ইমাম মাহ্দী (আ.) এর হুকুমতের বৈশিষ্ট সমূহ

ইমাম মাহ্দী (আ.) এর হুকুমতের বৈশিষ্ট সমূহ

ইমাম মাহ্দী (আ.) এর হুকুমতের বৈশিষ্ট সমূহ
বর্তমান যুগে যে বিষয়টি বেশী আলোচিত তা হচ্ছে আখেরুয যামান যার অর্থ হচ্ছে শেষ যুগ। এখন কথা হচ্ছে শেষ যুগ কখন শুরু হবে। কোন কোন স্থানে বলা হচ্ছে রাসুল (সা.) এর যুগ থেকে মানব সমাজ এক নতুন যুগে পদার্পণ করে যাকে আখেরুয যামান বলা হয়েছে, আবার অনেকের মতে ইমাম মাহদী (আ.) এর যুগ থেকে আখেরুয যামান শুরু হয়েছে।
একদা রাসুল (সা.) সালমান (রা.) কে আখেরুয যামান সম্পর্কে কিছু কথা বলেন তখন তিনি বলেন যে, ইয়া রাসুল (সা.) কি সত্যিই সেই যুগের অবস্থা এমন হবে। রাসুল (সা.) এর বর্ণিত সেই আখেরুয যামান এর কি বৈশিষ্ট হতে পারে? প্রায় প্রত্যেকটি ধর্মে এমন কেউ রয়েছে যার প্রতি তাদের বিশ্বাস যে তিনি দুনিয়ার বুকে আসবেন এবং দুনিয়াকে অপরাধ মুক্ত করবেন এবং মুসলমানদের মধ্যে সেই ব্যাক্তি হচ্ছে ইমাম মাহদী (আ.) যাকে আখেরুয যামান ও বলা হয়ে থাকে।
বর্তমানে আমরা যে যুগে বসবাস করছি সেই যুগকে আধুনিক যুগ বলা হয়। এই যুগের খলিফারও কিছু বৈশিষ্ট রয়েছেঃ
১- খোদার নির্বাচিত খলিফা হচ্ছে হাকেম, যার মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট অবশ্যই থাকতে হবেঃ
- খোদা প্রদত্ত ঐশী জ্ঞান ইমামের কাছে থাকবে।
- ইমাম হবেন মাসুম তিনি হবেন সকল প্রকারের গুনাহ থেকে মুক্ত।
- অন্যান্যদের তুলনায় বিভিন্ন গুণে তিনি গুনান্বিত হবেন।
যখন ইমাম মাহদী (আ.) এর অবির্ভাব ঘটবে তখন সবাই তাঁর খোদায়ী কার্যকলাপ দেখে স্বেচ্ছায় দ্বীনে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং নিজেদের ঈমানকে পূর্ণতা দান করবে। ইমাম মাহদী (আ.) এর আবির্ভাবের পরে হজরত ঈসা (আ.) আসবেন, তখন খৃষ্টানরা তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তিনি বলবেন যে, আমি উম্মতে মোহাম্মাদীর একজন সদস্য তখন আবার সবাই দ্বীনে ইসলামের প্রতি ঈমান নিয়ে আসবে এবং এভাবে দলে দলে মানুষেরা খোদা এবং তার রাসুল (সা.) এবং খোদার নির্বাচিত ইমামের (আ.) প্রতি ঈমান নিয়ে আসবে। তখন মুশরিকদের জন্য বিষয়টি হুমকির কারণ হয়ে দাড়াবে এবং তারা ইমাম (আ.) এর সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে এবং ইমাম (আ.) তাদের সাথে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ করবেন। আমার যদি কোরআনের আয়াতের প্রতি দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখতে পাব যে, খোদা কোরআনে বলেছেনঃ
هُوَ الَّذِى أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى‏ وَ دِينِ الْحَقّ‏ِ لِيُظْهِرَهُ عَلىَ الدِّينِ كُلِّهِ وَ لَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُون
তিনিই প্রেরণ করেছেন আপন রাসুলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে যেন এ দ্বীনকে অপরাপর দ্বীনের উপরে জয়যুক্ত করেন যদিও মুশরিকরা তা অপ্রীতিকর বলে মনে করে। সূরা তওবা- ৩৩।
উক্ত আয়াত থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট তা হচ্ছে, যখন রাসুল (সা.) বা তাঁর নির্বাচিত খলিফা দুনিয়ার বুকে দ্বীনে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবে তখন একদল লোক তার দ্বীনের তাবলিগের কাজে বাধা দান করবে, আর তারা হচ্ছে মুশরিক।
২- ইমাম মাহদী (আ.) পৃথিবীকে ন্যায়বিচারে পূর্ণ করে দিবেন যেমনভাবে মেঘ ও কালো পর্দা সরে যাওয়ার পর বিশ্বের সূর্য তাঁর চেহারা উম্মচোন করে অনুরূপভাবে তিনিও গোটা বিশ্বকে তাঁর জ্যোতিতে আলোকিত করবেন৷ হ্যাঁ, অন্যায় ও ফ্যাসাদের সাথে সংগ্রাম করার পর ন্যায় বিচারের হুকুমতের পালা আসবে৷ তখন ন্যায়বিচার হুকুমতের আসনে উপবিষ্ট হবেন এবং প্রতিটি জিনিসকে তার উপযুক্ত স্থানে স্থান দান করবেন ও প্রত্যেকের অধিকারেকে ন্যায়ের ভিত্তিতে বন্টন করবেন৷
মোটকথা পৃথিবী ও তার অধিবাসীরা সত্য ও ন্যায়পরায়ন হুকুমত দেখতে পাবে এবং সেখানে কারো প্রতি সামান্যত মজুলুম করা হবে না৷ সে হুকুমতে থাকবে ঐশী সৌন্দর্য এবং তার ছায়াতলে মানুষ তার সকল অধিকার খুঁজে পাবে৷
এ অধ্যায়ে আমরা চারটি প্রসঙ্গে আলোচনা করব:
১- ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বিশ্বজনীন হুকুমতের উদ্দেশ্য সমূহ৷
২- বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের কার্যক্রম সমূহ৷
৩- ঐশী ন্যায়পরায়ন হুকুমতের সাফল্য ও অবদান সমূহ৷
৪- ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের বৈশিষ্ট্য সমূহ৷

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বিশ্বজনীন হুকুমতের উদ্দেশ্য সমূহঃ
সমগ্র সৃষ্টির উদ্দেশ্য যেহেতু পূর্ণতায় পৌছানো এবং আল্লাহর নৈকট্যলাভ আর এ মহান উদ্দেশ্যে পৌছানোর জন্য প্রয়োজন তার সরঞ্জাম প্রস্তুত করা৷ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বিশ্বজনীন হুকুমতের উদ্দেশ্য হচেছ আল্লাহর নৈকট্য লাভ এবং তাতে উপণীত হতে সকল প্রতিকুলতাকে অপসারণ করা৷
মানুষ যেহেতু শরীর ও আত্মা দিয়ে তৈরী কাজেই তার প্রয়োজনও, পার্থিব ও আধ্যাত্মিক দুই ভাগে বিভক্ত৷ সুতরাং পূর্ণতায় পৌছানোর জন্য দুদিকেই সমানভাবে অগ্রসর হতে হবে৷ ন্যায়পরায়ণতা যেহেতু ঐশী হুকুমতের মূলমন্ত্র কাজেই তা মানুষের দুদিকেই উন্নত করার জামানত দিতে পারে৷
সুতরাং ইমাম মাহ্দী(আ.)-এর বিশ্বজনীন হুকুমতের উদ্দেশ্য হচেছ মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও তার প্রসার৷
ক) – আধ্যাত্মিক উন্নতি
উপরোক্ত উদ্দেশ্য সমূহের গুরুত্ব ও মর্যাদাকে উপলব্ধি করার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই তাগুতি হুকুমত সমূহের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে৷
মানুষের জীবনে ঐশী হুকুমত ব্যতীত, আধ্যাত্মিকতা এবং আধ্যাত্মিক মর্যাদা কোন অবস্থানে ছিল? এমনটাই নয় কি যে, মানবতা লোপ পেয়েছিল, সর্বদা মানুষ অসৎ পথে চলত, নফসের তাড়নায় এবং শয়তানের প্ররচনায় জীবনের সকল মর্যাদাকে ভুলে গিয়ে মানুষ তাদের সকল ইতিবাচক গুনকে নিজের হাতে কামনা-বাসনার গোরস্থানে দাফন করে রেখেছিল? পবিত্রতা, শালিনতা, সত্যবাদিতা, সৎকর্ম, সাহয্য-সহযোগিতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, দানশীলতা ও বদান্নতার স্থানে ছিল নফসের তাড়না, কামনা-বাসনা, মিথ্যাচার, স্বার্থপরতা ও সুযোগ সন্ধান, খিয়ানত, পাপাচার এবং উচচা ভিলাস৷ মোটকথা তাগুতি হুকুমতকালীন সময়ে মানুষের জীবনে আধ্যাত্মিকতা তার শেষ প্ররহর গুনছিল এবং এমনকি কিছু কিছূ স্থানে ও কিছু কিছূ মানুষের ক্ষেত্রে তার(আধ্যাত্মিকতার) কোন অস্থিত্বই ছিল না৷
ইমাম মাহদী (আ.)-এর বিশ্বজনীন হুকুমতে মানুষের জীবনের এ অধ্যায়কে জীবিত এবং তাতে প্রাণ সঞ্চার করার জন্য চেষ্টা করা হবে৷ এর মাধ্যমে প্রকৃত জীবনের মিষ্টি স্বাদ মানুষকে আস্বাদন করাবেন এবং সকলকে স্মরণ করিয়ে দিবেন যে, প্রথম থেকেই তাদেরকে এমন পবিত্রতাকে অনুভব করার কথা ছিল৷
﴿يَأَيهَا الّذينَ أَمَنوا اسْتَجيبوا لِلّهِ وَ لِلرّسولِ إِذا ذَعاكُمْ لِما يُحْييكُمْ﴾
হে মুমিনগণ! রাসূল যখন তোমাদেরকে এমন কিছুর দিকে আহবান করে যা তোমাদেরকে প্রাণবন্ত করে, তখন আল্লাহ ও রাসূলের আহবানে সাড়া দিবে (সূরা আনফাল আয়াত নং ২৪)৷
মানুষের আত্মিক দিকটা যেহেতু তাদেরকে অন্যান্য পশুদের থেকে পৃথক করে সুতরাং তা মানুষের বৃহদাংশ তথা প্রধান অংশকে গঠন করে৷ কেননা, মানুষ আত্মার অধিকারী হওয়ার কারণেই মানুষ হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছে এবং এদিকটাই তাকে আল্লাহর নৈকট্যলাভে সাহায্য করে থাকে৷
এ কারণেই আল্লাহর ওয়ালীর হুকুমতে মানুষের অস্তিত্বের এ দিকটিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে এবং আত্মিক মর্যাদাও মানবীয় গুনাবলী জীবনের প্রতিটি দিকে প্রাধান্য পাবে৷ আন্তরিকতা, আত্মত্যাগ, সত্যবাদিতা এবং সকল উত্তম গুনাবলী সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে৷
তবে এ উদ্দেশ্যে পৌঁছানোর জন্য একটি গঠনমূলক কর্মসূচীর প্রয়োজন রয়েছে যা পরবর্তীতে বর্ণিত হবে৷
খ) – ন্যায়পরায়ণতার প্রসার
যুগ যুগ ধরে মানুষের উপর যে বড় ধরনের অপরাধটি সংঘটিত হচেছ তা হল জুলুম ও অত্যাচার৷ মানুষ সর্বদা তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং মানুষের পার্থিব ও আত্মিক অধিকার কখনোই ন্যায়ের ভিত্তিতে বন্টিত হয় নি৷ সর্বদা ভরা পেটদের পাশাপাশি খালি পেটদেরকে (ক্ষুধাদর্থদেরকে) দেখা গেছে এবং বড় বড় প্রাসাদ ও অট্টালিকার পাশাপাশি শত-সহস্র মানুষকে পথে-ঘাটে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে৷ শক্তিশালী ও বিত্তশালীরা দূর্বলদেরকে দাস হিসাবে ব্যবহার করেছে৷ কৃষ্ণাঙ্গরা শেতাঙ্গদের কাছে অত্যাচারিত হয়েছে৷ মোটকথা সর্বদা ও সর্বত্র দূর্বলদের অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে এবং জালেমরা তাদের অসাধু চাহিদাকে চরিতার্থ করেছে৷ মানুষ সর্বদা ন্যায়পরায়ণতা ও সাম্যের জন্য প্রহর গুনেছে এবং ন্যায়বিচার সম্পন্ন হুকুমতের জন্য অধির আগ্রহে প্রতীক্ষা করেছে৷
এই প্রতীক্ষার শেষ হচেছ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ন্যায়পরায়ণ শাসনব্যাবস্থা৷ তিনি মহান ন্যায়পরায়ণ নেতা হিসাবেসারা বিশ্বে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন৷ বিভিন্ন রেওয়ায়াতও সে সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে৷
ইমাম হুসাইন (আ.) বলেছেন: যদি মহাপ্রলয়ের মাত্র একটি দিনও অবশিষ্ট থাকে আল্লাহ তায়ালা সে দিনকে এত বেশী দীর্ঘায়ীত করবেন যে, আমার বংশ থেকে একজন আবির্ভূত হবে এবং পৃথিবী যেমনঃ অন্যায়-অত্যাচারে ভরে গিয়েছিল তেমনিভাবে ন্যায়নীতিতে ভরে তুলবেন৷ রাসূল(সা.)-এর কাছে আমি এমনটি শুনেছি (কামালুদ্দিন, খণ্ড-১, বাব ৩০, হাঃ ৪ এবং৫৮৪)৷
এ ধরনের আরও বহু রেওয়ায়াত রয়েছে যেখানে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের ছায়াতলে বিশ্বজনীন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাও অত্যাচারকে নির্মূল করার সংবাদ দেওয়া হয়েছে৷
এটা জানা প্রয়োজন যে, ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ন্যায়পরায়ণতার বৈশিষ্ট্যটি এত বেশী স্পষ্ট যে, কিছু দোয়াতেও তাঁকে ওই উপাধিতে ভুষিত করা হয়েছে:
اللهم و صلی علی ولی امرک القائم المومل والعدل المنتظر
হে আল্লাহ আপনার ওয়ালী আমরের উপর দরুদ পাঠ করুন যিনি আদর্শ সংগ্রাম করবেন এবং সবার প্রতীক্ষিত ন্যায়বিচার (মাফাতীহ্ আল জিনান দোয়ায়ে ইফতিতাহ্)৷
হ্যাঁ তিনি ন্যায়বিচারকে তাঁর বিপ্লবের মূলমন্ত্র করেছেন৷ কেননা, ন্যায়বিচার হচেছ মানুষের ব্যক্তিগত ওসামাজিক জীবনের প্রাণ এবং ন্যায়পরায়ণতা ব্যতীত পৃথিবী ও তার অধিবাসীরা প্রাণহীন মানুষ যাদেরকে কেবল জীবিত মনে করা হয়ে থাকে৷
ইমাম কাযিম (আ.)নিম্নলিখিত আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে বলেছেন:
﴿اعْلَموا أَنّ اللّهَ يُحْيِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِها قَدْ بَيّنَا لَكُمُ الْأَيَتِ لَعَلّكُمْ تَعْقِلونَ﴾
এ আয়াতের অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ জমিনকে পানি দিয়ে জীবিত করেন বরং তিনি এমন ধরনের মহাপুরুষদেরকে (এখানে মহাপূরুষ বলতে ইমাম মাহদী (আ.) ও তাঁর সাথীদেরকে বোঝানো হয়েছে৷ তাফসীরে বোরহান, খণ্ড- ৭, পৃ.-৪৪৬) প্রেরণ করেন যারা ন্যায়পরায়ণ তাকে জীবিত করেন৷ অতঃপর (সমাজে)ন্যায়বিচার জীবিত হওয়ার মাধ্যমে জমিন জীবিত হয়৷
জমিন জীবিত হওয়া বলতে বোঝানো হয়েছে যে, ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ন্যায়বিচার হচেছ সর্বজনীন ন্যায়বিচার যা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়৷
বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের কার্যক্রমসমূহ
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সংগ্রামী উদ্দেশ্যের সাথে পরিচিত হওয়ার পর এই উদ্দেশ্যে উপণীত হওয়ার জন্য তার কার্যক্রমসমূহ নিয়ে আলোচনার পালা আসে৷ আর এর মাধ্যমেই আবির্ভাবের মুহুর্তের কর্মসূচীর পরিচিতি পেলেই আবির্ভাবের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত কি করা প্রয়োজন তার আর্দশগ্রহণ করা সম্ভব৷ এভাবে যারা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রতীক্ষায় রয়েছে তারা তাঁর প্রশাসনিক কর্মসূচীর সাথে পরিচিত হতে পারবে এবং নিজেদেরকে ও সমাজকে সে পথে অগ্রসরীত হতে প্রস্তুত করবে৷
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমত সম্পর্কে যে সকল রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে তা থেকে বোঝা যায় যে, তাঁর হুকুমতের প্রধান তিনটি কর্মসূচী রয়েছে এবং তা হচেছ: সাংস্কৃতিক কর্মসূচী, সামাজিক কর্মসূচীএবং অর্থনৈতিক কর্মসূচী৷
অন্য কথায় বলতে গেলে মনুষ্য সমাজ যেহেতু কোরআন ও আহলে বাইতের আদর্শ থেকে পিছিয়ে পড়েছে সুতরাং একটি বড় ধরনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়োজন রয়েছে যার মাধ্যমে মানুষ কোরআন ও ইতরাতের (আহলে বাইত) কোলে ফিরে আসবে৷
অনুরূপভাবে একটি পরিপূর্ণ সামাজিক কর্মসূচী এ জন্য প্রয়োজন যে, সমাজে এমন একটি সঠিক সমাজ ব্যবস্থার দরকার যার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি মানুষ তার নিজেস্ব অধিকার প্রাপ্ত হবে৷ কেননা, এত দিন ধরে যে অন্যায় ও অবিচার চলে আসছে অর্থাৎ ঐশী অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে এবং জালেমী পদ্ধতি সমাজকে নিষ্ঠুর পর্যায়ে নিয়ে গেছে একটি ন্যায় ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাই তা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে৷
একটি আদর্শ সভ্য সমাজ গড়ে তোলার জন্য একটি সুষ্ট অর্থনৈতিক কর্মসূচীরও প্রয়োজন রয়েছে৷ যার মাধ্যমে পার্থিব সকল সুযোগ-সুবিধা সমভাবে সবার মধ্যে বন্টিত হবে৷ অন্য কথায় এমন একটি গঠনমূলক অর্থব্যবস্থার প্রয়োজন যার মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত পার্থিব সকল সুযোগ-সুবিধা সমভাবে সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বন্টিত হবে৷
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সমাজিক কর্মসূচীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনার পর পবিত্র ইমাম (আ.)-গণের রেওয়ায়েত অনুসারে তার ব্যাখ্যা দান করা হল:
(ক)- সাংষ্কৃতিক কর্মসূচী:
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বিশ্বজনীন শাসন ব্যাবস্থায় সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মানুষেরজ্ঞান ও আমল বৃদ্ধির পথে অনুষ্ঠিত হবে এবং মুর্খতার সাথে সার্বিকভাবে মোকাবেলা করাহবে৷
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ন্যায়নিষ্ঠ শাসনব্যাবস্থার প্রধান প্রধান সাংস্কৃতিক কর্মসূচী হচেছ:
১- কোরআন ও সুন্নতজীবন্তকরণ:
যুগ যুগ ধরে যখন কোরআন বঞ্চিত ও একাকি হয়ে পড়েছে এবং জীবন পাতার এক কোণে ফেলে রেখেছিল এবং সকলেই তাকে ভুলে গিয়েছিল; আল্লাহর শেষ হুজ্জাতের হুকুমতের সময়ে কোরআনের শিক্ষা মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রবেশ করবে৷ সুন্নত যা হচেছ মাসুমদের বাণী, কার্যকলাপ এবং তাকরির, তা সর্বত্র উত্তম আদর্শ হিসাবে মানুষের জীবনে স্থানপাবে এবং সবার আচরণও কোরআন ও হাদীসের আলোকে পরিমাপ করা হবে৷
ইমাম আলী (আ.) ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কোরআনী হুকুমতকে স্পষ্ট ভাষায় এভাবে বর্ণনা করেছেন: যখন মানুষের নফস হুকুমত করবে তখন (ইমাম মাহ্দী আবির্ভূত হবেন) এবং হেদায়াত ও সাফল্যকে নফসের স্থলাভিষিক্ত করবেন৷ যেখানে ব্যক্তির মতকে কোরআনের উপর প্রাধান্য দেওয়া হত তা পরিবর্তন হয়ে কোরআনকে সমাজের উপর হাকেম করা হবে (নাহজুল বালাগা খোতবা ১৩৮)৷
তিনি অন্যত্র আরো বলেছেন: আমি আমার শিয়াদেরকে দেখতে পাচিছ যে, কুফার মসজিদে তাবু বানিয়ে কোরআন যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছিল সেভাবে জনগণকে শিক্ষা দিচেছ (গাইবাতে নোমানি বাব ২১, হাঃ ৩, পৃ.-৩৩৩)৷
কোরআন শেখা এবং শিক্ষা দেওয়া কোরআনের সাংস্কৃতির প্রসার ও সমাজের সর্বস্তরে কোরআনের কতৃত্বের পরিচায়ক৷
২- মারেফাত ও আখলাকের প্রসার : পবিত্র কোরআন ও আহলে বাইতের শিক্ষাতে মানুষের চারিত্রিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে৷ কেননা, মানুষের উদ্দেশ্যের পথে অগ্রগতি ও উন্নতির মূলমন্ত্র হচেছ তার উত্তম চরিত্র৷ রাসূল (সা.) নিজেও তাঁর নবুয়্যতের উদ্দেশ্যকে চারিত্রিক গুনাবলীকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছানো বুঝিয়েছেন (রাসূল(সা.) বলেছেন:
انمابعثتلاتمممکارمالاخلاق
নিঃসন্দেহে আমি চারিত্রিক গুনাবলীকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছানোর জন্য প্রেরিত হয়েছি৷ মিযানুল হিকমা খণ্ড- ৪, পৃ.-১৫৩০) পবিত্র কোরআনও রাসূল (সা.)-কে সবার জন্য উত্তম আদর্শ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে
(لقدکانلکمفیرسولاللهاسوةحسنة
সূরা আহযাব আয়াত নং ২১) কিন্তু অত্যান্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, মানুষ কোরআন ও আহলে বাইত থেকে দূরে সরে গিয়ে নষ্টামির নোংরা জ্বলে হাবুডুবু খাচেছ৷ আর এই চারিত্রিক অবক্ষয়ই ব্যক্তি ও সমাজের পতনের মূল৷
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর শাসন ব্যাবস্থায় যা কিনা ঐশী ও আদর্শ হুকুমত সেখানে চারিত্রিক গুনাবলীর প্রসার সবকিছুর উপর প্রাধান্য পাবে৷
ইমাম বাকের (আ.)বলেছেন:
اذا قام قائمنا وضع يده علی رووس العباد فجمع به عقولهم و اکمل به اخلاقهم
যখন আমাদের কায়েম কিয়াম করবেন তখন তাঁর পবিত্র হাতকে মানুষের মাথায় বুলাবেন এবং তাদের বিবেককে একত্রিত করবেন ও তাদের চরিত্রকে পরিপূর্ণ করবেন (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড- ৫২, পৃ.-৩৩৬)৷
এই সুন্দর উপমা থেকে বোঝা যায় যে, ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের মাধ্যমে যা কিনা চারিত্রিক ও আধ্যাত্মিক হুকুমত সেখানে মানুষের বিবেক ও চরিত্রের পূর্ণতার ব্যাবস্থা থাকবে৷ কেননা, যেহেতু মানুষের খারাপ চরিত্র তার খারাপ ও ভণ্ড মানষিকতার ফল, অনুরূপভাবে মানুষের সুন্দর ও আদর্শ চরিত্রও তার সুস্থ মস্তিষ্কের ফল৷
অন্যদিকে কোরআনের হেদায়েতপূর্ণ ঐশী পরিবেশ মাপনুষকে সৎকর্মের দিকে পরিচালিত করে৷ সুতরাং মানুষকে ভিতর ও বাহির থেকে শুধু সুন্দর্যের দিকে পরিচালিত করে আর এভাবেই গোটা বিশ্ব, মানবিকও ঐশী গুনাবলীতে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে৷
৩- জ্ঞানের প্রসার: ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের অপর সাংস্কৃতিক কর্মসূচী হচেছ জ্ঞানের বিপ্লব৷ ইমাম মাহ্দী (আ.) তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম (ইমাম আলী (আ) বলেছেন: তার জ্ঞান তোমাদের সবার চেয়ে বেশী৷ গাইবাতে নোমানি, বাব ১৩, হাঃ ১)৷ তাঁর সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটবে৷
রাসূল (সা.) ইমাম মাহ্দী(আ.)-এর আগমনের সুসংবাদ দেওয়ার সাথে সাথে এটাও বলেছেন:
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর নবম সন্তান হচ্ছেন ইমাম মাহ্দী৷ সমগ্র বিশ্ব অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা তাঁর মাধ্যমে পুনরায় সমগ্র বিশ্বকে আলোকিত করবেন৷ অন্যায়-অত্যাচারে পূর্ণ হওয়ার পর তিনি তা ন্যায়নীতিতে পূর্ণ করবেন৷ অনুরূপভাবে সমগ্র বিশ্ব অজ্ঞতায় পূর্ণহওয়ার পর তিনি তাকে জ্ঞানের আলোতে আলোকিত করবেন (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড- ৩৬, পৃ.-২৫৩৷কামালুদ্দিন খণ্ড- ১, বাব ২৪,হাঃ ৫, পৃ.-৪৮৭)৷
এই জ্ঞানের বিপ্লব সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য, সেখানে নারী-পুরুষের কোন ভেদাভেদ থাকবে না৷ বরং নারীরাও দ্বীনি শিক্ষার চরম শিখরে পৌঁছবে৷
ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন: ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের সময়ে তোমাদেরকে জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হবে এবং এমনকি নারীরা ঘরে বসে কিতাব ও সুন্নত অনুসারে বিচার করবে (গাইবাতে নোমানি ২৩৯৷ বিহারুলআনওয়ার খণ্ড- ৫২, পৃ.-৩৫২)৷
এটা থেকে প্রমাণ হয় যে, সে সময়ে তারা কোরআনের আয়াত ও আহলে বাইতের রেওয়ায়াত সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করবে৷ কেননা, বিচার করা একটি অতি কঠিন কাজ৷
৪-বিদয়াতয়ের সাথে সংগ্রাম: বিদয়াত হচেছ সুন্নতের বিপরীত যার অর্থ দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু প্রবেশ করানো৷ অনুরূপভাবে ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনাকে দ্বীনের মধ্যে প্রবেশ করানো৷
ইমাম আলী (আ.)বিদয়াতকারীদের সম্পর্কে বলেছেন: বিদয়াতকারী তারা যারা আল্লাহ ও তাঁর কিতাবের নির্দেশ অমান্য করে এবং তাঁর রাসূল (সা.)-এর বিরোধিতা করে৷ তারা নিজেদের নফসের তাড়নায় চলে যদিও তাদের সংখ্যা অধিক হোক না কেন (মিযানুল হিকমা হাঃ১৬৩২)৷
সুতরাং বিদয়াত হচেছ আল্লাহ, কোরআন ও রাসূলের বিরোধিতা করা এবং নফসের তাড়নায় ব্যক্তি কেন্দ্রিকভাবে চলা৷ তবে কোরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে নতুন কিছু বের করার সাথে বিদয়াতের অনেক পার্থক্যরয়েছে৷ বিদয়াত আল্লাহর বিধান ও রাসূলের সুন্নতকে ধবংস করে এবং কোন কিছুই বিদয়াতের ন্যায় ইসলামকে ক্ষতি করে না৷
হযরত আলী (আ.)বলেছেন:
ما هدم الدين مثل البدع
কোন কিছুই বিদয়াতের ন্যায় দ্বীনকে ধবংস করে না (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড- ৭৮, পৃ.-৯১)৷
এ কারণেই দ্বীনদারদেরকে বিদয়াতকারীদের সাথে লড়তে হবে এবং তাদের ধোকার পর্দা উম্মোচন করতে হবে৷ তাদের অসৎপথকে মানুষকে দেখিয়ে দিতে হবে এবং এভাবেই জনগণকে গোমরাহি থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব৷
রাসূল (সা.) বলেছেন: যখন উম্মতের মধ্যে বিদয়াত প্রকাশ পাবে তখন আলেমদের কর্তব্য হচেছ তাদের জ্ঞানের প্রকাশ ঘটানো৷ যদি কেউ এমনটি না করে তাহলে তার উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হবে (মিযানুল হিকমাহাঃ ১৬৪৯)৷
পরিতাপের সাথে বলতে হয় যে, রাসূল (সা.)-এর পর তাঁর সস্পষ্ট পথ থাকার পরও কত ধরনের বিদয়াত যে দ্বীনের মধ্যে প্রবেশ করেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না! এভাবে তারা দ্বীনের সঠিক চেহারাকে পাল্টে দিয়েছে, ইসলামের উজ্জল চেহারাকে নফসের কালো কাপড়ে ঢেকে ফেলেছে৷ যদিও পবিত্র ইমামরাও পরবর্তীতে আলেমরা অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু তার পরও বিদয়াত থেকে গেছে এবং তা অদৃশ্যকালীন সময়ে আরও বেশী বেড়ে গেছে৷
বর্তমানে বিশ্ব অপেক্ষায় আছে যে, বিশ্বমানবের মুক্তিদাতা তথা প্রতিশ্রুতি মাহদী আসবেন ও তাঁর হুকুমতের ছায়তলে সুন্নতসমূহ জীবিত হবে এবং বিদয়াত সমূহ বিতাড়িত হবে৷ নিঃসন্দেহে ইমাম মাহদী (আ.) বিদয়াত ও সকল গোমরাহির সাথে সংগ্রাম করবেন এবং হেদায়াতের পথকে সবার জন্য প্রস্তুত করবেন৷
ইমাম বাকের (আ.)বলেছেন:
ولا يترک بدعة الا ازالها و لا سنة الا اقامها
তিনি সকল বিদয়াতকে উৎখাত করবেন এবং সকল সুন্নতকে প্রতিষ্ঠিত করবেন (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড- ৫৮, হাঃ ১১, পৃ.-১১)৷
(খ)- অর্থনৈতিক কর্মসূচী: একটি সুস্থ সমাজের পরিচয় হচেছ তার সুস্থ অর্থব্যবস্থা৷ যদি দেশের সকল সম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় এবং তা একটি বিশেষ গোষ্ঠির হাতে সীমাবদ্ধ না থাকে বরংসরকার দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের উপর দৃষ্টি রাখে ও সবার জন্য সম্পদের এ উৎস থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ করে দেয় তাহলে এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে যেখানে আধ্যাত্মিক উন্নতির সুযোগও বেশী হবে৷ পবিত্র কোরআন ও মাসুমগণের হাদীসেও অর্থনৈতিক দিক ও মানুষের জীবনের উন্নতির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে৷ সুতরাং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কোরআনী হুকুমতে বিশ্বের অর্থ ব্যবস্থা ও মানুষের জন্য গঠনমূলক কর্মসূচীগ্রহণ করা হয়েছে৷ যার মাধ্যমে
প্রথমত: উৎপাদন খাত পরিপূর্ণতা পাবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার হবে৷
দ্বিতীয়ত: অর্জিত অর্থ ও সম্পদ সবার মধ্যে শ্রেণী নির্বিশেষে সমভাবে বন্টিত হবে৷
(গ)- সামাজিক কর্মসূচী: সমাজের উচছৃপখল ও দুস্কৃতিকারীদের সাথে আচরণের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে৷ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ন্যায়পরায়ণ হুকুমতে সুশিল সমাজ গঠনের জন্য কোরআন ও আহলে বাইতের নির্দেশ মোতাবেক কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে৷ আর তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের জীবন প্রণালী আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য প্রস্তুত হবে৷ যে বিশ্ব ঐশী হুকুমতের আয়ত্বে থাকবে সেখানে সৎকর্মের বিকাশ ঘটবে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবহার করা হবে৷ সেখানে সবার অধিকারকে সমানভাবে প্রদান করা হবে এবং সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা প্রকৃতার্থে বাস্তবায়িত হবে৷
এখন এ বিষয়টিকে আমরারেওয়ায়াতের আলোকে পর্যবেক্ষণ করব:
১- ন্যায় কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধের প্রসার: ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতে ন্যায় কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধ বিশেষভাবে প্রসার লাভ করবে৷ এ ওয়াজিব সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে:
﴿كُنْتُمْ خَيْرَ أُمّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَاسِ تَأْمُرونَ بِالْمَعْروفِ وَ تَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَ تُؤْمِنونَ بِاللّهِ﴾
তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত; মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে৷ তোমরা সৎকার্যের নির্দেশ দান কর, অসৎ কার্যে নিষেধ কর এবং আল্লাহে বিশ্বাস কর (সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ১১০)৷
এর মাধ্যমে আল্লাহর সকল ওয়াজিব প্রতিষ্ঠিত হবে (এই ওয়াজিব সম্পর্কে ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন: ন্যায় কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধ এমন একটি ওয়াজিব যার মাধ্যমে আল্লাহর সকল ওয়াজিব প্রতিষ্ঠিত হবে৷ মিযানুল হিকমা খণ্ড- ৮, পৃ.-৩৭০৪) এবং ন্যায় কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধ না করার কারণে পৃথিবীতে এত বেশী অন্যায় ও অত্যাচার বৃদ্ধি পেয়েছিল৷
সর্বোত্তম ন্যায় কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধ করার সর্বোত্তম পন্থা হচেছ যে, বাষ্ট্র প্রধানরা এ কাজ করবে৷
ইমাম বাকের (আ.)বলেছেন:
المهدی و اصحابه يَأْمُرونَ بِالْمَعْروفِ وَ يَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
মাহ্দী ও তাঁর সাহায্যকারীরা ন্যায় কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধ করবেন (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড-৫১, পৃ.-৪৭)৷
২- ফ্যাসাদ ও চারিত্রিক অবনতীর সাথে সংগ্রাম: ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সময়ে অন্যায় কাজের নিষেধ কেবলমাত্র মুখেই করা হবে না বরং কার্যত অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে৷ যার ফলে সমাজে আর কোন ফ্যাসাদ ও চারিত্রিক অবনতী দেখতে পাওয়া যাবে না এবং এবং সমাজ সকল প্রকার পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র হয়ে যাবে৷
দোয়া নুদবাতে এ সম্পর্কেবর্ণিত হয়েছে:
اين قاطع حبائل الکذب والافتراء اين طامس آثار الزيغ والاهواء
তিনি কোথায় যিনি মিথ্যা ও অপবাদকে নির্মূল করবেন? তিনি কোথায় যিনি সকল অধপতন এবং অবৈধ কামনা-বাসনাকে ধবংস করবেন (মাফাতিহ আল জিনান, দোয়া নুদবা)৷
৩- আল্লাহর বিধানের প্রয়োগ: সমাজের উচছৃপখল ও দুস্কৃতিকারীদের সাথে আচরণের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে৷ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ন্যায়পরায়ণ হুকুমতে সুশিল সমাজ গঠনের জন্য কোরআন ও আহলে বাইতের নিদের্শ মোতাবেক কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে৷ অনুরূপভাবে মানুষের সকল চাহিদা মেটানো ও সমাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কার্যত সকল অন্যায়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে৷কিন্তু এর পরও যদি কেউ অন্যায়ে লিপ্ত হয়,অন্যের অধিকার নষ্ট করে এবং আল্লাহর বিধি লঙ্ঘন করে তাদের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে৷
এ সম্পর্কে রাসূল(সা.) বলেছেন: সে আল্লাহর বিধান প্রয়োগ করবে (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড- ৫২, বাব ২৭, হাঃ৪)৷
৪- বিচার বিভাগিয় ন্যায়পরায়ণতা: ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের প্রধান কর্মসূচী হচেছ সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা৷ তিনি পৃথিবীকে অন্যায়-অত্যাচারে পূর্ণ হওয়ার পরন্যায়নীতিতে পূর্ণ করবেন৷ ন্যায়পরায়ণতার একটি বিশেষ ক্ষেত্র হচেছ বিচার বিভাগ৷ কেননা, এ বিভাগে অনেককেই তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে৷ অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ কেড়ে নেওয়া, রক্তপাত ঘটানো এবং নির্দোষিদের সম্মান নষ্ট করা হয়েছে! দুনিয়ার বিচারে দূর্বলদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং সর্বদাশক্তিশালী ও জালেমদের পক্ষে রায় গোষণা করা হয়েছে৷ এভাবে তারা অনেক মানুষের জান ওমালের ক্ষতি সাধন করেছে৷ অনেক বিচারকরাও তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অন্যায় বিচার করেছে৷ অনেক নির্দোষিদেরকে ফাসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয়েছে এবং অনেক দোষিদেরকে বেকুসুর খালাস করা হয়েছে৷
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ন্যায়নিষ্ঠ হুকুমতে সকল অন্যায়-অত্যাচারের অবসান ঘটবে৷ তিনি যেহেতু আল্লাহর ন্যায়বিচারের বাস্তব চিত্র তাই ন্যায়পরায়ন বিচারালয় গড়ে তুলবেন এবং সেখানে ন্যায়নিষ্ঠ, সৎকর্মশীল ও খোদাভীরু বিচারকদেরকে নিয়োগ করবেন৷ পৃথিবীর কোথাও কারোপ্রতি সমান্যতম জুলুম হবে না৷
ইমাম রেযা (আ.) এ সম্পর্কেবলেছেন:
فاذا خرج اشرقت الارض بنور ربها و وضع ميزان العدل بين الناس فلا يظلم احد احداً
তিনি যখন কিয়াম করবেন পৃথিবী আল্লাহর নুরে আলোকিত হয়ে যাবে৷ তিনি ন্যায়ের মানদণ্ডকে এমনভাবে স্থাপন করবেনযে কেউ কারো প্রতি সামান্যতম জুলুম করতে পারবে না (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড- ৫২,পৃ.-৩২১)৷
এ রেওয়ায়াত থেকে বোঝা যায়যে, ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ন্যায়বিচার এত বেশী ব্যাপক যে অত্যাচারীদের অত্যাচারের পথবন্ধ হয়ে যাবে৷ এভাবে অন্যায়ের পথ সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ হয়ে যাবে৷
ঐশী ন্যায়পরায়ণ হুকুমতের সাফল্য ও অবদান সমূহ
কোন ব্যক্তি বা দল ক্ষমতায়পৌঁছানোর আগে তার সরকারে কর্মসূচীকে বর্ণনা করে৷ কিন্তু সাধারণত ক্ষমতায় আসার পরতার কর্মসূচীর কিছুই বাস্তবায়ন করে না এবং মনকি পূর্বের দেওয়া সকল ওয়াদা বেমালুমভুলে যায়৷
কর্মসূচী বাস্তবায়ণ নাকরতে পারার কারণ হচেছ হয়ত কর্মসূচী গঠনমূলক ছিল না অথবা এ কর্মসূচী পরিপূর্ণ ছিল নাএবং অধিকংশ ক্ষেত্রে যোগ্যতার অভাবে এমনটি হয়ে থাকে৷
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এরহুকুমতের সকল উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী গঠনমূলক ও বাস্তবমুখী যার মূলে রয়েছে মানুষেরবিকেব, সকলেই যার প্রতীক্ষায় ছিল৷ ইমামের সকল কর্মসূচী কোরআন ও সুন্নত মোতাবেক এবংতা সম্পূর্ণটাই বাস্তবায়ন হওয়ার উপযোগি৷ সুতরাং এ মহান বিপ্লবের সাফল্য অতি ব্যাপক৷এক কথায় ইমাম মাহদী (আ.)-এর হুকুমতের সাফল্য মানুষের সকল পার্থিব ও আধ্যাত্মিকসমস্যা সমাধানে যথেষ্ট৷
রেওয়ায়াতের আলোকে আমরা এখনতার আলোচনা করব:
১- ব্যাপক ন্যায়বিচার:বিভিন্ন রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর মহান বিপ্লবের প্রধান সাফল্য হচেছ সর্বজনীন ন্যায়পরায়ণতা৷ এ অধ্যায়ে আমরা তার সাথে এ বিষয়টিকেও যোগ করতে চায় যে, কায়েমে আলে মুহাম্মদ (আ.)-এর হুকুমতে সমাজের প্রতিটি স্তরে ন্যায়বিচার একটিমূলমন্ত্র হিসাবে বিরাজ করবে এবং ছোট, বড় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে৷ এমনকি মানুষের আচরণও ন্যায়ের ভিত্তিতে হবে৷
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এসম্পর্কে বলেছেন: আল্লাহর শপথ! ন্যায়বিচারকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিব যেমনভাবে ঠাণ্ডা ও গরম মানুষের ঘরে প্রবেশ করে (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড- ৫২, পৃ.-৩৬২)৷
ঘর সমাজের একটি ছোট্ট জায়গা আর সেটাই যখন ন্যায়পরায়ণ হয়ে উঠবে এবং পরিবারের সকলেই সবার সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করবে তা থেকে বোঝা যায় যে, ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বিশ্বজনীন হুকুমতক্ষমতা বা আইনের বলে চলবে না বরং কোরআনের নির্দেশ অনুসারে ন্যায়ের ভিত্তিতে اناللهيأمربالعدلوالاحسانনিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচরণের নির্দেশদেন৷ সূরা নাহল আয়াত নং ৯০)৷ জনগণকে সেভাবেই গড়ে তোলা হবে এবং সকলেই তাদের ঐশীদায়িত্ব পালন করবে৷ সকলের অধিকারকেই সম্মান দেওয়া হবে৷
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতে ন্যায়বিচার একটি মূল সাংস্কৃতি হিসাবে স্থান পাবে এবং মুষ্টিমেয় কিছু লোক যারা ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিবে এবং কোরআনের শিক্ষা থেকে দুরে থাকবে তারাই কেবল এর বিরুদ্ধাচারণ করবে৷ তবে ন্যায়পরায়ণ হুকুমত তাদের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নিবে এবং তাদেরকে কোন সুযোগ দেওয়া হবে না, বিশেষ করে তাদেরকে হুকুমতে প্রভাব ফেলতেবাঁধা দেওয়া হবে৷
হ্যাঁ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতে ন্যায়পরায়ণতা এভাবেই প্রভাববিস্তার করবে আর এভাবেই ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বিপ্লবের মহান উদ্দেশ্য বাস্তবাইত হবে৷ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং অন্যায়-অত্যাচার চিরতরে বিদায় নিবে৷
২- চিন্তা, চরিত্র ও ঈমানের বিকাশ: পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সমাজের মানুষের সঠিক প্রশিক্ষণ, কোরআন ও আহলেবাইতের সাংস্কৃতির প্রসারের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়৷ বিভিন্ন রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতে চিন্তা, চরিত্র ও ঈমানের ব্যাপক বিকাশ ঘটবে৷
ইমাম বাকের (আ.)বলেছেন:
যখন আমাদের কায়েম কিয়াম করবেন নিজের হাতকে মানুষের মাথায় বুলিয়ে দিবেন এবং তার বরকতে তাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক ও চিন্তাশক্তি পুরিপূর্ণতায় পৌঁছবে (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড- ৫২, হাঃ ৭১, পৃ.-৩৩৬)৷
ভাল ও সৌন্দর্যসমূহ বিবেক পরিপূর্ণ হওয়ার মাধ্যমে অর্জিত হয়৷ কেননা, বিবেক হচেছ মানুষের অভ্যান্তরীণ নবী, তা যদি মানুষের শরীর ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে মানুষের কর্মও সঠিক পথে পরিচালিত হবে, আল্লাহর বান্দায় পরিণত হবে এবং সৌভাগ্যবাণ হবে৷
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর কাছে প্রশ্ন করা হল যে, বিবেক কি? তিনি বললেন: বিবেক হচেছ তা যার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত হয় এবং তার (নির্দেশনার) মাধ্যমে বেহেশ্ত অর্জিত হয় (কাফী খণ্ড- ১, হাঃ ৩, পৃ.-৫৮)৷
বর্তমান সমাজে আমরা দেখতে পাই যে, কামনা-বাসনা বিবেকের উপরে স্থান পেয়েছে এবং নফসের তাড়না ব্যক্তি, দল ও গোত্রের উপর এককভাবে নেতৃত্ব দান করছে৷ যার ফলে মানুষের অধিকার পয়মাল হচেছ ও ঐশীমর্যাদাকে উপেক্ষা করা হচেছ৷ কিন্তু ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সমাজ আল্লাহর হুজ্জাতের নেতৃত্বে যিনি হচেছন পরিপূর্ণ বিবেক৷ আর পরিপূর্ণ বিবেক কেবলমাত্র সৎকর্মের দিকেই আহবান করবে৷
৩- ঐক্য ও সহমর্মিতা: ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের সকলেই ঐক্যবদ্ধ ও আন্তরিক হবে এবং হুকুমত প্রতিষ্ঠার সময়কারো প্রতি কারো শত্রুতা ও হিংসা থাকবে না৷
ইমাম আলী (আ.)বলেছেন:
و لو قد قائمنا ... لذهبت الشحناء من قلوب العباد
যখন আমাদের কায়েম কিয়াম করবেন, সবার মন থেকে হিংসা ও বিদ্বেষ দূরিভুত হবে৷
তখন হিংসা-বিদ্বেষের আর কোন অজুহাত থাকবে না৷ কেননা, তখন সবত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠত হবে এবং কারো অধিকার পয়মল হবে না, সকলেই বিবেকের সাথে চলবে, কামনা-বাসনার সাথে নয়৷ সুতরাং হিংসা-বিদ্বেষের আর কোনো পথই অবশিষ্ট থাকবে না৷ এভাবে প্রত্যেকেই আন্তরিক ও ঐক্যবদ্ধভাবে জীবন-যাপন করবে এবং কোরআনী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে
انماالمومنوناخوة
সূরা হুজুরাত আয়াত নং ১০)৷
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এসম্পর্কে বলেছেন: সে সময় আল্লাহ সবার মধ্যে ঐক্য ও আন্তরিকতা দান করবেন (কামালুদ্দিন, খণ্ড- ২, বাব ৫৫, হাঃ ৭, পৃ.-৫৪৮)৷
কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, আল্লাহ যদি চান তাহলে সবই সম্ভব৷ আল্লাহর ইচছাতেই বর্তমান সমাজের এই অনৈক্য ও হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়ে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে ইঠবে৷
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)বলেছেন: আমাদের কায়েম কিয়াম করলে প্রকৃত বন্ধুত্ব ও সঠিক আন্তরিকতা প্রতিষ্ঠিত হবে৷তখন প্রয়োজনে একজন অন্য জনের পকেট থেকে প্রয়োজনীয় টাকা নিতে পারবে এবং সে তাতে কোন বাধা দিবে না (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড- ৫২, হাঃ ১৬৪, পৃ.-৩৭২)৷
৪- শারীরিক ও আন্তরিক সুস্থতা: বর্তমান যুগের মানুষের একটি বড় সমস্যা হচেছ বিভিন্ন ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধির বহিঃপ্রকাশ৷ এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে যেমন: পরিবেশ দূষণ, রাসায়নিক বোমা, এটোমবোমা ও জীবাণু বোমা৷ অনুরূপভাবে মানুষের অবৈধ মেলা-মেশা, জঙ্গল ধবংস করা, পানি দুষণ ইত্যাদির কারণে বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধি যেমন: ক্যানসার, এইডস, মহামারি, হার্টএ্যটাক, পঙ্গুত্ব ইত্যাদি হচেছ যার চিকিৎসা প্রায় অসম্ভব৷ শারীরিক অসুস্থতা ছাড়াও বহু ধরনের আন্তরিক অসুস্থতা রয়েছে যা মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে এবং এটাও মানুষের বিভিন্ন অন্যায়ের কারণে ঘটছে৷
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ন্যায়পরায়ণ হুকুমতে মানুষের সকল প্রকার শারীরিক ও আন্তরিক ব্যাধি দূর হয়ে যাবে এবং মানুষের শরীর ও মন অত্যান্ত বলিষ্ঠ হয়ে উঠবে৷
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)বলেছেন: যখন ইমাম মাহ্দী (আ.) কিয়াম করবেন আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের সকল অসুস্থতা দূর করে দিবেন এবং সুস্থতা ও (শান্তি) দান করবেন (বিহারুল আনওয়ার, হাঃ ১৩৮,পৃ.-৩৬৪)৷
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সময়ে বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি ঘটবে এবং আর কোন দূরারোগ্য ব্যাধির অস্তিত্ব থাকবে না৷চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটবে এবং ইমামের বরকেতে অনেকে সুস্থ হয়ে উঠবে৷
ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন:যে আমাদের কায়েমকে দেখবে যদি অসুস্থ থাকে সুস্থ হয়ে যাবে আর যদি দূর্বল থাকে তাহলে শক্তিশালী হয়ে যাবে (বিহারুল আনওয়ার, হাঃ ৬৮, পৃ.-৩৩৫)৷
৫- অধিক কল্যাণ ও বরকত: কায়েমে আলে মুহাম্মদ (আ.)-এর হুকুমতের আরও একটি সাফল্য হচেছ অধিক কল্যাণ ও বরকত৷তাঁর হুকুমতের বসন্তে সর্বত্র সবুজ-শ্যামল ও সাচছন্দময় হয়ে উঠবে৷ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং মাটি থেকে ফসল উৎপন্ন হবে ও ঐশী বরকতে ভরপুর হয়ে যাবে৷
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)বলেছেন: আল্লাহ তায়ালা তাঁর কারণে আকাশে ও মাটিতে বরকতের বন্যা বইয়ে দিবেন৷ আকাশ থেকে রহমতের বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং মাটি থেকে ফসল উৎপন্ন হবে (গাইবাতে তুসী,হাঃ১৪৯, পৃ.-১৮৮)৷
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সময়ে আর কোন অনুর্বর ভুমি থাকবে না প্রতিটি স্থানই সবুজ-শ্যামল হবে এবং ফসল দান করবে৷
এই নজির বিহীন পরিবর্তনেরকারণ হচেছ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবে সকল প্রকার পঙ্কিলতা দূর হয়ে যাবে এবং পবিত্রতার বৃক্ষ জন্ম নিবে ও ঈমানের ফুল ফুটবে৷ সব শ্রেণীর মানুষেরা ঐশী শিক্ষায় শিক্ষিত হবে এবং পারস্পারিক সকল সম্পর্ককে ঐশী মর্যাদা অনুসারে আঞ্জাম দিবে৷ আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, এমন পবিত্র পরিবেশকে কল্যাণ ও বরকতে পরিপূর্ণ করবেন৷
এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হযেছে:
﴿وَ لَوْ أَنّ أَهْلَ الْقُري أَمَنوا وَ اتّقَوْا لَفَتَحْنا عَلَيْهِمْ بَرَكَتٍ مِنَ السّماءِ وَ الْأَرْضِ وَ لَكِنْ كَذّبوا فَأَخَذْنَهُمْ بِما كانوا يَكْسِبونَ﴾
যদি সেই সকল জনপদের অধিবাসীবৃন্দ ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত তবে আমি তাদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কল্যাণ উন্মুক্ত করতাম, কিন্তু তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল৷ সুতরাং তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে শাস্তি দিয়েছি সূরা আরাফ আয়াত নং ৯৬)৷
৬- দারিদ্রতা নির্মূল হবে: পৃথিবীর সকল সম্পদ যখন ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কাছে প্রকাশ পাবে এবং তাঁর যামানার মানুষের উপর আকাশ ও মাটির সকল বরকত বর্ষিত হবে ও মুসলমানদের বাইতুল মাল সমভাবেবন্টিত হবে তখন দারিদ্রতার আর কোন স্থান থাকবে না৷ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতে সকলেই অভাব ও দারিদ্রতার কালো থাবা থেকে মুক্তি পাবে (মুনতাখাবুল আছার অধ্যায় ৭, বাব ৩ ও ৪, পৃ.-৫৮৯-৫৯৩)৷
তাঁর সময়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের সাথে গড়ে উঠবে৷ ব্যক্তিগত স্বার্থপরিতা ও অর্থলিপ্সার স্থানে সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ব স্থান নিবে৷ তখন সকলেই প্রত্যেককে একই পরিবারের সদস্যমনে করবে৷ সুতরাং প্রত্যেকেই অন্যকে নিজের মনে করবে এবং তখন সর্বত্র একতা ও অভিন্নতার সুবাস ছড়িয়ে পড়বে৷
ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন: ইমাম মাহ্দী (আ.) বছরে দুই বার জনগণকে দান করবেন এবং মাসে দুই বার তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তা পূরণ করবেন৷ এ ক্ষেত্রেও তিনি সমানভাবে সবার মধ্যে বন্টন করবেন৷ এভাবে মানুষ স্বনির্ভর হয়ে উঠবে এবং যাকাতের আর প্রয়োজন হবে না (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড-৫২, হাঃ ২১২, পৃ.-৩৯০)৷
বিভিন্ন রেওয়ায়েত থেকে বোঝা যায় যে, মানুষের স্বনির্ভরতার কারণ হচেছ তারা স্বল্পে তুষ্ট৷ অন্য কথায় মানুষের পার্থিব ধন-সম্পদ বেশী হওয়ার পূর্বে যার মাধ্যমে স্বনির্ভর হবে আত্মিক প্রশান্তি তথা আত্মিক স্বনির্ভরতার প্রয়োজন৷ আল্লাহ তাআলা তাদেরকে যা দিয়েছেন তারা তাতেই সন্তুষ্ট৷ কাজেই অন্যের সম্পদের দিকে তাদের কোন লোভ বা লালসা থাকবে না৷
রাসূল (সা.) এ সম্পর্কে বলেছেন: আল্লাহ তাআলা স্বনির্ভরতাকে মানুষের অন্তরে দান করে থাকেন (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড- ৫১, পৃ.-৮৪)৷
যদিও ইতপূর্বে অর্থাৎ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের পূর্বে মানুষ, লালসা ও সম্পদের আধিখ্যের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল এবং গরিবদের প্রতি দান-খয়রাতের কোন ইচছাই তাদের মধ্যে ছিল না৷ মোটকথা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সময়ে মানুষ বাহ্যিক ও আন্তরিক উভয় দিক থেকেই স্বনির্ভর থাকবে৷এক দিকে অধিক সম্পদ সমভাবে বন্টিত হবে অন্য দিকে অল্পে তুষ্টি মানুষকে স্বনির্ভর করবে৷
এ সম্পর্কে রাসূল (সা.)বলেছেন: আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মদিকে স্বনির্ভর করবেন এবং সকলেই ইমাম মাহ্দী (আ.) এর ন্যায়পরায়ণতার অন্তর্ভূক্ত হবে৷ ইমাম মাহ্দী একজনকে বলবেন যে ঘোষণা কর:
কার সম্পদের প্রয়োজন আছে? তখন সবার মধ্য থেকে মাত্র একজন বলবে আমার! তখন ইমাম (আ.) তাকে বলবেন: ক্যাশিয়ারের কাছে যেয়ে বল, ইমাম মাহ্দী (আ.) আমাকে পাঠিয়েছেন এবং আমাকে টাকা দিতে বলেছেন৷ তখন ক্যাশিয়ার তাকে বলবে: তোমার জামা (আরবী লম্বা জামা) নিয়ে এস, অতঃপর তার জামা অর্ধেক টাকায় ভরে দেওয়া হবে৷ সে ওই টাকা গুলোকে পিঠে করে নিয়ে যেতে যেতে ভাববে: উম্মতে মুহাম্মদির মধ্যে আমি কেন এত লোভী৷ অতঃপর সে তা ফিরিয়ে দিতে চাইবে কিন্তু তার কাছ থেকে তা গ্রহণ করা হবে না এবং তাকে বলা হবে: আমরা যা দান করি তা আর ফেরত নেই না (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড- ৫১, পৃ.-৯২)৷
৭- ইসলামী হুকুমত এবং কাফেরদের উৎখাত: কোরআন পাকে তিনটি স্থানে ওয়াদা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র ইসলামকে বিশ্বজনীন করবেন:
﴿هُوَ الّذي أَرْسَلَ رَسولَهُ بِالْهُدي وَ دينِ الْحَق لِيُظْهِرَهُ عَلَي الدَينِ كُله وَ لَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكونَ﴾
মুশরিকরা অপ্রীতিকর মনে করলেও অপর সমস্ত দীনের উপর জয়যুক্ত করার জন্য তিনিই পথ নির্দেশ ও সত্য দীনসহ তাঁর রাসূল প্রেরণ করেছেন (সূরা তাওবা আয়াত নং ৩৩, সূরা ফাতহ আয়ত নং ২৮, সূরা সাফ আয়াতনং ৯)৷
﴿إِنّ اللّهَ لايُخْلِفُ الْميعاذَ﴾
নিশ্চয়ই আল্লাহ ওয়াদা খেলাফ করে না (সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ৯)৷
কিন্তু রাসূল (সা.) ও আল্লাহর ওয়ালীগণের অনেক চেষ্টার পর এখনও তা বাস্তবায়িত হয় নি (এটা একটি বাস্তব বিষয়এ সম্পর্কে মোফাস্সেরগণ যেমন: ফখরে রাজি তার তাফসিরে কাবীরের খণ্ড- ১৬, পৃ.-৪০,কুরতুবী তার তাফসীরে কুরতুবীতে খণ্ড- ৮, পৃ.-১২১ এবং তাবরাসী তার তাফসীরে মাজমাউল বায়ানে খণ্ড- ৫, পৃ.-৩৫ এসম্পর্কে আরোচনা করেছেন) প্রতিটি মুসলমান সে দিনের প্রতীক্ষায় রয়েছে৷ এ সত্যটি মাসুম ইমামদের বাণীতেও বর্ণিত হয়েছে৷
সুতরাং ইমাম মাহ্দীরহুকুমতে
اشهدانلاالهالاالله
ধবনি যা ইসলামের পতাকা এবং আশহাদু আন্না মুহাম্মাদানরাসূলুল্লাহ গোটা বিশ্বকে পরিপূর্ণ করবে এবং র্শিক ও কুফরের কোন অস্তিত্ব আর থাকবে না৷
ইমাম বাকের (আ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন: ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের পর এই আয়াতের বাস্তবায়ন ঘটবে৷
﴿وَ قَتِلوهُمْ حَتَي لاتَكونَ فِتْنَةٌ وَ يَكونَ الدَينُ كُلهُ لِلّهِ فَإِنِ انْتَهَوْا فَإِنّ اللّهَ بِما يَعْمَلونَ بَصيرٌ﴾
এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধেসংগ্রাম করতে থাক যতক্ষণ না ফিত্না দূর হয় এবং আল্লাহর দ্বীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যদি তারা বিরত হয় তবে তারা যা করে আল্লাহ তো তার সম্যক দ্রষ্টা (সূরা আনফাল আয়াত নং ৩৯)৷
তবে ইসলামের এ বিশ্বজনীন তাই সলামের সত্যতার জন্যই এবং ইমাম মাহ্দী (আ.) এর সময়ে তা আরও বেশী স্পষ্ট হবে ও সকলকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করবে৷ কিন্তু যারা শত্রুতা করবে ও নফসের তাড়নায় অবাধ্য হবে তারা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর তলোয়ারের মুখোমুখী হবে৷
এ আলোচনার শেষ কথা হচেছ যে, এই আক্বীদাগত ঐক্যবদ্ধতা যা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের ছত্রছায়ায় অর্জিত হবে তা ঐক্যবদ্ধ পৃথিবী গড়ে তোলার একটি উত্তম প্রেক্ষাপট৷ এই ঐক্যবদ্ধ পৃথিবী ওঐক্যবদ্ধ আক্বীদা একটি তৌহিদী হুকুমতকে মেনে নিতে প্রস্তুত৷ অতপর তার ছত্রছায়ায় নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক সর্ম্পকে একই আক্বীদার ভিত্তিতে সুসজ্জিত করবে৷ এ বর্ণনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে,আক্বীদাগত ঐক্যবদ্ধতা এবং সকল মানুষের একইদ্বীন ও একই পতাকার তলে একত্রিত হওয়াটা অতিব জুরুরি বিষয় যা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এরহুকুমতে অর্জিত হবে৷
৮- সর্বসাধারণের নিরাপত্তা: ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতে মানুষের জীবনের প্রতিটি স্তরে সবধরনের সৎকর্ম ছড়িয়ে পড়বে তখন নিরাপত্তা যা মানুষের সবচেয়ে বড় চাওয়া অর্জিত হবে৷
সকল মানুষ যখন একই আক্বীদার অনুসরণ করে, সামাজিক আচরণেও ইসলামী আখলাক মেনে চলে এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে স্তরে ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠিত থাকে তখন জীবনের কোথাও আর ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার কোন অজুহাত থাকতে পারে না৷ যে সমাজে প্রত্যেকেই তার অধিকার প্রাপ্ত হয় এবং সামান্যতম অপরাধেরও উপযুক্ত শাস্তি হয় সেখানে অতি সহজেই সামাজিক নিরাপত্তাঅর্জিত হওয়া সম্ভব৷
ইমাম আলী (আ.) বলেছেন: আমাদের সময়ে অতি কঠিন সময় অতিবাহিত হবে কিন্তু যখন আমাদের কায়েম কিয়াম করবে তখন সকল হিংসা-বিদ্বেষ দূরীভূত হবে এমনকি সব ধরনের পশু-পাখিরাও একত্রে জীবন-যাপন করবে৷ সে সময়ে পরিবেশ এত বেশী নিরাপদ হবে যে, একজন নারী তার সকল স্বর্ণ-অলঙ্কার ও টাকা-পয়সাসহ একাকি ইরাক থেকে সিরিয়া পর্যন্ত নির্ভয়ে পরিভ্রমন করবে (খিসাল খণ্ড- ২, পৃ.-৪১৮)৷
আমরা যেহেতু অন্যায়, হিংসা, অত্যাচার ও সকল প্রকার অসৎকর্মের যুগে বসবাস করছি তাই এমন সোনালী যুগের ধারণাও আমাদের জন্য অতি কঠিন ব্যাপার৷ এর কারণের দিকে যদি দৃষ্টিপাত করি তাহলে বুঝব যে, ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের ওই সবের কোন অস্তিত্ব থাকবে না৷ সুতরাং আল্লাহর ওয়াদা বাস্তবায়িত হবে এবং সমাজ নিরাপত্তায় পরিপূর্ণ হয়ে যাবে৷
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলছেন:
﴿وَعَدَ اللّهُ الّذينَ أَمَنوا مِنْكُمْ وَ عَمِلُوا الصّلِحَتِ لَيَسْتَخْلِفَنّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الّذينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَ لَيُمَكنَنّ لَهُمْ ذينَهُمُ الّذِي ارْتَضي لَهُمْ وَ لَيُبَدلَنّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْناً يَعْبُدونَني لايُشْرِكونَ بي شَيْئاً وَ مَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَهُمُ الْفَسِقونَ﴾
তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দ্বীনকে যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন...(সূরা নুর আয়াত নং ৫৫)৷
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এই আয়াতের অর্থ সম্পর্কে বলেছেন: এই আয়াত ইমাম মাহ্দী (আ.) ও তাঁর সাহায্যকারীদের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছে (গাইবাতে নোমানি হাঃ৩৫, পৃ.-২৪০)৷
৯- জ্ঞানের বিকাশ: ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক বিকাশ ঘটবে এবং তাত্বিক জ্ঞানেরঅভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটবে৷
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)বলেছেন: জ্ঞান-বিজ্ঞানের ২৭টি অক্ষর রয়েছে নবীগণ যা এনেছেন তা হচেছ মাত্র ২টি অক্ষর এবং জনগণও এই দুই অক্ষরের বেশী কিছু জানে না৷ যখন আমাদের কায়েম কিয়াম করবে বাকি ২৫টি অক্ষর বের করবেন এবং মানুষের মধ্যে তা প্রচার করবেন৷ অতঃপর ওই দুঅক্ষরকেও তারসাথে যোগ করে মানুষের মাঝে প্রচার করবেন (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড-৫২, পৃ.-৩২৬)৷
এটা স্পষ্ট যে, মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটবে এবং হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ঐ সময়ের প্রযুক্তির সাথে বর্তমান প্রযুক্তির বিশাল ব্যবধান থাকবে (তবে হাদীসে হয়তবা মোজেযা সম্পর্কে বলা হয়ে থাকতে পারে )৷
বর্তমান প্রযুক্তির সাথেপূর্বের প্রযুক্তির যেমন বিশাল ব্যবধান রয়েছে৷
এখানে কয়েকটি হাদীসের দিকে ইঙ্গিত করা হল:
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)বলেছেন: ইমাম মাহ্দী (আ.) এর সময়ে মুমিন ব্যক্তি প্রাচ্য থেকে তার ভাইকে যে, প্রাশ্চাত্যে রয়েছে দেখতে পাবে (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড- ৫২, পৃ.-৩৯১)৷
তিনি আরও বলেছেন: যখন আমারদের কায়েম কিয়াম করবে আল্লাহ তায়ালা আমাদের অনুসারীদের শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টি শীক্তকে এত বেশী বৃদ্ধি করে দিবেন যে, ইমাম মাহ্দী (আ.) ২৮ কিলোমিটার দূর থেকে তাঁর অনুসারীদের সাথে কথোপকথন করবেন এবং তারাও তাঁর কথা শুনতে পাবে ও তাঁকে দেখতে পাবে৷ অথচ ইমাম সেখানেই দাড়িয়ে থাকবেন (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড- ৫২, পৃ.-৩৩৬)৷
একজন নেতা হিসাবে দেশের জনগণ সম্পর্কে ইমামের ধারণা ও জ্ঞান সম্পর্কে বর্ণিত হযেছে:
মানুষ ঘরের মধ্যেও কথা বলতে ভয় করবে যে, যদি দেওয়ালেরও কান থাকে? (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড- ৫২, পৃ.-৩৯০৷
আধুনিক যুগের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি দেখে তা উপলব্ধি করা খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়৷ কিন্তু আমরা জানিনা যে, ইমামের সময়ে এই সকল প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করে ব্যবহার করা হবে নাকি তিনি নতুন কোন প্রযুক্তির ব্যবস্থা করবেন৷
উক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ইমাম মাহদী (আ.) যখন আবির্ভূত হবেন তখন আমরা এমন কিছু অবলোকন করবো যা আমরা এই যুগে সম্ভবপর হয়নি। কেননা তিনি হচ্ছেন তার নির্বাচিত খলিফা যিনি নিজের আঙ্গুলের ইশারায় চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করেন তিনি হচ্ছেন তার নির্বাচিত খলিফা যিনি এই দুনিয়াকে সৃষ্টি করেছেন। তাই আসুন আমরা সেই পবিত্র ইমামের আবির্ভাবের জন্য দোয়া করি যেন আবার এই দুনিয়া ন্যায় বিচারে ভরে উঠে।

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন