সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৭৪-৭৮ (পর্ব-১৬)

সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৭৪-৭৮ (পর্ব-১৬)


সূরা আম্বিয়ার ৭৪ থেকে ৭৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
) وَلُوطًا آَتَيْنَاهُ حُكْمًا وَعِلْمًا وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْقَرْيَةِ الَّتِي كَانَتْ تَعْمَلُ الْخَبَائِثَ إِنَّهُمْ كَانُوا قَوْمَ سَوْءٍ فَاسِقِينَ (74) وَأَدْخَلْنَاهُ فِي رَحْمَتِنَا إِنَّهُ مِنَ الصَّالِحِينَ (75)
এ দুই আয়াতের অর্থ:
“এবং লূতকে আমরা বিচক্ষণতা ও জ্ঞান দান করেছিলাম এবং আমরা তাঁকে সেই জনপদ থেকে উদ্ধার করেছিলাম যার অধিবাসীরা অশ্লীল কাজ করত; নিশ্চয় তারা ছিল এক মন্দ ও (পাপাসক্ত) বিদ্রোহী সম্প্রদায়।” (২১:৭৪)
“এবং আমরা তাঁকে নিজ রহমত বা অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম; নিশ্চয় সে ছিল পূণ্যাত্মা বা সতকর্মশীলদের একজন।” (২১:৭৫)

আগের আলোচনায় আমরা হযরত ইব্রাহিম (আ.)'র কাহিনী শুনেছি। এ আয়াতে হযরত লুত (আ.)'র রিসালাত বা খোদায়ী মিশনের দিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলছেন, মানুষকে সুপথ দেখানোর জন্য যা যা দরকার ছিল তার সবই আমি লুতকে দান করেছিলাম। কারণ খোদায়ী মিশনের গুরু দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার ও তা সম্পন্ন করার যোগ্যতা তার ছিল। অবশ্য তার জাতির লোকেরা সমকামিতার মত জঘন্য পাপাচার ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল না। তাই যখন খোদায়ী শাস্তি নেমে এল তখন আল্লাহ রিসালাতের দায়িত্ব পালনকারী হযরত লুত (আ.)-কে এই শাস্তি থেকে মুক্ত রাখেন।

অনেকেই মনে করেন যে দূর্যোগ বা খোদায়ী শাস্তি নাজিলের সময় ভাল ও মন্দ সব মানুষই তার শিকার হয়। কিন্তু এই আয়াত থেকে বোঝা যায় কেবল পাপীরা বা পাপের মোকাবেলায় নিরবতা পালনকারী ভাল মানুষেরা শাস্তির শিকার হন। কারণ, তারা নিজেরা ভাল মানুষ হওয়া সত্ত্বেও পাপীদেরকে সতর্ক করার ও পথ-নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেননি।

এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. কেউ শয়তানের কুমন্ত্রণার শিকার হয়ে একবার কোনো পাপ করার পর অনুতপ্ত হলে তা আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু যে বার বার গোনাহ করতে থাকে সে আল্লাহর ক্রোধ ও শাস্তির শিকার হবে।
দুই. সতকর্মশীল মানুষ আল্লাহর অপার দয়া ও অনুগ্রহ পান এবং খোদায়ী শাস্তি তাদের স্পর্শ করে না।

সূরা আম্বিয়ার ৭৬ ও ৭৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَنُوحًا إِذْ نَادَى مِنْ قَبْلُ فَاسْتَجَبْنَا لَهُ فَنَجَّيْنَاهُ وَأَهْلَهُ مِنَ الْكَرْبِ الْعَظِيمِ (76) وَنَصَرْنَاهُ مِنَ الْقَوْمِ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا إِنَّهُمْ كَانُوا قَوْمَ سَوْءٍ فَأَغْرَقْنَاهُمْ أَجْمَعِينَ (77)
এ দুই আয়াতের অর্থ:
“এবং ( হে নবী! স্মরণ করুন) নূহকে, যখন সে ইতোপূর্বে (ইব্রাহিম ও লুত নবীর আগে আমাদের সাহায্যের জন্য) আহ্বান করেছিল তখন আমরা তা মঞ্জুর করেছিলাম। অতঃপর আমরা তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে মহা সংকট হতে উদ্ধার করেছিলাম।” (২১:৭৬)
“এবং আমরা তাঁকে সে সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য করেছিলাম যারা আমাদের নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল; নিশ্চয় তারা ছিল বিভ্রান্ত সম্প্রদায়, ফলে আমরা তাদের সকলকে নিমজ্জিত করেছিলাম।” (২১:৭৭)

হযরত ইব্রাহীম ও লুত (আ.)'র ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার পর মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে লুত (আ.)'র ঘটনা তুলে ধরেছেন। এখানে আল্লাহ বলছেন, দুই মহান নবী হযরত ইব্রাহীম ও লুত (আ.)'র আগে আরেকজন বড় রাসূল হযরত নুহ (আ.)ও এমন কাফেরদের মুখোমুখি হয়েছিলেন যারা সত্যের বিরোধিতায় অনড় ও অবিচল থাকত। তাদেরকে যত সতর্কই করা হত না কেন তাদের মধ্য হতে খুব কম মানুষই উপদেশে কান দিত, বরং নুহ (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে যা-ই বলতেন সেসব কিছুকেই তারা মিথ্যাচার বলে উড়িয়ে দিত এবং বিভ্রান্তির মধ্যেই তারা অবিচল থাকত। তাদের এই গোঁড়ামীর কারণে হযরত নুহ (আ.) ৯৫০ বছর ধরে একত্ববাদী ধর্মের দাওয়াত দেয়া সত্ত্বেও মুষ্টিমেয় সংখ্যক মানুষ তাঁর ও আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল। ফলে তিনি তার জাতির কাফিরদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নাজেল করার আবেদন জানান। ফলে আল্লাহর শাস্তি নেমে এসেছিল তাদের ওপর।

এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার :
১. অতীতের ইতিহাসে পাপীদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। এসব ইতিহাস সতকর্মশীল ও ঈমানদারদের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়।
২. যে সমাজের বেশিরভাগ মানুষ পাপ ও অনাচারে নিমজ্জিত তাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নাজেল হওয়া অনিবার্য। আল্লাহর আজাব বা শাস্তি মানুষেরই কাজের প্রতিফল।

সূরা আম্বিয়ার ৭৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
) وَدَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ إِذْ يَحْكُمَانِ فِي الْحَرْثِ إِذْ نَفَشَتْ فِيهِ غَنَمُ الْقَوْمِ وَكُنَّا لِحُكْمِهِمْ شَاهِدِينَ (78)
এ আয়াতের অর্থ :
“এবং স্মরণ কর দাউদ ও সুলায়মানকে, যখন তারা উভয়ে এক শস্যক্ষেতের ব্যাপারে বিচার করছিল; যেখানে রাত্রিকালে একদল লোকের মেষগুলো (তাতে প্রবেশ করে) ফসল বিনষ্ট করেছিল এবং আমরা তাদের বিচারের সাক্ষী ছিলাম।” (২১:৭৮)

আগের আয়াতের আলোচনায় আমরা পূর্ববর্তী নবীদের কাহিনী শুনেছি। এ আয়াতে হযরত দাউদ (আ.) ও তাঁর পুত্র সোলায়মান (আ.)'র ঘটনা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলছেন: কোনো একটি ঘটনার বিচারের ব্যাপারে তারা ভিন্ন ভিন্ন রায় দিচ্ছিলেন। কিন্তু আল্লাহ হযরত সোলায়মান (আ.)'র মতকে সঠিক বলে ঘোষণা করেছেন।

ঘটনাটি ছিল এরূপ: এক পাল ভেড়া রাতের বেলায় আঙ্গুরের বাগানে ঢুকে আঙ্গুরের পাতা ও আঙ্গুর খেয়ে ফেলে। বাগানের মালিক হযরত দাউদ (আ.)'র কাছে নালিশ করেন। তিনি রায় দেন যে, ভেড়ার পালের মালিককে তার সব ভেড়াগুলো দিয়ে দিতে হবে বাগান মালিকের কাছে যাতে তার বাগানের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু এই মহান নবীর পুত্র হযরত সোলায়মান (আ.) ক্ষতি পূরণের জন্য একটি ভিন্ন প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, যেহেতু ভেড়াগুলো ক্ষেতের ফসল ধ্বংস করেছে, মূল ক্ষেতই ধ্বংস করেনি তাই ভেড়াগুলো দিয়ে দেয়ার পরিবর্তে ভেড়াগুলোর পশম ও কম্বল এক বছর পর্যন্ত বাগানের মালিককে দেয়া উচিত। এভাবে বাগান মালিকের ক্ষতিও পুষিয়ে যাবে এবং ভেড়ার পালের মালিককেও তার পুঁজি স্থায়ীভাবে হারাতে হবে না।
এটা স্পষ্ট যে, এ দুই নবীই ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণের বিচারে দুই ধরনের নীতি গ্রহণ করেছেন। একজন চেয়েছেন তাতক্ষণিক ক্ষতিপূরণ। আর অন্য জন চেয়েছেন পর্যায়ক্রমিক ক্ষতিপূরণ।

এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. জনগণের অধিকার রক্ষা করা এবং ক্ষতিপূরণ দেয়া ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি। কেউ অনিচ্ছাকৃতভাবেও জনগণের ক্ষতি করলে তার ক্ষতি পূরণ করা ন্যায় বিচারের অংশ।
২. কেবল জনগণকে উপদেশ দেয়াই ধর্মীয় নেতাদের দায়িত্ব নয়। সামাজিক সব বিষয়ে জনগণকে দিক-নির্দেশনা দেয়াও তাদের দায়িত্ব।
সূত্রঃ তেহরান রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন