ইসলামের অনন্য সংরক্ষক ইমাম হুসাইন (আ.)
ইসলামের অনন্য সংরক্ষক ইমাম হুসাইন (আ.)
মহান আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি যিনি আমাদের পবিত্র আশুরা বা দশই মহররমকে স্মরণ করার তৌফিক দিয়েছেন। একইসঙ্গে অসংখ্য দরুদ আর সালাম পেশ করছি বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত এবং বিশেষ করে শহীদকুলের সর্দার হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ও কারবালার অন্যান্য মহান শহীদদের শানে। অনন্ত শোকের আধার মহান আশুরা উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি অশেষ শোক ও সমবেদনা।
উতারো সামান, দাঁড়াও সেনানী নির্ভিক-সিনা বাঘের মত/আজ এজিদের কঠিন জুলুমে হয়েছে এ প্রাণ ওষ্ঠাগত,
কওমি ঝাণ্ডা ঢাকা পড়ে গেছে স্বৈরাচারের কালো ছায়ায়, /পাপের নিশানি রাজার নিশান জেগে ওঠে অজ নভঃনীলায় ...
হেরার রশ্মি কেঁপে কেঁপে ওঠে ফারানের রবি অস্ত যায়! /কাঁদে মুখ ঢেকে মানবতা আজ পশু শক্তির রাজসভায়!...
হোক্ দুশমন অগণন তবু হে সেনানী! আজ দাও হুকুম/মৃত্যু সাগরে ঝাঁপ দিয়ে মোরা ভাঙ্গবো ক্লান্ত প্রাণের ঘুম!
হবে কারবালা মরু ময়দান শহীদ সেনার শয্যা শেষ/হে সিপাহসালার! জঙ্গী ইমাম আজ আমাদের দাও আদেশ! ...
হে ইমাম! দেখ বিস্মিত রবি তোমার শৌর্য দেখ্ ছে আজ/তোমার দীপ্ত পৌরুষে ম্লান শত্রু সেনার জরিন তাজ!
ভীরু বুজদিল পারে না সইতে তোমার যুদ্ধ আমন্ত্রণ /তীর ছুঁড়ে ছুঁড়ে বহুদূর হতে শত্রু বাহিনী দেখায় রণ। ...
জীবন দিয়ে যে রাখলো বাঁচায়ে দ্বীনি ইজ্জত বীর জাতির/দিন শেষে হায় কাটলো শত্রু সীমার সে মৃত বাঘের শির।
তীব্র ব্যথায় ঢেকে ফেলে মুখ দিনের সূর্য অস্তাচলে,/ডোবে ইসলাম-রবি এজিদের আঘাতে অতল তিমির তলে,
কলিজা কাঁপায়ে কারবালা মাঠে ওঠে ক্রন্দন লোহু সফেন/ওঠে আসমান জমিনে মাতম; কাঁদে মানবতা: হায় হোসেন। হায় হোসেন। (কবি ফররুখ আহমদের ‘শহীদে কারবালা ‘থেকে)
অশেষ শোকের বুক-ভাঙ্গা বেদনা নিয়ে আবারও হাজির হয়েছে পবিত্র আশুরা। মানবজাতির ইতিহাসে এই শোক এক অনন্য বা ব্যতিক্রমধর্মী শোক। কারণ, এই শোক এনে দেয় অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শক্তি আর প্রতিরোধের অফুরন্ত প্রেরণা।
কারবালার কালজয়ী বিপ্লবের মহানায়ক যখন রহস্যজনকভাবে পবিত্র হজের সবগুলো পর্ব সমাপন না করেই বা হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরুর মাত্র এক দিন আগে ৮ ই জিলহজ মক্কার আরাফাত থেকে কারবালার দিকে রওনা দিলেন তখন অনেকেই বিস্মিত হয়েছিল। তাঁদের প্রশ্নের জবাবে ইমাম হুসাইন (আ.) বলেছিলেন, এবারের হজ তিনি আরাফাতে না করে কারবালার ময়দানেই করবেন এবং আল্লাহর রাহে পশু কুরবানি না করে কুরবানি করবেন নিজেকে, নিজের পরিবার ও সঙ্গী-সাথীদেরকে। তিনি এও জানিয়েছিলেন যে, এই মহাযাত্রায় তিনি শহীদ হবেন।
প্রথমে অনেকেই জড়ো হয়েছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.)'র পাশে। তাঁর সফর-সঙ্গীর সংখ্যা হয়তো কয়েক হাজারও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যখন বোঝা গেল আত্মত্যাগ বা শাহাদত এ বিপ্লব বিজয়ের প্রধান শর্ত তখন গনিমত বা দুনিয়ার নানা স্বার্থ হাসিলের প্রত্যাশী সুবিধাবাদী মুসলমানরা ইমামের সঙ্গ ত্যাগ করলেন। অনেকেই ইমাম (আ.)-কে সতর্ক করলেন পরিবার ও নিজ জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে। কিন্তু ইমাম জানিয়ে দিয়েছিলেন, গোটা বিশ্বও যদি তাঁর জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়ে তবুও তিনি ইয়াজিদর মত জালিম ও অসত চরিত্রের শাসককে মুসলিম বিশ্বের শাসক হিসেবে মেনে নেবেন না।
আসলে ইমাম হুসাইন (আ.) কুফাবাসীর অনির্ভরযোগ্য সমর্থনের কথাও জানতেন। কিন্তু বিপ্লবের পথ তিনি ছাড়লেন না। এমনকি কুফায় জনসমর্থনের গণ-জোয়ার উল্টো দিকে বইতে শুরু করার পরও তিনি বিশ্ব ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠার সেই বিপ্লবের পথে আরো দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন।
ইমাম হুসাইন (আ.) ক্ষমতাসীন রাজশক্তির বিপুল সেনা-শক্তিকে ভ্রুক্ষেপও করলেন না। কারণ, তিনি জানেন আসল শক্তির যিনি মালিক তাঁর থেকে এরা রয়েছে লক্ষ-কোটি যোজন দূরে। এরা হল স্রেফ পশু শক্তি ও এমনকি তারও অধম। তবুও এদের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা তিনি চালিয়ে গেছেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।
ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবার-পরিজন এবং সঙ্গীদের ওপর যে অশেষ নির্যাতন, নৃশংসতা, বর্বরতা, বিপদ আর সংকট নেমে এসেছিল সেসবের মোকাবেলায় তাঁদের ধীর-স্থির ও প্রশান্ত চিত্ত, ধৈর্য, বীরত্ব এবং লক্ষ্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা গোটা মানব-জাতির জন্য সৃষ্টি করেছে অমর গৌরবের স্বর্ণজ্জ্বোল অধ্যায়। শিশু সন্তানসহ তৃষ্ণার্ত সন্তানদের ও সঙ্গীদের অবর্ণনীয় সংকট বা বিপদ-মুসিবত তাদের কাউকে এক মুহূর্তের জন্যও হীনবল করেনি। তাঁরা যেন সব সংকট, বিপদ আর মৃত্যুকে ফুলের মতই বরণ করে নিয়েছিলেন। এসবই যেন ছিল তাঁদের পরিপূর্ণতা লাভের এক-একটি সোপান। আর এ জন্যই হযরত জয়নাব (সা.) বলেছিলেন, 'কারবালায় সৌন্দর্য ছাড়া অন্য কিছুই দেখিনি।'
কারবালার বীরদের নজিরবিহীন বিপদ ও অসহায়ত্বের কথা জেনে খোদ বিশ্বনবী (সা.) কেঁদেছেন। কেঁদেছেন বড় বড় রাসূল এবং আহলে বাইতের ইমামগণ। কেঁপেছে আল্লাহর আরশ ও কেঁদেছে ফেরেশেতাকুল। কেঁদেছেন আলী (আ.) ও মা ফাতিমা (সা. আ.)। বিশ্বনবী (সা.)'র জীবনেও এর চেয়ে বড় কষ্ট ও গভীর দুঃখের কারণ কি হতে পারে যে, তাঁরই একদল বিভ্রান্ত উম্মত ইসলামের নাম-নিশানা মুছে ফেলার জন্য রাষ্ট্র-শক্তির অপব্যবহার করে তাঁরই পবিত্র আহলে বাইতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে?
ইমাম হাসান মুজতবা (আ.) যখন ইয়াজিদের বাবার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে শাহাদাতের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত তখন ছোট ভাই ইমাম হুসাইন (আ.) কাঁদছিলেন। এ সময় ইমাম হাসান (আ.) বললেন, কেঁদো না ছোট ভাই! তোমার ও তোমার পরিবার-পরিজন আর সঙ্গীদের ওপর যে কষ্ট আর বিপদ নেমে আসবে তার মত কষ্ট বিশ্বে আর কাউকেও সইতে হবে না।
ইমাম হুসাইন (আ.) জানতেন তিনি যদি শহীদ হন সেটাও বয়ে আনবে ইসলামের জন্য বৃহত্তম বিজয়। অর্থাত তিনি জানতেন যে কোনো অবস্থায় তিনি ও তার ক্ষুদ্র দল অবশ্যই বিজয়ী হবে। কারণ, যে তাঁর কাজ আল্লাহর ওপর সঁপে দেন ও কেবল আল্লাহরই ওপর ভরসা করেন তখন আল্লাহ তাঁর বিজয় আর সম্মানের ব্যবস্থা করেন। ইমাম হুসাইন (আ.) দৃঢ় আস্থা রাখতেন যে, সত্য ও ইসলামের পথে চলতে গিয়ে তাঁর ব্যাপারে যা কিছু ঘটছে, আল্লাহ তা তাঁর ও ইসলামের মঙ্গলের জন্যই করছেন। তাই মুমিনকে সব সময় প্রশান্ত, ধৈর্যশীল ও স্থিরচিত্ত হতে হবে, অস্থির-চিত্ত বা উদ্বিগ্ন হওয়া চলবে না।
এটা ঠিক বিপুল সংখ্যক শত্রু সেনার মোকাবেলায় ইমাম হুসাইন (আ.)'র সঙ্গে ছিল খুবই অল্প সংখ্যক সমর্থক। কিন্তু তাঁরা ছিলেন সবাইই খোদায়ী শক্তির ওপর ভরসাকারী। তাই পঙ্গপালের মত শত্রুসেনার আধিক্য তাঁদেরকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করেনি। এ ধরনের ভরসা নিয়েই ইব্রাহীম (আ.) অগ্রাহ্য করেছিলেন নমরুদকে, মূসা (আ.) পরাজিত করেছিলেন ফেরাউনকে এবং বর্তমান যুগে ইসলামী বিপ্লবের রূপকার হযরত ইমাম খোমেনী (র.) অগ্রাহ্য করেছেন পরাশক্তি আমেরিকার দাপটকে।
ইমাম হুসাইন (আ.) সেদিন ইসলামকে রক্ষা না করলে আজ ইসলাম হয়তো পুরনো ধর্মগুলোর মতই চরম বিকৃতির শিকার হত। এভাবে একদিন প্রিয় নাতি ইসলামকে রক্ষা করবেন বলেই বিশ্বনবী (সা.) বলে গিয়েছিলেন, আমি হুসাইন হতে ও হুসাইন আমা হতে। হুসাইনের (আ.) আত্মত্যাগের ফলেই টিকে আছে বিশ্বনবী (সা.)'র নাম ও প্রকৃত মুহাম্মদী ইসলাম, টিকে আছে তৌহিদের মূল চেতনা। আর এ জন্যই ভারত উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি সাধক খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি বলেছেন, হুসাইন হল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর ভিত্তি, হুসাইন হল ধর্মের আশ্রয়স্থল ও হুসাইনই হল ধর্ম, প্রকৃত বাদশাহ হল হুসাইন।
সেদিন ইয়াজিদ ও তার দলবলদের কেউ কেউ হয়তো ভেবেছিল, ইসলাম এবার সমূলে ধ্বংস হয়েছে। তাই কুখ্যাত নাস্তিক ও মাতাল ইয়াজিদ এক কবিতায় বলেছিল, ‘আমরা হুসাইনকে হত্যার মাধ্যমে মুহাম্মাদকেই হত্যা করেছি এবং মুসলমানদের হাতে আমাদের পূর্ব পুরুষদের হত্যার বদলা নিয়েছি। মুহাম্মাদ নামে কখনও কোনো নবী ছিলেন না।’ (নাউজুবিল্লাহ)
কিন্তু আজ হুসাইনের নাম কত শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করেন বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ ও মুসলমানরা। আজ হুসাইন কত বেশি জীবন্ত! অন্যদিকে কেউ তাদের সন্তানের নাম ইয়াজিদ বা মুয়াবিয়া রাখে না।
ইমাম হুসাইন (আ.) ইসলামকে পুনর্জীবন দান করা ছাড়াও স্বাধীনতার মূল্যবোধকে বসিয়ে গেছেন সর্বোচ্চ আসনে। কয়েক দিন ধরে পিপাসার্ত ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর বীর সঙ্গীরা পাষাণ-হৃদয় পাষণ্ডদের কাছে এক বারের জন্যও পানি ভিক্ষা চাননি। তাঁরা শত্রুদেরকে হারিয়ে দিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য ফোরাতের কূল দখলও করেছিলেন। কিন্তু সঙ্গীদের ও শিশুদের তৃষ্ণার কথা ভেবে তাঁরা পানি পান করেননি। পানি পান করেননি মহাবীর আব্বাস (আ.)। ইমাম (আ.) কেবল পিপাসার্ত দুধের শিশু আসগরের জন্য পানি চেয়েছেন, ইয়াজিদ বাহিনীর দয়াহীনতা, বিবেকহীনতা ও চরম বর্বরতার চিত্র তুলে ধরার জন্যই।
ইমাম হুসাইন (আ.)'র শাহাদতের পর হযরত জয়নাব (সা.) ইমামের একমাত্র জীবিত ও অসুস্থ পুত্র হযরত জয়নুল আবেদিনের (আ.) জীবন রক্ষার জন্যও শত্রুদের কাছে দয়া ভিক্ষা করেননি। ভাতিজাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি জল্লাদকে বলেছিলেন, আমার ভাতিজাকে হত্যা করতে হলে আমাকেও হত্যা করতে হবে। এভাবে তিনি একজন নিষ্পাপ ইমামের জীবন রক্ষা করেন নতজানু না হয়েই।
হযরত জয়নাব (সা.) যখন ইয়াজিদের দরবারে বক্তব্য রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেখানেও বীরত্ব ও স্বাধীনতা বজায় রেখে তিনি বলেছিলেন, ইয়াজিদকে তিনি ব্যক্তিত্বহীন ও তুচ্ছ ব্যক্তি বলে মনে করেন।
প্রতিটি ময়দান যেমন কারবালা ও প্রতিটি দিন হল আশুরা তেমনি মুমিনের হৃদয়েও সব সময়ই চলে আশুরার পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় তারা যেন ইয়াজিদি নফস বা কুপ্রবৃত্তির কাছে হুসাইনি বিবেক ও তার পবিত্রতাকে তৃষ্ণার্ত না করেন বা হত্যা না করেন।
ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম হুসাইন (আ.)'র মাজার জিয়ারত করতে আসেন বড় বড় নবী-রাসূলগণ মহান আল্লাহর অনুমতি নিয়ে। আর এ থেকেও হুসাইন (আ.)'র আত্মত্যাগের অনন্য মর্যাদা ফুটে উঠে। বলা হয় ইমাম হুসাইন (আ.) শাহাদত বরণ করলে ফেরেশতারা কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাতে থাকেন: হে আল্লাহ এ হুসাইন আপনার মেহমান, আপনার রাসূলের নাতি। তখন মহান আল্লাহ তাদেরকে ইমাম মাহদীর (আ.) একটি ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘আমি তাদের ওপর প্রতিশোধ নেব এর [হযরত ইমাম মাহদী (আ.)'র] মাধ্যমে’।
ইয়াজিদ, ইবনে জিয়াদ, শিমার, ওমর সাদ –তারা সবাই কঠোর শাস্তি পেয়েছিল মহান আল্লাহর ইচ্ছায় ও ইমাম হুসাইন (আ.)’র অভিশাপে। কিন্তু ইয়াজিদি নিপীড়ন আজো রয়ে গেছে। বর্তমান যুগের ইয়াজিদ, ইবনে জিয়াদ ও শিমাররা হল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং তাদের দোসরা বা সেবাদাসরা। এদের অনুচরদের হাতে প্রতিদিন নিহত হচ্ছে বহু নিরপরাধ বেসামরিক মানুষ ও নিরপরাধ সাধারণ মুসলমান। অনেক ক্ষেত্রে ধর্মের নামে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। আজ আমাদের চিনতে হবে সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রের ইয়াজিদ আর শিমারদেরকে।
আশুরার দিন ইমাম হুসাইন (আ.) যখন তাঁর পরিবারের তরুণ ও যুবকদের এবং বন্ধুদের লাশ দেখতে পেলেন তখন তিনি শহীদ হওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে উচ্চ কণ্ঠে বললেন: " কেউ কি আছে আল্লাহর রাসূলের (সা.) পরিবারকে রক্ষা করবে? তৌহিদবাদীদের কেউ কি আছে যে আল্লাহকে ভয় করবে আমাদের বিষয়ে? কোনো সাহায্যকারী কি আছে যে আল্লাহর জন্য আমাদের সাহায্য করতে আসবে? কেউ কি আছে যে আমাদের সাহায্যে দ্রুত আসবে আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কারের বিনিময়ে?"
ইমাম হুসাইন (আ.)'র এইসব আকুল আবেদন কি কেবল সেই সময়ের জন্যই ছিল? না। অনেকেই মনে করেন, ইমাম ভালভাবেই জানতেন যে ইয়াজিদি সেনাদের কেউই তাঁর কথায় সায় দেবে না। তা সত্ত্বেও তিনি ওই আহ্বান জানিয়ে গেলেন ভবিষ্যত প্রজন্মের মুসলমানদের কাছে যাতে তাঁরা হন হুসাইনি আদর্শের প্রচারক ও সংরক্ষক। যেই ইসলামকে রক্ষার জন্য তিনি জীবন দিয়ে গেলেন সেই মুহাম্মাদি ইসলামকে রক্ষার জন্য কাজ করা ও সাহায্য করাই হল হুসাইন (আ.)-কে সাহায্য করা।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে: ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁকে হত্যার জন্য দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ ইয়াজিদ সেনাদের উদ্দেশে বললেন: তোমরা কি আমার নানা রাসূল (সা.)'র এ হাদিসটি শোননি যে, আমি ও আমার ভাই জান্নাতের যুবকদের সর্দার?
পাষণ্ড শিমার ইমামকে (আ.) বলল, তুমি শিগগিরই জ্বলন্ত আগুন তথা জাহান্নামের দিকে যাবে। ইমাম হুসাইন (আ.) বললেন, আমার নানা আমাকে জানিয়েছিলেন একটি কুকুর তার গলা পূর্ণ করছে আহলুল বাইতের (আ.) রক্ত দিয়ে এবং আমি বুঝতে পারছি যে সেটি তুমিই ছাড়া অন্য কেউ নয়।
শিমার বলল, আমি শুধু জিহ্বা দিয়ে আল্লাহর ইবাদত করব, যদি আমি বুঝে থাকি যে তুমি কি বলছ।
ইমাম (আ.) ফিরে দেখলেন তাঁর শিশুপুত্র পিপাসায় কাঁদছে। তিনি তাঁকে কোলে নিলেন এবং বললেন: হে জনতা, যদি তোমরা আমার প্রতি দয়া না দেখাও, কমপক্ষে এ বাচ্চার প্রতি দয়া কর। এক ব্যক্তি এ সময় একটি তির ছুঁড়লো যা ইমামের ওই শিশুর গলা বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। ইমাম হুসাইন (আ.) কেঁদে বললেন: হে আল্লাহ! আপনি বিচারক হোন আমাদের মাঝে ও তাদের মাঝে, যারা আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সাহায্যের ওয়াদা দিয়ে এবং সাহায্যের পরিবর্তে তারা আমাদের হত্যা করেছে।
এ সময় আকাশ থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এল: তাঁকে ছেড়ে দাও হে হুসাইন! এক সেবিকা এই শিশুর শুশ্রূষা করার জন্য বেহেশতে অপেক্ষা করছে।
পরিবারের সবার ও সঙ্গীদের শাহাদতের পর ইমাম হুসাইন (আ.) একাকী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে ঘোড়ায় চড়েন। এ সময় তিনি কাব্যময় দীর্ঘ ভাষণও দিয়েছিলেন। সেইসব ভাষণে তিনি নিজের ও নিজ বংশের মর্যাদার কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলেন: যখন কুরাইশরা পূজা করত দুই মূর্তি লাত ও উজ্জার তখন আমার বাবা নামাজ পড়েছেন দুই কিবলার দিকে ফিরে। আমার বাবার হলেন সূর্য, মা হলেন চাঁদ, আর আমি এক নক্ষত্র, দুই চাঁদের সন্তান।... আমার নানা আল্লাহর রাসূল –সবার চেয়ে সম্মানিত।.. আমরা সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর বাতি। ..আমরা কাউসারের ওপর কর্তৃত্ব রাখি।..দুর্ভোগ তোমাদের ওপর হে আবু সুফিয়ানের পরিবারের অনুসারীরা, যদি তোমরা অধার্মিকও হয়ে থাক ও কিয়ামতকে ভয় না পাও, অন্ততঃ স্বাধীন চিন্তার অনুসারী হও।
ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর শেষোক্ত বাক্যের মাধ্যমে কি বোঝাতে চেয়েছেন জানতে চায় শিমার। উত্তরে ইমাম বলেন, আমরা পরস্পর যুদ্ধ করব, কিন্তু নারীরা তো কোনো দোষ করেনি। আমার পরিবারের তাঁবু লুট করা থেকে বিরত থাক, যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি।
আত্মীয়-স্বজন ও সঙ্গীদের শাহাদতের পর ইমাম হুসাইন (আ.) ইয়াজিদি সেনাদের ওপর বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপর এমন আক্রমণ চালান ঠিক যেভাবে নেকড়ে বাঘ ভেড়ার সারিতে ঢুকে পড়ে। তিনি তাদের পঙ্গপালের মত ছত্রভঙ্গ করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এক বর্ণনায় এসেছে ইমাম নিজ হাতে ১৮০০ ইয়াজিদ সেনাকে জাহান্নামে পাঠান ও আরো অনেক বেশি সংখ্যককে আহত করেছিলেন। কোনো কোনো বর্ণনামতে ইমাম হুসাইন (আ.) একাই ইয়াজিদ বাহিনীর ১৯৫০ জন যোদ্ধাকে হত্যা করেছিলেন। ইমামের সঙ্গী-সাথীরাও প্রবল বিক্রমে শত্রু নিধন করেছিলেন। তাঁদের অনেকেই শত শত ইয়াজিদ-সেনাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছিলেন।
শাহাদতের সময় পর্যন্ত ৫৭ বছর বয়স্ক ইমাম হুসাইন (আ.)'র শরীরে বিদ্ধ হয়েছিল বর্শা, তরবারি ও তিরের সর্বমোট ৩৬০ টি আঘাত। পাষণ্ড শিমার ও তার সহযোগীরা মাটিতে লুটিয়ে পড়া আহত ইমামের শির মুবারক এমন সময় ছিন্ন করেন যখন তিনি জীবিত ছিলেন। বর্ণনাকারীরা বলেছেন, ইমাম যখন শহীদ হন তখন তাঁর চেহারা এত উজ্জ্বল ছিল যে তেমন আলোকিত বা নুরানি ও প্রসন্ন চেহারা তারা আর কখনও দেখেনি। আসলে যতই শাহাদতের সময় ঘনিয়ে আসছিল মহান আল্লাহর সঙ্গে মিলনের আনন্দেই তাঁর চেহারা আরো প্রসন্ন ও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল।
ইমাম হুসাইন (আ.)-কে হত্যার পর ইয়াজিদ সেনারা শহীদদের লাশের মাথাগুলো ছিন্ন করে সেইসব পবিত্র মাথাকে বর্শায় বিদ্ধ করে এবং দেহগুলোকে ঘোড়ার পায়ের আঘাতে পিষ্ট করে। তারা ইমামের তাঁবুগুলো লুট করে এবং তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা.)'র স্ত্রী উম্মে সালামার কাছে সালামা এসে দেখেন যে তিনি কাঁদছেন। কান্নার কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে স্বপ্নে দেখলাম তাঁর মাথা ও দাড়ি ধুলায় মাখা। আমি প্রশ্ন করলাম, হে রাসূলুল্লাহ (সা.), আপনার কি হয়েছে যে আপনি ধুলায় মাখা? তিনি বললেন, এইমাত্র আমি আমার হুসাইনের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি।
বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, " নিশ্চয়ই প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ে হুসাইনের শাহাদতের ব্যাপারে এমন ভালবাসা আছে যে, তার উত্তাপ কখনও প্রশমিত হবে না।" যারা হুসাইনের জন্য কাঁদবে তাদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদও দিয়ে গেছেন বিশ্বনবী (সা.)।
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন, 'আমাদের ওপর যে জুলুম করা হয়েছে তার কারণে যে শোকার্ত, তার দীর্ঘশ্বাস হল তাসবিহ, আমাদের বিষয়ে তার দুশ্চিন্তা হল ইবাদত এবং আমাদের রহস্যগুলো গোপন রাখা আল্লাহর পথে জিহাদের পুরস্কার বহন করে।' এরপর তিনি বলেন, নিশ্চয়ই এ হাদিসটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত।
ইমাম হুসাইন (আ.)’র দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বাণী শুনিয়ে শেষ করব এই আলোচনা। তিনি বলেছেন, (সাধারণ) জনসাধারণ দুনিয়ার গোলাম। তারা ধর্মকে জিহ্বার মধ্যেই সীমিত রাখে। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা জানে যে এ ধরনের ধর্ম চর্চা তাদের জীবনে কোনো ক্ষতি বয়ে আনবে না ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ধর্মের চারপাশে ঘুরাফেরা করবে। কিন্তু যখন তারা কোনো পরীক্ষার মুখোমুখি হয় তখন খুব কম সংখ্যকই ধর্মের পথে অবিচল থাকে।”
এক ব্যক্তি ইমাম হুসাইন (আ.)’র কাছে আরজ করল, হে রাসূলের সন্তান, আমি গোনাহর মধ্যে জর্জরিত। আমার এ অবাধ্যতা থেকে পালানোর কোনো পথ নেই। আপনি আমাকে উপদেশ দিন। ইমাম (আ.) বললেন, “পাঁচটি কাজ করার পর বা ৫ টি বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার পর যত ইচ্ছা পাপ কর। প্রথমত: আল্লাহর রিজিক না খেয়ে যত ইচ্ছা পাপ কর। দ্বিতীয়ত: এমন স্থানে চলে যাও যেখানে আল্লাহর কর্তৃত্ব নেই এবং সেখানে যত ইচ্ছা পাপ কর। তৃতীয়ত: এমন জায়গায় যাও যেখানে আল্লাহ তোমাকে দেখবেন না, সেখানে যত পার গোনাহ কর। চতুর্থত: যখন মালেকুল মওত বা মৃত্যুর ফেরেশতা তোমার রুহ বা প্রাণ নিতে আসবে তখন তুমি নিজেকে রক্ষা করতে পারলে যত ইচ্ছা গোনা হ কর। পঞ্চমত: যখন আজাবের ফেরেশতা তোমাকে আগুনে নিক্ষেপ করবে তখন যদি তা থেকে বাঁচতে পার তাহলে এখন যত খুশি পাপ করে যাও।”
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন