সূরা মারিয়াম; আয়াত ৭১-৭৪

সূরা মারিয়াম; আয়াত ৭১-৭৪


সূরায়ে মারিয়ামের ৭১ ও ৭২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَإِنْ مِنْكُمْ إِلَّا وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْمًا مَقْضِيًّا (71) ثُمَّ نُنَجِّي الَّذِينَ اتَّقَوْا وَنَذَرُ الظَّالِمِينَ فِيهَا جِثِيًّا (72)
“তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। এটা তোমাদের রবের আবশ্যিক একটি হুকুম।” (১৯:৭১)
“তারপর যারা (দুনিয়ায়) মুত্তাকী ছিল তাদেরকে আমি নাজাত দেব এবং নতজানু জালেমদেরকে তার মধ্যে ছেড়ে দেব।” (১৯:৭২)

আগের আসরে কিয়ামত এবং কিয়ামত দিবসে শাস্তি ও পুরস্কারের বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই আয়াতগুলোতে বেহেশতবাসীদের চলার পথে দোযখ অতিক্রম করার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ সকল মানুষ-চাই পূন্যবানই হোক কিংবা পাপী সবাইকেই প্রথমে দোযখে যেতে হবে। কিন্তু রাসূলে খোদা (সা.) এর বর্ণনা অনুযায়ী পূণ্যবানদের ওপর আগুন কার্যকর হবে না, আগুন ঠাণ্ডা এবং পোড়ানোর বৈশিষ্ট্যহীন হয়ে যাবে, যেমনটি ঘটেছিল ইব্রাহিম (আ.) এর ব্যাপারে। এর কারণ হল নীতিগতভাবে ঈমানদার এবং পবিত্র লোকদের সাথে আগুনের সমন্বয় বা শ্রেণীগত সামঞ্জস্যই নেই। এ কারণেই তারা খুব দ্রুত দোযখ অতিক্রম করে যাবে এবং ঐশী নিরাপত্তাপূর্ণ বেহেশতে প্রবেশ করবে। কিন্তু পাপী মানুষেরা যারা আগেই আগুনকে পাঠিয়ে দিয়েছে-যে আগুন তারা নিজেরাই জ্বালিয়েছে-সেই আগুনে আটকা পড়ে যাবে এবং উদ্ধারের কোনো পথ খুঁজে পাবে না।

বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে পুলসিরাত দোযখের ওপর দিয়ে গেছে। সবাইকেই এই পুলসিরাত অতিক্রম করে যেতে হবে। বেহেশতবাসী যাঁরা তাঁরা খুব দ্রুত এই পুলসিরাত পার হয়ে যাবে, তাঁরা আগুনে আটকা পড়বেন না। কিন্তু দোযখবাসীরা ঐ পুলসিরাত কোনোভাবেই অতিক্রম করতে পারবে না, তারা আগুনে পড়ে যাবে।

এ দুই আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
১. কিয়ামত হচ্ছে ভাগ্য নির্ধারনী আদালত। এই আদালতের কার্যক্রম শেষে দোযখ সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হবে। এই দোযখই স্পষ্ট করে দেবে কারা বেহেশতে যাবেন আর কারা যাবে অগ্নিকুণ্ডে।
২. দোযখ থেকে মুক্তির পথ হচ্ছে তাকওয়া এবং খোদাভীতি। তাকওয়াশূণ্য সকল কিছুই এক ধরনের জুলুম বা অন্যায়। এই জুলুম কখনো নিজের প্রতি, কখনো সমাজের প্রতি কিংবা কখনো ঐশী আদর্শের প্রতি।

সূরা মারিয়ামের ৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آَيَاتُنَا بَيِّنَاتٍ قَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِلَّذِينَ آَمَنُوا أَيُّ الْفَرِيقَيْنِ خَيْرٌ مَقَامًا وَأَحْسَنُ نَدِيًّا (73)
“যখনই আমার সুস্পষ্ট আয়াত এদেরকে শোনানো হয় তখনই অস্বীকারকারীরা ঈমানদারদেরকে বলেঃ ‘বল,আমাদের দু’দলের মধ্যে কারা ভালো অবস্থায় আছে এবং কাদের মজলিসগুলো বেশী জাঁকালো?” (১৯:৭৩)

এ আয়াতে মক্কার শ্রেষ্ঠত্বকামী এবং আভিজাত্যকামী চিন্তাধারা ও মানসিকতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যখন তারা দেখল খাব্বাব, বেলাল এবং আম্মারের মতো শোষিত বঞ্চিতরা রাসূলে খোদার ওপর ঈমান এনেছে, তখন তারা তাদেরকে উপহাস বিদ্রুপ করে বলতোঃ একটি সমাজের মুরব্বি বা অভিজাত শ্রেণীকে সমাজের গোলাম বা দাস শ্রেণীর সাথে কীভাবে একই কাতারে মূল্যায়ন করা যেতে পারে! এরা মানে সমাজের অভিজাত শ্রেণী ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করছে আর ওরা বা বঞ্চিত শ্রেণী দারিদ্রের কষাঘাতে লাঞ্ছিত হচ্ছে।

জাহেলিয়াতের যুগে মূল্যায়নের মানদণ্ড ছিল শক্তি, ক্ষমতা ও সম্পদ। তাই সম্পদশালীরা নিজেদেরকে সমাজের অভিজাত বলে শ্রেণী বলে ভাবতো। গরিবদেরকে তারা খুবই নিচু শ্রেণীর বলে ভাবতো এবং সমাজে তাদের কোনো অধিকার বা অবস্থানকে স্বীকার করত না। অথচ সত্য মিথ্যার মানদণ্ড হচ্ছে সঠিক আকিদা বিশ্বাস এবং যথাযথ যুক্তি, শক্তি কিংবা সম্পদ নয়।

এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
১. সত্য মিথ্যার মানদণ্ড হল বুদ্ধি ও যুক্তি, শক্তি কিংবা সম্পদ নয়। কাফেররা যদিও তুলনামূলকভাবে উন্নত জীবনযাপন করে এর মানে এই নয় যে তারা সঠিক পথে রয়েছে কিংবা আল্লাহর কৃপাদৃষ্টি তাদের ওপর রয়েছে।
২. গর্ব অহংকার এবং শ্রেষ্ঠত্বকামিতা কুফরি এবং আল্লাহকে অস্বীকার করার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে।

সূরা মারিয়ামের ৭৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَكَمْ أَهْلَكْنَا قَبْلَهُمْ مِنْ قَرْنٍ هُمْ أَحْسَنُ أَثَاثًا وَرِئْيًا (74)
“অথচ এদের আগে আমি এমন কত জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছি যারা এদের চাইতে বেশী সম্পদশালী এবং বাহ্যিক শান শওকতের দিক দিয়েও ছিল এদের চেয়ে বেশী অগ্রসর।” (১৯:৭৪)

এ আয়াতে গর্ব অহংকারকারীদেরকে উদ্দেশ্য করে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছেঃ তোমরা কি ইতিহাস ভুলে গেছো! তোমরা মুমিনদেরকে এতোই নিকৃষ্ট এবং তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দ্যাখো? তাদেরকে দুর্বল এবং গুরুত্বহীন মনে কর? যদি শক্তি সম্পদ আল্লাহর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতো কিংবা সম্পদশালীদের অবস্থান আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় হতো, তাহলে কেন সম্পদের গর্বে অহংকারীরা মারা গেল? আল্লাহ কেন তাদেরকে এরকম দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি দিলেন?

মূলত কল্যাণমূলক সুযোগ সুবিধা সৌভাগ্য কিংবা মর্যাদার প্রতীক নয় কিংবা এগুলো আল্লাহর ক্রোধকে বাধাগ্রস্তও করে না। উল্টো বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো মানুষকে অহংকারী করে তোলে, ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। যার পরিণতি ধ্বংস বয়ে আনে।

এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলো :
১. ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তাগুতি শক্তির পতন এবং জুলুমবাজদের ধ্বংসের ইতিহাস সত্য ও মিথ্যাকে চেনার সবোর্ত্তম উৎস ও শিক্ষণীয় নিদর্শন।
২. সম্পদশালীরা যেসবের মোহে মুগ্ধ সেগুলো পার্থিব জগতের বৈদ্যুতিক ঔজ্জ্বল্যের মতোই ক্ষণস্থায়ী চমক। এগুলো না পার্থিব এই জগতে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে, না আখেরাতে পারবে। এসবের বাহ্যিক দিকটি বেশ জমকালো কিন্তু ভেতরের দিকটা যথেষ্ট নোংরা এবং দূষিত।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন