সূরা আম্বিয়া; আয়াত ১০৯-১১২
সূরা আম্বিয়া; আয়াত ১০৯-১১২
সূরা আম্বিয়ার ১০৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُلْ آَذَنْتُكُمْ عَلَى سَوَاءٍ وَإِنْ أَدْرِي أَقَرِيبٌ أَمْ بَعِيدٌ مَا تُوعَدُونَ (109)
এই আয়াতের অর্থ:
“(হে নবী!) অতএব, যদি তারা (তোমার আহ্বানের প্রতি) বিমুখ হয় তবে তুমি বল, আমি তোমাদের সকলকে যথাযথভাবে অবহিত করেছি, সতর্ক করেছি; আর আমি অবগত নই, যে (আজাব বা শাস্তির) প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হয়েছে, তা নিকটে না দূরে।” (২১:১০৯)
আগের পর্বে আমরা জেনেছি, মহান আল্লাহ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র রেসালাত ও রাসূল হিসেবে তাঁর মনোনয়নকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত বলে উল্লেখ করেছেন। এই আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা বিশ্বনবী (সা.) ও মুমিনদের উদ্দেশ করে বলছেন: সবাই তাওহীদের বা এক আল্লাহর ইবাদতের আহ্বান মেনে নেবে এমন প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না, বরং যুগে যুগে বহু মানুষ সত্যের আহ্বান তথা তাওহীদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছে এবং এর বিরোধিতা করেছে ও এই মিশনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। নবী-রাসূল ও মুমিনদের দায়িত্ব হল কেবল সতর্ক করা। অবশ্য অবিশ্বাসী বা কাফিরদের ওপর কখন খোদায়ী শাস্তি নেমে আসবে সে সম্পর্কে তোমাদের জানানো হয়নি। আল্লাহ যদি তাদেরকে এই দুনিয়াতেই শাস্তি দেন তাহলে তাকে অত্যাসন্ন বলা যায়, আর যদি পরকালে তাদের শাস্তি দেয়া হয় তাহলে কাফিরদের দৃষ্টিতে তা দূরবর্তী বিষয়।
এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র অস্তিত্ব ও তাঁর দেখানো পথ-নির্দেশনা মানুষের জন্য বৃষ্টিধারার মতই রহমত যা জমিনের সবখানে সমানভাবে বর্ষিত হয়। কিন্তু সমস্যা হল, নোনা জমিতে গাছ হয় না বা ফুল ফোটে না।
২. মানুষকে পথ ও মত বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দেয়ার ফলে অনেকেই এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে আল্লাহকেই অস্বীকার করে এবং আল্লাহর দেয়া বিধি-বিধানকে প্রত্যাখ্যান করে।
সূরা আম্বিয়ার ১১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنَّهُ يَعْلَمُ الْجَهْرَ مِنَ الْقَوْلِ وَيَعْلَمُ مَا تَكْتُمُونَ (110)
এই আয়াতের অর্থ:
“নিশ্চয়ই তিনি জানেন তোমাদের প্রত্যেক প্রকাশ্য কথা এবং সে সম্পর্কেও অবহিত যা তোমরা গোপন কর।” (২১:১১০)
আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, তোমাদেরকে শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে দেরি করার কারণে এমনটি ভেব না যে, আল্লাহ তোমাদের কাজ সম্পর্কে অবগত নন। কারণ, তিনি সব কিছুই জানেন। তোমরা যেসব কথা প্রকাশ্যে বলছ বা গোপনে বলছ এবং প্রকাশ্যে ও গোপনে যা কিছু করছ আল্লাহ তার সবই জানেন।
মহান আল্লাহ তোমাদের এবং এই সুবিশাল বিশ্বজগতের স্রস্টা বলে তার কাছে প্রকাশ্য ও গোপন বলে কিছুই নেই। তাঁর জ্ঞান অন্তহীন ও তাতে সীমাবদ্ধতা বলে কিছুই নেই। অন্যদিকে মানুষের চোখ, কান ও নানা অনুভূতি সময় আর স্থানের গণ্ডীতে সীমিত। তাই আমরা অদৃশ্যের খবর জানি না। আল্লাহর ক্ষেত্রে কোনো কিছু গোপন থাকে না ও ছিল না বলে তা প্রকাশ্য বা দৃশ্যমান হওয়ারও প্রশ্ন উঠে না।
এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. মানুষের কথা ও কাজের বৈপরীত্য বা দ্বিমুখী নীতি অন্যদের কাছে স্পষ্ট না হলেও মহান আল্লাহর কাছে স্পষ্ট। এইসব দ্বিমুখী চরিত্র মানুষের জন্য কলঙ্কজনক।
২. আল্লাহর জ্ঞানের সঙ্গে আমাদের জ্ঞানের তুলনা করা উচিত নয়। কারণ, আমরা কাজে-কর্মে ও চিন্তায় ভুল করি এবং অনেক কিছু গোপন করে থাকি।
সূরা আম্বিয়ার ১১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِنْ أَدْرِي لَعَلَّهُ فِتْنَةٌ لَكُمْ وَمَتَاعٌ إِلَى حِينٍ (111)
এই আয়াতের অর্থ:
“এবং আমি অবগত নই, হয়ত এ (শাস্তি বিলম্বিত হওয়া) তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা এবং এক নির্ধারিত কালঅবধি ভোগবিলাসের সুযোগ।”
এই আয়াতে আবারও মহান আল্লাহ তাদের উদ্দেশে কথা বলছেন যারা নবী-রাসূলদের দাওয়াত গ্রহণে বিমুখ হয়েছে। তিনি বলছেন: শাস্তি বা আজাব দেয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব একটি পরীক্ষা যাতে এটা দেখা সম্ভব হয় যে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষকে নিজের ইচ্ছেমত কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং তাদের হাত বেঁধে রাখা হয়নি। এটা আল্লাহর এক রীতি যে তিনি শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করেন না যাতে প্রত্যেক ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থা স্পষ্ট হয় এবং তারা অপরাধী বা নির্দোষ কিনা সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহের বিন্দুমাত্র সুযোগ না থাকে।
আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি বা আজাব দেয়ার ক্ষেত্রে দেরি করার আরেকটি সুফল হল এটা যে তওবা করার ও সংশোধনের পথ খোলা রাখা। কারণ, আল্লাহ ওয়াদা দিয়েছেন যে, তওবাকারী পাপীরাও তাঁর রহমত পাবে ও তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে না।
এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. পার্থিব জীবন অল্প কয় দিনের এবং এখানে আনন্দ ও ভোগ-বিলাসও সীমিত বা ক্ষণস্থায়ী। তাই দুনিয়ার চাকচিক্য যেন আমাদের ধোঁকায় না ফেলে। আমাদের ভুলভ্রান্তির কঠোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক হওয়া উচিত।
২. পার্থিব সব কিছুই হল পরীক্ষার মাধ্যম। তাই অমনোযোগী বা অসতর্ক হলেই খোদায়ী পরীক্ষায় ফেল করতে হবে।
সূরা আম্বিয়ার সর্বশেষ অর্থাত ১১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
) قَالَ رَبِّ احْكُمْ بِالْحَقِّ وَرَبُّنَا الرَّحْمَنُ الْمُسْتَعَانُ عَلَى مَا تَصِفُونَ (112
এই আয়াতের অর্থ:
“সে (রাসূল) বলল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি (আমাদের ও মুশরিকদের মধ্যে) ন্যায়ের সাথে মীমাংসা করে দাও এবং (মুশরিকরা জেনে রাখ) আমাদের প্রতিপালক অসীম দয়াময়, তোমরা অযৌক্তিক ও উদ্ভট যা কিছু বর্ণনা কর তার বিরুদ্ধে আল্লাহরই কাছে আমরা সাহায্য চাই।” (২১:১১২)
এই আয়াত সূরা আম্বিয়ার সর্বশেষ আয়াত। এখানে মহান আল্লাহ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র বক্তব্য তুলে ধরছেন যে বক্তব্য তিনি রেখেছেন মুশরিকদের সত্য-বিমুখতা ও সত্যের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে। বিশ্বনবী (সা.) বলছেন, আল্লাহ যেন কাফির মুশরিকদেরকে সত্য-বিরোধী আচরণের কারণে সত্য থেকে দূরে রাখেন ও তাদেরকে শাস্তি দেন যাতে সত্য-বিরোধীরা শাস্তি আসার বিলম্বের বিষয়টির অপব্যবহার করতে না পারে এবং মুমিনদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপের সুযোগ না পায় ও এ বিষয়টিকে মুমিনদের মনোবল দুর্বল করার সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে।
এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. শত্রুর ব্যাপারেও অন্যায় মন্তব্য করা উচিত নয় ও শত্রুর প্রতি অন্যায় নির্দেশ দেয়া যাবে না। কখনও অন্যায় কিছু আশা করা ঠিক নয়। সত্যকে লঙ্ঘন করা ও অতিরিক্ত শাস্তি দেয়াও জুলুমের শামিল।
২. নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীরা কেবল আল্লাহরই সাহায্য কামনা করেন। কাফির ও মুশরিকরা পাথর বা কাঠের মূর্তির কিংবা অক্ষম মানুষের কাছে সাহায্য চায়।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথের ওপর অবিচল রাখুন এই প্রার্থনার মধ্য দিয়ে শেষ করছি সূরা আম্বিয়ার তাফসির।
(সূরা আম্বিয়া সমাপ্ত)
সূত্রঃ তেহরান রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন