সূরা আম্বিয়া; আয়াত ১০৫-১০৮

সূরা আম্বিয়া; আয়াত ১০৫-১০৮

সূরা আম্বিয়া; আয়াত ১০৫-১০৮


সূরা আম্বিয়ার ১০৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ مِنْ بَعْدِ الذِّكْرِ أَنَّ الْأَرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُونَ (105)
এই আয়াতের অর্থ:
“নিঃসন্দেহে আমরা স্মারকবাণী তথা তাওরাতের পর যাবুরেও লিপিবদ্ধ করে দিয়েছিলাম যে, পৃথিবীর শাসন-ক্ষমতার অধিকারী হবে আমার সৎ বান্দারা।” (২১:১০৫)

আগের পর্বে বিচার দিবসে দোজখবাসী ও বেহেশতবাসীদের অবস্থার তুলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মুমিনদের জন্য রয়েছে ইহকাল ও পরকালে সুখময় প্রতিদান। আর এরই ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: কেবল হযরত মুসা (আ.)’র কাছে নাজেল হওয়া তাওরাতেই নয়, হযরত দাউদ (আ.)’র কাছে নাজেল হওয়া আল্লাহর কিতাব যাবুরেও এই সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, সৎকর্মশীলরাই হবে ভবিষ্যত পৃথিবীর অধিকারী ও পৃথিবীর শাসন-ক্ষমতার অধিকারী। যাবুরের ৫টি স্থানে এমন সুসংবাদ তথা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি দেখা যায়।

হযরত দাউদ (আ.) ছিলেন বনি ইসরাইলের একজন বিখ্যাত নবী। প্রাচীন শাম বা সিরিয়া অঞ্চলে তাঁর রাজ্য ছিল সৎকর্মশীলদের শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
যাবুরে এ সুসংবাদ লিখিত আছে যে, যারা আল্লাহর ইবাদাত করে এবং সৎকর্মপরায়ণ, তারা জানুক যে, সৎকর্মের প্রতিদান শুধু পরকালের জন্যই নির্দিষ্ট নয়; বরং দুনিয়াতেও আল্লাহ এরূপ বান্দাদের রাজত্ব ও শাসন ক্ষমতা প্রদান করবেন যেমনটি তিনি সূরা নূরের ৫৫ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেছেন। তবে সমগ্র বিশ্বের ওপর পরিপূর্ণ ন্যায়বিচারভিত্তিক এবং জুলুমমুক্ত রাজত্ব ও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর সর্বশেষ স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি দ্বাদশ ইমাম তথা ইমাম মাহদী (আ.)-এর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. পূর্ববর্তী ধর্মীয় গ্রন্থ বা আসমানি কিতাবগুলো এবং পবিত্র কুরআন পৃথিবীর আগামী দিনগুলোর অবস্থা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছে, সৎ ও মুমিন বান্দারাই হবে রাষ্ট্রীয় শাসন-ক্ষমতার অধিকারী।
২. বিশ্বে শাসন-ক্ষমতার অধিকারী হওয়া ও বিশ্বে ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য দুটি শর্ত জরুরি: আল্লাহ ও তার বিধি-বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বাস্তব ময়দানের অভিজ্ঞতা অর্জন করা।

সূরা আম্বিয়ার ১০৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
إِنَّ فِي هَذَا لَبَلَاغًا لِقَوْمٍ عَابِدِينَ (106)

এই আয়াতের অর্থ:
“নিশ্চয়ই এতে আল্লাহর দাসত্বকারী সম্প্রদায়ের জন্য স্পষ্ট বার্তা রয়েছে।” (২১:১০৬)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে মহান আল্লাহ এটা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, কেবল ইবাদতের মাধ্যমে জালিমদের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় শাসন-ব্যবস্থা কেড়ে নেয়া সম্ভব হবে না, সমাজ পরিচালনার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নানা ক্ষেত্রে যথেষ্ট যোগ্যতাও অর্জন করতে হবে। যেমন, ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যাপক জ্ঞান ও খোদাভীতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করা।

এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. পৃথিবীর শাসন-ক্ষমতা মুমিন ও সৎ মানুষদেরই প্রাপ্য অধিকার, বলদর্পী ও লুটেরাদের প্রাপ্য নয়। তাই ঈমানদারদেরকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
২. ইসলামী দেশের ব্যক্তি ও সমাজের সৌভাগ্য নিশ্চিত করার জন্য যা যা দরকার তা মহান আল্লাহ ধর্ম গ্রন্থগুলোতেই বলে দিয়েছেন। ঈমানদারদের দায়িত্ব হল আল্লাহর এইসব বাণীগুলোকে ভালভাবে বোঝা ও সেগুলোকে বাস্তবায়ন করা।

সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ (107)

“(হে নবী!) আমরা তো তোমাকে বিশ্বজগতের জন্য কেবলই রহমত বা অনুগ্রহস্বরূপ পাঠিয়েছি।” (২১:১০৭)

শেষ পর্যন্ত মুমিন ও বিশ্বাসীরাই বিশ্বের ওপর রাজত্ব করবেন এই সুসংবাদ দেয়ার পর মহান আল্লাহ এই আয়াতে বলছেন: ইসলামের নবী (সা.) গোটা মানব জাতির জন্য রহমত এবং তাঁর মিশন শেষ পর্যন্ত বিশ্বরাষ্ট্রের রূপ নেবে। সৎকর্মশীল ব্যক্তিরা দুনিয়ার প্রচলিত শাসকদের বিপরীতে ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থের দিকে ধাবিত হন না, বরং তারা আল্লাহর সৃষ্টির সেবায় এবং সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত থাকেন। তাদের শাসন-ব্যবস্থায় কাফের বা অবিশ্বাসীরাও নিরাপত্তা ও সুখ অনুভব করেন এবং কেউ তাদের ওপর জুলুম করে না।

নবী-রাসূলদের অস্তিত্ব কাফির ও মুমিন সবারই জন্যই রহমতের ওসিলা। কারণ, তারা মহান আল্লাহর ইচ্ছা বা পরিকল্পনা ছাড়া অন্য কিছু বাস্তবায়ন করেন না। আর আল্লাহও তাঁর সব সৃষ্টির প্রতিই করুণাশীল। তিনি তাদের সবারই সৌভাগ্য ও মঙ্গল চান। অবশ্য সব সময়ই একদল মানুষ নিজের সৌভাগ্য ও কল্যাণ বুঝতে এবং সত্যকে মেনে নিতে অক্ষম হয় গোঁড়ামির কারণে। এভাবে তারা ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় নিজের ক্ষতি করেন। এই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হল:

১. ইসলামের মহান নবী (সা.) মানুষের জন্য যা আল্লাহর পক্ষ থেকে এনেছেন তা তাদের জন্য মুক্তি ও চিরন্তন সৌভাগ্যের মাধ্যম।
২. হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বিশ্বের সব মানুষের জন্যই রাসূল। তিনি বিশেষ কোনো জাতি বা গোত্রের জন্য রাসূল নন। কারণ, ইসলাম ধর্মের শিক্ষা ও কর্মসূচীগুলো বিশ্বজনীন, বিশেষ কোনো অঞ্চলের জন্য সীমিত নয়।

সূরা আম্বিয়ার ১০৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قُلْ إِنَّمَا يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَهَلْ أَنْتُمْ مُسْلِمُونَ (108)

এই আয়াতের অর্থ:
“(হে নবী! আপনি মানুষকে) বলুন, আমার কাছে তো কেবল এই ওহি বা প্রত্যাদেশ আসে যে, তোমাদের উপাস্য একমাত্র অদ্বিতীয় আল্লাহ; তবে কি তোমরা আত্মসমর্পণকারী ও ইসলাম গ্রহণকারী (বান্দা) হবে?” (২১:১০৮)

আগের আয়াতে বিশ্বনবী (সা.)'র অস্তিত্বকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ আয়াতে নবী-রাসূলদের মিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা দায়িত্ব তথা একত্ববাদের দিকে মানুষকে আহ্বানের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলছেন: নবী-রাসূলগণ মানুষকে নিজের দিকে ডাকেন না, বরং তারা মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকেন যাতে মানুষকে মূর্তিপূজা ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে পারেন। অন্য কথায় নবী-রাসূলগণ মানুষকে এক আল্লাহর আনুগত্যের দিকে আহ্বান করেছেন যাতে মানুষ জালেম ও বলদর্পীদের কর্তৃত্ব থেকে মুক্তি পায় এবং প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হল:
১. তৌহিদ বা একত্ববাদের দিকে মানুষের আহ্বান ও খোদায়ী ধর্মের অভিন্ন শ্লোগান বিশ্বে আল্লাহর রহমতেরই প্রতিফলন।
২. একত্ববাদী হওয়ার জন্য আল্লাহর বিধিবিধান নতশিরে মেনে চলা জরুরি। মানুষের ঈমান বা বিশ্বাস তাদের কাজ থেকে আলাদা নয়।

সূত্রঃ তেহরান রেডিও

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন