সূরা মারিয়াম; আয়াত ২৪-২৮

সূরা মারিয়াম; আয়াত ২৪-২৮


সূরায়ে মারিয়ামের ২৪ ও ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
فَنَادَاهَا مِنْ تَحْتِهَا أَلَّا تَحْزَنِي قَدْ جَعَلَ رَبُّكِ تَحْتَكِ سَرِيًّا (24) وَهُزِّي إِلَيْكِ بِجِذْعِ النَّخْلَةِ تُسَاقِطْ عَلَيْكِ رُطَبًا جَنِيًّا (25)
“এরপর গর্ভের নবজাতক তার পায়ের দিক থেকে মা কে ডেকে বলল, দুঃখ কর না মা,তোমার রব তোমার পায়ের নীচে পানির একটি নহর প্রবাহিত করেছেন।” (১৯:২৪)
“এবং তুমি এই খুরমা গাছের কাণ্ডটিকে তোমার নিজের দিকে একটু নাড়া দাও, তোমার ওপর তরতাজা খেজুর ঝরে পড়বে।” (১৯:২৫)

আগের পর্বে বলা হয়েছিল, আল্লাহর ইচ্ছায় ফেরেশতা জিব্রাইলের মাধ্যমে হযরত মারিয়াম (সা.) গর্ভবতী হন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি প্রসব বেদনা উপলব্ধি করেন। এ কারণে নিরুপায় হয়ে বায়তুল মোকাদ্দাসে তাঁর ইবাদাতের স্থান ত্যাগ করেন। মানুষের বিচিত্র অভিযোগ আর কুৎসা রটনা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে তিনি শহরমুখী না হয়ে চলে গেলেন মরুভূমির মতো জনমানবহীন বিরান প্রান্তরে। সেখানে তিনি একটি খুরমা খেজুর গাছে হেলান দেন। এ আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছেঃ আল্লাহ পাক মারিয়ামের প্রশান্তির জন্যে তাঁর গর্ভের সন্তানের মুখে ভাষা দিয়ে দিয়েছেন। ইসা জন্মের আগেই মায়ের সাথে কথা বলেছেন এবং মাকে সহানুভূতি জানিয়ে বলেছেন, দুঃখ কর না। যদিও তোমার সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসে নি কিন্তু আল্লাহ পাক তোমার জন্যে তাঁর নিয়ামতসমূহ জারি রাখবেনঃ পায়ের তলা থেকে পানির প্রবাহ আর মাথার ওপরের খুরমা গাছ থেকে তরতাজা এবং পাকা খেজুর তিনি দান করবেন। মজার একটি বিষয় হল রাসূলে খোদা (সা.) এবং হযরত আলী (আ.) এর বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে একজন গর্ভবতী নারীর জন্যে সর্বোত্তম খাবার হচ্ছে তরতাজা খুরমা। আর সন্তান প্রসবের পরও প্রসূতি মায়ের সর্বপ্রথম খাবার হওয়া উচিত খুরমা।

এ দুই আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
১. গর্ভবতী মহিলার মানসিক এবং আত্মিক প্রশান্তির প্রয়োজন রয়েছে। তাই গর্ভবতী মহিলারা পরিবার পরিজন বা নিকটজনদের উচিত কথাবার্তার মাধ্যমে তাকে সহানুভূতি জানানো এবং তার সকল উদ্বেগ নিরসন করা।
২. তাজা খুরমা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর আওলিয়াদের জন্যে একটি বিশেষ নিয়ামত। এই নিয়ামত কাজে লাগানোর জন্যে তাঁদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সূরা মারিয়ামের ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَكُلِي وَاشْرَبِي وَقَرِّي عَيْنًا فَإِمَّا تَرَيِنَّ مِنَ الْبَشَرِ أَحَدًا فَقُولِي إِنِّي نَذَرْتُ لِلرَّحْمَنِ صَوْمًا فَلَنْ أُكَلِّمَ الْيَوْمَ إِنْسِيًّا (26)
“তারপর ঐ খুরমা তুমি খাও আর ঐ সুপেয় পানি পান কর এবং এরকম নবজাতকের দিকে তাকিয়ে নিজের চোখ জুড়াও। তারপর যদি তুমি মানুষের দেখা পাও তাহলে তাকে বলে দাও, আমি করুণাময়ের জন্য রোযা মানত করেছি তাই আজ আমি কোনো মানুষের সাথে কথা বলব না।” (১৯:২৬)

নবজাতকের কথা শুনে মায়ের প্রসব বেদনার কষ্ট কমে গেল। তবে তাঁর মনে তখনো মানুষের গালিগালাজ আর কুৎসা রটনার ভয় থেকে গেল। এ রকম পরিস্থিতিতে যখন তাঁর জন্যে ঐশী বাণী এলো : নীরবতার রোযা রাখ, কারো সাথে রোযা রেখ না, কারো কোনো প্রশ্নের জবাব দেবে না, আল্লাহ এর মাধ্যমে তোমার সমস্যা সমাধানের পথ খুলে দেবেন।

মজার বিষয়টি হল এই আয়াতে বলা হয়েছে, নবজাতকরা হল বাবা-মায়ের নয়নের মণি, চোখের আলো। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। আসলেই পিতা-মাতার জীবনে সন্তানের ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও গঠনমূলক।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে-
১. জীবনের বিচিত্র সমস্যা ও অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্যে মানত করাটা আল্লাহর ওলিদেরই প্রদর্শিত একটি পথ। কেননা ওলিরাও মানতের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন। অবশ্য মানত হতে হবে একান্তই আল্লাহর উদ্দেশ্যে।
২. জনগণের কুৎসা রটনা আর অভিযোগের মুখে কখনো কখনো চুপ করে থাকা উচিত যতক্ষণ না সত্য উদঘাটিত হয়।

সূরা মারিয়ামের ২৭ এবং ২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَأَتَتْ بِهِ قَوْمَهَا تَحْمِلُهُ قَالُوا يَا مَرْيَمُ لَقَدْ جِئْتِ شَيْئًا فَرِيًّا (27) يَا أُخْتَ هَارُونَ مَا كَانَ أَبُوكِ امْرَأَ سَوْءٍ وَمَا كَانَتْ أُمُّكِ بَغِيًّا (28)
“তারপর মারিয়াম তার শিশুটিকে কোলে নিয়ে নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে এলো। লোকেরা বলতে লাগল “হে মারিয়াম! সত্যিই তো তুমি মহাপাপ করে ফেলেছো।” (১৯:২৭)
“হে হারুনের বোন! না তোমার বাপ কোন খারাপ লোক ছিল, না তোমার মা ছিল কোন ব্যভিচারিনী।” (১৯:২৮)

আসলে মারিয়ামের পক্ষে তো আর শিশুপুত্রকে নিয়ে মরুভূমিতে বাস করা সম্ভব ছিল না, অবশ্যই তাকে জনগণের মাঝে ফিরে যেতে হতো। কিন্তু তার কোলে সন্তান দেখে তো জনগণ স্বাভাবিকভাবেই মারিয়ামকে জেনাকারী ব্যভিচারিনী ইত্যাদি বলে গালিগালাজ করত। পূত পবিত্রতম নারীদেরকে অপবিত্র বলে গালি দেওয়ার ঘটনায় মনে পড়ে যাবে জুলায়খার গল্প। জুলায়খাও সমকালীন পবিত্রতম মানুষ ইউসূফ (আ.)’র ওপর অপবিত্রতার অভিযোগ এনেছিল। এই ইতিহাসটি আমাদের জন্যে খুবই শিক্ষণীয়। আমরা যেন ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে সমাজের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে না দেই সে ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। অনেকেই নিজেদের মূর্খতা, সন্দেহ আর হিংসা বিদ্বেষ বশত কাউকে এমনসব বিষয়ে অভিযুক্ত করে বসে যার সাথে সত্যের কোনো মিল থাকে না বরং অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতা ঠিক রটনার বিপরীত বলে প্রতীয়মান হয়।

এ দুই আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
১. অনেক সময় মানুষের বিচার বাহ্যিক নিদর্শনের ভিত্তিতে দ্রুততার সাথে হয়ে থাকে, সত্যে উপনীত হবার জন্যে তদন্ত বা গবেষণা করা হয় না। তাই উদ্ভুত পরিস্থিতিতে প্রভাবিত হওয়া ঠিক নয়।
২. বাবা-মা চাক বা না চাক, তারাই কিন্তু সন্তানদের আচরণের জন্যে দায়ী। তাই সন্তানদের প্রশিক্ষণের চেষ্টা চালাতে হবে যাতে নিজের সুনাম কুড়ানো যায়।
৩. নোংরা বা খারাপ কাজ যে-ই করুক না কেন সেটা খারাপই, তবে খ্যাতিময় পবিত্র পরিবারের কোনো খারাপ কাজ অনেক বেশি নোংরা এবং অপছন্দনীয়।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন