শিয়া মাজহাব সম্পর্কে ইখওয়ান নেতাদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি

শিয়া মাজহাব সম্পর্কে ইখওয়ান নেতাদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি


'৮০-এর দশকে অসুস্থ ইখওয়ান প্রধান শেখ আমর আততালমাসানি'র পাশে ইরানের একজন আলেম ও নীচে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শহীদ হাসান আল বান্নার দুটি ছবি
২০০০ সালে হিজবুল্লাহর হাতে ব্যাপক মার খেয়ে দক্ষিণ লেবাননের দখলদারিত্ব ছেড়ে ইসরাইলি সেনাদের পলায়ন এবং ২০০৬ সালে লেবাননের ইসরাইল বিরোধী কিংবদন্তীতুল্য প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহর হাতে ৩৩ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলের পরাজয়ের পর থেকে মার্কিন ও ইহুদিবাদী মহলের সেবাদাস কোনো কোনো আরব রাজতান্ত্রিক সরকারের সহায়তায় এক শ্রেণীর দরবারি এবং ওয়াহাবি আলেম শিয়া মুসলিম মাজহাব সম্পর্কে বিষাক্ত প্রচারণা শুরু করেন। তারা শিয়া মুসলমানদেরকে বেদাআতপন্থী, বিভ্রান্ত, রাফেজি বা ধর্ম থেকে বিচ্যুত ও এমনকি কাফির বলে ফতোয়া দিচ্ছেন। শিয়াদের হত্যা করা ফরজ- এমন ফতোয়াও দিচ্ছে এইসব দরবারি ও সৌদি-ওয়াহাবি আলেম।

তারা বহু বই-পুস্তক, লিফলেট, রেডিও-টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে এ ধরণের প্রচারণা চালিয়ে ফিলিস্তিনের সংগ্রামী দল হামাসের সঙ্গে ইসলামী ইরান ও হিজবুল্লাহর গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক সহযোগিতার সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।

গত দুই তিন বছরে শেখ ইউসুফ কারজাভির মত আলেমও এ ধরনের বিষাক্ত প্রচারণা জোরদার করেছেন। ইসরাইল ও পাশ্চাত্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ইরান ও হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য সম্প্রতি এই আলেম 'ন্যাটোর মুফতি' হিসেবে সমালোচিত হচ্ছেন।

(অথচ এক সময় তিনি শিয়া মাজহাব সম্পর্কে উদার মনোভাব পোষণ করতেন এবং শিয়া-সুন্নি ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিতেন। তার অতীতের বক্তব্যে অনুযায়ী ইসলামের কেবল অপ্রধান বা শাখাগত বিষয়গুলোতে শিয়া-সুন্নি মতপার্থক্য রয়েছে এবং এ দুই মাজহাবের মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলের দিকগুলো অনেক বেশি। তিনি শিয়া ও সুন্নি মাজহাবকে এক করার জন্য গঠিত মুসলিম মাজহাবগুলোর মধ্যে ঐক্যের বিশ্বসংস্থার প্রধান বা সভাপতিও ছিলেন। সেই কারজাভি সম্প্রতি হিজবুল্লাহকে 'হিজবুশ শয়তান' বলে মন্তব্য করেছেন। কারজাভির ইসরাইল সফর ও ইসরাইল থেকে নিয়মিত বিপুল অর্থ নেয়ার খবর ফাঁস হয়েছে কোনো কোনো সংবাদ মাধ্যমে তারই স্ত্রীর মাধ্যমে।)

শেখ কারজাভি «تاريخنا المفتري عليه» শীর্ষক একটি বই লিখে সেই বইয়ে মোয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান, তার পুত্র ইয়াজিদ এবং কুখ্যাত হাজ্জাজ বিন ইউসুফসহ উমাইয়া বংশের অন্যান্য জালিম শাসকদের পক্ষে সাফাই দিয়েছেন। এ ছাড়াও তিনি সাফাই দিয়েছেন আব্বাসিয় জালিম শাসকদের পক্ষে।এইসব জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে কথা বলায় কারজাভি পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদি, ইখওয়ান নেতা শহীদ সাইয়্যেদ কুতুব ও শেখ মুহাম্মাদ গাজ্জালির কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, উমাইয়া ও আব্বাসিয় জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে এইসব চিন্তাবিদ বা বিশেষজ্ঞদের সমালোচনা বাস্তবতা বিরোধী! কারজাভি মওদুদির লিখিত 'খেলাফত ও রাজতন্ত্র' এবং শহীদ সাইয়্যেদ কুতুবের লিখিত 'ইসলামের সামাজিক ন্যায়বিচার' শীর্ষক বইগুলোকে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী বই ও তাদের বক্তব্যকে 'অপবাদ'বলে উল্লেখ করেছেন। কারজাভির এই বই আরব বিশ্বে বিনা মূল্যে ব্যাপক সংখ্যায় বিতরণ করা হয়েছে। এই বইয়ের জবাবে 'কারজাভি বনি উমাইয়ার উকিল' শীর্ষক বই লিখেছেন মিশরীয় অধ্যাপক আহমদ রাসেম আননাফিস। এই বইয়ে তিনি ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ ও যুক্তি দিয়ে বলিষ্ঠভাবে কারজাভির বক্তব্য খণ্ডন করেছেন।

সমস্যা হল সৌদি ওয়াহাবিরা এক সময়কার কট্টর ওয়াহাবি ও সালাফি বিরোধী কারজাভিকে ইখওয়ানের অন্যতম নেতা বলে প্রচার করছেন।

আসলে মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সঙ্গে শিয়া মুসলমানদের এবং বিশেষ করে ইরান ও হিজবুল্লাহর সম্পর্ককে তিক্ত করাও তাদের এই প্রচারণার অন্যতম লক্ষ্য।

বিশেষ করে লেবাননে ইসরাইলি আগ্রাসন চলাকালে ইখওয়ানের ততকালীন প্রধান নেতা বা মুর্শিদে আম শেখ মাহদি আকেফ ইখওয়ান বলেছেন, ইখওয়ান লেবাননের শিয়া হিজবুল্লাহর গেরিলাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য দশ হাজার মুজাহিদকে লেবাননে পাঠাতে প্রস্তুত রয়েছে। শিয়া মাজহাবের অনুসারীদের নিয়ে গঠিত এই বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি সুন্নি মাজহাবে বিশ্বাসী ইখওয়ানের এই সহানুভূতি এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল আরব রাজা-বাদশাহ এবং সেবাদাস ওয়াহাবিদের হিংসা ও হিংস্রতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে (হোসনি মুবারকের শাসনামলে) মিশরে গ্রেফতার করা হয় ব্রাদারহুডের বহু নেতা ও সদস্যকে এবং এ ছাড়াও মিশরের বহু শিয়া মুসলমানকেও শুধু শিয়া হওয়ার অপরাধে কারাগারে পাঠানো হয়। এর কয়েক সপ্তাহ পর মিশরের ১৭ জন ইখওয়ান নেতাকে আততানজিম আদদৌলি নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের অভিযোগে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়। এ ছাড়াও এই সংস্থার কথিত সদস্যদেরও গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয় মিশরের নিরাপত্তা সংস্থার পক্ষ থেকে। এর পাশাপাশি গাজার মজলুম ফিলিস্তিনিদের কাছে মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর কাজে হিজবুল্লাহর সঙ্গে সহযোগিতাকারী একদল মিশরীয় যুবককে গ্রেফতার করা হয়। অজুহাত হিসেবে বলা হয় যে এরা হল হিজবুল্লাহর মিশর শাখার সদস্য। তাদেরকে বিচারের জন্য মিশরের সামরিক আদালতের হাতে সোপর্দ করা হয়েছিল।

এ অবস্থায় ২০০১ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বরে মার্কিন টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনার পর ইখওয়ানের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন তীব্রতর হয়। আর এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও শিয়া মাজহাব সম্পর্কে ইখওয়ানের উদার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন ইখওয়ানের সিনিয়র ও প্রবীণ নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইউসুফ নেদা। তিনি ৬০ বছর ধরে এ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ছিলেন ইখওয়ানের আন্তর্জাতিক সংস্থা আততানজিম আদদৌলার অন্যতম নেতা এবং সুইজারল্যান্ডে আততাক্বওয়া নামের একটি ইসলামী ব্যাংকেরও প্রতিষ্ঠাতা। শিয়া মাজহাব ও শিয়া মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতি তুলে ধরা ওই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে 'ইসলাম অনলাইন' ওয়েবসাইটে।

শেখ আমর আততালমাসানি ( شيخ عمر التلمساني) ছিলেন ইখওয়ানের অন্যতম আমির বা মুর্শিদে আম। (প্রায় ২৫-২৯ বছর আগে তিনি জীবিত ছিলেন। ) তিনি শিয়া-সুন্নি ঐক্যের ওপর জোর দিতেন এবং ইরানের ইসলামী বিপ্লবের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন ও এই বিপ্লবের অগ্রগতির ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতেন। হাসানুল বান্না ছিলেন ইখওয়ানের প্রথম আমির বা মুর্শিদে আম। আর আততালমাসানি ছিলেন এই আন্দোলনের ইতিহাসের তৃতীয় আমির। শিয়া মাজহাব ও শিয়া মুসলমানদের ব্যাপারে তিনি হাসানুল বান্নার সঙ্গে কথা বলেছিলেন এবং সেই স্মৃতি-কথা প্রকাশিত হয়েছিল ذکريات لامذکرات শীর্ষক বইয়ে।

শেখ আমর আততালমাসানি শিয়া ও সুন্নি প্রসঙ্গে হাসানুল বান্নার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন," ইমামুল বান্না রিজওয়ানুল্লাহ আলাইহি (আল্লাহ তার ওপর সন্তুষ্ট হোক) ইসলামী ঐক্যের ওপর বিশেষ জোর দিতেন এবং ইখওয়ান অতীতে, বর্তমানে ও ভবিষ্যতেও এই নীতি অব্যাহত রাখবে তা এই বড় লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে যত সমস্যাই দেখা দিক না কেন। পবিত্র কুরআনের বক্তব্যের আলোকে মুসলমানরা হচ্ছে এক জাতি। আমার মনে আছে ৪০’র দশকে জনাব ক্বোমি নামের একজন শিয়া আলেম ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় অফিসে মেহমান হিসেবে অবস্থান করতেন। সে সময় ইমাম শহীদ বান্না ইসলামী মাজহাবগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টির জন্য জোরালো প্রচেষ্টা চালাতেন যাতে শত্রুরা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যকে ধ্বংস করতে না পারে।

আমি একদিন ইমামকে শিয়া-সুন্নির মতভেদ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি আমাকে এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে নিষেধ করে বললেন, মুসলমানদের উচিত নয় এসব বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকা এবং তাদের বোঝা উচিত ইসলামের শত্রুরা এসব বিষয়কে ফেতনা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার আগুন জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করে।

আমি ইমামকে বললাম, না আমি মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ছড়ানোর ইচ্ছা নিয়ে এবং বিদ্বেষ নিয়ে এ বিষয়টি উত্থাপন করিনি বরং আমি সত্য সম্পর্কে সচেতন হতে চাই। কারণ, বই-পুস্তকে শিয়া-সুন্নি বিষয়ে অসংখ্য বিতর্ক দেখা যায়, তাই স্বাভাবিকভাবেই আমরা এসব বই ও উতস নিয়ে গবেষণা বা তদন্ত করতে কি সক্ষম?

ইমাম হাসানুল বান্না (রেজ.) বললেন, আপনি জেনে রাখুন আহলে সুন্নাত ও শিয়া –এরা সবাইই মুসলমান। কলেমায়ে তৌহিদ لااله‌الا‌الله، و اشهد ان محمد رسول‌الله তাদের সবাইকে পরস্পরের কাছে নিয়ে আসছে। মুসলমানদের এই মূল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে শিয়া ও সুন্নিরা একই অবস্থানে রয়েছে। উভয়ই এ বিষয়ে পরস্পরের সহযোগী। তবে এই দুই ধারার মধ্যে মতভেদ অপ্রধান কিছু বিষয়ে সীমিত, আর এইসব বিষয়েও উভয়কে কাছাকাছি করতে পারব আমরা।

আমি প্রশ্ন করলাম, কোনো দৃষ্টান্ত দিতে পারবেন কি?

ইমাম বললেন: শিয়ারাও আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের মতই একটি মাজহাব। তাদের মধ্যেও আছে নানা গ্রুপ। যেমন, ইমামিয়া বা ১২ ইমামি শিয়া। তারা ইমামতের বিষয়কে ইসলামের একটি জরুরি বিষয় বলে মনে করে, আর এ বিষয়ে অবশ্যই গবেষণা হওয়া উচিত। যেহেতু (শিয়াদের দৃষ্টিতে) ইমাম হচ্ছেন শরিয়তের রক্ষক এবং শরিয়তের বিষয়ে তার বক্তব্যই হচ্ছে চূড়ান্ত বক্তব্য, তাই তার নিঃশর্ত আনুগত্য করা ওয়াজিব বা ফরজ।

ফিকাহ সংক্রান্ত বিষয়েও (শিয়া মাজহাবের সঙ্গে সুন্নি মাজহাবের) কিছু মতভেদ রয়েছে যা দূর করা সম্ভব যেমন, অস্থায়ী বিয়ে ও শিয়াদের কোনো কোনো ফেরকার দৃষ্টিতে স্ত্রীর সংখ্যার মত বিষয়; আর এসব বিষয়কে শিয়া ও সুন্নির মধ্যে দূরত্বের বা বিভেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। বরং আমাদের মনে রাখা উচিত শিয়া ও সুন্নি মাজহাব শত শত বছর ধরে পরস্পর পাশাপাশি বসবাস করেছে শান্তিপূর্ণভাবে ও কোনো সংঘাত ছাড়াই –তবে দ্বন্দ্ব যা দেখা যায় তা শুধু বই-পুস্তকে ও কাগজে-কলমে। আর এটাও জানা উচিত যে শিয়াদের ইমামগণ অনেক ভাল লেখনী বা বই রেখে গেছেন এবং এইসব বই মুসলমানদের গ্রন্থাগারের মূল্যবান সম্পদ। এই ছিল ইমাম হাসান আল বান্নার বক্তব্য শিয়া ও সুন্নি প্রসঙ্গে।

আমিও মনে করি যেসব বিষয় শিয়া-সুন্নি মতভেদ সৃষ্টি করে সেসব বিষয়ে কখনও মশগুল না হওয়ার মধ্যেই রয়েছে আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ। কারণ শিয়া-সুন্নি বিভেদ সৃষ্টি ইসলামের শত্রুদের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।"

এবারে শিয়া মাজহাব সম্পর্কে ইখওয়ানের উদার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে ইঞ্জিনিয়ার শেখ ইউসুফ নেদা যে প্রবন্ধ লিখেছেন সেই প্রবন্ধের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি:

আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও কুরআনকে সর্বোচ্চ পবিত্র বিষয় এবং ভুলের ঊর্ধ্বে বলে মনে করে ইখওয়ান। এর বাইরে অন্য সবার মধ্যে ভুল থাকতে পারে এবং সাহাবিরা সম্মানিত হলেও নবী (সা.)'র মত ভুলের ঊর্ধ্বে নন।

নেদা লিখেছেন, ইখওয়ান মনে করে খলিফায়ে রাশিদিনের মধ্যে আলী(আ.) ছিলেন সবচেয়ে সত ও খোদাভীরু। এ ছাড়াও তাঁর স্ত্রী নবী-নন্দিনী ফাতিমা (সা. আ.) ও কন্যা জেইনাব (সা. আ.) তাঁদের কথা আর আচার-আচরণের কারণে সম্মানিত। নৈতিক চরিত্র, ধর্ম ও জ্ঞানের দিক থেকে ইমাম হাসান (আ.) অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। ইখওয়ানের দৃষ্টিতে ইমাম হুসাইন (আ.)ও ছিলেন খোদাভীরু এবং উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। তাঁর শাহাদত ছিল ধর্ম রক্ষা ও আল্লাহর পথে শাহাদতের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত।

ইখওয়ানের মতে মুসলমানদের মধ্যে মাজহাবগত পার্থক্য ও ফিকাহ বা আইন বিষয়ে মতভেদ মানবীয় বিষয়। ইখওয়ান সব মাজহাবের ফকিহ বা আইনবিদকেই শ্রদ্ধা করে। তারা ধর্মকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন, যদিও তাদের গবেষণার ফসল ওহী বা কুরআনের মত নির্ভুল নয়।

ইখওয়ান মনে করে ইসলামী আইন বিষয়ে গবেষণা বা ইজতিহাদের পথ কিয়ামত পর্যন্ত খোলা, তবে এ জন্য দরকার ইতিহাস ও আরো কিছু বিষয়ে গভীর জ্ঞান।

অতীতের ফকিহদের সব ফতোয়া সব যুগের জন্য প্রযোজ্য নয় বলে ইখওয়ান মনে করে। যেমন, ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কিমের উল্লেখিত মুসলমানদের 'ওয়ালিয়ে আমর' বা ক্ষমতাসীন শাসকের আনুগত্য করা সংক্রান্ত ফতোয়াকে খোদাদ্রোহী শাসকদের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে যাতে তাদের দখল করা ক্ষমতার রাজতান্ত্রিক মসনদ বংশ পরম্পরায় টিকে থাকে। তারা ধর্মের নাম ব্যবহার করে বলে যে আমাদের নির্দেশ মান্য করা মুসলমানদের জন্য ফরজ। এ ব্যাপারে কুরআনের আয়াতের কিছু অংশকে ব্যবহার করে ওই আয়াতের পরবর্তী অংশের দিকে লক্ষ্য করা হয় না। (সুরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াত)

ইখওয়ান মনে করে শিয়াদেরকে রাফেজি বা ধর্ম থেকে বিচ্যুত ও বেদাতি বলা একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি যা কেবল উত্তেজনা ও বিভেদ বাড়ায়। এ ধরনের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে শিয়া মাজহাবের বিরুদ্ধে বন্যার মত বহু বই প্রকাশ করা হয়েছে যেগুলো মিথ্যা, বিভ্রান্তি ও অতিরঞ্জনে ভরপুর। শিয়াদের বিরোধী নানা অপবাদ ও বক্তব্যে ভরপুর এইসব বইয়ের সব কথাকেই বেশির ভাগ সুন্নি মুসলমান ধ্রুব সত্য ও অনস্বীকার্য বলে মনে করেন। কিন্তু বাস্তবতা হল এইসব মন্তব্য বা ধারণা হয় বিদ্বেষ-প্রসূত বা অজ্ঞতা-প্রসূত অথবা প্রতারিত ব্যক্তির কিংবা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য সুবিধাবাদীদের সুবিধা লাভের প্রচেষ্টার অংশ যারা নিজের ধর্মকে বিক্রি করছেন রাজা-বাদশাহ বা শাসকদেরকে খুশি করার জন্য। আরো নিকৃষ্ট ব্যাপার হল- এরা কখনও কখনও কাফির এবং ইহুদি-খ্রিস্টানদেরকে শিয়াদের চেয়ে ভালো মনে করেন!

ইঞ্জিনিয়ার ইউসুফ নেদা লিখেছেন, ইতিহাস বিষয়ক সবচেয়ে জঘন্য অপরাধের মধ্যে অন্যতম হল শিয়াদেরকে (আবদুল্লাহ) ইবনে সাবার অনুসারী বলে অপবাদ দেয়া। অথচ এমন কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব ঐতিহাসিক দিক থেকে প্রমাণিত কোনো বিষয় নয়। এই ব্যক্তির অস্তিত্ব একটি কাল্পনিক বিষয় বা রূপকথা মাত্র। শিয়াদের কাফির বলার জন্য এটা এক ধরনের অজুহাতের লেবেল বা স্টিকার মাত্র।

ইখওয়ান নেতা নিদা লিখেছেন, সুন্নিদের চার মাজহাব ও ১২ ইমামে বিশ্বাসী শিয়া মাজহাব মিলে মোট ৫ টি মাজহাব মুসলিম উম্মাহরই অংশ। এইসব মাজহাবের কোনোটিকেই কাফির বলা ঠিক নয়। কারণ, ইসলামের মূল বিশ্বাসগুলোর প্রতি তাদের সবার ঈমান রয়েছে।

শিয়াদের মধ্যে একটি অতি বিচ্যুত বা অজ্ঞ ও জাহেল অংশ যারা আলী (আ.)-কে খোদা মনে করে তাদেরকে শিয়া আলেমগণ সব সময়ই ধর্মত্যাগী ও কাফির বলে ঘোষণা করেছেন। সুন্নিদের একদল বিচ্যুত অংশও তাদের নেতাদের সম্পর্কে একই ধরনের ধারণা পোষণ করে।

মোট কথা ধর্মের মূল বিষয়গুলোতে শিয়া-সুন্নি মতপার্থক্য নেই, কেবল শাখাগত বিষয়ে মতভেদ আছে। আর এ ধরনের মতপার্থক্যের জন্য কোনো মাজহাবকে ইসলামের বাইরের মাজহাব বলা যায় না বলে জনাব নেদা মন্তব্য করেছেন।

নেদা লিখেছেন, খেলাফতের জন্য আলী (আ.) মুয়াবিয়ার চেয়ে বেশি যোগ্য ও সত ছিলেন এবং মুয়াবিয়া খেলাফতকে দখল করেছিলেন। মুয়াবিয়া মুসলমানদেরকে খেলার পুতুলে পরিণত করেছিলেন এবং নিজের রাজত্বের মালিকানাকে নিজের দুর্নীতিগ্রস্ত বা চরিত্রহীন সন্তানদের জন্য নির্ধারিত করেছিলেন। এটা ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও কেবল ইখওয়ানের কথা নয়।

রাসূল (সা.)'র স্ত্রীগণ ও সাহাবিগণের প্রতি ইখওয়ানের শ্রদ্ধার নীতির কথাও তুলে ধরেছেন ইঞ্জিনিয়ার ইউসুফ নেদা। তিনি লিখেছেন, ইখওয়ান মনে করে ইমামত ও খেলাফতের বিষয়ে শিয়া-সুন্নি মতপার্থক্য ধর্মের মৌলিক বিষয় নয় বরং শাখাগত বিষয় এবং এই মতপার্থক্য রাজনৈতিক।

তিনি কথিত ওয়াহাবি সালাফিদের সমালোচনা করে লিখেছেন, সালাফি শব্দের অর্থ হল মূল নীতির অনুসারী, কিন্তু ওয়াহাবি সালাফিরা এই নাম ব্যবহারের যোগ্য নয় কারণ, তারা সংকীর্ণমনা, একপেশে ও কেবল বাহ্যিক দিকের জ্ঞান রাখে এবং তাদের জ্ঞানের গভীরতা নেই।যুক্তির চোখ দিয়ে অন্যদের মত শোনার মত উদারতা তাদের নেই। সালাফিদের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিও দুটি বা তিনটির বেশি বই পড়েননি।

ইখওয়ান একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী। এ আন্দোলন অতীতের পরহিজকার বা খোদাভীরু আলেমদের অনুসরণ করছে। কিন্তু সালাফিরা চরমপন্থী ও উগ্র দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির মোকাবেলা করছে এমন ভাব দেখিয়ে যে যেন তারাই প্রকৃত তৌহিদবাদী বা একত্ববাদী। কথায় কথায় মুসলমানদের কাফির বলে না ইখওয়ান। তাই এই মধ্যপন্থী আন্দোলন সব শ্রেণীর মুসলমানের মন জয় করেছে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন