গিলানের মযান্দারন প্রদেশ

গিলানের মযান্দারন প্রদেশ


ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় সবুজ শ্যামলিময় প্রদেশগুলোর মাঝে মযান্দারন প্রদেশটির স্থান সবার উর্ধ্বে। ২৪ হাজার ৪ শ ৬০ বর্গকিলোমিটার এর আয়তন। প্রদেশের উত্তরদিকে রয়েছে মযান্দারন সাগর, পশ্চিমে গিলান প্রদেশ, দক্ষিণে সেমনান এবং তেহরান আর পূর্বে রয়েছে ঐতিহাসিক গুলিস্তান প্রদেশ।

মযান্দারন প্রদেশটির প্রাচীন নাম ছিল তাবারেস্তান। এখানে কয়েক হাজার বছর আগে জনবসতি গড়ে উঠেছিল বলে ইতিহাসে প্রমাণ মেলে। যারা বাস করতো এখানে তাদেরকে বলা হতো ‘তাপুর’। আর তাদের বাসস্থানকে কিছুটা ভিন্ন উচ্চারণে বলা হতো ‘তাপুরেস্তান’। যদিও ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় শব্দটির উচ্চারণ পরিবর্তিত হতে হতে দাঁড়িয়েছে ‘তাবারেস্তান’। পরবর্তীকালে খ্রিষ্টিয় তেরো শতাব্দিতে মোঙ্গলদের হামলার পর তাবারেস্তান নামটি পাল্টে গিয়ে বর্তমান মযান্দারন নাম ধারণ করেছে। ইয়াকুত হেমাভি সর্বপ্রথম নিজের লেখা ইতিহাসের পাতায় এই মযান্দারন নামটি উল্লেখ করেছেন বলে প্রসিদ্ধি রয়েছে ঠিকই তবে বিভিন্ন লেখালেখি ও বর্ণনা থেকে বোঝা যায় তার আগেও এই ভূখণ্ডটিকে মযান্দারন নামে অভিহিত করা হতো।

মযান্দারন ইতিহাসের বিচিত্র ঘটনা দুর্ঘটনার স্মৃতি বিজড়িত একটি প্রদেশ। কালের দীর্ঘ পরিক্রমায় এখানে রাজনৈতিক চড়াই উৎরাই যেমন পরিলক্ষিত হয়েছে, তেমনি সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বহু ঘটনারও নীরব স্বাক্ষী এই মযান্দারন প্রদেশ। সম্ভবত এ কথা বলাটা অতিশয়োক্তি হবে না যে, ইরানের মাঝে যতোগুলো ঐতিহাসিক শহর আছে,এই মযান্দারনের মতো ব্যাপক ঘটনাবহুল শহর আর দ্বিতীয়টি নেই। এ কারণেই ইরানী এবং বিদেশী ইতিহাসবিদ ও লেখকগণ এই ঐতিহাসিক ভূখণ্ডের বিচিত্র ঘটনা দুর্ঘটনার ইতিহাস নিজেদের লেখায় তুলে ধরতে ভুল করেন নি।

তাবারিস্তানের জনগণ তাদের নিজ ভূখণ্ডের স্বাধীনতার জন্যে দীর্ঘ সময় বিদেশীদের সাথে যুদ্ধ করেছে, দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়েছে। এই সংগ্রাম, স্বদেশের জন্যে এই স্বাধীনতার লড়াই তাহেরিয়ানদের সময় থেকে শুরু করে সাফফারিয়ান, সামানিয়ান, গাযনাভিয়ান, সালজুকিয়ান এমনকি তাদের পরবর্তী রাজবংশের আমলেও অব্যাহত ছিল। পরবর্তীকালে মোঙ্গলদের সময় এবং তৈমুরীয়দের সময়ও ইরানের এই ভূখণ্ডটি ক্ষয়ক্ষতি থেকে মুক্ত ছিল না। এমনকি এ সময়ও মযান্দারন অঞ্চলের বহু নিরীহ মানুষ হতাহত হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে বহু বসত ভিটা।

ইতিহাসখ্যাত সাফাভি শাসনামলে অর্থাৎ খ্রিষ্ট্রিয় ১৬ এবং ১৭ শতকে মযান্দরন বেশ আকর্ষণীয় ছিল। তখনকার রাজা-বাদশাগণও সে কারণে মযান্দারনের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। শাহ আব্বাস সাফাভি বেশ কয়েকবার এই মযান্দারন সফর করেছিলেন। তাঁর আদেশে আশরাফুল বালাদ শহর অর্থাৎ এখনকার বেহশাহর শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল। ইতালির বিখ্যাত ভূবন পর্যটক পিট্রো দিলা ভ্যালে শাহ আব্বাসের শাসনামলে মযান্দরন সফর করেছিলেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে শাহ আব্বাসের শাসনকাল নিয়ে যেমন লিখেছেন তেমনি এই মযান্দরন সম্পর্কেও লিখেছেন। বিশেষ করে মযান্দারনের আর্দ্রতাপূর্ণ শহর খোররাম শহরের কথা লিখেছেন।

সবুজ শ্যামল এই মযান্দারনের আরো যে দিকটি পিট্রো দিলা ভ্যালের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে তা হলো এ অঞ্চলের লোকজনের আন্তরিক অতিথি পরায়নতা এবং বিনয়, নম্রতা ও ভদ্রতাপূর্ণ আচরণ। তিনি লিখেছেনঃ ‘মযান্দারনের সকল জনগণই চায় মেহমানকে নিজের বাসায় নিয়ে যেতে, মেহমানের সাথে ভদ্র, নম্র এবং বিনয়ী আচরণ করতে। এ রকম আতিথেয়তা আমি পৃথিবীর কোত্থাও আর দেখি নি। ফলে এ অঞ্চলের লোকজন যে কতোটা সুসভ্য এবং সংস্কৃতিবান তা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না। আমি সমগ্র এশিয়ায় মযান্দারনের এই চমৎকার দিকটি আর কোথাও দেখি নি।’

মযান্দারনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এই ভূখণ্ডটি ইরানের জনসংখ্যাবহুল একটি এলাকা। তবে সর্বত্র সমানভাবে যে জনসংখ্যার এই হার বিরাজ করছে, তা নয়। বরং এলাকা হিসেবে কোথায় বেশি, কোথাও কম। যেমন শহরগুলোতে, শিল্প এলাকাগুলোতে কিংবা কৃষি নির্ভর অঞ্চলে জনবসতির হার একটু বেশি। আবার পার্বত্য এলাকাগুলোতে এই হার একটু কম। তার মানে মাটির উর্বরতা যে এলাকায় যতো বেশি এবং উৎপাদনশীল সে এলাকা ততো বেশি জনবসতিপূর্ণ। তবুও বলা যায় মযান্দারনের শহর অঞ্চলই হোক কিংবা গ্রামাঞ্চল-ইরানের অন্যান্য এলাকা থেকে মানব বসতিতে অনেক বেশি অগ্রসর। তবে সমতল ভূমি থেকে যতই উপরের দিকে অর্থাৎ আলবোর্য পর্বতমালার উত্তর উপত্যকার দিকে অগ্রসর হওয়া যাবে ততই জনবসতি কম লক্ষ্য করা যাবে।

মযান্দারন প্রদেশের আবহাওয়ায় এখানকার বৃষ্টিপাত এবং উষ্ণতাভেদে বেশ তারতম্য রয়েছে। কাস্পিয়ান সাগর উপকূলীয় হাওয়া আর্দ্র। পার্বত্য এলাকার আবহাওয়া কখনো ঠাণ্ডা কখনো আবার নাতিশীতোষ্ণ। পশ্চিমাঞ্চলীয় সমতলভূমি এবং কেন্দ্রীয় এলাকা থেকে আলবোর্য পর্বতমালার উত্তর উপকূলীয় আবহাওয়া কাস্পিয়ান সাগরীয় অর্থাৎ নাতিশীতোষ্ণ। এই আবহাওয়া আলবোর্য থেকে পূব দিকে একইভাবে বিরাজমান। এর কারণটা হলো পর্বতমালা থেকে সমুদ্রের দূরত্ব খুব বেশি নয়। তাই সমুদ্রের আর্দ্র এবং নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া পর্বতের দেয়াল ভেদ করে দ্রুত সরে যেতে পারে না। আবহাওয়ায় আর্দ্রতার মাত্রা বেশি হবার কারণও তাই। এখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এক হাজার তিন শ’ মিলিমিটারের মতো। এজন্যে এখানকার আবহাওয়ায় শুষ্ক ঋতুর মেয়াদ কম।

তবে মযান্দারনের সুউচ্চ পর্বত চূড়াগুলোতে আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। এখানে চূড়াগুলোর নীচে মেঘ জমে। তিন হাজার মিটার পর্যন্ত উঁচু চূড়া আছে মযান্দারনে। আলবোর্যের উত্তরাঞ্চলের চূড়াগুলোর কথা বলছি আমরা। এ এলাকায় বাতাসের উষ্ণতা একেবারেই কম। সে কারণে বরফ জমে প্রচুর এবং সেগুলো জমাটবদ্ধ থাকে ধীর্ঘ সময়। স্বাভাবিকভাবেই শীতকালটা এখানে একটু দীর্ঘ এবং প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর গ্রীষ্মকাল ছোটো। আর প্রাকৃতিক হিমাগারও এখানে সৃষ্টি হয়েছে অনেক। তাই সারা বছর ধরেই প্রায় বরফ দেখতে পাওয়া যায় এখানে। এগুলোর সৌন্দর্যটা যে কেমন সেটা আর নাইবা বললাম, একবার কল্পনার চোখেই দেখে নিন।

খনিজ পানির ধারাও এখানে তৈরি হয়েছে এইসব প্রাকৃতিক হিমাগার থেকে। খনিজ পানির মধ্যে গরমও যেমন আছে ঠাণ্ডাও আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত রমসারের অবে এমারাত, সাদাত মাহলেহ ইত্যাদি। এগুলো গরম পানির ধারা। এসব পানিতে মানুষ গোসল করে ত্বকের বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকেও মুক্তি পাচ্ছে প্রসিদ্ধি আছে।
সূত্রঃ তেহরান রেডিও

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন