নৈতিকতা-১৩ তম পর্ব

নৈতিকতা-১৩ তম পর্ব

‘সাবর’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো বাধা দেয়া, বিরত রাখা ও বেঁধে রাখা। আর পারিভাষিক অর্থ হলো- বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, অত্যাচার-অনাচার, অসুস্থতা, রোগ-ব্যাধি ও বিচ্ছেদের মতো সংকটগুলোর মোকাবেলায় বিচলিত ও অস্থির না হয়ে বিপদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করা এবং আল্লাহর সাহায্যের অপেক্ষা করা। ধৈর্য হচ্ছে মানুষের এমন একটা গুন,যার কারণে সে অসুন্দর ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। এটি মানুষের একটি অন্তর্গত শক্তি, যা দিয়ে সে নিজেকে সুস্থ ও সুরক্ষিত রাখতে পারে। হিজরি ১৩ শতাব্দীর বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ মোল্লা আহমাদ নারাকি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মিরাজুস সায়াদাত’এ লিখেছেন, ‘সবর বা ধৈর্য ধারণ হলো- ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তা। অস্থির না হওয়া। বালা-মুসিবতকে মোকাবিলা করা। আর বালা-মুসিবতকে এমনভাবে মোকাবিলা করা, যাতে এর ফলে ব্যক্তির অন্তর উদ্বেলিত না হয় এবং মানসিক প্রশান্তি বজায় থাকে। পাশাপাশি নিজের জিহ্বাকে অভিযোগ-অনুযোগ করা থেকে বিরত রাখা এবং দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অস্বাভাবিক কাজ থেকে দূরে রাখা।’ ঈমান সম্পর্কে রাসূল (সা.)কে প্রশ্ন করা হলে তিনি এক কথায় বলেছিলেন, ‘ঈমান হচ্ছে ধৈর্য ধারণ।’

পৃথিবীর জীবনে সমস্যা-সংকট ও বাধা-বিপত্তির অন্ত নেই। মানুষ তার ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমেই এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পায় এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনে সক্ষম হয়। এ কারণে ধৈর্যকে যে কোনো সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে গণ্য করা হয়। পৃথিবীতে যারা সুন্দর জীবন গড়েছে, তারা ধৈর্যের মাধ্যমেই তা করতে পেরেছে। অনেকে ধৈর্যের মাধ্যমে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরেও আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছে। এ ধরনের ব্যক্তি যেমন দুঃসময়ে ধৈর্য ধারণ করে, তেমনি সু-সময় এলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। ধৈর্য ধারণ করলে সুখ ও প্রশান্তি আসবেই। যেমনিভাবে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা তালাকের ৭ নম্বর আয়াতে বলেছেন, আল্লাহ শিগগিরই কষ্টের পর দেবেন স্বস্তি। এ আয়াতেও এটা স্পষ্ট যে, কষ্টের পর সুখ ও স্বস্তি আসবেই। কিন্তু কষ্টের সেই সময়টুকুতে ধৈর্য ধরতে পারলেই সুখ অর্জন করা সম্ভব হবে।

যে কোনো দুঃখ-দুর্দশার মধ্যদিয়ে মানুষের ধৈর্য শক্তি ও সহ্য ক্ষমতা বাড়ে। ধৈর্য ধারণ এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ সম্ভব হয় না। ধৈর্যশীলরা খারাপ কাজের জবাব দিতে পারে ভালো ভাবে এবং সত পন্থায়। সূরা ফুসসিলাতের ৩৫ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ধৈর্যশীল ছাড়া এ গুণ আর কারো ভাগ্যে জোটে না এবং অতি ভাগ্যবান ছাড়া এ মর্যাদা আর কেউ লাভ করতে পারে না।’ ধৈর্যশীলদেরকে পুরস্কৃত করার বিষয়ে কুরআনে আরো অনেক আয়াত রয়েছে। পবিত্র কুরআনের সুরা লুকমানের ১৭ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘হে আমার প্রিয় বৎস, নামাজ কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎকাজে নিষেধ কর এবং তোমার ওপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয় এগুলো অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ।’

ইহজগতে এমন কোনো কাজ নেই যা ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা ছাড়া সমাধান করা যেতে পারে। তাই মানবজীবনে ধৈর্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি মানবজাতির একটি মহৎ গুণ। মানুষ পৃথিবীতে ব্যক্তিগত,পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ছোটবড় বহু ধরনের দুঃখ-কষ্ট, বাধা-বিপত্তি, দ্বন্দ্ব-কলহ, বিবাদ-বিসংবাদের সম্মুখীন হয়। কিন্তু মানুষ ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে এসব বাধা-বিপত্তি ও দুঃখ-কষ্ট অতিক্রম করে নিজের লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। বাধা-বিপত্তি ও দুঃখ-কষ্টে ভারাক্রান্ত না হয়ে সবাইকে ধৈর্যের মাধ্যমে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হতে হবে এবং বিপদ-আপদে ও বালা-মুসিবতে ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে এ প্রার্থনা করতে হবে যে, ‘হে আমাদের প্রভু! তুমি আমাদের ওপর এমন বোঝা চাপিয়ে দিয়ো না-যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই।’ স্বয়ং আল্লাহই পবিত্র কুরআনে এ পথ বাতলে দিয়েছেন। ধৈর্যের মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করলে তিনি খুশি হন। মনে রাখতে হবে- সৎপথ পাওয়া মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ। আর এ সত পথ পাওয়ার জন্য ধৈর্য দরকার। রাসুলুল্লাহ (সা.)’র গোটা জীবনই ছিল ধৈর্যের আদর্শ।

মহানবী (সা.) যখন আল্লাহর একত্ববাদ প্রচারে অটল,মক্কার বিধর্মীরা তখন দেখল যে প্রলোভন, ভীতি ও অকথ্য নির্যাতন তথা কোনো কিছুর মাধ্যমেই তাকে দমন করা যাচ্ছে না, বরং ইসলামের অনুসারীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ অবস্থায় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে সামাজিকভাবে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিলো। তারা মহানবী (সা.) ও তার অনুসারীদের সঙ্গে ওঠা-বসা, বেচাকেনা, লেনদেন এমনকি খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে অবরোধ আরোপ করলো। এ ধরনের দুর্দিনেও রাসুলুল্লাহ (সা.) ধৈর্য হারাননি, বরং তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা করে সব সহ্য করে গেলেন। পরে কুরাইশরা নিজেদের ভুল বুঝে তাদের বর্জননীতি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।

তবে ধৈর্য ধারণ খুব সহজ কাজ নয়, সবার পক্ষে তা সম্ভব হয় না। এ জন্য ধৈর্যের অনুশীলন প্রয়োজন। অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষের এ গুনটি বিকশিত হয়। আল্লাহকে সঠিক ভাবে চিনতে পারলে এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস সুদৃঢ় হলে ধৈর্য-শক্তি বাড়ে।

মহান আল্লাহ ধৈর্যশীলদের অত্যন্ত ভালোবাসেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা তুলে ধরা যেতে পারে। ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন বিশ্বনবী (সা.)’র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম জাফর সাদেক (আ.)।

ঘটনা এরকম। হঠাতই একদিন আল্লাহতায়ালা হজরত দাউদ (আ.)’র ওপর ওহি নাজিল করলেন। দাউদ (আ.)কে আল্লাহ বললেন- ‘খালোদে’ নামের এক মহিলা আছে। আপনি তার কাছে গিয়ে এ সুসংবাদ পৌঁছে দিন যে, সে বেহেশতবাসী হবে এবং বেহেশতে তার স্থান হবে আপনার সঙ্গে। দাউদ (আ.) ওই মহিলার বাসায় গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লেন। শব্দ শুনে তিনি বেরিয়ে এসে বললেন- কী ব্যাপার আপনি এখানে কেন? দাউদ(আ.) বললেন- আল্লাহ আমাকে ওহির মাধ্যমে জানিয়েছেন বেহেশতে আপনি আমার সঙ্গী হবেন। খালোদে নামের ওই মহিলা এ খবর শুনে বললেন- আপনার কথা উড়িয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু আল্লাহর কসম-আমার ভেতর এ ধরনের যোগ্যতা নেই। তবে জানালেন যে, তিনি যে কোনো বিপদে-আপদে ধৈর্য ধারণ করেছেন। দুঃখ-কষ্ট মেনে নিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছেন।
সূত্রঃ তেহরান রেডিও

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন