মযান্দারন প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর সারি

সারি উপশহরটি মযান্দারন অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। বেশ নামকরা এই সারি অঞ্চলটির এতোটা পরিচিতির কারণ হচ্ছে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

মযান্দারন প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর সারি
সারি উপশহরটি মযান্দারন অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। বেশ নামকরা এই সারি অঞ্চলটির এতোটা পরিচিতির কারণ হচ্ছে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কেবল মযান্দারনের মধ্যেই যে সারি সুন্দর এলাকা তাই নয় বরং উত্তরাঞ্চলীয় ইরানের মধ্যেই একটি আকর্ষণীয় এলাকা হিসেবে মনে করা হয়। সারি উপশহরটির উত্তরে রয়েছে কাস্পিয়ান সাগর, পূবদিকে রয়েছে বেহশাহর, দক্ষিণ দিকে পড়েছে আলবোর্য পর্বতমালার নিস্তব্ধতা আর পশ্চিম দিকে রয়েছে কয়েম শাহর এবং সাভদ কূহ উপশহর। সারি উপশহরটির আয়তন চার হাজার বর্গ কিলোমিটারের কাছাকাছি।

সারি শহরে বেশ কয়েকটি নদী আছে। তাজেন নদীটির নাম সবার আগে স্মরণ করতেই হয়। এই নদীটির দৈর্ঘ এক শ চল্লিশ কিলোমিটার। নদীটি ধীরে ধীরে বয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মিলে গেছে কাস্পিয়ান সাগরের সাথে। সারির আরেকটি বিখ্যাত নদীর নাম হলো নেকা নদী। এই নদীর পানি মযান্দারন প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর সারির উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার জমিগেুলোর তৃষ্ণা মেটায়।

সারি উপশহরে বিভিন্ন রকমের শিল্প গড়ে উঠেছে। এখানকার গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে খাদ্য পণ্য সম্পর্কিত শিল্প। রয়েছে ছাপাখানা বা মুদ্রণ শিল্প এবং প্রকাশনা শিল্প। রাবার শিল্প এবং ধাতব শিল্প সামগ্রী উৎপাদন শিল্পও রয়েছে প্রচুর।

আরো রয়েছে সেলাই এবং তাঁত শিল্প। কাঠ শিল্প, চামড়া শিল্প, রাসায়নিক বিচিত্র শিল্প, খনিজ অধাতব শিল্প ইত্যাদি। এসবের বাইরেও রয়েছে তুলা, ভেষজ তেল, আটা-ময়দা, প্যাস্তোরাইজড দুধ এবং দুগ্ধজাত বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী উৎপাদনের কথাও এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। সারি এলাকার লোকজনের মূল পেশা হলো কৃষিকাজ। তবে কৃষিকাজের পাশাপাশি পশুপালনের রেওয়াজও রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। বলা যেতে পারে এই দুটি পেশাই প্রধানত সারি অঞ্চলের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। নদী থাকার কারণে পানি সরবরাহের সমস্যা হয় না। নদী ছাড়াও ঝর্ণাধারা, পার্বত্য উপত্যকা নিসৃত পানিও রয়েছে, রয়েছে পানিভর্তি অনেক কূপও। যার ফলে কৃষিকাজ করতে কোনোরকম বিপত্তির মুখেও পড়তে হয় না। তাছাড়া সারির মাটিও বেশ উর্বর, তাই ফসল ফলে ভালোভাবে।

সারি উপশহরের এই উর্বর পলিময় মাটিতে যেসব ফসল ফলে সেগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ গম, যব, ধান, তুলা, তামাক, ভুট্টা বিচিত্র শাকশব্জি আর ফলমূল, তেল তৈরি হয় যেসব দানাদার শস্য থেকে, সেসব শস্যদানাও প্রচুর উৎপাদিত হয় এখানে। এখানকার উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী আঞ্চলিক চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানী হয় এলাকার বাইরে বিভিন্ন শহর নগরে এমনকি দেশের সীমানার বাইরেও। যেহেতু সারি উপশহরের পাশেই রয়েছে সমুদ্র, সেজন্যে সামুদ্রিক বহু জিনিসও এখানে সহজলভ্য। মাছ শিকারের ব্যাপারটা তো সারি’তে রয়েছেই, যতদূর সমুদ্রের অস্তিত্ব রয়েছে ততদূর এই মাছ শিকারের পেশাটি লক্ষ্য করা যাবে। চাই তা সারি’তেই হোক কিংবা সারি ছেড়ে অন্য কোনো এলাকায়।

মযান্দারন প্রদেশের কেন্দ্রিয় এই শহরটি ইরানের একটি প্রাচীন শহর হিসেবে ইতিহাসখ্যাত। লিখিত দলিল দস্তাবেজে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সারি শহরটির গোড়াপত্তন করেছিলেন তাবারেস্তানের শাসক সেপাহবোদ ফারখন। হিজরি প্রথম দশকে তিনি তাঁর ছেলের নামে এই শহরটির নামকরণ করেছিলেন। তাঁর ছেলের নাম ছিল সারভিয়ে। সে সময় মযান্দারন নামের কোনো অস্তিত্বই ছিল না, শুধুমাত্র তাবারিস্তান নামেই পরিচিত ছিল প্রদেশটি।

যাই হোক সারি শহরটির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ইতিহাসের বহু কালো ঝড়। আব্বাসীয় খলিফা মানসুর এই শহরটি জয় করার পর এখানে গড়ে তুলেছিলেন নামায পড়ার জন্যে মসজিদ।

২৬০ হিজরিতে ‘ইয়াকুব লেইস’ সাফফরি এই শহরটি দখল করেছিলেন। তারপর শহরটি চলে গিয়েছিল ইসমাইল সামানির হাতে। আলে যিয়র এবং আলে বুইয়ে’র স্বল্পমেয়াদি শাসনকালে ফিরে পান এবং ৪২৬ হিজরিতে মাহমুদ গাযনাভি আবার সারি শহরে প্রবেশ করেন। ৭৯৫ হিজরিতে তৈমুর লং মযান্দারনের জনগণ এবং সারির লোকজনের ওপর গণহত্যা চালায়। তারপরও মোঙ্গলদের বর্বর হামলা থেকে রেহাই পায় নি এই শহরটি, মোঙ্গলরা ধ্বংস করে দিয়েছিল পুরো সারি শহরটিকে। পরবর্তীকালে সাফাভি বাদশারা সারি’র প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। শাহ আব্বাস সাফাভির আমলে এই শহরটিকে ভালো করে গড়ে তোলা হয়েছিল। তারা সরকারী বেসরকারী বড়ো বড়ো বহু ইমারত নির্মাণ করেছিলেন। রাস্তাঘাট বানিয়েছেন এমনকি নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণ করে শহরটিকে বাসোপযুগি বানিয়েছেন, সাজিয়েছেন তিলোত্তমা করে। তাজের নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করার ফলে পুরো সারি এলাকার সৌন্দর্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

বর্তমানে অবশ্য সারি শহরটি প্রশাসনিক দিক থেকে যেমন তেমনি বাণিজ্যিক দিক থেকেও মযান্দারন প্রদেশের মধ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে সারি’র। এখানে যোগাযোগের জন্যে নতুন নতুন সড়কপথ যেমন গড়ে উঠেছে তেমনি তৈরি করা হয়েছে বিমান বন্দরও। যার ফলে কেবল মযান্দারনই নয় বরং সমগ্র ইরানের মধ্যেই এই এলাকাটির আলাদা একটা গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। ইরানের বৃষ্টিপাতপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যেই সারি পড়ে। প্রায় সকল ঋতুতেই এখানে বৃষ্টিপাত হয়। সারি শহরে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কখনো কখনো সত্তুর সেন্টিমিটারও ছেড়ে যায়।

কী গ্রীষ্মকাল আর কী শীতকাল সকল ঋতুতেই এই শহরের আবহাওয়া থাকে আর্দ্রতাপূর্ণ। সে কারণে বাতাসে জলীয় বাষ্পের মাত্রা থাকে বেশি। এ কারণেই শীতকালে বরফ জমে কম। যার ফলে প্রকৃতি হয়ে ওঠে সবুজ সবুজ আর সবুজে ভরা। এছাড়া এখানে জঙ্গলও বা বন বনানীও আছে অনেক। আছে সমুদ্র উপকূল। আবার মরু এলাকাও। সবমিলিয়ে ঐতিহাসিক বহু নিদর্শনের শহর হয়ে উঠেছে সারি। শহরের একেবারে মাঝখানে আছে ঘড়ি স্কোয়ার। আছে মোল্লা মাজদুদ্দিনের কবর। ইমামযাদেহ ইয়াহিয়ার কবরও আছে এখানে। সুলতান যয়নুল আবেদিন টাওয়ার তো সবারই চেনা। সেইসাথে রয়েছে ঐতিহাসিক জামে মসজিদ। যাঁরা দেখেন নি এখনো, যাবার সুযোগ হলে দেখে আসতে ভুলবেন না-এ প্রত্যাশায়।
সূত্রঃ তেহরান রেডিও

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন