। খাদীজার স্বপ্ন এভাবেই বাস্তবে পরিণত হয়।
খাদীজা তাঁর স্বামীর আধ্যাত্মিকতার বিষয়টি খুব ভালো করেই জানতেন। আর এ কারণেই তিনি তাঁর স্বামীর প্রতি বেশী আকৃষ্ট হন। তিনি তাঁর সকল ধন-সম্পদ স্বামীর হাতে সোপর্দ করলেন। মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর দয়ালু চাচার ঘর থেকে খাদীজা (সা.)'র ঘরে এলেন। বিত্তবান জীবনে আসার পরও কিন্ত তাঁর আচার-আচরণে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসে নি। তিনি সহজ-স্বাভাবিক বা অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতেন। সাধারণ খাবার খেতেন। যে-কোনো অভাব-অভিযোগ বা প্রয়োজনে তিনি একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভর করতেন। বঞ্চিত, আর অভাবগ্রস-দের প্রতি তিনি ছিলেন সবসময়ই সদয়। তাদের চিন্তা ছিল তাঁর সার্বক্ষণিক একটা বিষয়। কিন্তু অন্ধকার সে সময়কার লোকজন যে মূর্তিপূজা করতো,সে বিষয়টি তাঁর বিনীত অন্তরকে সারাক্ষণ আহত করতো,কষ্ট দিতো। তিনি মক্কার গোলোযোগ এবং দাঙ্গাপূর্ণ পরিবেশ থেকে দূরে থাকতেন। মুহাম্মাদের অন্তরাত্মা ধীরে ধীরে বৃহৎ দায়িত্ব পালনের জন্যে প্রস্তত হচ্ছিল, যার অপেক্ষায় তিনি ছিলেন।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন