ইমাম হুসাইন (আ.) ইসলামে শক্তির উতস

ইরাকের কারবালায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র প্রায় ১০০ জন সঙ্গী মৃত্যু ও রক্তের সাগরে ভেসে ইসলামকে দিয়ে গেছেন পরমাণু শক্তির চেয়েও লক্ষ কোটি গুণ বেশি শক্তিশালী বিপ্লবের তথা শাহাদতের সংস্কৃতির বাস্তব শিক্ষা। কারবালার এ বিপ্লব আধুনিক যুগে সংঘটিত ইরানে

ইমাম হুসাইন (আ.) ইসলামে শক্তির উতস
১৩৭৪ বছর আগে ৬১ হিজরির এই দিনে সংঘটিত হয়েছিল বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্তক ঘটনা বা ট্র্যাজেডি।

ইরাকের কারবালায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র প্রায় ১০০ জন সঙ্গী মৃত্যু ও রক্তের সাগরে ভেসে ইসলামকে দিয়ে গেছেন পরমাণু শক্তির চেয়েও লক্ষ কোটি গুণ বেশি শক্তিশালী বিপ্লবের তথা শাহাদতের সংস্কৃতির বাস্তব শিক্ষা। কারবালার এ বিপ্লব আধুনিক যুগে সংঘটিত ইরানের ইসলামী বিপ্লবসহ যুগে যুগে সব মহতী বিপ্লবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

জালিম ও দুরাচারী পাপিষ্ঠ ইয়াজিদকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবারের সব পুরুষ সদস্যসহ (কেবল ইমাম যেইনুল আবিদিন আ. ছাড়া) ইমামের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং নবী-পরিবারের প্রেমিক একদল মুমিন মুসলমানকে নৃশংসভাবে শহীদ করা হয়েছিল কারবালায়।

ইয়াজিদের আনুগত্য করতে ইমামের অস্বীকৃতির খবর জানার পর কুফার প্রায় এক লাখ নাগরিক চিঠি ও প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল ইমাম (আ.)-কে যাতে তারা প্রকৃত ইসলামী শাসনের স্বাদ পেতে পারে এবং মুক্ত হয় ইয়াজিদের কলঙ্কিত শাসনের নাগপাশ থেকে। তাই ইমাম (আ.)ও মক্কা থেকে রওনা হয়েছিলেন কুফার উদ্দেশ্যে যাতে তাদের সহযোগিতায় ইয়াজিদের রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। কিন্তু ইয়াজিদের গভর্নর ও প্রশাসনের নানা ধরনের ভয়-ভীতি এবং প্রলোভনের মুখে কুফায় ইমামপন্থী জনগণ ইমামের প্রতিনিধিকেই সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয় এবং ইমামের প্রতিনিধি মুসলিম ইবনে আকিল (রা.) নির্মমভাবে শহীদ হন।

এ অবস্থায় ইমাম কুফার জনগণের সহায়তার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেলেও প্রতিশ্রুতি পালনের জন্য কুফার দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখেন যাতে কেউ তাকে ভীতু, কাপুরুষ ও আপোসকামী বলে অভিযোগ করতে না পারেন। যদিও তিনি জানতেন কুফায় তাঁকে ও তাঁর পরিবার এবং সঙ্গীদেরকে শহীদ করা হতে পারে, তবুও তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মৃতপ্রায় ইসলামকে জীবিত করার স্বার্থে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার তথা শাহাদতের জন্যও প্রস্তুত ছিলেন।

ইমাম দূরদর্শিতার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন যে নবী-পরিবারের রক্তদান বৃথা যাবে না এবং একদিন জনগণ জেগে উঠবে। 

কুফায় পৌঁছার আগেই কারবালায় ইমামকে তাঁর পরিবার-পরিজন ও সঙ্গীসহ ঘেরাও করে ইয়াজিদ-বাহিনী। হয় ইয়াজিদের আনুগত্য নতুবা মৃত্যু –এ দুয়ের যে কোনো একটি পথ বেছে নিতে বলা হয়েছিল তাঁদেরকে। কিন্তু তাঁরা বীরোচিতভাবে লড়াই করে শহীদ হওয়ার পথই বেছে নিয়েছিলেন। ইমাম যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তবে শাহাদত-ভিত্তিক বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। আর এ জন্যই তিনি তাঁর পরিবারের শিশু ও নারীদেরও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।

দশই মহররম যুদ্ধ যখন অনিবার্য তখনও ইমাম (আ.) ইয়াজিদ বাহিনীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তারা এক অন্যায় যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছে নবী-পরিবারের নিষ্পাপ সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু অর্থ লোভী ও হারাম খাদ্য খেতে অভ্যস্ত ইয়াজিদ বাহিনীর নেতা-কর্মীদের মনে কোনো উপদেশই প্রভাব ফেলছিল না। অবশ্য হোর ইবনে ইয়াজিদ (রা.) নামক ইয়াজিদ বাহিনীর একজন কর্মকর্তা তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন এবং তিনি তার কয়েকজন আত্মীয় ও সঙ্গীসহ ইমামের শিবিরে যোগ দেন ও শেষ পর্যন্ত বীরের মত লড়াই করে শহীদ হয়েছিলেন। বলা হয় প্রায় ত্রিশ জন ইয়াজিদি সেনা ইমাম (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের ভাষণে প্রভাবিত হয়ে যুদ্ধ শুরুর আগেই ইমামের শিবিরে যোগ দেন। 

ইমামের দিকে সর্ব প্রথম তীর নিক্ষেপ করেছিল ইয়াজিদ বাহিনীর সেনাপতি ওমর ইবনে সাদ। ইমামের জন্য জান-কুরবান করতে প্রস্তুত পুরুষ সঙ্গীদের প্রায় সবাই ত্রিশ হাজার মুনাফিক সেনার বিরুদ্ধে মহাবীরের মত লড়াই করেন এবং বহু মুনাফিক সেনাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে একে-একে শহীদ হন। ইমামের প্রায় ১৮ বছর বয়সী সুদর্শন যুবক পুত্র হযরত আলী আকবর (আ.) বহু মুনাফিককে জাহান্নামে পাঠিয়ে শহীদ হন। তিনি ছিলেন দেখতে এবং আচার-আচরণে অবিকল রাসূল-সা. সদৃশ। এমনকি তাঁর কণ্ঠও ছিল রাসূল সা.-এর কণ্ঠের অনুরূপ। কারবালা ময়দানে তাঁর আজান শুনে অনেক বয়স্ক শত্রুও চমকে উঠেছিল। একইভাবে শহীদ হন ইমাম হাসান (আ.)’র পুত্র হযরত কাসিম (আ.)। সম্মুখ যুদ্ধে তাঁদের সঙ্গে কেউই পারছিলেন না। শত্রুরা যখন দেখত যে ইমাম শিবিরের প্রত্যেক পিপাসার্ত বীর সেনা তাদের বহু সেনাকে হত্যা করতে সক্ষম হচ্ছেন তখন তারা ওই বীর সেনাকে ঘেরাও করে ফেলত এবং দূর থেকে বহু তীর বা বর্শা নিক্ষেপ করে কাবু করে ফেলত। 

ফোরাতের পানি ইমাম শিবিরের জন্য কয়েকদিন ধরে নিষিদ্ধ থাকায় নবী-পরিবারের সদস্যরাসহ ইমাম শিবিরের সবাই ছিলেন পিপাসায় কাতর। প্রচণ্ড গরমে শিশুদের অবস্থা হয়ে পড়ে শোচনীয়।

এ অবস্থায় ইমাম তাঁর দুধের শিশু আলী আসগর (রা.)’র জন্য শত্রুদের কাছে পানি চাইলে ওই নিষ্পাপ শিশুর গলায় তীর নিক্ষেপ করে তাঁকে শহীদ করে। শিশুদের জন্য পানি আনতে গিয়ে বীরের মত লড়াই করে ও দুই হাত হারিয়ে নির্মমভাবে শহীদ হন ইমামের সত ভাই হযরত আবুল ফজল আব্বাস (আ.)। তিনি ছিলেন ইমাম বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি এবং বহু শত্রুকে জাহান্নামে পাঠিয়েছিলেন। নবী পরিবারের কয়েকজন শিশুও বীরের মত লড়াই করে শহীদ হয়েছিলেন। নবী (সা.)’র পরিবারের সদস্যরা বাহ্যিক ও আত্মিক সৌন্দর্যে ছিলেন অনন্য। অর্থাত তারা দেখতে যেমন অপরূপ সুন্দর ছিলেন তেমনি আচার-আচরণেও ছিলেন শ্রেষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী।

সন্তান, ভাই, ভাতিজা ও সঙ্গীরা সবাই শহীদ হওয়ার পর যুদ্ধে নামেন আল্লাহর সিংহ হযরত আলী (আ.)’র পুত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)। (তাঁর আগে তিনি যদিও জানতেন যে তাঁর ডাকে সাড়া দেয়ার মত কেউ নেই। তবুও তিনি বলেন, কেউ কি আছ আমাকে সাহায্য করার? অথবা, আমার সাহায্যের ডাকে কেউ কি সাড়া দেবে?-এ কথা তিনি চার বার বলেছিলেন। অনেকেই মনে করেন আসলে কিয়ামত পর্যন্ত তিনি তাঁর আদর্শের পথে সহায়তা করতেই মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন ওই আহ্বানের মাধ্যমে।) তিনি একাই প্রায় দুই হাজার মুনাফিক সেনাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর আঘাতে আহত হয়েছিল আরও বেশি সংখ্যক মুনাফিক। কিন্তু এক সময় তিনিও চরম পিপাসায় ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েন। এ সময় তাঁকে ঘিরে ফেলে মুনাফিক সেনারা। পাথর ও অনেক বিষাক্ত তীর মারে তারা বেহেশতী যুবকদের অন্যতম সর্দারের গায়ে। একটি তীর ছিল তিন শাখা-বিশিষ্ট। এরপর এক নরাধম মারে একটি বর্শা। ফলে অশ্বারোহী ইমাম (আ.) ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান। এরপর আরেক নরাধম শিমার অথবা সিনান জীবন্ত অবস্থায় ইমামের মস্তক মুবারক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। (এই নরাধমদের উপর অনন্তকাল ধরে আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক। ) ইমামের গায়ে বর্শা, তীর ও তরবারির অন্তত তিনশ ষাটটি আঘাত ছিল। কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী আঘাতের সংখ্যা এক হাজার তিনশ। সেদিন ছিল শুক্রবার এবং ইমামের বয়স ছিল ৫৭ বছর।

ইমামের মাথা মুবারক বর্শার আগায় বিদ্ধ করেছিল নরাধমরা। শুধু তাই নয় ইমামের লাশসহ শহীদদের লাশগুলোর ওপর ঘোড়া দাবিয়ে পবিত্র লাশগুলোকে দলিত-মথিত করেছিল নরপশুরা। বলা হয় শাহাদতের সময় যতই ঘনিয়ে আসছিল আল্লাহর দিদার ও শাহাদত-প্রেমিক ইমামের চেহারা ততই উজ্জ্বল বা নূরানি হচ্ছিল স্বর্গীয় আনন্দে। যোহর ও আসরের নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁকে শহীদ করা হয়। এর আগে তিনি সঙ্গীদের নিয়ে সালাতুল খওফ তথা যুদ্ধ বা ভয়ের সময়কার (সংক্ষিপ্ত পদ্ধতির) জামায়াতে নামাজ পড়েছিলেন।

ইয়াজিদ সেনারা ইমাম শিবিরের তাবুগুলোতে আগুন দিয়েছিল এবং নারীদের অলঙ্কার ছিনিয়ে নেয়াসহ লুট-পাট চালায়। তারা ইমামের জিনিসপত্র ও উটগুলো লুট করে। এমনকি নবী-পরিবারের মহিলাদের বোরকাগুলোও লুট করেছিল নরাধমরা। তাঁদেরকে খালি পায়ে হাঁটিয়ে বন্দীদের মত সারি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় কুফা ও দামেস্কের দিকে।

একটি বর্ণনায় এসেছে ইমামকে নির্মমভাবে শহীদ করার পর কুফার এক ইয়াজিদি সেনা উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠে। তাকে তিরস্কার করা হলে সে বলে, আমি কাঁদছি এ জন্য যে রাসূল (সা.)-কে দেখলাম তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি একবার পৃথিবীর দিকে দেখছেন একবার তোমাদের যুদ্ধের দিকে। আমি ভয় পাচ্ছি তিনি পৃথিবীর ওপর অভিশাপ দেবেন এবং তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে।

ইয়াজিদি সেনারা বলল, লোকটি পাগল। কিন্তু তাদের মধ্যে অনুতপ্ত কেউ কেউ বলল: আল্লাহর শপথ, আমরা বেহেশতের যুবকদের সর্দারকে হত্যা করেছি সুমাইয়্যার সন্তানের জন্য। এরপর তারা বিদ্রোহ করে ইবনে জিয়াদের প্রতি।

ইমামের শাহাদতের পর বিশ্বনবী (সা.)’র স্ত্রী উম্মে সালামাহ (আ.)-কে কাঁদতে দেখে তাঁকে প্রশ্ন করা হয় এর কারণ সম্পর্কে। তিনি বলেন, স্বপ্নে দেখলাম আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে, তাঁর মাথা ও দাড়ি ধুলায় মাখা। এ ব্যাপারে রাসূলকে (সা.) প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, এইমাত্র আমি আমার হুসাইনের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি।

আশুরার দিন সূর্য কালো হয়ে গিয়েছিল। লাল আকাশে তারা দেখা যাচ্ছিল দিনের বেলায়। অনেকেই ভয় পাচ্ছিল যে হয়তো কিয়ামত শুরু হয়েছে। যে কোনো পাথর তুললে তার নিচে তাজা রক্ত দেখা যেত।

ইসলামী বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা.) নিজে অলৌকিকভাবে ইমাম হুসাইন (আ.)’র পবিত্র খুন সংগ্রহ করেছেন এবং আল্লাহর দরবারে বিচার দিয়েছেন। আশুরার দিন কেঁদেছিল ফেরেশতাকুলও। মহান আল্লাহ এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়া হবে বলে ফেরেশতাদের সান্ত্বনা দিয়েছেন।

কারবালায় নবী-পরিবারের বিরুদ্ধে নৃশংস হত্যাযজ্ঞে ও বর্বরতায় শরিক সবাই কঠিন শাস্তি দুনিয়াতেই পেয়েছিল। মহামতি মুখতার সাকাফি (র.) অধিকাংশ ঘাতককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। অন্যদিকে ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর মহান সঙ্গীদের জন্য যুগ যুগ ধরে কাঁদছেন নবী-পরিবার-প্রেমিক মুসলমানরা এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। এই শোক ইসলামের অন্যতম প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছে। মুসলমানদের হৃদয়-রাজ্যের চির-অধিপতি হয়ে আছেন কারবালার বীর শহীদরা। 
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

১৩৭৪ বছর আগে ৬১ হিজরির এই দিনে সংঘটিত হয়েছিল বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্তক ঘটনা বা ট্র্যাজেডি।

ইরাকের কারবালায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র প্রায় ১০০ জন সঙ্গী মৃত্যু ও রক্তের সাগরে ভেসে ইসলামকে দিয়ে গেছেন পরমাণু শক্তির চেয়েও লক্ষ কোটি গুণ বেশি শক্তিশালী বিপ্লবের তথা শাহাদতের সংস্কৃতির বাস্তব শিক্ষা। কারবালার এ বিপ্লব আধুনিক যুগে সংঘটিত ইরানের ইসলামী বিপ্লবসহ যুগে যুগে সব মহতী বিপ্লবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

জালিম ও দুরাচারী পাপিষ্ঠ ইয়াজিদকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবারের সব পুরুষ সদস্যসহ (কেবল ইমাম যেইনুল আবিদিন আ. ছাড়া) ইমামের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং নবী-পরিবারের প্রেমিক একদল মুমিন মুসলমানকে নৃশংসভাবে শহীদ করা হয়েছিল কারবালায়।

ইয়াজিদের আনুগত্য করতে ইমামের অস্বীকৃতির খবর জানার পর কুফার প্রায় এক লাখ নাগরিক চিঠি ও প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল ইমাম (আ.)-কে যাতে তারা প্রকৃত ইসলামী শাসনের স্বাদ পেতে পারে এবং মুক্ত হয় ইয়াজিদের কলঙ্কিত শাসনের নাগপাশ থেকে। তাই ইমাম (আ.)ও মক্কা থেকে রওনা হয়েছিলেন কুফার উদ্দেশ্যে যাতে তাদের সহযোগিতায় ইয়াজিদের রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। কিন্তু ইয়াজিদের গভর্নর ও প্রশাসনের নানা ধরনের ভয়-ভীতি এবং প্রলোভনের মুখে কুফায় ইমামপন্থী জনগণ ইমামের প্রতিনিধিকেই সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয় এবং ইমামের প্রতিনিধি মুসলিম ইবনে আকিল (রা.) নির্মমভাবে শহীদ হন।

এ অবস্থায় ইমাম কুফার জনগণের সহায়তার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেলেও প্রতিশ্রুতি পালনের জন্য কুফার দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখেন যাতে কেউ তাকে ভীতু, কাপুরুষ ও আপোসকামী বলে অভিযোগ করতে না পারেন। যদিও তিনি জানতেন কুফায় তাঁকে ও তাঁর পরিবার এবং সঙ্গীদেরকে শহীদ করা হতে পারে, তবুও তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মৃতপ্রায় ইসলামকে জীবিত করার স্বার্থে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার তথা শাহাদতের জন্যও প্রস্তুত ছিলেন।

ইমাম দূরদর্শিতার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন যে নবী-পরিবারের রক্তদান বৃথা যাবে না এবং একদিন জনগণ জেগে উঠবে।

কুফায় পৌঁছার আগেই কারবালায় ইমামকে তাঁর পরিবার-পরিজন ও সঙ্গীসহ ঘেরাও করে ইয়াজিদ-বাহিনী। হয় ইয়াজিদের আনুগত্য নতুবা মৃত্যু –এ দুয়ের যে কোনো একটি পথ বেছে নিতে বলা হয়েছিল তাঁদেরকে। কিন্তু তাঁরা বীরোচিতভাবে লড়াই করে শহীদ হওয়ার পথই বেছে নিয়েছিলেন। ইমাম যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তবে শাহাদত-ভিত্তিক বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। আর এ জন্যই তিনি তাঁর পরিবারের শিশু ও নারীদেরও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।

দশই মহররম যুদ্ধ যখন অনিবার্য তখনও ইমাম (আ.) ইয়াজিদ বাহিনীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তারা এক অন্যায় যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছে নবী-পরিবারের নিষ্পাপ সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু অর্থ লোভী ও হারাম খাদ্য খেতে অভ্যস্ত ইয়াজিদ বাহিনীর নেতা-কর্মীদের মনে কোনো উপদেশই প্রভাব ফেলছিল না। অবশ্য হোর ইবনে ইয়াজিদ (রা.) নামক ইয়াজিদ বাহিনীর একজন কর্মকর্তা তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন এবং তিনি তার কয়েকজন আত্মীয় ও সঙ্গীসহ ইমামের শিবিরে যোগ দেন ও শেষ পর্যন্ত বীরের মত লড়াই করে শহীদ হয়েছিলেন। বলা হয় প্রায় ত্রিশ জন ইয়াজিদি সেনা ইমাম (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের ভাষণে প্রভাবিত হয়ে যুদ্ধ শুরুর আগেই ইমামের শিবিরে যোগ দেন।

ইমামের দিকে সর্ব প্রথম তীর নিক্ষেপ করেছিল ইয়াজিদ বাহিনীর সেনাপতি ওমর ইবনে সাদ। ইমামের জন্য জান-কুরবান করতে প্রস্তুত পুরুষ সঙ্গীদের প্রায় সবাই ত্রিশ হাজার মুনাফিক সেনার বিরুদ্ধে মহাবীরের মত লড়াই করেন এবং বহু মুনাফিক সেনাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে একে-একে শহীদ হন। ইমামের প্রায় ১৮ বছর বয়সী সুদর্শন যুবক পুত্র হযরত আলী আকবর (আ.) বহু মুনাফিককে জাহান্নামে পাঠিয়ে শহীদ হন। তিনি ছিলেন দেখতে এবং আচার-আচরণে অবিকল রাসূল-সা. সদৃশ। এমনকি তাঁর কণ্ঠও ছিল রাসূল সা.-এর কণ্ঠের অনুরূপ। কারবালা ময়দানে তাঁর আজান শুনে অনেক বয়স্ক শত্রুও চমকে উঠেছিল। একইভাবে শহীদ হন ইমাম হাসান (আ.)’র পুত্র হযরত কাসিম (আ.)। সম্মুখ যুদ্ধে তাঁদের সঙ্গে কেউই পারছিলেন না। শত্রুরা যখন দেখত যে ইমাম শিবিরের প্রত্যেক পিপাসার্ত বীর সেনা তাদের বহু সেনাকে হত্যা করতে সক্ষম হচ্ছেন তখন তারা ওই বীর সেনাকে ঘেরাও করে ফেলত এবং দূর থেকে বহু তীর বা বর্শা নিক্ষেপ করে কাবু করে ফেলত।

ফোরাতের পানি ইমাম শিবিরের জন্য কয়েকদিন ধরে নিষিদ্ধ থাকায় নবী-পরিবারের সদস্যরাসহ ইমাম শিবিরের সবাই ছিলেন পিপাসায় কাতর। প্রচণ্ড গরমে শিশুদের অবস্থা হয়ে পড়ে শোচনীয়।

এ অবস্থায় ইমাম তাঁর দুধের শিশু আলী আসগর (রা.)’র জন্য শত্রুদের কাছে পানি চাইলে ওই নিষ্পাপ শিশুর গলায় তীর নিক্ষেপ করে তাঁকে শহীদ করে। শিশুদের জন্য পানি আনতে গিয়ে বীরের মত লড়াই করে ও দুই হাত হারিয়ে নির্মমভাবে শহীদ হন ইমামের সত ভাই হযরত আবুল ফজল আব্বাস (আ.)। তিনি ছিলেন ইমাম বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি এবং বহু শত্রুকে জাহান্নামে পাঠিয়েছিলেন। নবী পরিবারের কয়েকজন শিশুও বীরের মত লড়াই করে শহীদ হয়েছিলেন। নবী (সা.)’র পরিবারের সদস্যরা বাহ্যিক ও আত্মিক সৌন্দর্যে ছিলেন অনন্য। অর্থাত তারা দেখতে যেমন অপরূপ সুন্দর ছিলেন তেমনি আচার-আচরণেও ছিলেন শ্রেষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী।

সন্তান, ভাই, ভাতিজা ও সঙ্গীরা সবাই শহীদ হওয়ার পর যুদ্ধে নামেন আল্লাহর সিংহ হযরত আলী (আ.)’র পুত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)। (তাঁর আগে তিনি যদিও জানতেন যে তাঁর ডাকে সাড়া দেয়ার মত কেউ নেই। তবুও তিনি বলেন, কেউ কি আছ আমাকে সাহায্য করার? অথবা, আমার সাহায্যের ডাকে কেউ কি সাড়া দেবে?-এ কথা তিনি চার বার বলেছিলেন। অনেকেই মনে করেন আসলে কিয়ামত পর্যন্ত তিনি তাঁর আদর্শের পথে সহায়তা করতেই মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন ওই আহ্বানের মাধ্যমে।) তিনি একাই প্রায় দুই হাজার মুনাফিক সেনাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর আঘাতে আহত হয়েছিল আরও বেশি সংখ্যক মুনাফিক। কিন্তু এক সময় তিনিও চরম পিপাসায় ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েন। এ সময় তাঁকে ঘিরে ফেলে মুনাফিক সেনারা। পাথর ও অনেক বিষাক্ত তীর মারে তারা বেহেশতী যুবকদের অন্যতম সর্দারের গায়ে। একটি তীর ছিল তিন শাখা-বিশিষ্ট। এরপর এক নরাধম মারে একটি বর্শা। ফলে অশ্বারোহী ইমাম (আ.) ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান। এরপর আরেক নরাধম শিমার অথবা সিনান জীবন্ত অবস্থায় ইমামের মস্তক মুবারক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। (এই নরাধমদের উপর অনন্তকাল ধরে আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক। ) ইমামের গায়ে বর্শা, তীর ও তরবারির অন্তত তিনশ ষাটটি আঘাত ছিল। কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী আঘাতের সংখ্যা এক হাজার তিনশ। সেদিন ছিল শুক্রবার এবং ইমামের বয়স ছিল ৫৭ বছর।

ইমামের মাথা মুবারক বর্শার আগায় বিদ্ধ করেছিল নরাধমরা। শুধু তাই নয় ইমামের লাশসহ শহীদদের লাশগুলোর ওপর ঘোড়া দাবিয়ে পবিত্র লাশগুলোকে দলিত-মথিত করেছিল নরপশুরা। বলা হয় শাহাদতের সময় যতই ঘনিয়ে আসছিল আল্লাহর দিদার ও শাহাদত-প্রেমিক ইমামের চেহারা ততই উজ্জ্বল বা নূরানি হচ্ছিল স্বর্গীয় আনন্দে। যোহর ও আসরের নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁকে শহীদ করা হয়। এর আগে তিনি সঙ্গীদের নিয়ে সালাতুল খওফ তথা যুদ্ধ বা ভয়ের সময়কার (সংক্ষিপ্ত পদ্ধতির) জামায়াতে নামাজ পড়েছিলেন।

ইয়াজিদ সেনারা ইমাম শিবিরের তাবুগুলোতে আগুন দিয়েছিল এবং নারীদের অলঙ্কার ছিনিয়ে নেয়াসহ লুট-পাট চালায়। তারা ইমামের জিনিসপত্র ও উটগুলো লুট করে। এমনকি নবী-পরিবারের মহিলাদের বোরকাগুলোও লুট করেছিল নরাধমরা। তাঁদেরকে খালি পায়ে হাঁটিয়ে বন্দীদের মত সারি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় কুফা ও দামেস্কের দিকে।

একটি বর্ণনায় এসেছে ইমামকে নির্মমভাবে শহীদ করার পর কুফার এক ইয়াজিদি সেনা উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠে। তাকে তিরস্কার করা হলে সে বলে, আমি কাঁদছি এ জন্য যে রাসূল (সা.)-কে দেখলাম তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি একবার পৃথিবীর দিকে দেখছেন একবার তোমাদের যুদ্ধের দিকে। আমি ভয় পাচ্ছি তিনি পৃথিবীর ওপর অভিশাপ দেবেন এবং তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে।

ইয়াজিদি সেনারা বলল, লোকটি পাগল। কিন্তু তাদের মধ্যে অনুতপ্ত কেউ কেউ বলল: আল্লাহর শপথ, আমরা বেহেশতের যুবকদের সর্দারকে হত্যা করেছি সুমাইয়্যার সন্তানের জন্য। এরপর তারা বিদ্রোহ করে ইবনে জিয়াদের প্রতি।

ইমামের শাহাদতের পর বিশ্বনবী (সা.)’র স্ত্রী উম্মে সালামাহ (আ.)-কে কাঁদতে দেখে তাঁকে প্রশ্ন করা হয় এর কারণ সম্পর্কে। তিনি বলেন, স্বপ্নে দেখলাম আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে, তাঁর মাথা ও দাড়ি ধুলায় মাখা। এ ব্যাপারে রাসূলকে (সা.) প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, এইমাত্র আমি আমার হুসাইনের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি।

আশুরার দিন সূর্য কালো হয়ে গিয়েছিল। লাল আকাশে তারা দেখা যাচ্ছিল দিনের বেলায়। অনেকেই ভয় পাচ্ছিল যে হয়তো কিয়ামত শুরু হয়েছে। যে কোনো পাথর তুললে তার নিচে তাজা রক্ত দেখা যেত।

ইসলামী বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা.) নিজে অলৌকিকভাবে ইমাম হুসাইন (আ.)’র পবিত্র খুন সংগ্রহ করেছেন এবং আল্লাহর দরবারে বিচার দিয়েছেন। আশুরার দিন কেঁদেছিল ফেরেশতাকুলও। মহান আল্লাহ এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়া হবে বলে ফেরেশতাদের সান্ত্বনা দিয়েছেন।

কারবালায় নবী-পরিবারের বিরুদ্ধে নৃশংস হত্যাযজ্ঞে ও বর্বরতায় শরিক সবাই কঠিন শাস্তি দুনিয়াতেই পেয়েছিল। মহামতি মুখতার সাকাফি (র.) অধিকাংশ ঘাতককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। অন্যদিকে ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর মহান সঙ্গীদের জন্য যুগ যুগ ধরে কাঁদছেন নবী-পরিবার-প্রেমিক মুসলমানরা এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। এই শোক ইসলামের অন্যতম প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছে। মুসলমানদের হৃদয়-রাজ্যের চির-অধিপতি হয়ে আছেন কারবালার বীর শহীদরা।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন