সূরা আম্বিয়া; আয়াত ২৫-২৯
সূরা আম্বিয়া; আয়াত ২৫-২৯
সূরা আম্বিয়ার ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ (25)
এ আয়াতের অর্থ:
“(হে রাসূল!) আমরা আপনার আগে যত রাসূল পাঠিয়েছি তাঁদের প্রত্যেকের কাছে এই ওহি বা প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি যে, আমি ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, সুতরাং আমারই ইবাদাত কর।” (২১:২৫)
আগের আয়াতে আমরা আলোচনা করেছি, বিশ্ব যদি কয়েকজন খোদা দ্বারা সৃষ্ট ও পরিচালিত হত, তাহলে তা বিশৃঙ্খলার শিকার হয়ে ধ্বংস হয়ে যেত। অনুরূপভাবে বলা হয়েছে, সৃষ্টি জগতের মধ্যে নানা বিধান ও শৃঙ্খলার মধ্যে সমন্বয়, মিল বা ঐকতান আল্লাহর একত্ববাদের প্রমাণ তুলে ধরছে। আর এ আয়াতেও আল্লাহ বলছেন: সব নবী-রাসূল মনোনীত হয়েছেন এক আল্লাহর মাধ্যমে। তাঁদের সবারই দায়িত্ব ছিল এক আল্লাহ তায়ালার দিকে তথা একত্ববাদের দিকে দাওয়াত দেয়া এবং তাঁরই ইবাদত করার জন্য আহ্বান জানানো।
হযরত আলী (আ.) তাঁর সন্তান ইমাম হাসান (আ.)-কে বলেছেন: পুত্র আমার! বিশ্বে যদি একাধিক প্রভু থাকত, তাহলে তারাও মানুষের কাছে নবী পাঠাতেন, যাতে জনগণ তাঁদেরকে জানতে পারে ও তাঁদেরকে অনুসরণ করতে পারে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দু’টি দিক হচ্ছে:
১. একত্ববাদের দাওয়াত দেয়া ছিল সব নবী-রাসূলগণের প্রধান কাজ। তাই খৃস্টানদের তিন খোদার প্রতি বিশ্বাস হযরত ঈসা (আ.) এর একত্ববাদের দাওয়াতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
২. ঈমান আমল থেকে আলাদা নয়, যে আল্লাহর ওপর ইমান আনবে সে কিভাবে নামাজ না পড়ে থাকবে ও আল্লাহর ইবাদত ত্যাগ করবে?
সূরা আম্বিয়ার ২৬ ও ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَنُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ بَلْ عِبَادٌ مُكْرَمُونَ (26) لَا يَسْبِقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُمْ بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ (27)
এ দুই আয়াতের অর্থ:
“তারা বলে, অসীম দয়াময় আল্লাহ (ফেরেশতাদেরকে) সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেছেন।” (২১:২৬)
“(অথচ) তিনি পবিত্র, মহামহিম। বরং তারা (ফেরেশতা) তাঁর সম্মানিত বান্দা। তারা কোন বিষয়ে তাঁর (আল্লাহর) অগ্রবর্তী হয় না এবং তারা তাঁর নির্দেশে সব সময়ই কর্মরত।” (২১:২৭)
খ্রিস্টানরা ঈসা(আ.)কে আল্লাহর সন্তান বলে মনে করে। আল্লাহ আগের আয়াতে তাদের অলীক এই ধারণাকে অকাট্য যুক্তি দেখিয়ে নাকচ করে দিয়েছেন। আর এ আয়াতে 'ফেরেশতারা আল্লাহর সন্তান'- মুশরিকদের এই বাতিল বিশ্বাসের ভিত্তিহীনতা তুলে ধরে মহান আল্লাহ বলছেন: “তারা বলত: আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেছে, অথচ সন্তানের বিষয়টি আল্লাহ'র শান বা মর্যাদার সঙ্গে কখনও সঙ্গতিপূর্ণ নয়, আর কথিত সেই সন্তান নবী হোক বা ফেরেশতা, যা-ই হোক না কেন।
আল্লাহ আরো বলছেন: ফেরেশতারাও আল্লাহরই সৃষ্টি, তারা আল্লাহর নির্দেশের অনুগত। তারা কথা ও কাজে আল্লাহর চেয়ে অগ্রবর্তী হয় না। অর্থাত ফেরেশতারা আল্লাহর আগে বেড়ে কথা বলতে পারে না ও কোনো কাজও করতে পারে না নিজ সিদ্ধান্তে। তারা পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর ইবাদত করে।
ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী, ফেরেশতারা পরিপূর্ণ বিবেক ও বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী। তাদের মধ্যে কুপ্রবৃত্তির অস্তিত্ব নেই। তাই তারা আল্লাহর পরিপূর্ণ অনুগত এবং ফেরেশতাদের দ্বারা আল্লাহর নাফরমানি করা সম্ভব নয়।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১. কুফরি কথা শুনলে আল্লাহর গুণাবলী বর্ণনা করে তিনি যে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত তা তুলে ধরতে হবে এবং অবশ্যই সত্যকে প্রকাশ করতে হবে।
২. আল্লাহর সামনে মাথা নত করা ও তাঁর দাসত্ব করাই হল বান্দার জন্য মর্যাদাপূর্ণ।
সূরা আম্বিয়ার ২৮ ও ২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى وَهُمْ مِنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ (28) وَمَنْ يَقُلْ مِنْهُمْ إِنِّي إِلَهٌ مِنْ دُونِهِ فَذَلِكَ نَجْزِيهِ جَهَنَّمَ كَذَلِكَ نَجْزِي الظَّالِمِينَ (29)
“যা তাদের (তথা ফেরেশতাদের) সামনে আছে এবং যা তাদের পেছনে আছে, তার সবই (অর্থাত তাদের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত) তিনি জানেন এবং তারা শুধু তাদের জন্যে সুপারিশ করে, যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং তারা স্বয়ং তাঁর ভয়ে সব সময় শংকিত।” (২১:২৮)
“এবং তাদের মধ্যে যে বলে, নিশ্চয় আল্লাহ ব্যতীত আমিই উপাস্য, তবে এর প্রতিফলে আমরা তাকে জাহান্নাম দান করব এবং এরূপেই আমরা অবিচারকদের প্রতিফল দিয়ে থাকি।” (২১:২৯)
ফেরেশতা সম্পর্কে আগের আয়াতের বক্তব্যের পর এখানে আল্লাহ বলেছেন: যদিও আল্লাহ মানুষের বিষয়সহ বিশ্বজগতের নানা বিষয় পরিচালনা করেন ফেরেশতাদের মাধ্যমে, কিন্তু তারা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী সব কিছু করেন। ফেরেশতারা আল্লাহর আদেশের বিরোধিতার ব্যাপারে সব সময়ই ভীত-সন্ত্রস্ত। কেননা তারা জানে আল্লাহ তাদের অতীত ও ভবিষ্যৎ কাজকর্ম সম্পর্কে অবগত আছেন। তারা আল্লাহর আদেশ ছাড়া কাউকে জান্নাতে নিতে পারে না অথবা কাউকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দিতে পারে না।
মুশরিকদের একটি বিভ্রান্ত বিশ্বাস হল, তারা প্রত্যেক বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রভু গ্রহণ করে থাকে। যেমন বৃষ্টির ও সূর্যের প্রভু। আর এই প্রভুরাই হল ফেরেশতা সম্প্রদায়ের। এ আয়াতে মুশরিকদের এই ভুল বিশ্বাসকে খণ্ডণ করে আল্লাহ বলছেন: যদি কেউ ফেরেশতাদের মধ্য হতে এরূপ দাবি করে, তাহলে তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। তাই তোমরা কিভাবে ফেরেশতাদের সম্পর্কে এমন অপবাদ দিচ্ছ?
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দু’টি দিক হচ্ছে:
১. কেবল নবীগণ নয়, বরং ফেরেশতারাও শাফায়ত করতে পারবেন, অবশ্য যাদের ধর্ম ও আকিদা-বিশ্বাসের ব্যাপারে আল্লাহ সন্তুষ্ট, কেবল তাদের জন্যই ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে শাফায়ত বা মুক্তির সুপারিশে করবেন।
২. ভুল আকিদার প্রতি বিশ্বাস ধর্ম বা দ্বীনের ওপর, স্বয়ং আল্লাহর ওপর এবং নিজের ওপরও জুলুম। এইসব ভুল বিশ্বাস রাসূলের উপরও জুলুম। কেননা রসূল মানুষের হেদায়েতের জন্য অফুরন্ত কষ্ট সহ্য করেছেন।
সূত্রঃ তেহরান রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন