ঐতিহাসিক ঈদে গাদীরকে ঈমানের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজ উপলক্ষে গাদীরে খোম নামক স্থানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, সে ভাষণের পর থেকে যারা প্রকৃত মুমিন, যারা আশেকে রাসূল (সা.), আশেকে আহলে বাইত (আ.) তারা প্রতিবছর অত্যন্ত গুরুত্ব ও মহব্বতের সঙ্গে

ঐতিহাসিক ঈদে গাদীরকে ঈমানের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে
প্রতি বছরের ১৮ জিলহজ ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদে গাদীর পালিত হয়। দশম হিজরির এই দিনে বিদায় হজ থেকে ফেরার পথে ‘গাদীর’ নামক স্থানে সুরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াত নাজিল হওয়ার পর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর চাচাতো ভাই ও জামাতা আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)-কে নিজের উত্তরসূরি বা স্থলাভিষিক্ত বলে ঘোষণা করেন। এ দিনটির ইতিহাস, গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে আমরা কথা বলেছি বাংলাদেশের দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দায়রা শরীফের প্রধান খাদেম আলহাজ খাজা শাহ সুফি সাইয়্যেদ নুরী আখতার হুসাইন আহমাদি নুরীর সঙ্গে। তাঁর সাক্ষাতকারটি এখানে উপস্থাপন করা হলো:

শাহ সুফি সাইয়্যেদ নুরী আখতার হুসাইন! আপনি জানেন যে, প্রতি বছর পবিত্র ঈদুল আজহার কয়েকদিন পর ঈদে গাদীর পালন করে বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে,এই ঈদ কি এবং কবে থেকে এ ঈদ চালু হয়?

সাইয়্যেদ নুরী আখতার হুসাইন: বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলিহিল কারিম, আম্মাবাদ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজ উপলক্ষে গাদীরে খোম নামক স্থানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, সে ভাষণের পর থেকে যারা প্রকৃত মুমিন, যারা আশেকে রাসূল (সা.), আশেকে আহলে বাইত (আ.) তারা প্রতিবছর অত্যন্ত গুরুত্ব ও মহব্বতের সঙ্গে ঈদে গাদীর পালন করে আসছেন।

এর কারণ হল- নবী করীম (সা.) শেষবারের মত যখন হজ করে আসেন এবং গাদীরে খোমের নিকটবর্তী রাস্তায় আসেন তখন আল্লাহর তরফ থেকে তাঁর হাবীবের ওপরে ওহী নাজিল হল- যা সূরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এ আয়াত নাজিল হওয়ার পরে নবী করীম (সা.) তাঁর প্রিয় সাহাবী হযরত বেলাল (রা.)কে বললেন: চারদিকে যারা চলে গেছে তাদেরকে ফিরিয়ে আন এবং পেছন দিক থেকে যারা আসছে তাদেরকে এখানে অবস্থান করতে বল কারণ, এখানে আমি ভাষণ দেব। আমার সঙ্গে যে এক লক্ষ বিশ হাজার হাজী হজ করেছে তাদের উদ্দেশে আমি কিছু বলব।

রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী হাজীগণ গাদীরে খোম নামক স্থানে সমবেত হলেন। সেখানে মঞ্চ তৈরি করা হল। সেখানে রাসূলেখোদা দীর্ঘ তিন ঘণ্টা বিশদভাবে তাঁর উম্মতের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন।

এই ভাষণ এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াতে তা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন: "হে রাসূল,পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন,তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।"

নবী করীম (সা.) বিদায় ভাষণের শেষভাগে তাঁর উম্মতদের উদ্দেশ্য বললেন, আমি তোমাদের নিকট দু'টি ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি, একটি হল আল্লাহর কুরআন আর অপরটি হল আমার আহলে বাইত। আহলে বাইত বলতে নবী করীম (সা.)এর আওলাদ অর্থাৎ হযরত মাওলা আলী (আ.) হযরত ফাতেমা (সা.আ.), হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.) এই চারজনকে বোঝায়। নবীজী বলেছেন, "আল্লাহর কুরআন ও আমার আহলে বাইত একে অপর থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হবে না, যারা এই দু'টি জিনিসকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারবে তারা কেয়ামতের দিন হাউজে কাউসারে আমার নিকট পৌঁছে যাবে।"

এ কারণেই গাদীরের যে ঐতিহাসিক ভাষণ তার শেষভাগে তিনি বললেন, আমি কি তোমাদের মাওলা? উপস্থিত সকলেই বললেন, হ্যাঁ আপনিই আমাদের মাওলা অর্থাৎ আপনিই আমাদের অভিভাবক। এ সময় তিনি হযরত আলীর হাত নিজের হাতে ধরে উঁচু করে সবার উদ্দেশ্য বললেন, আমি যার মাওলা, আলী তার মাওলা অর্থাৎ আমি যাদের অভিভাবক, আলী তাদের অভিভাবক।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবীজী গাদীরে খোমে পরবর্তী তিন দিন হাজিদের নিয়ে ছিলেন এবং সকলেই রাসূল (সা.)এর নির্দেশে হযরত আলী (আ.)এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন।

আপনি ঈদে গাদীরের ইতিহাস তুলে ধরলেন। তো মুসলমানদের কাছে এই ঈদের গুরুত্ব কতখানি এবং এ দিনকে ঈদ বা আনন্দের দিন বলা হয় কেন?

সাইয়্যেদ নুরী আখতার হুসাইন: এ দিনটি অত্যন্ত আনন্দের দিন কারণ, নবী করিম (সা.)এর ওপর আল্লাহপাক বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গাদীরের আয়াত নাজিল করেন এবং সে আয়াত অনুযায়ী নবী করীম (সা.) বেলায়েতের ধারাকে অত্যন্ত মহব্বতের সাথে মাওলা আলীর হাতে তুলে দেন। এ কারণে আমি মনে করি, বিশ্ববাসী অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ঈদে গাদীর পালন করে।

আপনি ঈদে গাদীরের গুরুত্ব তুলে ধরলেন। তো এবার আমরা জানতে চাইব-বাংলাদেশে এ ঈদ কীভাবে পালিত হয়? কোথায় কোথায় এ ঈদ বেশি গুরুত্ব দিয়ে পালন করেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা?

শাহ সুফি সাইয়্যেদ নুরী আখতার হুসাইন: বাংলাদেশের মানুষজন অত্যন্ত মহব্বতের সঙ্গে নবী করীম (সা.)এর বিদায় হজের ভাষণকে মূল্যায়ন করে থাকেন। দেশের বিভিন্ন আধ্যাত্মিক দরবার শরীফ ও সুফি সাধকদের মাজার শরীফে বিশেষত রাসূল (সা.)এর যেসব বংশধর এদেশে আছেন তারা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে, মহব্বতের সঙ্গে এবং জাঁকজমকপূর্ণভাবে দিনটি পালন করে থাকেন। সবাই যাতে গুরুত্ব দিয়ে দিনটি পালন করতে পারেন সে ব্যাপারে বিভিন্ন দরবার শরীফ থেকে মানুষকে অবহিত করা হয়।

বাংলাদেশে প্রখ্যাত দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দায়রা শরীফ, কাউসার শরীফ, হযরত শাহ আমজাদ হুজুরের কদমিয়া দরবার শরীফ, ময়মনসিংহের দরবারে উয়াইসিয়া, মানিকগঞ্জের গড়পাড়া দরবার শরীফে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দৌলতবাড়ি দরবার শরীফ, চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে বিশেষত হযরত শাহ আমানত হুজুরের দরবারসহ অগণিত স্থানে গুরুত্বের সঙ্গে দিনটি পালিত হয়ে আসছে।

ঈদে গাদীর উপলক্ষে বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের জন্য আপনার কোনো বক্তব্য আছে কিনা?

সাইয়্যেদ নুরী আখতার হুসাইন: ঈদে গাদীরে খোম সম্পর্কে আমি বাংলাদেশে ভাইদের উদ্দেশ্যে বলব, আপনারা কুরআন এবং সুন্নাহের আলোকে নবী করীম (সা.)-এর বিদায় হজের বাণীকে মূল্যায়ন করুন। যদিও কেউ কেউ বিদায় হজের ভাষণের শেষ কথাটা অর্থাৎ 'দু'টি ভারী বস্তু (আল্লাহর কুরআন ও আহলে বাইত) রেখে যাচ্ছি' এ কথাটা পরিবর্তন করে আহলে বাইতের পরিবর্তে 'সুন্নাহ' বলে থাকেন কিন্তু এটা ঠিক নয়।

বাংলাদেশের ভাইদেরকে আমি বলব, কুরআন-সুন্নাহ ও ইতিহাসের আলোকে ঈদে গাদীরে খোমের এ ঘটনাকে হৃদয়ের গভীরে ঈমানের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহর ইশারায় নবী করীম (সা.) রেসালত থেকে মাওলা আলীকে বেলায়েতের যে ধারা দান করলেন আমরা সকলে যেন তা পালন করতে পারি এবং একই বিশ্বাসে থাকতে পারি-মহান আল্লাহ আমাদের সেই তৌফিক দান করুন।

সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন