সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৮৩-৮৮
সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৮৩-৮৮
সূরা আম্বিয়ার ৮৩ ও ৮৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَأَيُّوبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ (83) فَاسْتَجَبْنَا لَهُ فَكَشَفْنَا مَا بِهِ مِنْ ضُرٍّ وَآَتَيْنَاهُ أَهْلَهُ وَمِثْلَهُمْ مَعَهُمْ رَحْمَةً مِنْ عِنْدِنَا وَذِكْرَى لِلْعَابِدِينَ (84)
এ দুই আয়াতের অর্থ:
“এবং (স্মরণ কর) আইউবকে, যখন সে তাঁর প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিল, (হে আমার প্রতিপালক!) আমাকে দুঃখ-ক্লেশ (ব্যাধি) স্পর্শ করেছে, আর তুমি তো (দয়ালুদের মধ্যে) শ্রেষ্ঠ দয়ালু।” (২১:৮৩)
“তখন আমরা তাঁকে (তাঁর প্রার্থনা) গ্রহণ করলাম এবং আমরা তাঁর যত দুঃখ-ক্লেশ ছিল তা দূর করেছিলাম এবং আমরা তাঁকে তাঁর পরিবারবর্গ ফিরিয়ে দেই এবং তাঁদের অনুরূপ আরও দিয়েছিলাম; যেন তা আমাদের পক্ষ হতে (তাঁর জন্য) অনুগ্রহস্বরূপ এবং ইবাদাতকারীদের জন্য স্মারক ও উপদেশস্বরূপ হয়।” (২১:৮৪)
আগের আলোচনায় আমরা হযরত সুলায়মান ও হযরত দাউদ (আ.)'র ঘটনা শুনেছি। এখানে হযরত আইয়ুব (আ.)'র ঘটনার বর্ণনা শুরু হয়েছে। তিনি এই সূরায় উল্লেখিত দশম নবী।
মহান আল্লাহ হযরত আইয়ুব (আ.)-কে দারিদ্র ও প্রাচুর্য দানের মাধ্যমে পরীক্ষা করেছিলেন। আল্লাহ প্রথমে এই মহান নবীকে বিপুল সম্পদ দান করেন। হযরত আইয়ুব (আ.) সব সময়ই আল্লাহর নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতেন এবং কখনও অহংকার ও দম্ভ দেখা দেয়নি তাঁর মধ্যে।
এরপর মহান আল্লাহ তাঁকে দারিদ্রসহ নানা সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত করলেন। হযরত আইয়ুব (আ.)'র সম্পদ নেয়ার পর আল্লাহ তাঁর সন্তানদেরও কেড়ে নেন। কিন্তু এতসব কঠিন সংকটের মধ্যেও আইয়ুব (আ.) মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। তাঁর পরীক্ষা এখানেই শেষ হয়নি। আল্লাহ তাঁকে শারীরিক অসুস্থতা ও চর্মরোগেও আক্রান্ত করেন। এ সময় তাঁর চামড়ায় ঘা ছড়িয়ে পড়ে ও চলাফেরার শক্তি রহিত হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি আল্লাহর ব্যাপক প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন।
তাঁর এত দূরবস্থা দেখে মানুষও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তারা এই মহান নবীকে বলে:
‘ওহে আইয়ুব! তুমি কী পাপ করেছিলে যে এতসব বালা-মুসিবতের শিকার হলে?’
এ ধরনের আক্রমণাত্মক কথা বা অপবাদ সহ্য করা আইয়ুব (আ.)'র জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাই তিনি এমন কঠিন দিনে আল্লাহর সাহায্য কামনা করলেন এবং রোগ ও বিপদ-মুসিবত থেকে মুক্তি চাইলেন। ফলে আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহের দুয়ার খুলে দেন আইয়ুব (আ.)'র জন্য। একে-একে সব সমস্যা থেকে মুক্ত হন তিনি। ফিরে পান হারানো ধন-সম্পদ ও জীবিত হয় সন্তান-সন্ততি। এমনকি তাঁকে নতুন সন্তান-সন্ততিও দান করেন। সূরা সাদে আইয়ুব (আ.)'র ঘটনা আরো বিস্তারিতভাবে এসেছে।
এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. অন্য সব মানুষের মত আল্লাহ নবী-রাসূলদেরকেও পরীক্ষা করেন। তবে তাঁদের পরীক্ষা হয় সাধারণ মানুষের চেয়ে বহু গুণ কঠিন ও কষ্টকর।
দুই. বিপদ-মুসিবত যত কঠিনই হোক না তা দূর করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া ও মুনাজাতের সময় আদব রক্ষা করা জরুরি।
তিন. মুমিন ও ইবাদতে অগ্রগামী লোকদের জন্যও উপদেশ এবং সতর্কবার্তা জরুরি।
সূরা আম্বিয়ার ৮৫ ও ৮৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِسْمَاعِيلَ وَإِدْرِيسَ وَذَا الْكِفْلِ كُلٌّ مِنَ الصَّابِرِينَ (85) وَأَدْخَلْنَاهُمْ فِي رَحْمَتِنَا إِنَّهُمْ مِنَ الصَّالِحِينَ (86)
এ দুই আয়াতের অর্থ :
“এবং ইসমাইল, ইদরিস ও যুলকিফ্ল-কে (স্মরণ কর), তাঁরা সবাই ছিল ধৈর্যশীল।” (২১:৮৫)
“এবং তাঁদেরকে আমরা নিজ অনুগ্রহে প্রবেশ করিয়েছিলাম; নিশ্চয় তাঁরা ছিল সৎকর্মপরায়ণ।” (২১:৮৬)
হযরত আইয়ুব (আ.)'র অসাধারণ ধৈর্য ও অবিচল মনোভাবের ঘটনা তুলে ধরার পর মহান আল্লাহ এ আয়াতে আরো তিন নবীর কথা উল্লেখ করছেন। আল্লাহ বলছেন, এই তিন নবীও ছিলেন ধৈর্যশীল। তাঁরা ভেতরের সমস্যা ও বাইরের শত্রুতাগুলোকে প্রতিরোধ করেছেন এবং ধৈর্য, দৃঢ়তা ও প্রতিরোধের আদর্শে পরিণত হয়েছেন। আর এ জন্যই আল্লাহ তাঁর অপার রহমতের মধ্যে শামিল করেছেন তাঁদেরকে একনিষ্ঠতা ও সতকর্মশীলতার পুরস্কার হিসেবে।
হযরত ঈসমাইল (আ.) মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পিতা ইব্রাহীম (আ.)'র হাতে জবাই হতেও প্রস্তুত হয়েছিলেন। আর ইব্রাহীম (আ.)ও এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন আল্লাহর নির্দেশকে শিরোধার্য করে। আর এখানেই তাঁদের ধৈর্য ও আনুগত্য প্রমাণিত হয়েছে।
হযরত ইদরিস (আ.) ছিলেন হযরত নুহ (আ.)'র দাদা। পবিত্র কুরআনে তাঁর উচ্চ মর্যাদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত যুলকিফ্ল (আ.) ছিলেন বনি ইসরাইলের একজন নবী। তিনি ছিলেন হযরত ঈসা (আ.)'র পূর্ববর্তী নবী।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. যারা যুগে যুগে মানবজাতিকে সুপথ দেখানোর জন্য অনেক কষ্ট স্বীকার করেছেন তাঁদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা উচিত এবং তাঁদেরকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
২. আল্লাহর পথে ধৈর্যশীল, দৃঢ়চেতা ও সতকর্মশীল মানুষেরা খোদায়ী বিশেষ রহমত, পুরস্কার ও দয়া পেয়ে থাকেন।
সূরা আম্বিয়ার ৮৭ ও ৮৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَذَا النُّونِ إِذْ ذَهَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ أَنْ لَنْ نَقْدِرَ عَلَيْهِ فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ (87) فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَلِكَ نُنْجِي الْمُؤْمِنِينَ (88)
এ দুই আয়াতের অর্থ :
“এবং (স্মরণ কর) যুননুন (ইউনুস)-কেও (আমরা নিজ অনুগ্রহে প্রবেশ করিয়েছিলাম), যখন সে ক্রোধান্বিত হয়ে প্রস্থান করেছিল এবং ধারণা করেছিল যে, আমরা তাঁর ওপর সংকীর্ণতা আরোপ করব না। অতঃপর সে অন্ধকার রাশির মধ্য হতে আহ্বান করেছিল যে, ‘(হে আমার প্রতিপালক!) তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তুমি পবিত্র, মহিমাময়; নিশ্চয় আমি (নিজের প্রতি) অবিচারকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম।” (২১:৮৭)
“আমরা তাঁর প্রার্থনা গ্রহণ করেছিলাম এবং তাঁকে বিষন্নতা থেকে মুক্তি দান করেছিলাম এবং আমরা এভাবেই বিশ্বাসীদের মুক্তি দান করে থাকি।” (২১:৮৮)
হযরত ইউনুস (আ.) বহু বছর ধরে মানুষকে একত্ববাদের দিকে আহ্বান জানানো সত্ত্বেও দুই একজন ছাড়া কেউই আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেনি। ফলে ক্ষুব্ধ হন এই মহান নবী। তিনি নিজ জাতির প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করে নিজ শহর থেকে বেরিয়ে যান। কিন্তু এভাবে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ায় আল্লাহ ইউনুস (আ.)-কে কঠিন সংকটে নিমজ্জিত করেন।
ইউনুস (আ.) কিশতিতে উঠলে একটি তিমি মাছ ওই কিশতিতে হামলা করতে উদ্যত হয়। কিশতির যাত্রীরা সিদ্ধান্ত নিল কোনো একজন আরোহীকে সাগরে নিক্ষেপ করা হবে যাতে তিমি কেবল ওই যাত্রীকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এ জন্য লটারি করা হল। লটারিতে হযরত ইউনুস (আ.)'র নাম উঠল। ফলে তাঁকে নিক্ষেপ করা হল দরিয়ায়। ওই তিমি মাছ হযরত ইউনুস নবীকে গিলে ফেলল, কিন্তু হজম করল না। তিমির সংকীর্ণ পেটে ও অন্ধকারে একাকী অবস্থায় ইউনুস (আ.) রেসালাতের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে নিজের অধৈর্য হয়ে পড়ার কথা স্বীকার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। আল্লাহ তাঁকে তিমির পেট থেকে মুক্তি দেন। ইউনুস (আ.)-কে বলা হয় জুন্নুন। এর অর্থ মাছের অধিকারী।
এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. মহামানবরা অবহেলার জন্য সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি শাস্তির শিকার হন। ইউনুস (আ.) নিজ জাতির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে এবং আল্লাহর অনুমতি না নিয়ে ওই জাতির শহর থেকে বের হয়ে অধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাই আল্লাহ তাঁর ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছেন।
২. আমরা কখনও কোনো ভুল করে ফেললে তা দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গেই স্বীকার করা উচিত এবং আল্লাহ আমাদের ওপর জুলুম করছেন- কখনও তা ভাবা উচিত নয়।
৩. পবিত্র কুরআন পড়াই যথেষ্ট নয়। কুরআন থেকে শিক্ষা নিতে হবে আমাদের পার্থিব ও পারলৌকিক জীবনের জন্যই এবং জানতে হবে খোদায়ী সুন্নাত ও বিধানকে।
সূত্রঃ তেহরান রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন