সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৭-১০

সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৭-১০


সূরা আম্বিয়ার সপ্তম ও অষ্টম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمَا أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ (7) وَمَا جَعَلْنَاهُمْ جَسَدًا لَا يَأْكُلُونَ الطَّعَامَ وَمَا كَانُوا خَالِدِينَ (8)

“এবং (হে রাসূল!) আমরা আপনার আগেও কেবল পুরুষদের পাঠিয়েছিলাম যাদের কাছে আমরা ওহি পাঠাতাম বা প্রত্যাদেশ করতাম। (তাই আপনি তাদের বলুন) যদি তোমরা না জান, তবে যারা জানে (তথা যারা আহলে কিতাব) তাদের কাছে জিজ্ঞেস কর।” (২১:৭)
“এবং আমরা তাঁদের এমন দেহ বিশিষ্ট করিনি যে, তাঁরা খাদ্য গ্রহণ করবে না এবং তাঁদের আয়ু চিরস্থায়ীও ছিল না।” (২১:৮)

আগের অনুষ্ঠানগুলোর আলোচনায় আমরা জেনেছি, মক্কার মুশরিকরা ও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র বিরোধীরা তাঁর বিরোধিতায় বিভিন্ন ধরনের অজুহাত দেখাত। যেমন, তারা কখনও বলত : তিনি তো একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি কিছু নন! আর তাঁর বক্তব্যের প্রভাব তো জাদু ছাড়া অন্য কিছু নয়! আবার কখনও তারা বলত: ইসলামের নবী (সা.) ওহি বা প্রত্যাদেশ হিসেবে যা এনেছেন তা আসলে দুঃস্বপ্ন বা বিক্ষিপ্ত ও এলোমেলো স্বপ্ন মাত্র, কিন্তু এই নবী (সা.) সেসবকে সত্য বলে মনে করছেন! আবার কখনও কখনও বলত: তিনি একজন কবি, তাঁর কথা তথা কুরআন কাব্যিক-কল্পনা মাত্র, অথচ তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে নিজ কথাকে আল্লাহর কথা বলে প্রচার করছেন! সবশেষে তারা এটাও বলত যে, তিনি যদি সত্যিই আল্লাহর নবী হয়ে থাকেন তাহলে অতীতের নবীগণের মত তাঁকেও অবশই মুজিযা বা অলৌকিক নিদর্শন দেখাতে হবে।

মক্কার কাফির মুশরিকদের এইসব অজুহাতের কিছু জবাব আগের আলোচনাগুলোতে তুলে ধরা হয়েছে। সেইসব জবাবের ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে বলা হচ্ছে: সব নবী-রাসূলরাই ছিলেন মানুষ। আল্লাহ কখনও কোনো ফেরেশতাকে নবী হিসেবে মনোনীত করেননি। মক্কার কাফির-মুশরিকরা যদি তা না জেনে থাকে তাহলে তারা পূর্ববর্তী নবীদের উম্মত হওয়ার দাবিদার সম্প্রদায়ের জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে এ বিষয়ে জেনে নিক। এর উদ্দেশ্য হল, যাতে তারা এটা বলতে না পারে যে, মানুষের পরিবর্তে ফেরেশতাদেরকে নবী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেই ভাল হত এবং তাদের মানবীয় চাহিদা থাকত না ও তারা চিরকাল বেঁচে থাকতেন

এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. মানুষের এই প্রতিভা ও যোগ্যতা রয়েছে যে তারা মহান আল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করতে এবং আল্লাহর বাণী লাভ করতে সক্ষম। অবশ্য আল্লাহ যাকে চান কেবল তাঁকেই নবী হিসেবে মনোনীত করেন।
২. জ্ঞানী ও অবহিত ব্যক্তিদের কাছে প্রশ্ন করা মানুষের জন্য কুরআনের অন্যতম বড় পরামর্শ।
৩. মানবীয় ও বস্তুগত চাহিদার দিক থেকে নবী-রাসূলদের সঙ্গে অন্য মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। তাঁরাও অন্য মানুষদের মতই মারা যান এবং এ পৃথিবীতে তাঁদের জীবনকাল ছিল সীমিত।

সূরা আম্বিয়ার নয় নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
ثُمَّ صَدَقْنَاهُمُ الْوَعْدَ فَأَنْجَيْنَاهُمْ وَمَنْ نَشَاءُ وَأَهْلَكْنَا الْمُسْرِفِينَ (9)
“অতঃপর আমরা তাদের সাথে কৃত ওয়াদা তথা শত্রুদের পরাজয়ের ও মুমিনদের বিজয়ের ওয়াদাকে সত্য করে দেখালাম এবং তাঁদের ও তাঁদের সাথে আমরা যাদের চেয়েছিলাম (তাদের) রক্ষা করেছিলাম এবং সীমালঙ্ঘনকারীদের ধ্বংস করেছিলাম।” (২১:৯)

এ আয়াতে মুমিনদের সুসংবাদ ও অবিশ্বাসীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে মহান আল্লাহ বলছেন: আমরা নবীদের ওয়াদা দিয়েছিলাম যে তাঁদের শত্রুদের ষড়যন্ত্রগুলো বানচাল করে দেব এবং শত্রুরা যদি গোঁড়ামি অব্যাহত রাখে ও সীমালঙ্ঘন করে তাহলে তাদের ধ্বংস করে দেব। আর আমরা শেষ পর্যন্ত সীমালঙ্ঘনকারী কাফিরদের ধ্বংস করে দিয়েছি। এভাবে আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি পালন করেছি এবং বিশ্বাসী ও সতকর্মশীলদের রক্ষা করেছি।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার :
১. আল্লাহ নবী-রাসূলদের বিজয়ের যে ওয়াদা দিয়েছিলেন তা ছিল অনিবার্য। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, জালিমরা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সত্য সব সময়ই প্রতিষ্ঠিত ও টিকে থাকে।
২. কেবল বস্তুগত বিষয়েই সীমালঙ্ঘন ঘটে তা নয়, যে সত্যের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়ায় সে নিজের ওপরই জুলুম করে এবং সীমালঙ্ঘন করে।

সূরা আম্বিয়ার ১০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
لَقَدْ أَنْزَلْنَا إِلَيْكُمْ كِتَابًا فِيهِ ذِكْرُكُمْ أَفَلَا تَعْقِلُونَ (10)

“নিঃসন্দেহে আমরা তোমাদের কাছে এমন গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি যা তোমাদের (উম্মতে মুহাম্মাদীর) জন্য (সর্বোচ্চ জ্ঞান ও শেষ শরিয়তের) স্মারক বা সতর্ক করার মাধ্যম, তবে কি তোমরা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ কর না?” (২১:১০)

পবিত্র কুরআনকে যারা নবী (সা.)'র কল্পনা বা স্বপ্ন বলে দাবি করত তাদেরকে লক্ষ্য করে এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, কুরআন মানুষকে সচেতন ও সতর্ক করার মাধ্যম এবং তাদের সৌভাগ্য ও প্রশান্তির মাধ্যম। এ মহাগ্রন্থ মানুষকে বিপদ ও ধ্বংসের পথগুলো সম্পর্কে সতর্ক করে। অবশ্য কেবল চিন্তাশীল মানুষই এ মহাগ্রন্থের সতর্কবাণী থেকে শিক্ষা নেয়। যারা মনের লাগামহীন কামনা-বাসনার দাস তারা এইসব সতর্কবাণী থেকে শিক্ষা নেয় না।
কাফির বা অবিশ্বাসীরা পবিত্র কুরআন সম্পর্কে অনেক অযৌক্তিক কথা বলে আসলেও এ ঐশী মহাগ্রন্থ মানুষকে যুক্তি এবং বুদ্ধি-বিবেকের দিকেই আহ্বান জানিয়ে বলছে: কুরআন থেকে উপকৃত হতে হলে বুদ্ধি-বিবেক খাটাতে হবে ও হতে হবে চিন্তাশীল ।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার :
১. কুরআন মানুষকে জাগিয়ে তোলার মাধ্যম। মানুষের জন্য নিজ সত্তাকে ভুলে যাওয়া ও নিজ অস্তিত্বের পুঁজি সম্পর্কে উদাসীন থাকা সবচেয়ে বড় বিপদ। কুরআন মানুষকে অসচেতনতার ঘুম থকে জাগিয়ে তোলে।
২.আল্লাহর নবী-রাসূলদের ও তাঁদের দেয়া মুক্তির শিক্ষাগুলোকে অস্বীকার করা হচ্ছে মূর্খতার লক্ষণ। কারণ,পবিত্র কুরআনের শিক্ষাগুলো মানুষের বিবেকের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
সূত্রঃ তেহরান রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন