সূরা মারিয়াম; আয়াত ৫৬-৬০

সূরা মারিয়াম; আয়াত ৫৬-৬০


সূরা মারিয়ামের ৫৬ ও ৫৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِدْرِيسَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيقًا نَبِيًّا (56) وَرَفَعْنَاهُ مَكَانًا عَلِيًّا (57)
“আর এ কিতাবে ইদরিসের কথা স্মরণ কর। সে একজন সত্যনিষ্ঠ মানুষ এবং একজন নবী।” (১৯:৫৬)
“এবং আমি তাঁকে উন্নীত করেছিলাম উচ্চ মর্যাদায়।” (১৯:৫৭)

আগের কয়েকটি আয়াতে আল্লাহর প্রশংসার পাশাপাশি হযরত ইব্রাহিম (আ.), হযরত মুসা (আ.) ও হযরত ঈসমাইল (আ.) সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। এ আয়াতে হযরত ইদ্রিস (আ.)-এর কথা বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত নূহ (আ.)-এরও আগে হযরত ইদ্রিস (আ.) নবী হিসেবে এসেছিলেন। তওরাতে তাকে ‘আখনুখ’ নামে ডাকা হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, হযরত ইদ্রিস (আ.)-ই সর্বপ্রথম মানুষকে পোশাক সেলাইয়ের পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। পাশাপাশি কলম দিয়ে লেখাও শুরু করেছিলেন হযরত ইদ্রিস (আ.)-ই।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. সত্যবাদিতা ও সদাচরণ হল নবী-রাসূলদের বৈশিষ্ট্য। সতকর্মশীলদের জন্য তারা আদর্শ।
২. সত ও পবিত্র মানুষকে আল্লাহ যেমন ভালোবাসেন তেমনি সাধারণ মানুষও তাদেরকে পছন্দ করেন। এ ধরনের ব্যক্তি ইহকাল ও পরকালে সম্মানিত হন।

সূরা মারিয়ামের ৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ مِنْ ذُرِّيَّةِ آَدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِنْ ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آَيَاتُ الرَّحْمَنِ خَرُّوا سُجَّدًا وَبُكِيًّا (58)
“আল্লাহ তাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন। এরা হলেন, আদম বংশের নবীগণ ও নূহের সঙ্গে নৌকায় যাদের আরোহণ করিয়েছিলাম, তাদের বংশধরদের থেকে, ইব্রাহিম ও ইয়াকুবের বংশধরদের থেকে এবং যাদেরকে আমি সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছিলাম ও বাছাই করে নিয়েছিলাম। যখন করুণাময়ের আয়াত তাদেরকে শুনানো হতো তখন তারা কান্নারত অবস্থায় সিজদায় লুটিয়ে পড়তো।” (১৯:৫৮)

আমরা প্রতিদিনের নামাজে বেশ কয়েক বার ‘ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম, সিরাতাল লাযিনা আনয়ামতা আলাইহিম’-এ দু’টি আয়াত তেলাওয়াত করি।

এ দু’টি আয়াতেও বলা হয়েছে, আল্লাহ নবীদেরকে বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন এবং তাদের পথই সঠিক পথ। আগের আয়াতগুলোতে ১০ জন নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ইদ্রিস (আ.) ছিলেন হযরত আদম (আ.)-এর সন্তান। ইব্রাহিম (আ.) ছিলেন হযরত নূহ (আ.)-এর নাতি। ইসহাক (আ.), ইসমাঈল (আ.) ও ইয়াকুব (আ.) হলেন হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সন্তান। হযরত মুসা(আ.), হযরত হারুন(আ.), হযরত যাকারিয়া (আ.), হযরত ইয়াহিয়া(আ.) ও হযরত ঈসা (আ.) হচ্ছেন হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর বংশধর। এসব নবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল, তারা একাগ্র চিত্তে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করতেন। এ ক্ষেত্রে তারা ছিলেন অতুলনীয়। তারা আল্লাহর সামনে লুটিয়ে পড়তেন, সিজদা করতেন এবং কাঁদতেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. বংশধারার পবিত্রতা আল্লাহর একটি বড় নেয়ামত। নবী-রাসূল মনোনীত করার ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালা এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি নবী-রাসূলদেরকে পবিত্র বংশ ও পরিবার থেকে বাছাই করেছেন।
২. পবিত্র পরিবারের সদস্য হলেই চলবে না বরং ব্যক্তিকেও ধর্মনিষ্ঠ ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ও বিনয়ী হতে হবে। তাহলেই কেবল আল্লাহর বিশেষ রহমত পেতে পারে তারা।

সূরা মারিয়ামের ৫৯ ও ৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلَاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا (59) إِلَّا مَنْ تَابَ وَآَمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ شَيْئًا (60)
“কিন্তু তাদের পরের বংশধরেরা নামাজের অবমাননা করত এবং কাম-প্রবৃত্তির অনুসরণ করত। শিগগিরই তারা (তাদের) বিভ্রান্তির পরিণতি প্রত্যক্ষ করবে।” (১৯:৪৯)
“(অবশ্য) যারা তওবা করে , ঈমান আনে, সৎকাজ করে তারা ব্যতীত। তারা তো জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের প্রতি বিন্দু পরিমাণ জুলুম করা হবে না।” (১৯:৬০)

আগের আয়াতে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিকে নবী-রাসূল ও মনোনীত ব্যক্তিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ দুই আয়াতে বলা হয়েছে, ঐশী ব্যক্তিত্বরা ব্যাপক দুঃখ-কষ্ট করার পরও তাদের পরের বংশধরেরা নামায ত্যাগ করেছে, যে নামায হচ্ছে আল্লাহর ইবাদত ও বন্দেগির উত্তম প্রকাশস্থল। এমনকি তারা কাম ও প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়েছিল। তারা সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তাদের জন্য খারাপ পরিণতি অপেক্ষা করছে। তবে যারা সৎ পথে ফিরে আসে, অতীত ভুল সংশোধন করে এবং ভালো কাজ করে, তাদের কথা আলাদা।

দুঃখজনকভাবে বর্তমান যুগের মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষই সৃষ্টিকর্তাকে সিজদা করে না। এ ছাড়া, যারা নামায পড়েন, তাদের অনেকে আবার সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন না। এসব কারণে মানুষের ওপর অন্যায় কামনা-বাসনা এমনকি কাম-প্রবৃত্তি আধিপত্য বিস্তার করছে এবং মানুষের জন্য নানা ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা ও সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. নামায হচ্ছে ধর্মের অবয়ব। নামাজের অবমাননা করার অর্থ হল, সব ধর্ম বিশেষকরে ইসলাম ধর্মের অবমাননা করা।
২. মানুষ ও কাম-প্রবৃত্তির মধ্যে দেয়াল হিসেবে কাজ করে নামায। এ দেয়াল ভেঙে গেলে মানুষের ওপর কাম প্রবৃত্তির আধিপত্য বিস্তারের পথ সহজ হয়।
৩. প্রকৃত তাওবার মধ্যদিয়ে মানুষের মধ্যে আত্মিক পরিবর্তন ঘটে। তাওবা লোক দেখানো কোনো বিষয় নয়। প্রকৃত তওবা মানুষকে বিভ্রান্তির পথ থেকে কল্যাণের দিকে নিয়ে আসে। খারাপ মানুষ ভালো হয়ে যেতে পারে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন