সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৭৯-৮২
সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৭৯-৮২
সূরা আম্বিয়ার ৭৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
) فَفَهَّمْنَاهَا سُلَيْمَانَ وَكُلًّا آَتَيْنَا حُكْمًا وَعِلْمًا وَسَخَّرْنَا مَعَ دَاوُودَ الْجِبَالَ يُسَبِّحْنَ وَالطَّيْرَ وَكُنَّا فَاعِلِينَ (79)
এই আয়াতের অর্থ:
“এবং আমরা (আমাদের পছন্দনীয় মীমাংসা) সুলাইমানকে বুঝিয়েছিলাম এবং অবশ্য আমরা তাদের উভয়কে (দাউদ ও সুলায়মান) বিচক্ষণতা বা প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম। এবং আমরা পর্বতমালা ও পাখিকুলকে দাউদের অধীন (অনুগত) করেছিলাম, এভাবে যে তারা তার সাথে (আল্লাহর) পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করত। আমরাই (এ সব কিছুর) কর্তা ছিলাম।”
আগের পর্বে আমরা বলেছি, ভেড়ার পালের মালিক ও বাগানের মালিকের মধ্যে বিরোধের ঘটনায় তারা হযরত দাউদ (আ.)'র কাছে বিচারের শরণাপন্ন হয়েছিল। তিনি নিজে একটি রায় দেয়ার পর এ ব্যাপারে পুত্র সুলায়মানেরও মতামত জানতে চান। তারা দু’জনই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণের রায় দেন। তবে সুলায়মান (আ.) তাতক্ষণিক ক্ষতিপূরণের পরিবর্তে ধীরে ধীরে এক বছরের মধ্যে ক্ষতিপূরণের রায় দেন।
৭৯ নম্বর আয়াত অনুযায়ী হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলাইমান (আ.) উভয়েই মহান আল্লাহর কাছ থেকে বিচক্ষণতা (প্রজ্ঞা) ও নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করেছিলেন, তাই এক্ষেত্রে তাদের উভয়ের বিচার সঠিক ছিল। কিন্তু হযরত সুলাইমান (আ.)-এর বিচার প্রায়োগিক দৃষ্টিতে সহজতর ছিল এবং বাদী ও বিবাদী উভয়ের সন্তুষ্টির কারণ ছিল। এজন্য তাঁর বিচারের বিষয়টি আল্লাহ বিশেষভাবে নিজের সাথে সম্পর্কিত করে বলেছেন, ‘আমরা সুলায়মানকে তা বুঝিয়েছিলাম।'
মহান আল্লাহর কাছ থেকে বিচক্ষণতা (প্রজ্ঞা) ও নিশ্চিত জ্ঞান লাভ রেসালাত বা নবুওয়্যাতের প্রমাণ। হযরত দাউদ (আ.)-র ক্ষেত্রে আল্লাহ এমন ব্যবস্থা নিয়েছিলেন যে পাখি বা বিহঙ্গকুল এবং পাহাড়-পর্বতও এই মহান নবীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করত। অন্যরাও এ অলৌকিক ঘটনা নিজ চোখে দেখতে পেত ও বুঝতে পারত।
এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:
১. নবী-রাসূলদের দায়িত্ব কেবলই ধর্ম প্রচার ও উপদেশ দেয়া নয়। মানুষের নানা সমস্যা পূরণ ও নালিশের ব্যাপারে বিচার করাও তাদের দায়িত্ব ছিল।
২. যে কোনো অস্তিত্বের রয়েছে বোধ শক্তি এবং বাতাস ও পাহাড়-পর্বত থেকে শুরু করে সব সৃষ্টিই আল্লাহর তাসবিহ পাঠ বা প্রশংসায় মশগুল। কিন্তু আমাদের সেই কান নেই বলে আল্লাহর প্রতি সৃষ্টিকূলের প্রশংসা আমরা শুনতে পাই না।
সূরা আম্বিয়ার ৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَعَلَّمْنَاهُ صَنْعَةَ لَبُوسٍ لَكُمْ لِتُحْصِنَكُمْ مِنْ بَأْسِكُمْ فَهَلْ أَنْتُمْ شَاكِرُونَ (80)
“এবং আমরা তাকে (দাউদকে) তোমাদের জন্য বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম যাতে তা তোমাদের (যুদ্ধের) কাঠিন্য হতে রক্ষা করে; তবে কি তোমরা কৃতজ্ঞ হবে না?” (২১:৮০)
এ আয়াতে হযরত দাউদ (আ.)'র প্রতি আরো একটি অনুগ্রহের কথা তুলে ধরেছেন মহান আল্লাহ। তিনি বলছেন, দাউদ (আ.) কেবলই দোয়া ও ইবাদত নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন না, শত্রুর ধারালো তরবারির বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছেন। মুজাহিদদের রক্ষার জন্য তিনি তৈরি করেছেন লোহার বর্মের পোশাক। তিনি লোহাকে নরম করে রিং তৈরির মাধ্যমে এই বর্ম গড়ে তুলতেন। সূরা সাবাহ'র একটি আয়াতের অর্থ অনুযায়ী আল্লাহই দাউদ (আ.)-কে এইসব কাজ শিখিয়েছেন। তাই মানুষের উচিত আল্লাহর শোকর করা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:
১. মানুষ যা কিছু আবিষ্কার করে তার মূলে রয়েছে খোদায়ী প্রেরণা ও দিক-নির্দেশনা।
২. জীবিকা নির্বাহের জন্য নবী-রাসূলরাও ছিলেন সাধারণ কর্মজীবী বা পেশাজীবী।
৩. সামরিক শিল্প গড়ে তোলার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জনগণের নিরাপত্তা বিধান ও শত্রুদের হামলা প্রতিরোধ করা। অর্থাত ইসলামের দৃষ্টিতে সামরিক শিল্পের লক্ষ্য প্রতিরক্ষামূলক। পররাজ্য দখল ও কর্তৃত্বপনা নয়।
সূরা আম্বিয়ার ৮১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
) وَلِسُلَيْمَانَ الرِّيحَ عَاصِفَةً تَجْرِي بِأَمْرِهِ إِلَى الْأَرْضِ الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا وَكُنَّا بِكُلِّ شَيْءٍ عَالِمِينَ (81)
এ আয়াতের অর্থ:
“এবং সুলাইমানের জন্য প্রবল বায়ু প্রবাহকে (বশীভূত করেছিলাম), তা তার নির্দেশে সে ভূখণ্ডের দিকে প্রবাহিত হত যার মধ্যে আমরা কল্যাণ রেখেছিলাম এবং আমরা সকল বস্তু সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত।” (২১:৮১)
আগের আয়াতে আমরা জেনেছি, আল্লাহ পাহাড়গুলোর ওপর হযরত দাউদ (আ.)'র কর্তৃত্ব দান করেছিলেন। এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, তিনি হযরত সুলাইমান (আ.)-কে বাতাসের ওপর কর্তৃত্ব দান করেছিলেন। ফলে বাতাস তাঁকে তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী যে কোনো দিকে যত দূর ইচ্ছা নিয়ে যেতে পারত। ফলে অন্যদের যে পথ অতিক্রম করতে এক মাস সময় লাগত, তিনি সেই পথ অতিক্রম করতেন অর্ধেক দিনে। এই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে সৃষ্টি জগতের সব কিছুই খোদায়ী বিধান মেনে চলে এবং আল্লাহ চাইলে তাঁর যে কোনো বান্দাকে সৃষ্টিকূলের ওপর কর্তৃত্বও দান করতে পারেন।
হযরত সুলাইমান (আ.)- ছিলেন অনন্য এক রাজত্বের অধিকারী। তিনি সাড়ে সাতশ’ বছরব্যাপী রাজত্ব করেন এবং মানুষ, জ্বীন, পশু-পাখি, বৃক্ষ, হাওয়া সমস্ত জিনিসের ওপর তাঁর রাজত্ব ছিল। তিনি কাঠের ওপর কাঁচ যুক্ত করে এক হাজার দৃষ্টিনন্দন মহল নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর সেনাবাহিনী একশ’ ক্রোশ দৈর্ঘ ও একশ’ ক্রোশ প্রস্থ নিয়ে পরিব্যাপ্ত ছিল। তিনি একটি অতিশয় লম্বা-চওড়া সিংহাসন তৈরি করেন যার নিকট সোনা-রূপার ছয়টি চেয়ার পাতা ছিল যাতে তাঁর বিশিষ্টজনরা বসতেন। তাঁদের পিছনে অন্যরা দাঁড়িয়ে থাকত। আর তাদের পিছনে থাকত জ্বীনরা। তাদের সকলের ওপর পাখিরা সারিবদ্ধভাবে ডানা মেলে ছায়া দিত। তাঁদের সকলকে বাতাস একস্থান হতে অন্যস্থানে নিয়ে যেত।
এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:
১. মহান আল্লাহর বন্ধু বা আওলিয়ায়ে কেরাম আল্লাহর ইচ্ছায় সৃষ্টিকূলের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম।
২. মহান আল্লাহই সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা এবং তিনি সব বিষয়ে সম্যক অবহিত। কোনো কিছুই তার জ্ঞান ও ক্ষমতার আওতামুক্ত নয়।
সূরা আম্বিয়ার ৮২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمِنَ الشَّيَاطِينِ مَنْ يَغُوصُونَ لَهُ وَيَعْمَلُونَ عَمَلًا دُونَ ذَلِكَ وَكُنَّا لَهُمْ حَافِظِينَ (82)
এ আয়াতের অর্থ:
“এবং জ্বীনদের মধ্যেও একদল তাঁর (সুলায়মানের) জন্য ডুবুরীর কাজ করত এবং এ ছাড়াও অন্যান্য কাজকর্ম করত (আমরা তার অধীন করেছিলাম); এবং আমরা তাদের (বিদ্রোহ থেকে) রক্ষা করতাম।” (২১:৮২)
কেবল প্রকৃতির নানা উপাদানই নয়, জিনরাও ছিল হযরত সুলায়মান (আ.)'র অনুগত। তারা এই মহান নবীর দরবারে কাজ করত। তারা ডুবুরির কাজও করত সুলায়মান (আ.)'র জন্য। এ ছাড়াও বড় বড় সুদৃশ্য ভবন নির্মাণ এবং বড় বড় পাতিল ও ট্রের মত নানা যন্ত্রপাতিও তৈরি করত সেই জিনরা। এখানে কুরআনের আয়াতে জিনদেরকে শয়তান বলে উল্লেখ করা হলেও সূরা সাবায় তাদেরকে জিন বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। শয়তান নিজেও ছিল জিন জাতির অন্তর্ভুক্ত। জিনদের রয়েছে বুদ্ধি, বিবেক ও দায়িত্ববোধ। মানুষ তাদের দেখতে পায় না বলেই তাদের জিন বলা হয়। তাদের মধ্যেও রয়েছে মুমিন, কাফির ও শয়তান। কাফির জিনরা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে সচেষ্ট। হযরত সুলায়মান (আ.) শয়তানদের ওপরও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি একদল শয়তানকে ব্ন্দী করে রেখেছিলেন। একদল শয়তানকে ডুবুরির কঠিন কাজ করতে বাধ্য করতেন। আল্লাহ এ আয়াতের শেষাংশে বলছেন, বিদ্রোহী স্বভাবের এই শয়তানরা যাতে সুলায়মান (আ.)'র নির্দেশ অমান্য করতে না পারে সে ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছিলেন মহান আল্লাহ।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. মানুষ ছাড়া জিনদেরও রয়েছে ইচ্ছার স্বাধীনতা, বুদ্ধি, বিবেক ও দায়িত্ববোধ। তাই তাদের মধ্যেও রয়েছে কাফির ও মুমিন।
২. কোনো কোনো নবী-রাসূল রেসালাত ছাড়াও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। মানুষের পার্থিব বিষয় পরিচালনাও ছিল তাঁদের দায়িত্ব।
সূত্রঃ তেহরান রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন