নৈতিকতা-৭ম পর্ব
নৈতিকতা-৭ম পর্ব
আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের মধ্যেই মানুষের প্রকৃত পূর্ণতা ও সাফল্য নির্ভর করছে। আর এই পূর্ণতা অর্জনের জন্য সব ধরনের সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের বিষয়টি অনেকটাই ব্যক্তির ইচ্ছা ও লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সব কিছুর আগে আল্লাহ ও কিয়ামতের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। নবী-রাসূলদের মেনে চলতে হবে। মানুষের যে কোনো কাজের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য অর্জনের জন্য হয়, তাহলে সে সব কাজ ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে।
প্রকৃত সাফল্য ও পূর্ণতা প্রাপ্তির আকাঙ্খা মানুষের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যেরই অংশ। সৎ কাজের মাধ্যমে এ বৈশিষ্ট্য বিকাশ লাভ করে এবং মানুষের আচার-আচরণ ও কাজ-কর্ম আরো গ্রহণযোগ্য ও কল্যাণকর হয়ে উঠে। ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে, মানুষকে তার অস্তিত্বের নানা দিক এবং বিশ্ব বাস্তবতা সঠিকভাবে উপলব্ধির মাধ্যমে প্রকৃত সাফল্য ও কল্যাণ অর্জনের জন্য নিজের সক্ষমতাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় কাজে লাগাতে হবে। মানুষ যদি সঠিক উপলব্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে জীবন পরিচালনা করে, তাহলে তার লেখাপড়া, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিয়ে-শাদি, খাওয়া-দাওয়া, অবসর এবং বিনোদনসহ সব কাজই এবাদত হিসেবে গণ্য হতে পারে। মানুষের জন্য আল্লাহ তথা একত্ববাদে বিশ্বাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একত্ববাদের অর্থ হলো, গোটা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা এক এবং অদ্বিতীয়, যিনি সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞাত। মানুষের সব কাজসহ গোটা বিশ্বের সব কিছুর ওপরই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
একত্ববাদে বিশ্বাসী মানুষ বিশ্বাস করে, বিশ্বকে উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করা হয়নি। সব কিছুর পেছনেই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। এই বিশ্বাসই মানুষের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। এর ফলে মানুষের সব কাজ হয়ে উঠে লক্ষ্যপূর্ণ এবং মানসিক সুস্থতার ক্ষেত্রে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। আমাদের ভেতরে যখন এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয় যে, সব কিছুর ওপরই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং আমরা যখন আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপনের পাশাপাশি তার এবাদত অব্যাহত রাখি, তখন আমাদের মন ও আত্মায় প্রশান্তির জন্ম হয়। ইসলাম ধর্ম মতে, প্রতিটি মানুষই সৃষ্টিগতভাবে আল্লাহর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। এ কারণে আল্লাহপ্রেম হচ্ছে, মানুষের আত্মিক চাহিদার অংশ। এই চাহিদাকে উপেক্ষা করা হলে মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং মানসিক সুস্থতায় ব্যাঘাত ঘটে। মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণেই মানুষ জীবনকে অর্থহীন ও শূন্য ভাবতে শুরু করে। কিন্তু মানুষ যখন এটা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ সব সময় তার পাশে রয়েছেন এবং পৃথিবীর জীবনই শেষ নয়, তখন সে আশাবাদী হয়ে উঠে ও তার হতাশা কেটে যায়। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস মানুষকে খুবই আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
ঈমানদার ব্যক্তিরা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ককে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কের সাথে তুলনা করে থাকেন। তারা এটাও বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহর প্রতি নির্ভরতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ-অযোগ্য অশুভ ঘটনাবলী থেকেও মুক্ত হওয়া যেতে পারে। একজন ঈমানদার ব্যক্তির দৃষ্টিতে, বিশ্ব হচ্ছে অর্থপূর্ণ অস্তিত্ব। ঈমানদার ব্যক্তির জীবনের সব ক্ষেত্রেই একত্ববাদী চিন্তা-বিশ্বাসের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু যারা আল্লায় বিশ্বাস করেন না,তাদের কাছে বিশ্বকে খুবই রহস্যময় মনে হয় এবং তারা হতাশার মধ্যে ডুবে থাকে। এর প্রভাব পড়ে ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা এবং আচার-আচরণে। মানুষের নৈতিক ভারসাম্যও নষ্ট হযে যায়,যা গোটা বিশ্বের জন্যই ক্ষতি ডেকে আনে। কেবল ইসলামী চিন্তাবিদরাই নন, পাশ্চাত্যের অনেক মনোবিজ্ঞানীও মনে করেন- আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী ও মনোভাবকে ইতিবাচক করে তোলে এবং তার কাজ ও আচার-আচরণে এর গঠনমূলক প্রভাব পড়ে। মানসিক ও চিন্তাগত সুস্থতার জন্য একত্ববাদে বিশ্বাস অপরিহার্য।
ঈমানদারেরা সত কাজ করার পাশাপাশি আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী। তারা বিশ্বাস করেন, আল্লাহ সর্বশক্তিমান হওয়ার পরও কারো ওপর জুলুম করেন না এবং তিনি সবচেয়ে দয়াবান। কেউ তার অতীত ভুল বোঝার পর তওবা করলে আল্লাহ তা গ্রহণ করেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন। তওবা করে সত পথে চললে আল্লাহ মানুষকে সফলকাম করেন। ঈমানদার ব্যক্তিরা পৃথিবীকে পরকালীন জীবনের শস্যক্ষেত্র হিসেবে মনে করেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহতায়ালা মানুষের সব কাজ দেখছেন এবং সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম কাজেরও হিসাব হবে পরকালে। জীবনের সবচেয়ে কঠিন ও অন্ধকার মূহুর্তেও ঈমানদারেরা ভেঙে পড়েন না এবং একাকীত্ব অনুভব করেন না। আল্লাহকে নিজের খুব কাছের বলে মনে করেন তারা। এর ফলে মানুষের সুদৃষ্টিভঙ্গী ও মনোভাব আরো সুদৃঢ় হয়। নিজের স্বার্থ রক্ষিত না হলেই সেটাকে খারাপ বলতে হবে, এমন প্রবণতা ঈমানদারদের মধ্যে থাকে না। ঈমানদার ব্যক্তিরা বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধাকেই তার সুখ নিশ্চিত করার মাধ্যম বলে মনে করেন না। পৃথিবীর জীবনের চড়াই-উতড়াইকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেন ঈমানদারেরা। সুখ ও সমৃদ্ধি কখনোই তাকে আসল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে না।
আল্লাহতায়ালা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে পবিত্র ও সফল ব্যক্তিত্বের গুণাবলী তুলে ধরতে যেয়ে ঈমানের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি ভালো কাজ ও আচরণ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মনোবিজ্ঞানী ও মনোচিকিতসকরা মনে করেন, আল্লাহর প্রতি ঈমানের সঙ্গে অলৌলিক শক্তি ও ক্ষমতা জড়িত এবং ঈমান থাকার কারণে মানুষ আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী হন। আসলে আল্লাহর প্রতি ঈমান, মানুষের জীবনের জন্য বড় পুঁজি। সুইজারল্যান্ডের মনোচিকিতসক কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং তার ‘মনোবিজ্ঞান ও ধর্ম’ বিষয়ক বইয়ে লিখেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানদার, তার ব্যাপারে বলতে হবে তিনি মূল্যবান রত্মের অধিকারী হয়েছেন। কারণ ঈমান হচ্ছে মানব জীবন, সৌন্দর্য ও গতিময়তার উতস। আসলে ইতিবাচক মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গী হচ্ছে, মানুষের একটি বড় গুণ। যে কোনো কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে এর বিকল্প নেই। পরিবার, সমাজ ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ পরিচালনা ও শান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টিতে ইতিবাচক মনোভাব অদৃশ্য শক্তি হিসেবে কাজ করে। ইতিবাচক মনোভাব মানুষের মধ্যে মানবীয় গুণাবলি ফুটিয়ে তোলে।
অন্যদিকে, নেতিবাচক মনোভাব ডেকে আনে মানুষের ধ্বংস। মানুষের মনে রাগ-ক্ষোভ এবং শত্রুতার জন্ম দেয় নেতিবাচক মনোভাব। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী মানুষের ভেতর থেকে মনুষ্যত্ব হরন করে নিয়ে যায়; তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না, তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে পশুত্ব। আর এই ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির জন্য আল্লাহর প্রতি ঈমান অপরিহার্য।
সূত্রঃ তেহরান রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন