সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৫১-৫৬
সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৫১-৫৬
সূরা আম্বিয়ার ৫১ ও ৫২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَقَدْ آَتَيْنَا إِبْرَاهِيمَ رُشْدَهُ مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا بِهِ عَالِمِينَ (51) إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَا هَذِهِ التَّمَاثِيلُ الَّتِي أَنْتُمْ لَهَا عَاكِفُونَ (52)
“ইতিপূর্বে আমি ইব্রাহীমকে (চিন্তাগত) উতকর্ষ ও পূর্ণতা দান করেছিলাম এবং আমি তার (যোগ্যতা) সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত ছিলাম।” (২১:৫১)
“যখন তিনি তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: এই মূর্তিগুলো কী, যাদের তোমরা পূজারী হয়ে বসে আছ?” (২১:৫২)
আগের আসরে আমরা বলেছি, সূরা আম্বিয়ায় ১৬ জন নবীর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে হযরত ইব্রাহীম (আ.) বিশেষ মর্যাদা ও অবস্থানের অধিকারী। এ সুরার কয়েকটি আয়াতে মূর্তিপূজারীদের সঙ্গে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-র কথোপকথন তুলে ধরা হয়েছে। এ দুই আয়াতের প্রথমেই বলা হয়েছে, হযরত ইব্রাহিম (আ.) যে রেসালাতের দায়িত্ব গ্রহণের যোগ্যতা ও ক্ষমতা রাখেন, তা আল্লাহ ভালোকরেই জানতেন। এ কারণে আল্লাহ তাঁকে উতকর্ষ ও পূর্ণতা লাভ এবং পথ প্রদর্শনের উপায়-উপকরণ দান করেন। ইব্রাহিম (আ.) যে ওই দায়িত্ব পালনের যোগ্য, অল্প বয়সেই তিনি এর প্রমাণ দিয়েছিলেন। কিশোর বয়সেই তিনি মূর্তিপুজার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর স্বগোত্রীয় লোকদের সামনে এ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন যে, তোমরা কেন মূর্তি পুজা করছো? কেন তোমরা রাত-দিন জড় এ বস্তুর সামনে মাথানত করছো? আসলে যিনি অল্প বয়সেই গোত্রের নেতাদের সঙ্গে এমন বিতর্কে জড়াতে পারেন, তিনি যে বয়োপ্রাপ্ত হওয়ার পর মানুষকে অংশিবাদ ও অজ্ঞতা থেকে সত্যের পথে হেদায়াতের মহান দায়িত্বটি সুনিপুণভাবে পালন করতে সক্ষম হবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. সবচেয়ে বড় পাপ হচ্ছে শিরক বা অংশীবাদ। কাজেই ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে সবার আগে এ বিষয়টির ওপর জোর দিতে হবে।
২. মানুষকে সৎ পথে নিয়ে আসার কাজটি নিজের আত্মীয়-পরিজনদের মাধ্যমে শুরু করতে হবে।
৩. যোগ্যতা না থাকলে আল্লাহ কাউকে বিশেষ কোনো দায়িত্ব দেন না এবং অনুগ্রহ দান করেন না।
সূরা আম্বিয়ার ৫৩ ও ৫৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالُوا وَجَدْنَا آَبَاءَنَا لَهَا عَابِدِينَ (53) قَالَ لَقَدْ كُنْتُمْ أَنْتُمْ وَآَبَاؤُكُمْ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ (54)
“(মুশরিকরা এর জবাবে) বলল: আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এদের পূজা করতে দেখেছি।” (২১:৫৩)
“তিনি বললেন, তোমরাও পথভ্রষ্ট এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যেই অবস্থান করছিল।”(২১:৫৪)
ইব্রাহিম (আ.) মুশরিকদের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, তোমরা কেন মূর্তির উপাসনা করছো? তার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি মুশরিকরা। তারা শুধু বললো: এটা আমাদের পূর্বপুরুষদের রীতি। আমরা এ রীতির বাইরে যেতে পারবো না। তাদের পথ থেকে বিচ্যুত হতে পারবো না। কিন্তু তাদের পুর্বপুরুষরা যে তাদের চেয়ে বেশি জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন ও নির্ভুল ছিলেন, তার কোনো প্রমাণ তারা দিতে পারেননি। তাদের এ বক্তব্য ছিল একেবারেই অযৌক্তিক।
এ কারণে হযরত ইব্রাহিম (আ.) মুশরিকদের ওই অযৌক্তিক বক্তব্যের জবাবে বলেছেন, তোমাদের যুক্তি যদি এটাই হয়ে থাকে যে, বাবা-দাদারা এ কাজ করেছে বলেই তোমরাও তাই করবে, তাহলে জেনে রাখ তোমাদের বাপ-দাদারা ভুল পথে ছিল এবং তোমরাও ভুল করছো।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. সন্তানেরা বড়দের কাছ থেকে শেখে। এ কারণে বাপ-দাদাদের ভুল-ভ্রান্তির প্রভাব পড়ে সন্তানদের ওপর। অর্থাত পূর্বপুরুষদের অসদাচরণ পরবর্তী প্রজন্মকে ভুল পথে চলতে উতসাহিত করে।
২. গোত্র ও বংশপ্রীতির কারণে কখনোই খারাপ কাজের ধারা অব্যাহত রাখা যাবে না। পূর্বপুরুষরা ভুল করলে তা সংশোধন করতে হবে। গোঁড়ামি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
৩. ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে দলিল-প্রমাণ থাকতে হবে। পূর্বপুরুষদের প্রচলিত রীতি-নীতি কোনো কিছুর ভিত্তি হতে পারে না।
সূরা আম্বিয়ার ৫৫ ও ৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالُوا أَجِئْتَنَا بِالْحَقِّ أَمْ أَنْتَ مِنَ اللَّاعِبِينَ (55) قَالَ بَل رَبُّكُمْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الَّذِي فَطَرَهُنَّ وَأَنَا عَلَى ذَلِكُمْ مِنَ الشَّاهِدِينَ (56)
“তারা বলল: তুমি কি আমাদের কাছে সত্যসহ আগমন করেছ,না তুমি কৌতুক করছ?” (২১:৫৫)
“তিনি বললেন: না, তিনিই তোমাদের পালনকর্তা যিনি নভোমন্ডল ও ভূমণ্ডলের পালনকর্তা,যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন এবং আমি এই বিষয়েরই সাক্ষ্যদাতা।” (২১:৫৬)
মূর্তির বিরুদ্ধে হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র দৃঢ় অবস্থান ও আচরণের কারণে কিছু মুশরিক প্রশ্ন করলো- ইব্রাহিম কি ঠাট্টাচ্ছলে আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে বিভ্রান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করছে নাকি তার প্রকৃত বিশ্বাসই এ রকম? কারণ তারা বিশ্বাসই করতে পারতো না যে, তাদের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে কেউ এ ধরনের কথা বলতে পারে? কিন্তু হযরত ইব্রাহিম (আ.) তার বিশ্বাসের কথা প্রকাশ্যে বলেছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছিলেন, মানুষ তথা গোটা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা শুধুই একজন। তোমাদের মূর্তিগুলোর এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা নেই।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো:
১. চিন্তাগত বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে বক্তব্য তুলে ধরতে হবে। এর ফলে পথভ্রষ্টরা সত পথে আসতেও পারে।
২. যিনি পৃথিবী ও মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তিনিই তা পরিচালনা করবেন। এমন নয় যে তিনি পৃথিবী সৃষ্টি করে অন্যকে পরিচালনা করে তা অন্যকে পরিচালনা করতে দিয়েছেন।
সূত্রঃ তেহরান রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন