ঠাকুরগাঁও জেলার ঐতিহ্য
ঠাকুরগাঁও জেলার ঐতিহ্য
নদী মেখলা প্রকৃতি দুলালী এই বাংলাদেশে সংস্কৃতি ও জীবনধারার সাথে লোক সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্য। আজ অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের যুগে সভ্যতার চরম বিকাশ হওয়ার সাথে সাথে বাংলার পল্লী জীবনের জীবনযাত্রা পদ্ধতিতে, আচার-অনুষ্ঠানেও পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। কিন্তু এতদসত্বেও তা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এই দেশ কৃষির- এই দেশ কৃষকের। এখনও দিনান্তে শ্রান্ত ক্লান্ত কৃষকের ঘরের দাওয়ায় মাদুর পেতে বসে কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে সোনাভানের পুঁথি কিংবা দেওয়ান ভাবনার পালাপাঠের আসর বসে। লোকসাহিত্য, লোকনৃত্য, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল মুর্শিদি, মারফতী, কবিগান, যাত্রা, জারী, কীর্তন, পালাগান ইত্যাদি সবই বাংলার লোকসংস্কৃতির অবদান। সমগ্র দেশের লোকসংস্কৃতির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকলেও ভৌগোলিক পরিবেশের কারণে অঞ্চল ভেদে এর ভিন্নতা লক্ষ করা যায়।
উৎসব অনুষ্ঠান
এদেশে বার মাসে তের পার্বণ লেগেই আছে। মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, মিলাদুন্নবী, মুহররম (আশুরা), শবে বরাত ইত্যাদি। হিন্দুদের তো পূজাপার্বণের অন্ত নেই। তাদের প্রধান উৎসব দুর্গা পূজা, কালীপূজা, লক্ষ্মীপূজা, ভাইফোঁটা, সরস্বতী পূজা, চড়কপূজা, রাসযাত্রা, দোলযাত্রা, জন্মাষ্টমী ইত্যাদি। আর নববর্ষ, নবান্ন, পৌষ সংক্রান্তি সব সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত। কোন শুভ কাজ শুরু করার আগে এবং কোন সুসংবাদ পেলে মুসলমানদের মধ্যে মিলাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। লক্ষণীয় ঈদ, দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতীপূজায় হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরা পরস্পরের বাড়িতে সৌজন্য সাক্ষাতে যায়, আমন্ত্রিতও হয়। এছাড়া বিয়ে, আকিকা, খাতনা, জন্মদিন, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে সব সম্প্রদায়ের লোককেই আমন্ত্রণ জানানো হয়। ধর্ম এখানে কোন বাধা নয়। সবেবরাতের রুটি হালুয়া বা রুটি মাংস খাওয়া, বাদ্যযন্ত্রের সাথে মহরমের লাঠি খেলা বা তাজিয়া মিছিল এসবকে আর ধর্মীয় উৎসব বা অনুষ্ঠান মনে হয় না। এগুলো আমাদের লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নববর্ষ উপলক্ষে পাখি শিকার, মাছ শিকার, বনভোজন, পিচকারী দিয়ে রং খেলা, নিমপাতা, তিতারী শাক ইত্যাদি তিক্ত ভাজা খাওয়া, পান্তা ভাত খাওয়া, সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক আচার।
মুসলমানদের বিয়ের অনুষ্ঠানে কাজী বা মৌলভী সাহেব উকিল, সাক্ষীর মাধ্যমে বর ও কনের সম্মতি আদায় করে দোয়া কালাম পড়ে বিয়ে পড়ায়। হিন্দুদের বিয়েতে পুরোহিত বৈদিক মন্ত্র পাঠ করে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে। বিয়ে পড়ানো এবং আনুষ্ঠানিক কিছু পদ্ধতি ছাড়া অন্যান্য আচার অনুষ্ঠানে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। বিয়ের ২/৩ দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায় ‘গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান। বর কনে উভয় পক্ষের মেয়েরা যায় উভয়ের বাড়িতে হলুদ মাখাবার জন্য। কাপড়-চোপড়, প্রসাধনী, পান সুপারি, মিষ্টি, হলুদ, মেহেদী ইত্যাদি দিয়ে হলুদের ডালা সাজিয়ে পাঠানোর রীতি প্রচলিত আছে। এ ধরনের রীতি আগেও ছিল, তবে এখন এর আধুনিকায়ন হয়েছে। হলুদ কুটা হয় ছাম গাহিনে। ৩, ৫ বা ৭ জন (বেজোড় সংখ্যা) মহিলা এক সাথে একটি গাহিনে হাত দিয়ে হলুদ কুটা শুরু করে। বর ও কনেকে হলুদ মাখানো হয়, মিষ্টি খাওয়ানো হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে অভ্যাগত মহিলা অতিথিদেরও হলুদ মাখানো হয়, মহিলারা নিজেদের মধ্যেও হলুদ মাখামাখি করে। এমনকি কোন কোন সময় রং খেলা পর্যন্ত গড়ায়। ‘গায়ে হলুদ’ অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদেরকে সাধ্যানুযায়ী আপ্যায়ন করা হয়। কোথাও কোথাও হলুদ দেওয়ার অনুষ্ঠানে বর ও কনের দ্বারা কালাই ভাঙ্গানো হয়। এ কাজে ঠাকুরীকালাই (মাসকলাই) ব্যবহার করা হয়। অনুষ্ঠান চলাকালে মহিলারা গলা ধরাধরি করে গীত (বিয়ের গান) গায়।
মুসলমানদের মৃত্যুর পর কুলখানি, চল্লিশা, তামদারী ইত্যাদি অনুষ্ঠানে মৃতের জন্য দোয়া করা ছাড়াও সাধ্যানুযায়ী খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই রেওয়াজ চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানেও সাধ্যানুসারে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, তবে মাছ মাংস বর্জন করা হয়।
জীবন যাত্রা
ঠাকুরগাঁও জেলার গ্রামাঞ্চলে অতীতে পাকা ঘর-বাড়ি ছিলনা বললেই চলে। ছিল খড়ের বা কাশের ছাউনি ঘর ও বাঁশের তৈরি বেড়া বা মাটির দেওয়াল। অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারে দেখা যেতো টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর। আধা পাকা বা পাকা বাড়ি ছিল দু-একটা। এখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন প্রচুর টিনের ঘর, আধাপাকা ও পাকা বাড়ি দেখা যায়। প্রধান পেশা কৃষি। জোতদার, প্রান্তিক চাষী, ভূমিহীন চাষী, ক্ষেতমজুর প্রায় সবাই কৃষির উপর নির্ভরশীল। যারা শহরে ব্যবসা করছেন তাদেরও অনেকের আয়ের উৎস কৃষি। ব্যবসায়ীও রয়েছে কিছু। শহর থেকে গ্রামের হাটবাজার পর্যন্ত দোকান, পাইকারী ইত্যাদি নানাভাবে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ। কিছু চাকরিজীবীও রয়েছেন। শিক্ষকতা, চিকিৎসা, সরকারি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত সব মিলিয়ে চাকরিজীবীর সংখ্যাও নগণ্য নয়। এছাড়া রয়েছে হাতে গোনা কিছু কর্মজীবী, যারা লোকশিল্পের সাথে জড়িত। কৃষকদের প্রধান উৎপাদিত খাদ্য শস্য ধান, গম, যব, কাউন, ডাল, ভূট্টা ইত্যাদি। অর্থকরী ফসল হলো পাট ও ইক্ষু। কারো কারো আম, কাঁঠাল, সুপারি, নারিকেলের বাগান রয়েছে, কেউ বা পুকুরে মাছের চাষ করছে। এভাবেই আয় করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত, মাছ, মাংস, নানা ধরনের সব্জি। অতীতে এখানকার মানুষ গমের আটার রুটি খেতোই না। গম চাষও হতো না। পাকিস্তানী শাসনামলের মাঝামাঝি সময় থেকে এই অঞ্চলে গম চাষের প্রচলন শুরু হয়। এখনতো রুটিও প্রধান খাদ্যের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। কয়েকটি বিশেষ খাবার এ অঞ্চলে প্রচলিত আছে। যেমন পাটশাক ও লাফা শাকের ঝোল, সিদলের ভর্তা, চেং বা শাটি (টাকি) মাছের পোড়া বা সিদ্ধ ভর্তা, কচি কচু পাতার পোড়া বা সিদ্ধ ভর্তা, পেল্কা। এগুলো অনেকেরই প্রিয় খাবার। কাঁচা আমের তরকারি, কাঁচা কাঁঠালের তরকারি, আমসি বা টমেটোর টক খেতে পছন্দ করেন। শীতকালে তৈরি হয় নতুন ধানের ভাকা (ভাপা পিঠা), পাকোয়ান, নুনাস বা নুনিয়া, চিতুয়া, গুড়গুড়িয়া ইত্যাদি নানা নামের নানান পিঠা। আঁখের নতুন গুড় দিয়ে তৈরি হয় খৈয়ের মুড়কি, মুড়ির নাড়ু, চিড়ার চিপড়ি। এগুলো খুবই উপাদেয়। এখানকার মানুষ অতিথিপরায়ন। গ্রামাঞ্চলে চা-নাস্তা দিয়ে আপ্যায়ন করা সম্ভব না হলেও গুয়া-পান, বিড়ি দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। অতীতে নারিকেলের তৈরি হুঁকার প্রচলন ছিল কৃষকদের মধ্যে, এখন তা বিলুপ্ত প্রায়। তার স্থান দখল করে নিয়েছে বিড়ি ও সিগারেট। সম্পন্ন গেরস্থ বা জোতদারদেরও আজ আর আলবোলায় সুগন্ধি তামাক সেবন করতে দেখা যায় না।
সাধারণ মানুষের পোশাক লুঙ্গি, গেঞ্জি, ধুতি, গামছা, সার্ট, পায়জামা ও পাঞ্জাবী। ভদ্র, শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের লোকেরা সার্ট, প্যান্ট, পায়জামা, পাঞ্জাবী, জুতা, মোজা পরিধান করে, অতীতেও করতো। নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন লোকেরাও এখন অনেকে সার্ট, প্যান্ট, সোয়েটার ও কোট পরিধান করে পুরাতন বিদেশী বা দেশী (সেকেন্ড হ্যান্ড) কাপড় সহজলভ্য হওয়ার কারণে। শীতকালে সাধারণ মানুষ গায়ের চাঁদর এবং অপেক্ষাকৃত বিত্তবান লোকেরা দামি শাল, সোয়েটার, কোট, মাফলার ইত্যাদি পরিধান করে। অতীতে শিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকেরা হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ধুতি পরিধান করতো। বিত্তহীন পরিবারের মহিলারা সেলাই ছাড়া একখন্ড কাপড় বুকের উপর বেঁধে পরিধান করতো। একে বলা হতো ‘বুকানী’ বা ‘ফতা’। কেউ কেউ দুখন্ড কাপড় ব্যবহার করতো। একটা কোমরে বেঁধে নিচের অংশ ঢাকতো, অপরটা বুকের উপর জড়িয়ে নিতো। গহনা পরার প্রচলন পূর্বেও ছিল, এখনও আছে। তবে অতীতে গ্রামের মহিলারা দস্তার মল পড়তো। এখন মল পড়ার প্রচলন উঠে এসেছে শহরে শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যে, তবে আর দস্তার নয় রূপার। সাধ্যানুযায়ী সোনার গহনা পরার প্রচলন সচ্ছল পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। নিম্নবিত্ত বা একেবারে দরিদ্র পরিবারে বাধ্য হয়ে বিয়ের সময় ধার কর্জ করে সোনার গহনা মেয়েকে দেয়। কিন্তু দারিদ্রে্যর কারণে বিয়ের কিছুদিন পরে সেগুলো বিক্রি হয়ে যায়। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে বা মহিলাদের জন্য অনেকটা সুবিধা এনে দিয়েছে নকল সোনার (ইমিটেশন) গহনা। বিয়ের সময় কমপক্ষে নাকের নথুয়া (নোলক), নিদেন পক্ষে খিলা (নাক ফুল) না হলে বিয়ে হয় না। এ ধরনের বিশ্বাস থেকে এখনও দরিদ্র পরিবারে সোনার প্রচলন টিকে আছে। গ্রামাঞ্চলে সাধারণ যানবাহন হিসেবে ব্যবহৃত হতো গরু বা মহিষের গাড়ি। ব্যবসায়ীরা এই গাড়িতে হাট বাজারে দোকানের মালপত্র আনা নেওয়া করতো, গেরস্থরা ধান, পাট, সরিষা ইত্যাদি বিক্রি করতে নিয়ে যেতো গরুর গাড়িতে করে। ছই বা টোপর দেওয়া গরু গাড়িতে খড় বিছিয়ে বিছানা পেতে অবস্থাপন্ন লোকেরা আত্মীয়ের বাড়ি মেহমান খেতে কিংবা রেল স্টেশনে ট্রেন ধরতে যেতো। যে কোন ধরনের মাল পরিবহনের একমাত্র বাহন ছিল গরুর গাড়ি। অনেকে গরুর গাড়ি ভাড়া দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু এখন আর গরু বা মহিষের গাড়ির প্রচলন আর নেই। কেননা, গরুর গাড়ির জায়গা দখল করে নিয়েছে রিকশা ভ্যান। তাই আজ আর গাড়িয়াল ভাই’র গান শোনা যায় না। ভ্যান চালকের কণ্ঠে শোনা যায় বাংলা বা হিন্দি সিনেমার চটুল গানের সুর। এখন গ্রামাঞ্চলে মাল পরিবহন থেকে শুরু করে আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়া, হাটে বাজারে পণ্য আনা নেওয়া সবই সম্পন্ন হচ্ছে রিকশা ভ্যানে। এছাড়া যাতায়াতের জন্য গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত মিশুক, টেম্পু ও মিনিবাসের সুবিধা এখন সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। অনেকের বাড়িতে এখন মোটরসাইকেল দেখা যায়। কিন্তু অতীতে এটা ছিল কল্পনার বাইরে। তবে বাই সাইকেল চলতে দেখা যেতো রাস্তা ঘাটে।
শহর এবং গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবার ছাড়া চেয়ার, টেবিল, পালংক, ড্রেসিং টেবিল, আলনা এসব আসবাব পত্রের প্রচলন ছিল না। সাধারণ পরিবারের অতিথি আসলে পিঁড়ি, দড়ির খাট, (স্বল্প উচ্চতা সম্পন্ন বাঁশের খুঁটির উপর রশি দিয়ে ছাওয়া), সপ্ বা পাটি বসতে দেওয়া হতো। নিকটাত্মীয় হলে শোবার ঘরের বিছানায় বসতো। অতিথি বা মেহমানকে ভাত খাওয়াতো পাটি বিছিয়ে। সম্ভ্রান্ত পরিবারে মেহমানকে খাওয়ানো হতো বিছানার উপর দস্তরখান বিছিয়ে। পাটি বা মাদুর বিছিয়ে খাওয়ানোর প্রচলন এখনো আছে, তবে তা একেবারে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারে। আর দস্তরখানের প্রচলন আর নেই। কেননা চেয়ার টেবিল, ডাইনিং টেবিল এখন আর শহুরে শিক্ষিত বিত্তবানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; চলে এসেছে গ্রামের সাধারণ মানুষের ঘরে।
অতীতে গেরস্থালি তৈজসপত্রের মধ্যে মাটির তৈরি হাঁড়ি, থালা, ঢাকনা, তাওয়া, দস্তার তৈরি ডেকচি, কড়াইল, থালা, বাটি, গ্লাস, চামচ, লোহার কড়াই, বাঁশের তৈরি লকরী বা নাখুরি, ডাল ঘুটার জন্য লাহি, ডই বা ডুয়ার প্রচলন ছিল। এগুলোর ব্যবহার কম বেশি এখনও চলছে। তবে বিবর্তিত হয়ে টিনের তৈরি তৈজসপত্র, পরবর্তীতে স্টীলের তৈরি এবং ইদানিং কালে ম্যালামাইনের তৈজসপত্র ব্যবহার করছেন সাধারণ মানুষ। সম্ভ্রামত্ম পরিবারে কাঁচের এবং চিনামাটির তৈজসপত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। পাথরের তৈরি শিলপাটায় বা হামান দিস্তায় অতীতেও মসলা পিষা হতো, এখনো হয়।
গ্রামাঞ্চলে ধান কুটা হতো ঢেঁকিতে বা ছাম-গাহিনে। দরিদ্র পরিবারের মহিলারা নিজেদের ছাড়াও সম্পন্ন গেরস্থদের ধান কুটে দিতো পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। পারিশ্রমিক দেওয়া হতো ধান বা চাউল দিয়ে। এভাবে তারা চিড়া, মুড়ি, খৈ ইত্যাদি তৈরি করে দিতো। এটা দরিদ্র মহিলাদের অনেকেরই জীবিকা ছিল। এখন এই পেশাটির আর অসিত্মত্ব নেই বললেই চলে। গ্রামে বিদ্যুৎ আসায় অনেক ছোট বড় চাল কল গড়ে উঠেছে। চাল, চিড়া, মুড়ি, চালের আটা এমনকি মরিচ ও হলুদের গুড়া কলের মাধ্যমে পাওয়া যায়। বেশির ভাগ লোকই এগুলো হাট বাজার থেকে কেনে। ফলে এই জীবিকার মহিলারা এখন ক্ষেত মজুরে পরিণত হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও জেলার অর্থনীতি কৃষি নির্ভর হওয়ার কারণে এখানকার লোক সংস্কৃতি কৃষি নির্ভর। কৃষকেরা ভোর বেলা সূর্য উঠার আগেই হাল গরু নিয়ে ক্ষেতে চলে যেতো কিছু না খেয়েই। এক প্রহর বেলা হলে (সকাল নয়-দশটা) পরিবারের কেউ অর্থাৎ ছেলে, মেয়ে বা স্ত্রী পানতা নিয়ে যেতো ক্ষেতে। ক্ষেতের আইলে বসে কৃষক পিয়াজ মরিচ দিয়ে পানতা খেয়ে নারিকেলের হুঁকোয় বা ছিলিমে ধুমপান করতো মনের সুখে। বিশ্রাম নিয়ে আবার লেগে যেতো কাজে। বাড়িতে ফিরে বেলা তিন প্রহরে (বিকেল তিন-চারটা)। গোসল সেরে ভাত খেয়ে বিশ্রাম নিত গাছতলায়, মাচায় শুয়ে বসে। পড়মত্ম বেলায় কেউ বা যায় হাট-বাজারে, কেউ বাড়ির প্রয়োজনীয় কাজ সারে। এ বেলা আর ক্ষেতের কাজে যায় না। কর্মহীন অলস দুপুরে, অবিরাম বৃষ্টির দিনে অথবা সন্ধ্যায় কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে সোনাভান, লায়লী মজনু, পুঁথি পাঠ, তাস খেলা, পাট দিয়ে রশি তৈরি করা, গান গাওয়া মহিলাদের দাওয়ায় বসে কাঁথা সেলাই অথবা পাট থেকে শিকা তৈরি করা, শীতকালে উঠানে বসে ‘পোড়’-এ আগুন পোহানো, এসবই অতীতের অতি পরিচিত দৃশ্য। আধুনিক সভ্যতার যান্ত্রিক জীবনে এসব দৃশ্য আর চোখে পড়েনা। ছেলেদের হা-ডু-ডু, দাড়িয়াবান্ধা, পাকিভোট এবং মেয়েদের এক্কা-দোক্কা, বুড়ি-চিঁ, এ্যাপেন্টি বায়োস্কোপ ইত্যাদি খেলা আজকাল আর দেখা যায় না।
জেলার সাধারণ মানুষেরা আটপৌরে ভাষা হিসেবে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেন। শহর ও গ্রামের শিক্ষিত পরিবারে কেউ কেউ শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করেন। আঞ্চলিক ভাষা জেলার সর্বত্র প্রায় একই রকম হলেও দূরত্ব ভেদে উচ্চারণে বা বলবার ভঙ্গিমায় সামান্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রে এর তারতম্য ঘটে যেমন- ‘খেয়েছি’ এই ক্রিয়াপদের আঞ্চলিক উচ্চারণ ‘খাইচু’, কোথাও ‘খাইযু’। ‘খেয়েছে’, এর উচ্চারণ কোথাও ‘খাইচে’, আবার কোথাও ‘খাইয়ে’।
লোকশিল্প
ঠাকুরগাঁও জেলায় রয়েছে কুম্ভকার, কর্মকার, স্বর্ণকার, জেলে, তাঁতী, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, বাঁশের কাজ করে হাঁড়ি বা ডোম।
মাটির তৈরি জিনিসপত্রের মধ্যে পাওয়া যায় হাঁড়ি, কলস, পাতিল, থালা, বাটি, ঢাকনা, তাওয়া, মাছ ধোয়ানী, টব, ফুলদানী, প্রদীপ, ধুপদান, ছিলিম, দেবদেবীর মূর্তিসহ শো-কেসে সাজিয়ে রাখার মত নানা প্রাণীর মূর্তি। কর্মকাররা তৈরি করে কাসেত্ম, দা, কাঠারী, বটি, সর্ত্তা বা জাতী, হামান দিস্তা, হালের ফাল, খুন্তি, ডোহকী, কুড়াল, বশিলা ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। অতীতে তারা গরু গাড়ির চাকা তৈরি করতো। এখন গরুর গাড়ির প্রচলন না থাকায়, থাকলেও লোহার চাকার ব্যবহার না থাকায় আর চাকা তৈরি করতে দেখা যায় না।
বাঁশের তৈরি জিনিস পত্রের মধ্যে ঢাকী, চাঙ্গারী, বাহুংকা বা বইংঘা, কুলা, ডুলি, চাটাই, ফুলের ডালা, ধামা, খৈ চালনী, পাখা, মাছ ধরার ডিহিরী, জালাঙ্গা, পোলোই, ছোট খাট, খাটিয়া ইত্যাদি। কাঠমিস্ত্রি তৈরি করে চেয়ার, টেবিল, সোফা, খাট, ড্রেসিং টেবিল, শো-কেস, মিটসেফসহ নানা আসবাবপত্র। গ্রামে কোন কোন কাঠ মিস্ত্রি মানুষের বাড়িতে গিয়েও কাজ করে। এরা টিনের ঘরেরও কাজ করে। রাজমিস্ত্রিরা পাকা ঘরের কাজ করে। স্বর্ণকারেরা তৈরি করে বিভিন্ন ধরনের সোনা ও রূপার গহনা। এক সময় তাঁতীদের অবস্থা ভালই ছিল। তাঁতের কাপড় গ্রাম অঞ্চলে বিক্রি হতো ভালই। এই পেশার মানুষেরা এখন কৃষি বা অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়েছে। তবুও এখনও গামছা, ডাং বা দৌর (এক ধরনের বিছানা) তৈরি হয়। তবে এরা এখন পুরাতন উল দিয়ে কম্বল ও গায়ের চাঁদর তৈরি করে বিক্রি করে এগুলোর চাহিদাও আছে দরিদ্র মানুষের কাছে। এছাড়াও অনেকে মোটা সুতা দিয়ে ফিকাজাল, লাফিজাল তৈরি করে বিক্রি করে। কেউ কেউ পাট দিয়ে রশি বানিয়ে বিক্রি করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমানে নাইলনের রশি ও সুতলীর প্রচলন হওয়ায় হাতের তৈরি রশির চাহিদা আর নেই। ঝিনুক থেকে চুন তৈরি করতো একটা সম্প্রদায়। এই চুন পানের সাথে খাওয়ার জন্য ব্যবহার হয়। এই শিল্পও এখন প্রায় ধ্বংসের পথে। রাণীশংকৈল ও বালিয়াডাঙ্গী এলাকায় কিছু মানুষ ‘মথা’ দিয়ে সপ বা পাটি তৈরি করে বাজার জাত করে।
লোকসাহিত্য
লোক সংস্কৃতির একটা প্রধান অঙ্গ লোকসাহিত্য। লোককাহিনী, লোকসংগীত, ভাওয়াইয়া, বিয়ের গীত, পালাগান, ছড়া, ধাঁধা ও প্রবাদ প্রবচন লোক সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। এগুলো মূলত অলিখিত সাহিত্য। পাড়াগায়ের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত নরনারীর রস পিপাসা মিটানোর তাগিদেই এর সৃষ্টি। এগুলো মানুষের মুখে মুখে সৃষ্টি হয়েছে, মুখে মুখেই চলে এসেছে। এর রচয়িতারা চিরদিন লোক চক্ষুর অন্তরালে থেকে গেছে। আধুনিককালে এগুলোকে বইয়ের পাতায় বন্দি করার চেষ্টা করা হলেও বহুকাল ধরে তা গ্রামের পথে ঘাটে নরনারীর মুখে মুখে বিচরণ করছে।
লোককাহিনী
গ্রাম অঞ্চলে প্রচলিত লোক কাহিনীগুলো মূলত সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য সৃষ্টি। এগুলোতে তত্ত্ব কথা বা শিক্ষনীয় কিছু নেই। বরং স্থূল হাস্যরস সহ আদিরস বিদ্যমান। বেশিরভাগ কাহিনী বাস্তবতার সাথে সম্পর্কহীন। রাজা-রানী, জ্বিন-ভূত, রাক্ষস-খোক্ষস, সিংহ-বকরী, বোকা-পাগল, এই ধরনের অতি পরিচিত কাহিনীগুলোই লোক কাহিনীর ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।
প্রবাদ প্রবচন
মানুষের সূক্ষ্মতম অভিজ্ঞতার ফসল প্রবাদ প্রবচন। এর মাধ্যমে মানুষ নিজের চলমান জীবনের প্রয়োজনীয় উপলব্ধি ছড়িয়ে দেয় অন্যকে। মানুষ তা জড়িয়ে নেয় জীবনের সাথে।
১। বসিবা দিলে শুতিবা চাহে।
২। নরম মাটিত বিলাই হাগে।
৩। হবে ছুয়া কহিবে বাপ,
তে জুড়াবে মনের তাপ।
৪। মাঘ মাসের জারে
ভঁইষের শিং নড়ে।
৫। আমও গেল, ছালাও গেল্।
৬। হাজার ধুলেও কয়লার নি যায় রং
সাত ধুয়া দিলেও শুটকির নি যায় গন্।
৭। যত খাউক হলুয়া রুটি
তাহুঁ ওই পচকটা কটি।
৮। কিয়ের মাঝত কি
তিত কল্লাত ঘি।
শালবাড়ি মসজিদ ও ইমামবাড়া
ঠাকুরগাঁও উপজেলার পশ্চিমে ভাউলারহাটের নিকটে শালবনে শালবাড়ি মসজিদটি অবস্থিত। একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় মসজিদটি বাংলা ১২১৫ সালে তৈরি হয়েছে। সংস্কারের কারণে মসজিদটির মূল নকশা নষ্ট হয়ে গেছে। শালবাড়ি মসজিদটির অদূরে ভগ্নদশার একটি ইমামবাড়া আছে। এটাও মসজিদটির সমসাময়িক বলে অনুমান করা হয়। ইমামবাড়াটির পূর্ব ও পশ্চিম দেয়ালে দুটি করে চারটি এবং উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে দুটি দরজা আছে। এর বাইরের পরিমাপ দৈর্ঘ্যে ঊনিশ ফুট ছয় ইঞ্চি এবং প্রস্থে তের ফুট। এখানে মহরমের অনুষ্ঠানাদি হতো।
অবস্থান:
ঠাকুরগাঁও উপজেলার পশ্চিমে ভাউলারহাটের নিকটে শালবনে অবস্থিত
জগদল বিরেন্দ্র নাথ চৌধুরীর পরিত্যাক্ত রাজবাড়ি
কিভাবে যাওয়া যায়:
উপজেলা সদর হতে নেকমরদ জাতীয় মহাসড়ক ৯ কিঃ মিঃ, নেকমরদ হতে কাদিহাট বটতলী পাকা রাম্তা ৫ কিঃ মিঃ এবং বটতলী হতে কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদ হয়ে জগদল রাজবাড়ি কাঁচা রাস্তা ৬ কি: মি:
উপজেলা সদর হতে নেকমরদ জাতীয় মহাসড়ক ৯ কিঃ মিঃ, নেকমরদ হতে কাদিহাট বটতলী পাকা রাম্তা ৫ কিঃ মিঃ এবং বটতলী হতে কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদ হয়ে জগদলনামক স্থানে নাগর ওতীরনই নদীর মিলনস্থলে ছোট একটি রাজবাড়ি রয়েছে। রাজবাড়িটির সম্ভাব্যনির্মাণকাল ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। বর্তমানে রাজবাড়িটি প্রায় ধ্বংসাবশেষেপরিণত হয়েছে। রাজবাড়ি থেকেপ্রায় একশ মিটার পশ্চিমে নাগর নদীর পাড়ে মন্দির ছিল যা আজ সম্পূর্ণধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নেই। জগদলের রাজকুমার ছিলেন শ্রী বীরেন্দ্র নাথ চৌধুরী । তাঁর সঙ্গে বাকীপুরের জমিদার রায় পূর্ণেন্দু নারায়ণ সিংহের পুত্রশ্রী নলিনী রঞ্জনের কনিষ্ঠা কন্যা শ্রীমতি আশালতা দেবীর বিয়ে হয়। শ্রীবীরেন্দ্র নাথ সুশিক্ষিত ছিলেন। বইয়ের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল অনুরাগ। একারণে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সমৃদ্ধ পাঠাগার । তৎকালীন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ -বর্তমান দিনাজপুর সরকারি কলেজে ১৯৪৮ সালে তাঁর পাঠাগারের বইগুলো দান করাহয়, যার মূল্যমান ধরা হয় পঞ্চাশ হাজার টাকা।
অবস্থান:
ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় নাগর ও তীরনই নদীর মিলনস্থলে এবং জগদল বি.ও.পি ক্যাম্প সংলগ্ন বীরেন্দ্র নাথ চৌধুরীর পরিত্যাক্ত রাজবাড়িটি অবস্থিত।
রামরাই (রাণীসাগর)
কিভাবে যাওয়া যায়:
ঢাকা থেকে বাস যোগে ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলায় আসতেহবে। তারপরে বাস,ট্রাক,মোটর সাইকেল বাইসাইকেল,ভ্যান ও রিক্সা যোগে আসা যায়। ভ্যান ও রিক্সা ভারা (১৫-২০)টাকা
যার আয়তন (৯০০দৈর্ঘ্য ৪০০প্রসস্থ )মিটার গভীরতা ৮/৯ মিঃ পাড়গুলো
অনেক উচু ও প্রসস্থ । বর্তমানে জলাশয়ে মাছ চাষ এবং পাড়গুলিতে ১২০০ লিচু গাছ রোপন করা হয়েছে । বৃহত্তর জলাশয়টিকে বিনোদন পার্ক এবং পর্যটক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার জন্য জেলা পযায়ে উদ্যোগ চলছে.....।
অবস্থান:
উপজেলা সদর থেকে ৪ কিঃ মিঃ দূরত্ব উত্তরগাঁও গ্রামের নিকটেই বরেন্দ্র অঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তর জলাশয় রামরাই দিঘী।
খুনিয়া দিঘী স্মৃতি সৌধ
কিভাবে যাওয়া যায়:
ঢাকা থেকে বাস যোগে ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলায় আসতে হাবে।তারপরে বাস,মাইক্রোবাস,মটরসাইকেল,ভ্যান-রিক্সা ইত্যাদিযোগে যাওয়া যায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও জেলা সর্বচ বড় আকারের বদ্ধ ভূমি খুনিয়া দিঘী ।
৬একর আয়তনে খুনিয়া দিঘী। কবে কখন খনন করা হয়েছে তা অজানা থেকে গেছে।মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক গন হত্যার নিরিহ মানুসের রক্ত পান করে ।তার নামে স্বার্থকতা তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। ১০০০জনের অধিক মানুষকে হত্যা কার হয়্ ।(শিব দিঘীতে শিব মন্দির অসত্বহীন)।
অবস্থান:
উপজেলা সদর থেকে মাএ সিকি মাইল দক্ষিণে পাকা রাস্তার সংগ্লন খুনিয়া দিঘী।হোসেনগাও ইউনিয়ন পরিষদ পুরাতন অফিস সলগ্ন
বাংলাগড়
কিভাবে যাওয়া যায়:
ঠাকুরগাও জেলা হতে পশ্চিমে ৪০কি:মি: পাকা রাস্তা রাণীশংকৈল উপজেলা, আবার রাণীশংকৈল উপজেলা হতে উত্তরে নেকমরদ ১০কি:মি:, নেকমরদ হতে বাংলাগড় ৭কি:মি: পুবে।
এখানে অনেক দিন আগে এক রাজা বসবাস করেছিলেন।উনার নাম ছিল চান্দু সওদাগর।তিনি বাড়িব চতুর পার্শে মাটিদিয়ে প্রায় ৩০ফিট উচু এক দেওয়াল তৈরী করেছিলেন।এখন সেটা বাংলাগড় নামে পরিচিত।
অবস্থান:
গ্রাম:বাংলাগড়, ডাক:বাংলাগড়, উপজেলা:রাণীশংকৈল, জেলা:ঠাকুরগাঁও
রাণীশংকৈল (রাজা টংকনাথের) জমিদার বাড়ী
রানীশংকৈল উপজেলার পূর্বপ্রান্তে কুলিক নদীর তীরে মালদুয়ার জমিদার রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি। টংকনাথের পিতার নাম বুদ্ধিনাথ চৌধুরী। তিনি ছিলেন মৈথিলি ব্রাহ্মণ এবং কাতিহারে ঘোষ বা গোয়ালা বংশীয় জমিদারের শ্যামরাই মন্দিরের সেবায়েত। নিঃসন্তান বৃদ্ধ গোয়ালা জমিদার কাশীবাসে যাওয়ার সময় সমস্ত জমিদারি সেবায়েতের তত্ত্বাবধানে রেখে যান এবং তাম্রপাতে দলিল করে যান যে তিনি কাশী থেকে ফিরে না এলে শ্যামরাই মন্দিরের সেবায়েত এই জমিদারির মালিক হবেন। পরে বৃদ্ধ জমিদার ফিরে না আসার কারণে বুদ্ধিনাথ চৌধুরী জমিদারি পেয়ে যান। তবে অনেকে মনে করেন এই ঘটনা বুদ্ধিনাথের দু এক পুরুষ পূর্বেরও হতে পারে।
রাজবাড়ি নির্মাণের কাজ বুদ্ধিনাথ চৌধুরী শুরু করলেও সমাপ্ত করেন রাজা টঙ্কনাথ। বৃটিশ সরকারের কাছে টঙ্কনাথ রাজা পদবী পান। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে রাজবাড়িটি নির্মিত হয়। বর্তমানে রাজবাড়িটির অনেক অংশই নষ্ট হয়ে গেছে। রাজবাড়ির পশ্চিমদিকে সিংহদরজা। দরজার চূড়ায় দিক নির্দেশক হিসেবে লৌহদন্ডে S.N.E.Wচিহ্ন অঙ্কিত রয়েছে। রাজবাড়ি সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব কোণে কাছারিবাড়ি। পূর্বদিকে দুটি পুকুর। রাজবাড়ি থেকে প্রায় দু'শ মিটার দক্ষিণে কুলিক নদীর তীরে রাস্তার পূর্বপ্রান্তে রামচন্দ্র (জয়কালী) মন্দির। এই মন্দিরটি রাজবাড়ির চেয়ে প্রাচীন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকসেনারা মন্দিরটির ক্ষতি সাধন করে। এখন এটা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
অবস্থান:
রাণীশংকৈল উপজেলা সদর থেকে ১ কি:মি: দূরে অবস্থিত
হরিপুর জমিদার বাড়ী
হরিপুর উপজেলার কেন্দ্রস্থলে হরিপুর রাজবাড়ি। এই রাজবাড়ি ঘনশ্যাম কুন্ডুর বংশধরদের দ্বারা প্রতি''ষ্ঠত। মুসলিম শাসন আমলে আনুমানিক ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে ঘনশ্যাম কুন্ডু নামক একজন ব্যবসায়ী এন্ডি কাপড়ের ব্যবসা করতে হরিপুরে আসেন। তখন মেহেরুন্নেসা নামে এক বিধবা মুসলিম মহিলা এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। তাঁর বাড়ি মেদিনীসাগর গ্রামে। জমিদারির খাজনা দিতে হতো তাজপুর পরগনার ফৌজদারের নিকট। খাজনা অনাদায়ের কারণে মেহেরুন্নেসার জমিদারির কিছু অংশ নিলাম হয়ে গেলে ঘনশ্যাম কুন্ডু কিনে নেন।
ঘনশ্যামের পরবর্তী বংশধরদের একজন রাঘবেন্দ্র রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বৃটিশ আমলে হরিপুর রাজবাড়ির কাজ শুরু করেন। কিন্তু তাঁর সময়ে রাজবাড়ির কাজ শেষ হয়নি। রাঘবেন্দ্র রায়ের পুত্র জগেন্দ্র নারায়ণ রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে রাজবাড়ির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। এসময় তিনি বৃটিশ সরকার কর্তৃক রাজর্ষি উপাধিতে ভূষিত হন। জগেন্দ্র নারায়ণ রায়ের সমাপ্তকৃত রাজবাড়ির দ্বিতল ভবনে লতাপাতার নকশা এবং পূর্ব দেয়ালের শীর্ষে রাজর্ষি জগেন্দ্র নারায়ণের চৌদ্দটি আবক্ষ মূর্তি আছে। তাছাড়া ভবনটির পূর্বপাশে একটি শিব মন্দির এবং মন্দিরের সামনে নাট মন্দির রয়েছে। রাজবাড়িতে ছিল একটি বড় পাঠাগার যার অস্তিত্ব এখন নেই। রাজবাড়িটির যে সিংহদরজা ছিল তাও নিশ্চিহ্ন হয়েছে। ১৯০০ সালের দিকে ঘনশ্যামের বংশধররা বিভক্ত হলে হরিপুর রাজবাড়িও দু'টি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। রাঘবেন্দ্র-জগেন্দ্র নারায়ণ রায় কর্তৃক নির্মিত রাজবাড়িটি বড় তরফের রাজবাড়ি নামে পরিচিত। এই রাজবাড়ির পশ্চিমদিকে নগেন্দ্র বিহারী রায় চৌঃ ও গিরিজা বল্লভ রায় চৌঃ ১৯০৩ সালে আরেকটি রাজবাড়ি নির্মাণ করেন যার নাম ছোট তরফ।
অবস্থান:
হরিপুর উপজেলা সদরে অবস্থিত
গোরক্ষনাথ মন্দির
নেকমরদ থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে ঠাকুরগাঁওয়ের আরো একটি ইতিহাস সমৃদ্ধ স্থান হলো গোরকই বা গোরকুই। আর এখানেই রয়েছে বিখ্যাত গোরক্ষনাথ মন্দির ও নাথ আশ্রম। কোনো কোনো ঐতিহাসিক গোরক্ষনাথকে নাথপন্থীদের ধর্মীয় নেতা মীননাথের শিষ্য বলে ধারণা করে থাকেন। গবেষকদের মতে, এই গোরক্ষনাথ কোনো ব্যক্তি বিশেষের নাম নয়, গোরক্ষনাথ হলো নাথপন্থি সম্প্রদায়ের গুরু বা যোগীর উপাধি মাত্র। কেননা উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিম কামরূপসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে গোরক্ষনাথের নাম পাওয়া যায়। এছাড়া নেপালেও বৌদ্ধযোগী হিসেবে একজন গোরক্ষনাথের অস্তিত্বের কথা ইতিহাসে উল্লেখ আছে।
কোচবিহার রাজ সরকারের অনুমতিক্রমে খাঁ চৌধুরী আমানতউল্লাহ আহমদ কর্তৃক সংকলিত ‘‘কোচবিহারের ইতিহাস, প্রথম খন্ড’’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, ‘‘গোরক্ষনাথ কোন ব্যক্তি বিশেষের নাম না হইয়া নাথপন্থি সম্প্রদায়ের কোন গুরু বা যোগি বিশেষের একটি উপাধি হওয়াই অধিকতর সঙ্গত বলিয়া অনুমতি হয়।’’ কিন্তু গোরক্ষনাথ যে ধর্মীয় উপাধি মাত্র এই যুক্তি অনেক পন্ডিত মেনে নেননি। নাথ উপাধি হতে পারে, কিন্তু পুরো গোরক্ষনাথই উপাধি নয়। গোরক্ষনাথ যে একজন ব্যক্তি তাতে বোধহয় কোনো সন্দেহ নেই। ‘মহাযানী’ বৌদ্ধধর্ম পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের মধ্যে বিলীন হওয়ার পর যে সহজিয়া ধর্মমতের উদ্ভব হয় তার সঙ্গে হিন্দু যোগবাদের সংমিশ্রণের ফলে এই নাথধর্মের সৃষ্টি। গুপি চন্দ্রের সন্ন্যাস গ্রন্থে নাথধর্ম প্রসঙ্গে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেছেন; ‘‘বাঙলাদেশে বৌদ্ধধর্মের ক্রমবিবর্তনের ফলে এক নতুন ধর্মের পত্তন হয় এবং সেটাই হচ্ছে মীননাথ প্রবর্তিত নাথ ধর্ম।’’ নাথপন্থিদের ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে, ‘‘প্রাচীন নাথপন্থিগণের মতে মহাপ্রলয়ের শেষে একমাত্র ‘অলেখ নিরঞ্জন’ই অবশিষ্ট থাকেন এবং সিদ্ধ নাথগুরুগণ নিরঞ্জনের স্বরূপ বলিয়া কথিত হন’’ বর্তমানে নাথপন্থি সম্প্রদায়ের আলাদা অস্তিত্ব নেই। নাথ উপাধিধারী ব্যক্তিরা হিন্দু সমাজভুক্ত হয়ে কোনো প্রকারে তাদের প্রাচীন স্মৃতি রক্ষা করছে।
এই নাথপন্থি ধর্ম সম্প্রদায়ের গুরু গোরক্ষনাথের স্মৃতিবাহী গোরক্ষনাথ মন্দির ও আশ্রমটি রাণীশংকৈলের গোরকুইয়ের একটি মৃত নদীর তীরে উঁচু জমির উপর অবস্থিত। মন্দির চত্বরটিতে মোট ৫টি মন্দির রয়েছে। ৩টি শিব মন্দির ও ১টি কালিমন্দির ছাড়াও ১টি প্রধান মন্দির আছে যা নাথ মন্দির নামে পরিচিত। এই নাথমন্দিরটি দক্ষিণমুখিভাবে চত্বরের প্রায় মধ্যস্থলে অবস্থিত। এর পেছনে অর্থাৎ উত্তর দিকে পাষাণ বাঁধানো একটি চৌবাচ্চার মতো নিচু স্থানের মধ্যস্থলে বড় বড় কালো পাথরের খন্ড দিয়ে ঘেরা এক অলৌকিক ইদাঁরা বা কুয়ো আছে। কুয়োর একেবারে নিচু অংশটুকুও পাথর দিয়ে বাঁধানো। কিন্তু মাঝে একটি ছিদ্র আছে যা দিয়ে নিচ থেকে কুয়োতে পানি আসে। কুয়োর চারপাশে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে অনেক লোক পূণ্যস্নান করলেও কুয়োর পানি কমেনা। মন্দিরের উত্তর চত্বরে টিনের চাল বিশিষ্ট যে আশ্রম রয়েছে তার দরজায় একটি শিলালিপি বা ফলক ছিল। এই শিলালিপিটি বর্তমানে দিনাজপুর যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এর সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার করা সম্ভব না হলেও বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক আবু তালিবের মতে, এই শিলালিপিটি বাংলা অক্ষরে উৎকীর্ণ এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত শিলালিপিগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম।
অবস্থান:
রাণীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ ইউনিয়নে অবস্থিত
রাজভিটা
পীরগঞ্জ উপজেলার জাবরহাট ইউনিয়নের হাটপাড়া নামক স্থানে টাঙ্গন নদীর বাঁকে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে যে রাজবাড়ির অস্তিত্ব অনুভব করা যায় তা রাজভিটা নামে বর্তমান মানুষের নিকট পরিচিত। এর সঠিক ইতিহাস পাওয়া কঠিন। তবে অনুমান করা হয় এটি শেরশাহের সময়ে নির্মিত হয়েছিল। এখানে শেরশাহ আমলের মুদ্রা পাওয়া যায়। একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে যার বর্ণগুলো অপরিচিত এবং শিলালিপিতে একটি উট, একটি ঘোড়া ও একটি শুকরের প্রতিকৃতি আছে। সাংবাদিক কাজী নুরল ইসলাম তাঁর 'পীরগঞ্জের ঐতিহাসিক রাজভিটা' নিবন্ধে এ সমস্ত তথ্য প্রদান করে বলেছেন-'এগুলোর সূত্র বিশ্লেষণ করা হলে ঐ স্থানে কোন আমলে কোন রাজার রাজভিটা ছিল এর সঠিক তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হবে।'
রাজভিটায় দাঁড়িয়ে থাকা রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ নেই- সবই মাটির গর্ভে। মাটি খুড়লেই ইট পাথর বের হয়ে আসে। বিভিন্ন ভবনের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। আর নদীর ভাঙনেও নানা আকৃতির প্রচুর ইট ও পাথর বেরিয়ে আসে। নদীর উপত্যকায় পড়ে আছে বহু পাথর ও প্রাচীন ইট। রাজ পরিবারবর্গ টাঙ্গন নদীকেই নৌপথ হিসেবে ব্যবহার করত যা সহজে বোঝা যায়। রাজভিটা প্রায় ৫০০ মিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার প্রস্থ। রাজভিটা থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে শেরশাহ আমলের পূর্ণিয়া সড়কের নিদর্শন আছে।
অবস্থান:
পীরগঞ্জ উপজেলার জাবরহাট ইউনিয়নের হাটপাড়া নামক স্থানে অবস্থিত
হরিপুর রাজবাড়ি
হরিপুর উপজেলার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত রাজবাড়িটি আজো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রাসাদোপম অট্টালিকাটি নির্মিত হয় ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে। এটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন ঘনশ্যাম কুন্ডুর বংশধর রাঘবেন্দ্র রায় চৌধুরী আর সম্পন্ন করেন তারই পুত্র জগেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী।মুসলিম শাসন আমলে আনুমানিক ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে ঘনশ্যাম কুন্ডু নামক একজন ব্যবসায়ী এন্ডি কাপড়ের ব্যবসা করতে হরিপুরে আসেন। তখন মেহেরুন্নেসা নামে এক বিধবা মুসলিম মহিলা এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। তাঁর বাড়ি মেদিনীসাগর গ্রামে। জমিদারির খাজনা দিতে হতো তাজপুর পরগনার ফৌজদারের নিকট। খাজনা অনাদায়ের কারণে মেহেরুন্নেসার জমিদারির কিছু অংশ নিলাম হয়ে গেলে ঘনশ্যাম কুন্ডু কিনে নেন।ঘনশ্যামের পরবর্তী বংশধরদের একজন রাঘবেন্দ্র রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বৃটিশ আমলে হরিপুর রাজবাড়ির কাজ শুরু করেন। কিন্তু তাঁর সময়ে রাজবাড়ির কাজ শেষ হয়নি। রাঘবেন্দ্র রায়ের পুত্র জগেন্দ্র নারায়ণ রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে রাজবাড়ির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। এসময় তিনি বৃটিশ সরকার কর্তৃক রাজর্ষি উপাধিতে ভূষিত হন। জগেন্দ্র নারায়ণ রায়ের সমাপ্তকৃত রাজবাড়ির দ্বিতল ভবনে লতাপাতার নকশা এবং পূর্ব দেয়ালের শীর্ষে রাজর্ষি জগেন্দ্র নারায়ণের চৌদ্দটি আবক্ষ মূর্তি আছে।
এক শতাব্দীরও বেশি পুরোনো এই অট্টালিকাটির দৃষ্টিনন্দন কারুকাজের বিলুপ্তপ্রায় নিদর্শনগুলো প্রাচীনত্বের বিবেচনায় খুব মূল্যবান না হলেও এ অঞ্চলের একটি আকর্ষণীয় স্থাপত্য কীর্তি হিসেবে এখনো মানুষকে কাছে টেনে নিয়ে যায়। জগেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী বৃটিশ সরকার কর্তৃক রাজর্ষি উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। সে সময়ে বৃটিশ সরকার তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই সামন্তপ্রভুদের বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করে খুশি করতে চাইতেন। জগেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরীকে এই একই উদ্দেশে রাজর্ষি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন সত্য। কিন্তু এই উপাধি প্রদানের ক্ষেত্রে সম্ভবত আরো একটি বিষয় কাজ করেছিলো। আর সেটি হলো তাঁর বিদ্যানুরাগ ও শিল্প সংস্কৃতি চর্চার ব্যাপারে আগ্রহ। রাজর্ষি জগেন্দ্রনারায়ণ যেমন আকর্ষণীয় স্থাপত্য শৈলীর প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন তেমনি তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারও। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাজর্ষির এই অনুরাগ শুধু তাঁর ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে তা নয়, সমগ্র হরিপুরবাসীর মানসিক ঐশ্বর্যের উজ্জ্বল দিকটিকেও তুলে ধরে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার এই ধারায় যে আলোকিত জীবনের আকাঙ্ক্ষা সেদিন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিলো তা আজো অনেকটাই বহমান রয়েছে এই হরিপুরে।
ভবনটির পূর্বপাশে একটি শিব মন্দির এবং মন্দিরের সামনে নাট মন্দির রয়েছে। রাজবাড়িতে ছিল একটি বড় পাঠাগার যার অস্তিত্ব এখন নেই। রাজবাড়িটির যে সিংহদরজা ছিল তাও নিশ্চিহ্ন হয়েছে। ১৯০০ সালের দিকে ঘনশ্যামের বংশধররা বিভক্ত হলে হরিপুর রাজবাড়িও দু'টি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। রাঘবেন্দ্র-জগেন্দ্র নারায়ণ রায় কর্তৃক নির্মিত রাজবাড়িটি বড় তরফের রাজবাড়ি নামে পরিচিত। এই রাজবাড়ির পশ্চিমদিকে নগেন্দ্র বিহারী রায় চৌঃ ও গিরিজা বল্লভ রায় চৌঃ ১৯০৩ সালে আরেকটি রাজবাড়ি নির্মাণ করেন যার নাম ছোট তরফ।
অবস্থান:
হরিপুর উপজেলার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত
জগদল রাজবাড়ি
রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পশ্চিমে জগদল নামক স্থানে নাগর ও তীরনই নদীর মিলনস্থলে ছোট একটি রাজবাড়ি রয়েছে। রাজবাড়িটির সম্ভাব্য নির্মাণকাল ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। বর্তমানে রাজবাড়িটি প্রায় ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। রাজবাড়ি থেকে প্রায় একশ মিটার পশ্চিমে নাগর নদীর পাড়ে মন্দির ছিল যা আজ সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নেই। জগদলের রাজকুমার ছিলেন শ্রী বীরেন্দ্র কুমার। তাঁর সঙ্গে বাকীপুরের জমিদার রায় পূর্ণেন্দু নারায়ণ সিংহের পুত্র শ্রী নলিনী রঞ্জনের কনিষ্ঠা কন্যা শ্রীমতি আশালতা দেবীর বিয়ে হয়। শ্রী বীরেন্দ্র কুমার সুশিক্ষিত ছিলেন। বইয়ের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল অনুরাগ। এ কারণে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সমৃদ্ধ পাঠাগার । তৎকালীন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ - বর্তমান দিনাজপুর সরকারি কলেজে ১৯৪৮ সালে তাঁর পাঠাগারের বইগুলো দান করা হয়, যার মূল্যমান ধরা হয় পঞ্চাশ হাজার টাকা।
অবস্থান:
রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পশ্চিমে জগদল নামক স্থানে অবস্থিত
মহালবাড়ি মসজিদ
ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলা হতে উত্তরে মীরডাঙ্গী থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে মহেশপুর গ্রামে মহালবাড়ি মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হোসেন শাহের আমলে এটি প্রতিষ্ঠিত। দিনাজপুর জাদুঘরে শিলালিপিটি সংরক্ষিত ছিল। শিলালিপি সূত্রে জানা যায় মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মিয়া মালিক ইবনে জুযমদার। এটি ছিল তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদে ভূমি থেকে প্রায় চার ফুট উঁচু চারদিকে শিলা প্রাচীর ছিল। যে শিলাগুলো থাম হিসেবে ব্যবহৃত সেগুলো নকশা করা। শিলা-প্রাচীরের উপরে নির্মিত হয় ইটের দেয়াল। ছাদেও শিলাখন্ডের ব্যবহার ছিল। ছাদ থেকে পানি বের করে দেয়ার জন্য খোদিত শিলার ব্যবহার দেখা যায়। ১৯৭১ সালের পূর্বেই মূল মসজিদটি ধ্বংস হয় এবং সেখানে নির্মিত হয় নতুন মসজিদ। নবনির্মিত মসজিদটির ভিত ও মেঝেতে প্রাচীন মসজিদের পাথর এবং দেয়ালে ইট ব্যবহার করা হয়েছে। তবে মসজিদের কাছে নকশা করা ও নকশাবিহীন বেশকিছু শিলাখন্ড পড়ে রয়েছে। প্রাচীন মসজিদের নকশা করা প্রায় ৩৬ ×৩০ ইঞ্চি আয়তনের শিলাখন্ড নতুন মসজিদের মিহরাবে আটকানো আছে। এছাড়া প্রাচীন মসজিদের তিন তাকের নকশা করা শিলাখন্ডের মিম্বারটি এখনো নতুন মসজিদের সামনে পড়ে রয়েছে।
মসজিদের পূর্বপাশে আছে একটি ছোট দিঘি। দিঘিটির উত্তর পাড়ের ঘাট উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পাথরে বাঁধানো। মসজিদের দুশ মিটার পূর্বে জঙ্গলের মধ্যে দুটি কবর। কবর দুটি একসঙ্গে ইট দিয়ে বাঁধানো। কবরের উত্তর-পশ্চিমের কোণে নকশা করা একটি পাথরের থাম রয়েছে। হয়তো কবরের চারকোণেই এ ধরনের থাম ছিল। কবর দুটির মধ্যে একটি 'বিশ্বাস পীরের' মাজার বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমত। সম্ভবত বিশ্বাস শব্দটি ক্রমান্বয়ে বিশওয়াশ থেকে বিশ বাইশ শব্দে বিকৃত হয়েছে। ফলে এলাকাটিকে বলা হয় বিশবাইশ মহাল।
অবস্থান:
ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলা হতে উত্তরে মীরডাঙ্গী থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে মহেশপুর গ্রামে অবস্থিত
জামালপুর জমিদারবাড়ি জামে মসজিদ
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে পীরগঞ্জ যাওয়ার পথে বিমান বন্দর পেরিয়ে শিবগঞ্জহাট। হাটের তিন কিলোমিটার পশ্চিমে জামালপুর জমিদারবাড়ি জামে মসজিদ। মসজিদ অঙ্গনে প্রবেশমুখে বেশ বড় সুন্দর একটি তোরণ রয়েছে। তাজপুর পরগনার জমিদারবাড়ি থেকে রওশন আলী নামক এক ব্যক্তি এ অঞ্চলে আসেন। তাঁরই বংশধররা পরবর্তীতে এখানে জমিদারী পান। ১৮৬২ সালে জমিদারবাড়ির ভিত্তি স্থাপন করা হয়। বাড়িটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই ১৮৬৭ সালে মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ফলে মসজিদের ব্যয়বহুল নির্মাণ কাজ শেষ হলেও জমিদার বাড়িটির নির্মাণ অসমাপ্ত থেকে যায়।
মসজিদটির শিল্পকলা দৃষ্টিনন্দিত, মনোমুগ্ধকর ও প্রশংসাযোগ্য। মসজিদে বড় আকৃতির তিনটি গম্বুজ আছে। গম্বুজের শীর্ষদেশ কাচ পাথরের কাজ করা। এই মসজিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো মিনারগুলো। মসজিদের ছাদে আটাশটি মিনার আছে। একেকটি মিনার ৩৫ ফুট উঁচু এবং প্রতিটিতে নকশা করা রয়েছে। গম্বুজ ও মিনারের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে অপূর্ব সৌন্দর্য। এত মিনার সচরাচর কোন মসজিদে দেখা যায় না। মসজিদটির চারটি অংশ হলো মূল কক্ষ, মূল কক্ষের সঙ্গে ছাদসহ বারান্দা, ছাদবিহীন বারান্দা এবং ছাদবিহীন বারান্দাটি অর্ধ প্রাচীরে বেষ্টিত হয়ে পূর্বাংশে মাঝখানে চার থামের উপর ছাদ বিশিষ্ট মূল দরজা। খোলা বারান্দার প্রাচীরে এবং মূল দরজার ছাদে ছোট ছোট মিনারের অলংকার রয়েছে। মূল কক্ষের বাইরের দিক থেকে পরিমাপ হচ্ছে ২৯×৪৭ ফুট এবং ছাদবিহীন বারান্দার পরিমাপ ২১×৪৭ ফুট। মূল কক্ষের কোণগুলো তিন থাম বিশিষ্ট। এর জানালা দুটি, দরজা তিনটি, কুলুঙ্গি দুটি। মসজিদটির ভিতরে দরজায়, বারান্দায় এবং বাইরের দেয়ালগুলোতে প্রচুর লতাপাতা ও ফুলের সুদৃশ্য নকশা রয়েছে। ভারতের উত্তর প্রদেশের হংসরাজ এবং তার পুত্র রামহিৎ মসজিদটির মূল কারিগর। দ্বারভাঙ্গা এলাকার কারিগরেরাও নির্মাণ কাজে অংশ নেয়।
অবস্থান:
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে পীরগঞ্জ যাওয়ার পথে বিমান বন্দর পেরিয়ে শিবগঞ্জ হাটের তিন কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত
শালবাড়ি মসজিদ ও ইমামবাড়া
ঠাকুরগাঁও উপজেলার পশ্চিমে ভাউলারহাটের নিকটে শালবনে শালবাড়ি মসজিদটি অবস্থিত। একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় মসজিদটি বাংলা ১২১৫ সালে তৈরি হয়েছে। সংস্কারের কারণে মসজিদটির মূল নকশা নষ্ট হয়ে গেছে। শালবাড়ি মসজিদটির অদূরে ভগ্নদশার একটি ইমামবাড়া আছে। এটাও মসজিদটির সমসাময়িক বলে অনুমান করা হয়। ইমামবাড়াটির পূর্ব ও পশ্চিম দেয়ালে দুটি করে চারটি এবং উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে দুটি দরজা আছে। এর বাইরের পরিমাপ দৈর্ঘ্যে ঊনিশ ফুট ছয় ইঞ্চি এবং প্রস্থে তের ফুট। এখানে মহরমের অনুষ্ঠানাদি হতো।
অবস্থান:
ঠাকুরগাঁও উপজেলার পশ্চিমে ভাউলারহাটের নিকটে শালবনে অবস্থিত
সনগাঁ শাহী মসজিদ
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার কালমেঘ হাট থেকে দু কিলোমিটার উত্তরে সনগাঁ নামক গ্রামে সনগাঁ মসজিদটি নির্মিত। মোঘল সম্রাট শাহ আলমের সময় এই মসজিদ নির্মাণ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। মসজিদে তিনটি গম্বুজ ও তিনটি দরজা আছে। দক্ষিণে একটি পাকা কূপ আছে। কূপের গায়ে পোড়ামাটির বাংলালিপি রয়েছে। তবে লিপিটি অস্পষ্ট হওয়ায় পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মসজিদের পূর্বপাশে প্রাচীন কবর আছে। এখানেই শুয়ে রয়েছেন 'সুধিবাদ পীর' নামক এক পূণ্যাত্মা।
অবস্থান:
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার কালমেঘ হাট থেকে দু কিলোমিটার উত্তরে সনগাঁ নামক গ্রামে অবস্থিত
মেদিনীসাগর জামে মসজিদ
হরিপুর উপজেলার উত্তরে মেদিনীসাগর গ্রামে মেদিনীসাগর জামে মসজিদটি অবস্থিত। স্থাপত্যকাল মোঘল আমল । বাইরের দিক থেকে মসজিদের দৈর্ঘ্য সাড়ে একত্রিশ ফুট এবং প্রস্থ চৌদ্দ ফুট। ভিতরের দৈর্ঘ্য চবিবশ ফুট এবং প্রস্থ ছয় ফুট। এক কাতারে নামাজ পড়া যায়। মিহরাব ও মিম্বার আছে। দুটি জানালা, তিনটি দরজা, আটটি কুলুঙ্গি, তিনটি খিলান রয়েছে। মসজিদের চার কোণে চারটি কৌণিক থামের নিচে ঘড়া আছে। এছাড়া মসজিদের পূর্ব ও পশ্চিম দেয়ালে দুটি করে চারটি থাম রয়েছে। এই মসজিদের সঙ্গে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ফতেহ্পুর মসজিদের স্থাপত্য মিল রয়েছে।
অবস্থান:
হরিপুর উপজেলার উত্তরে মেদিনীসাগর গ্রামে মেদিনীসাগর জামে মসজিদটি অবস্থিত
গেদুড়া মসজিদ
হরিপুর উপজেলার গেদুড়া ইউনিয়নে গেদুড়া মসজিদটি প্রায় আড়াইশ বছর পূর্বে স্থাপিত হয়। বর্তমানে পুরাতন মসজিদটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। একইস্থানে নতুন মসজিদ তৈরি হয়েছে। এখানে আরবি ও ফারসি ভাষায় লিখিত গোলাকার একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। শিলালিপিটির পরিধি ৫৪ বর্গ ইঞ্চি।
অবস্থান:
হরিপুর উপজেলার গেদুড়া ইউনিয়নে অবস্থিত
গোরক্ষনাথ মন্দির কূপ ও শিলালিপি
রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পশ্চিমে গোরকুই নামের একটি গ্রাম। নাথগুরু গোরক্ষনাথের সাথে গ্রামের নামটি স্মৃতি বিজড়িত। এই গ্রামে নাথ আশ্রমে পাঁচটি মন্দির ও একটি ব্যতিক্রমধর্মী অতি প্রাচীন কূপ রয়েছে। গোরক্ষনাথ নামের সাথে কূপটির নাম যুক্ত হয়ে গোরক্ষকূপ থেকে গোরকুই নামটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়। গোরক্ষনাথের মহিমা প্রচারে নাথ সাহিত্যের কারণে বাংলা সাহিত্যে গোরক্ষনাথ নামটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গোরক্ষনাথের সময় নির্ধারণ করতে গিয়ে ‘বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত’ 'গ্রন্থে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন-'অষ্টম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যে যে-কোন সময়ে তিনি মর্ত্যদেহ ধারণ করে বর্তমান ছিলেন, এমন কথা শোনা যায়'। তাঁর আবির্ভাবের স্থান নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কল্পকাহিনীর প্রচার আছে। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে গোরক্ষনাথ পেশোয়ারে আবির্ভূত হন। গোরক্ষপন্থীদের মতে তিনি পাঞ্জাবের অধিবাসী কিন্তু পরে বিহারে বসবাস করেন। সম্ভবত সন্ন্যাসীদের মতো অনেক জায়গা তিনি ভ্রমণ করেছেন। একটি প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। জনশ্রুতিটি হলো-গোরক্ষনাথ এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে ফকিরদের আগমনের কথা মায়া শক্তিতে জানতে পেরে উৎকণ্ঠিত হন। তাই তিনি শিষ্যদের উদ্দেশ্যে পশ্চিমদিক থেকে আসছিলেন। পথিমধ্যে খরস্রোতা নোনা নদী বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ বাধা তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। তিনি খড়ম পায়ে পানির উপর হাঁটতে শুরু করেন। পূর্বে কাইচা নদীর তীরে অবস্থান করছিলেন পীর শাহ নেকমরদ। অলৌকিক ক্ষমতায় তিনি দেখতে পান গোরক্ষনাথের কেরামতি। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন পীর শাহ নেকমরদ। আর এতেই অঘটন ঘটলো। গোরক্ষনাথ নদীতে তলিয়ে যেতে লাগলেন। তাঁর পরনের গামছা ভিজে গেল। ধ্যানের মাধ্যমে ঘটনা জানতে পেরে গোরক্ষনাথ আর অগ্রসর হলেন না। সেখানে বালুচর সৃষ্টি করে তিনি বসে পড়েন। বালুচরে নাথ আশ্রম গড়ে উঠে। কিন্তু এটা শুধুই কাহিনী। কারণ পীর শাহ নেকমরদ গোরক্ষনাথের সমসাময়িক নন। তিনি গোরক্ষনাথের অনেক পরে। তবে গোরক্ষনাথ এই অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন না, তিনি যে ভ্রমণকারী সিদ্ধপুরুষ সন্ন্যাসী ছিলেন এই ধারণাকে কাহিনীটি সমর্থন করে।
গোরকুই নাথ আশ্রমের মন্দির পাঁচটি কয়েক দফা সংস্কার করা হয়েছে। সম্ভবত পুরাতন মন্দিরের উপর সর্বশেষ ঊনবিংশ শতাব্দীতে বর্তমান মন্দিরগুলো নতুন করে নির্মাণ করা হয়। ইটের প্রাচীর বেষ্টিত আশ্রমটির উত্তরদিকে দক্ষিণমুখী দরজার একটি, পূর্বদিকে পশ্চিমমুখী দরজার তিনটি এবং কূপের প্রাচীর সংলগ্ন দক্ষিণমুখী দরজার একটি মন্দির রয়েছে। পূর্বদিকের তিনটি মন্দিরের মধ্যে মাঝখানেরটি তুলনামূলকভাবে পাশের দুটির চেয়ে উচ্চতায় বড়। জানা যায় এই মন্দিরটির পূর্ব দেয়ালে কালো পাথরের নরমুন্ড বেষ্টিত খুব ছোট কালীমূর্তি আটকানো ছিল। মন্দিরের সেবায়েত জানান বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ১২/১৩ বছর পর কে বা কারা এই কালীমূর্তিটি নিয়ে যায়, যার সন্ধান আর পাওয়া যায়নি। কালীমন্দিরটির ছাদ অনেকটা দোচালা ঘরের মত। এর দু'পাশের মন্দির দুটিকে বলা হচ্ছে শিব মন্দির এবং উভয় মন্দিরে একটি করে গম্বুজ রয়েছে। উত্তরের মন্দিরটিও শিব মন্দির। 'বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস' গ্রন্থে প্রত্নতাত্তিক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া কূপ সংলগ্ন মন্দিরটিকে বলেছেন 'সমাধি মন্দির'। অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে মনে করেন এটিই নাথ মন্দির। মন্দিরটি চারচালা বিশিষ্ট। এর দৈর্ঘ্যে প্রস্থে পরিমাপ হলো সাড়ে এগার ফুট ও এগার ফুট।
নাথ মন্দিরের সাথেই উত্তরপাশে গোরকুই কূপ। কূপটি সম্পূর্ণ বেলে পাথরে নির্মিত। বাংলাদেশের কোথাও পাথরের নির্মিত এধরনের কূপের সন্ধান পাওয়া যায় না। কূপটির চারদিকে ইটের প্রাচীর। তবে পূর্ব ও পশ্চিমদিকে একটি করে দরজা আছে। মূল ভূমি থেকে প্রায় তিন ফুট নিচুতে কূপের মেঝে। মেঝেটি বেলে পাথরে নির্মিত। মূল ভূমি থেকে মেঝেতে নামার জন্য সিঁড়িগুলোও বেলে পাথরের। কূপটির গভীরতা সাড়ে সাত ফুট এবং এর ব্যস আড়াই ফুট। বেলে পাথর সামান্য বাঁকানোভাবে কেটে কূপের মুখ থেকে তলদেশ পযন্ত অত্যন্ত নিখুঁতভাবে বসানো হয়েছে। কূপের তলটুকুতেও মাটি নেই। একটি পাথরের সাথে আরেকটি পাথরের জোড়া লাগাতে কোনো মসলা ব্যবহার করা হয়নি। মনে করা হয় পাথরের জোড়াগুলো দিয়ে কূপটি পানিতে ভর্তি হতো। আবার এরূপ কথাও প্রচলিত রয়েছে যে কূপের তলদেশে পাথরের মাঝখানে দুটি ছিদ্র ছিল। সেই ছিদ্র দুটি বন্ধ করে দিলে কূপের ভিতরে পানি আসত না এবং খুলে দিলে পানিতে পূর্ণ হতো। এখানকার নিম্নবর্ণের হিন্দুরা কূপের পানিকে পবিত্র মনে করে। ফালগুন মাসে প্রতি বছর এখানে মেলা বসে। মানুষের বিশ্বাস মেলার তিথিতে এই কূপের পানি দিয়ে গোসল করলে রোগমুক্তি ঘটে।
কূপের উত্তরে একটি টিনের চারচালা ঘরের দরজার নিচের চৌকাঠ হিসেবে ব্যবহৃত দুটি বেলে পাথরে উৎকীর্ণ শিলালিপি পাওয়া যায়। এগুলোর প্রথম সন্ধান পান প্রত্নতাত্ত্বিক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। শিলালিপির পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন-প্রথম পাথরে খোদিত লিপিতে ১০ পঙক্তির নিচে একটি রেখা টানা। রেখার নিচে আছে একটি অশ্বমূর্তি ও একটি বরাহের মসত্মকদেশ। সংলগ্ন দ্বিতীয় পাথরে ছিল বরাহের দেহের অবশিষ্টাংশ ও একটি বৃষমূর্তি। অমসৃণ ও নিকৃষ্টমানের বেলে পাথরে খোদিত লিপিটি ক্ষয়প্রাপ্ত ও দুর্বোধ্য হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় পঙক্তির 'খরগাম', নবম পঙক্তির 'রমনসক' ও দশম পঙক্তির '৯২০ তারিখ( বা তারখ) ১৭ মাঘ' এই ক'টি শব্দ ছাড়া এই দুর্বোধ্য ও ক্ষয়প্রাপ্ত শিলালিপির আর কোনো পাঠ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত আলোচ্য শিলালিপিটি গোরকুই কূপের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। জনাব যাকারিয়া বলেন-নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর কোন এক সময়ে গোরক্ষনাথের আবির্ভাব বলে ধরা হয়। কূপটি যদি গোরক্ষনাথের সমাধির সাথে সম্পৃক্ত হয় তবে এটি পাল-সেনযুগে নির্মিত হয়েছিল। আরবি তারিখ শব্দের উপস্থিতি ও লিপির রূপ দেখে নিঃসন্দেহে ধরা যায় যে, এটি মুসলিম আমলে খুব সম্ভব সুলতানি আমলের শেষদিকে লিপিকৃত হয়েছে। প্রাচীন মন্দির ধ্বংস হয়ে গেলে সুলতানি আমলে ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের উপরেই নতুন মন্দির নির্মাণ করা হয়। আলোচিত শিলালিপিটি সম্ভবত মন্দির নির্মাণের সময় সংযুক্ত করা হয়েছিল।
অবস্থান:
রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পশ্চিমে গোরকুই নামের একটি গ্রামে অবস্থিত
হরিণমারী শিব মন্দির
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা থেকে দশ কিলোমিটার দূরে উত্তর পশ্চিমদিকে হরিণমারী হাটের উপর শিবমন্দিরটি অবস্থিত। এই মন্দিরের ছাদ চারচালা পদ্ধতিতে নির্মিত। এটা বেশ খানিকটা বসে গেছে। মন্দিরটির বর্তমান উচ্চতা প্রায় ত্রিশ ফুট এবং আয়তন ১৪ ×১৪ ফুট। দক্ষিণ দিকে একটি দরজা আছে। দরজায় পোড়ামাটির ফলকে লতাপাতার নকশার সাথে বিভিন্ন মূর্তির প্রতিকৃতি ছিল। বর্তমানে সেগুলো ভেঙ্গে গেছে। মন্দিরের পূর্বদিকে বেশ বড় একটি পুকুর আছে। আনুমানিক চারশ বছরের পুরাতন হতে পারে মন্দিরটি।
অবস্থান:
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা থেকে দশ কিলোমিটার দূরে উত্তর পশ্চিমদিকে হরিণমারী হাটের উপর শিবমন্দিরটি অবস্থিত
হরিপুর রাজবাড়ি শিব মন্দির
ছোট তরফের রাজবাড়ির সামনে একটি শিব মন্দির আছে। এর ছাদ অনেকটা ছাতা আকৃতির আটচালা বিশিষ্ট এবং দেয়ালগুলো অনুরূপ আট কোণ বিশিষ্ট। মন্দিরের চারদিকে বিভিন্ন নকশা ও মূর্তির প্রতিকৃতি ছিল। এর দক্ষিণে একটি দরজা এবং পূর্ব ও পশ্চিম দেয়ালে একটি করে ক্ষুদ্রাকৃতির জানালা আছে। মন্দিরটির ছাদ বর্তমানে প্রায় বিধ্বস্ত হওয়ার পথে। এই মন্দিরটি আনুমানিক চারশ বছরের পুরাতন।
অবস্থান:
হরিপুর উপজেলার কেন্দ্রস্থলে ছোট তরফের রাজবাড়ির সামনে অবস্থিত
গোবিন্দনগর মন্দির
ঠাকুরগাঁও শহরে টাঙ্গন নদীর পশ্চিম তীরে কলেজপাড়ায় গোবিন্দনগর মন্দির অবস্থিত। গোবিন্দনগরের একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৭০১ সালে রাজা গোবিন্দ রায়ের মাতা টাঙ্গনের তীরে হরির সন্তুষ্টি সাধনে একটি মন্দিরের আচ্ছাদন তৈরি করেন। বর্তমানে যে মন্দিরটি রয়েছে তার সাথে লাগা পশ্চিমে গড়ে উঠা বস্তিতে এক সময়ে একটি ছোট মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ পাওয়া যায়। এটাই গোবিন্দ মন্দির বলে ধারণা করা হয়। মন্দিরটি রাজা গোবিন্দ রায় বা তার পূর্ব পুরুষ কর্তৃক মোঘল আমলের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরে গোবিন্দজী নামে শ্রী কৃষ্ণের পূজা করা হতো। মন্দির ও রাজবাড়ি গড়ের ভেতরে অবস্থিত। গড়টির চারদিক মাটির প্রাচীর ও গভীর পরিখা দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। গড়ের পূর্বের সম্পূর্ণ ও দক্ষিণের বেশ খানিকটা প্রাচীর নদী ভাঙনে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের উত্তরপাশের প্রাচীর কেটে সমতল করা হয়েছে। পশ্চিমে জেলা পরিষদ কার্যালয়ের কাছে শহীদ ফাদার লুকাস টেড্র স্কুলটি গড়ের প্রাচীর কেটে তার উপরে স্থাপিত হয়েছে। শুধুমাত্র জেলা পরিষদের দক্ষিণপাশে সাঁওতাল বস্তির কাছে গড়ের প্রাচীরের সামান্য অংশ এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
বর্তমানে গোবিন্দ মন্দিরটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা রামনাথ নতুন করে তৈরি করেছিলেন। পরে মন্দিরটি বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। মন্দিরে যে গোবিন্দজী বিগ্রহের পূজা হতো সে সম্পর্কে একটি গল্পের প্রচলন আছে। বলা হয় শালবাড়ি পরগনার জমিদারের রক্ষক হিসেবে এই মূর্তিটি তার বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাজা রামনাথ মূর্তিটি চুরির উদ্দেশ্যে একজন চতুর ব্রাহ্মণ নিয়োগ করেন এবং চুরির সুবিধার্থে পুনর্ভবার সাথে টাঙ্গন নদীকে যুক্ত করে ১২ মাইল দীর্ঘ খাল খনন করেন, যার নাম হয় রামদাড়া। ব্রাহ্মণ চৌর্যবৃত্তে সফল হলে রাজা রামনাথের সাথে জমিদারের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে জমিদার পরাজিত হলে শালবাড়ি পরগনা রাজা রামনাথের দখলে আসে। গোবিন্দজী'র বিগ্রহ ও রামদাড়া সম্পর্কে মিঃ স্ট্রং রচিত দিনাজপুর জেলার গেজেটিয়ারে পাওয়া যায় - Ramnath conquered and dispossessed the zaminder of Gobindanagar, near the present village of Thakurgaon, employing a Brahmin to steal his protecting deity or family idol Gabinda, and thus causing his downfalll. The conqueror subsequently constructed a canal connecting Gobindanagar on the Tangan with Prannagar near the Punarbhaba for the purpose of taking the idol backwards and forwards between the two places.
ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর সড়কে ঠাকুরগাঁও বিডিআর ক্যাম্প থেকে খোচাবাড়ী-ঊনত্রিশ মাইল পর্যন্ত রাস্তার উত্তরপাশে ক্ষীণকায় যে খালটি আজও দেখা যায়, যার উঁচু ঢিবির উপর বন বিভাগের সেগুন গাছগুলো রয়েছে, সেই খালের নাম রামদাড়া।
অবস্থান:
ঠাকুরগাঁও শহরে টাঙ্গন নদীর পশ্চিম তীরে কলেজপাড়ায় গোবিন্দনগর মন্দিরটি অবস্থিত
ঢোলরহাট মন্দির
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে নয় কিলোমিটার দূরে রুহিয়া যাওয়ার পথে ঢোলরহাট নামক জায়গায় পাকা রাস্তার পশ্চিমপাশে তিনটি মন্দির আছে। মন্দির তিনটির একটি শিব মন্দির, একটি দেবী মন্দির এবং একটি বিষহরি মন্দির নামে পরিচিত। ঢোলরহাট শিব মন্দিরটি দ্বিতল বিশিষ্ট। গম্বুজসহ মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট। মন্দিরটির বাইরের দেয়াল ৮ কোণ বিশিষ্ট, কিন্তু ভিতরে কোণ নেই । প্রথম তলার পূর্ব ও দক্ষিণদিকে দুটি দরজা আছে। দক্ষিণ দরজায় সতেরটি শিবলিঙ্গের প্রতিকৃতি ছিল যা অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া দরজার উপরে কুকুরের মূর্তি রয়েছে। পূর্ব দরজায় শিবলিঙ্গের কোনো প্রতিকৃতি নেই। কিন্তু বিভিন্ন প্রকার মূর্তি আছে। বাইরের দেয়ালে পলেস্তরার উপরে লতাপাতা ও ফুলের নকশা দেখা যায়। প্রথম তলায় ভিতরে ছাদ গম্বুজের ন্যায় গোলাকৃতি কিন্তু দ্বিতীয় তলার মেঝে সমতল। দ্বিতীয় তলার চারদিকে চারটি ছোট দরজা ও চারটি জানালা আছে। জানালাগুলোতে ত্রিভুজ আকৃতির ইটের জাল বা খোপ রয়েছে। দ্বিতীয় তলার উপরে যে গম্বুজটি ছিল তা ভেঙ্গে গেছে। মন্দিরের ভিতরে বৃহৎ আকৃতির শিব লিঙ্গ আছে এবং এখনো তার পূজা হয়। মন্দিরটির পূর্ব পাশে একটি বড় পুকুর আছে। শিব মন্দির থেকে ৫০ গজ পশ্চিমে বিষহরি মন্দির। এই মন্দিরে মনসা দেবীর পূজা করা হতো। বর্তমানে মন্দিরটির ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নেই। বিষহরি মন্দিরের সঙ্গে লাগা পশ্চিমে দেবী মন্দির। মন্দিরটিতে দেবী দুর্গার পূজা হতো এবং এখনো পূজা হয়। মন্দিরের ছাদ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। শুধু দাঁড়িয়ে আছে চারপাশের দেয়াল । উত্তর দেয়ালে পলেস্তরায় দুর্গার মূর্তি ছিল যা নষ্ট হয়ে গেছে। মূর্তিটির উপরে এবং পাশে পৌরাণিক কাহিনীচিত্র আছে। দুর্গার পায়ের কাছে বেদীতে শুয়ে আছে শিব মূর্তি। তার নিচে বেদীর দেয়ালে ছয়টি মূর্তি অঙ্কিত আছে এবং মূর্তিগুলোর উপরে নারদ, ইন্দ্র, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ও নন্দি এই ছয়টি নাম লেখা আছে। মন্দিরটির ভিতরের দিকে উচ্চতায় ২০ ফুট, দৈর্ঘ্য ৩২ ফুট এবং প্রস্থ ১২ ফুট। মন্দিরের পূর্ব পশ্চিমে দুটি ছোট দরজা এবং দক্ষিণে একটি বড় দরজা রয়েছে। দক্ষিণে ৭.৫ ফুট প্রশস্ত একটি বারান্দা ছিল যা এখন সম্পূর্ণ নষ্ট। বারান্দার যে অংশটুকু এখনো দাuঁড়য়ে আছে তাতে নানাধরনের পৌরাণিক মূর্তি আছে।
মন্দির তিনটি সম্পর্কে নানা রকম কাহিনী প্রচলিত। যেমন মন্দির তৈরির জন্য যত লোক নিয়োগ করা হয়েছিল কাজ সেই অনুপাতে দ্রুত গতিতে হতে থাকে। আবার কখনো নিয়োগকৃত শ্রমিকের চেয়ে অনেক বেশি শ্রমিককে মন্দিরের কাজ করতে দেখা যেত। তাই লোকে বলে স্বয়ং বিশ্বব্রহ্মা নিজ হাতে মন্দির নির্মাণ করেন। অন্য একটি কাহিনী হলো অতীতে এখানে নরবলি দেয়া হতো। তবে মন্দিরে বর্তমান সেবায়েত এই কাহিনী নাকচ করে দিয়ে বলেন-মন্দিরের পার্শ্ববর্তী গ্রামে এক বিধবা মহিলা ছিল। সম্ভবত চরিত্র নষ্টের আশংকায় বিধবা মহিলাটিকে দুর্গার সন্তুষ্টির জন্য দেবী মন্দিরে পূজার উদ্দেশ্যে নিয়ে আসা হয়। দুর্গা সন্তুষ্ট চিত্তে বিধবাটিকে পূজা হিসেবে গ্রহণ করে ফিরিয়ে দেয়। বিধবা মহিলাটি অক্ষত শরীরে মন্দির থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু এ ঘটনাটি লোকমুখে নরবলির কাহিনীতে রূপান্তরিত হয়।
জনশ্রুতি আছে এ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা গৌরলাল রায় চৌধুরী নামক এক নিঃসন্তান ভূস্বামী। তার বাড়ি মন্দির থেকে দুশ গজ পশ্চিমে। বাড়িটি ছোট দুর্গের মতো। বাড়ির চারদিকে ১৫ ফুট উঁচু মাটির প্রাচীর এবং ২৫ ফুট প্রশস্ত গভীর জলাধার দ্বারা সুরক্ষিত। গৌরলাল রায় চৌধুরী মনোরঞ্জনের জন্য জলাধারে নৌকায় করে সেবিকা ও দাসীদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। দুর্গটির পশ্চিম উত্তর ও দক্ষিণের প্রাচীরের কিছু অংশ এখনো আছে। পূর্বদিকের প্রাচীরটি কেটে ফেলা হয়েছে। দুর্গের ইট কিংবা ইমারতের চিহ্ন পাওয়া যায় না। চাষাবাদের সময় বা খননের সময়ও কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। তবে এমন ধারণা অস্বাভাবিক নয় যে, এটি কোনো রাজা সাময়িকভাবে দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করতেন। মন্দির নির্মাণ কৌশলে মনে হয় এগুলো মোঘল আমলের তৈরি। তবে দেবী মন্দিরের বেদীতে পরিষ্কার বাংলায় যে ছয়টি নাম লেখা আছে তন্তুা সংস্কারের পর লিখিত হয়েছিল।
অবস্থান:
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে নয় কিলোমিটার দূরে রুহিয়া যাওয়ার পথে ঢোলরহাট নামক স্থানে অবস্থিত
ভেমটিয়া শিবমন্দির
পীরগঞ্জ পৌরসভা থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্বে ভেমটিয়া নামক জায়গায় শিব মন্দির আছে। মন্দিরটি প্রায় তিনশত বছর পূর্বের। মন্দিরের পূর্বদিকে দেয়াল ধসে পড়েছে। দক্ষিণের দেয়ালে একটি দরজা আছে। মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৩৫ ফুট।
অবস্থান:
পীরগঞ্জ পৌরসভা থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্বে ভেমটিয়া নামক স্থানে শিব মন্দিরটি অবস্থিত
মালদুয়ার দুর্গ
রানীশংকৈল উপজেলা হতে এক কিলোমিটার দক্ষিণে একটি প্রাচীন দুর্গের সন্ধান পাওয়া যায়। দুর্গটির আয়তন প্রায় ২.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এক কিলোমিটার প্রস্থ। এর প্রাচীর মাটির তৈরি ও বাইরে জলাধারের চিহ্ন রয়েছে। দুর্গটির উত্তরাংশে যেখানে গ্রাম ও বাজার আছে সেখানে প্রাচীন ইট,মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ এবং প্রাচীন পাথরের মূর্তি পাওয়া যায়। এগুলো থেকে অনুমান করে প্রত্নতাত্ত্বিক জনাব যাকারিয়া বলেছেন এখানে প্রাচীনকালে হিন্দু, বৌদ্ধ যুগের একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল।
অবস্থান:
রানীশংকৈল উপজেলা হতে এক কিলোমিটার দক্ষিণে প্রাচীন দুর্গটি অবস্থিত
গড়গ্রাম দুর্গ
রানীশংকৈল উপজেলার প্রায় তের মাইল উত্তরে নেকমরদ হাট ও মাজার। এখান থেকে প্রায় দু'কিলোমিটার উত্তরে গড়গ্রামে একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। দুর্গটির বাইরে পরিখা আছে। দুর্গের প্রাচীরগুলো মাটির। এর আয়তন দৈর্ঘ্যে প্রায় ৫০০ মিটার এবং প্রস্থ ৩০০ মিটার। দুর্গটি ছোট হলেও বিচিত্র ধরনের। কারণ দুর্গটির ভেতরে আরেকটি ছোট দুর্গ ছিল যার অস্তিত্ব এখনো বোঝা যায়। দুর্গের বাইরে সন্নিকটে উত্তরে ইট পাথর ও বিভিন্ন প্রত্নবস্ত্ততে পূর্ণ একটি ঢিবি ছিল যা মূলত ইমারতের অস্তিত্ব বোঝায়। ধারণা করা হয় এখানে হিন্দু বৌদ্ধযুগের মন্দির জাতীয় কোনো ইমারত ছিল। এছাড়া দুর্গে মসৃণ কালো পাথর পাওয়া গিয়েছিল যা দিনাজপুর জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। পাথরটিতে সাপের পূর্ণফণার আকারে খোদিত রয়েছে পদ্মপাপড়ির কারুকার্য। এই অলংকরণ দশম একাদশ শতাব্দীর হতে পারে।
অবস্থান:
রানীশংকৈল উপজেলার প্রায় তের মাইল উত্তরে নেকমরদ হাট ও মাজার থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তরে গড়গ্রামে দুর্গের ধ্বংসাবশেষটি অবস্থিত
বাংলা গড়
রানীশংকৈল উপজেলা থেকে প্রায় আট কিলোমিটার উত্তরে এবং নেকমরদ থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পূর্বদিকে কাতিহার- পীরগঞ্জ যাওয়ার রাস্তায় বাংলা গড় অবস্থিত। গড়ের ভিতর দিয়েই একটি পাকা রাস্তা পীরগঞ্জ রানীশংকৈলে চলে গেছে। গড়টির পশ্চিমদিকে এক বিশাল নদী প্রবাহিত ছিল যা এখন সম্পূর্ণ মৃত। মাটির প্রাচীর ও গভীর পরিখা দ্বারা গড়টি পরিবেষ্টিত। প্রবাদ আছে যে এখানে চাঁদ সদাগরের বাড়ি ছিল- বাসর রাতে লখিন্দরকে মনসাদেবীর কাল নাগিনী বাংলা গড়েই দংশন করেছিল।
গড়টির প্রাচীনত্ব নির্ণয় করা খুব কঠিন। ধারণা করা হয় মুসলিম শাসন আমলের বহু বছর পূর্বে এটা নির্মিত হয়েছিল। ঝামা ইটের মত কালো রঙের ছিদ্রযুক্ত ইট ও নির্মাণ কৌশল দেখে গড়টিকে অত্যন্ত প্রাচীন বলে মনে হয়। অনুমান করা হয় যে, নেকমরদ অঞ্চল যারা শাসন করতেন তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গভীর অরণ্যের ভিতর এই গড় তৈরি করা হয়েছিল। মুসলমানদের আগমনের অনেক আগেই গড়টি জনশূন্য ও পরিত্যক্ত হয়।
অবস্থান:
রানীশংকৈল উপজেলা থেকে প্রায় আট কিলোমিটার উত্তরে এবং নেকমরদ থেকে প্রায় পাঁচকিলোমিটার পূর্বদিকে কাতিহার-পীরগঞ্জ যাওয়ার পথে এটি অবস্থিত
কোরমখান গড়
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে প্রায় এগার কিলোমিটার উত্তরে টাঙ্গন ব্যারেজ থেকে দু'কিলোমিটার পূর্বে কোরমখান গড়। সম্ভবত সুলতানি আমলে গড়টি নির্মিত হয়েছিল। আবার অনেকে মনে করেন সম্রাট শাহজাহানের আমলে এটি নির্মিত। সম্রাটের প্রথম নাম খুররম থেকে কোরম শব্দটি এসেছে। মেজর শেরউইলের মানচিত্রে এ গড়কে বলা হয়েছে 'কোরমখান গড়'। ফ্রান্সিস বুকানন এর নাম উল্লেখ করেছেন 'মোঘলিকোট' হিসেবে।
কোরমখান গড় থেকে প্রায় দু'কিলোমিটার উত্তরে কোয়েলি রাজার দুর্গ। বর্তমানে এ দুর্গটি পঞ্চগড় জেলার অন্তর্ভুক্ত। এর সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে অনুমান করা হয় কামরূপের কোনো নৃপতি কোরমখান গড়ে সামরিক অভিযান চালানোর উদ্দেশ্যে কোয়েলি দুর্গ নির্মাণ করেন। মোঘল সাম্রাজ্য ও কুচবিহার সীমান্ত সংলগ্ন সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত সুরক্ষিত কোরমখান গড়টি বর্গাকৃতির এবং দৈর্ঘ্যে প্রস্থে প্রায় এক কিলোমিটারের কাছাকাছি। দুর্গটির বাইরে চারদিক চল্লিশ ফুট প্রশস্ত ও গভীর পরিখা এবং বিশ ফুট উঁচু মাটির প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। আবার উত্তর ও দক্ষিণে বাইরের প্রাচীর থেকে ভিতরে প্রায় তিনশ ফুট দূরে আরো দু'টি করে পরিখা ও প্রাচীর রয়েছে। পশ্চিম প্রাচীর সংলগ্ন একটি বিরাট দিঘি আছে। দিঘির পূর্ব প্রান্তে ভূমিতে প্রাচীন ইমারতের প্রচুর ইটের টুকরা পাওয়া যায়। দক্ষিণের ভিতরের প্রাচীরে একটি প্রাচীন কূপ আবিষ্কৃত হয়। জানা যায় কূপটি মাটি ঢাকা ছিল এবং মাটির প্রাচীর কাটার সময় এটি স্থানীয় লোকজনেরা দেখতে পায়।
অবস্থান:
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে প্রায় এগার কিলোমিটার উত্তরে টাঙ্গন ব্যারেজ থেকে দু'কিলোমিটার পূর্বে কোরমখান গড় অবস্থিত
সাপটি বুরুজ
ঠাকুরগাঁও উপজেলার ভুল্লীহাট থেকে দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে সাপটি বুরুজ অবস্থিত। বুরুজ মূলত পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। মোঘল সাম্রাজ্য ও কুচবিহারের সীমান্ত এলাকা ছিল এ অঞ্চল।। মনে করা হয় মোঘলরা সীমান্ত পর্যবেক্ষণের জন্য এ অঞ্চলে সাতটি বুরুজ তৈরি করেছিল। সাতটি বুরুজের একটি হলো সাপটি বুরুজ। সাতটি শব্দটি বিকৃত হয়ে সাপটি শব্দ হয়েছে। বুরুজটি বর্তমানে মাটির ঢিবিমাত্র। প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু এবং শীর্ষদেশে ইটের টুকরা পাওয়া যায়। বুরুজটির নিকটেই একটি পুকুর আছে-তাকে সাপটি দিঘি বলে।
অবস্থান:
ঠাকুরগাঁও উপজেলার ভুল্লীহাট থেকে দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে সাপটি বুরুজ অবস্থিত
পীর নাছিরউদ্দীন শাহ্ এর মাজার শরীফ।
কিভাবে যাওয়া যায়:
১)রাণীশংকৈল উপজেলা হইতে উত্তরে হাইওয়ে রাস্তা ১০কি:মি: পরে নেকমরদ । নেকমরদ চৌরাস্তর পূর্বে মাজার শরীফটির অবস্থান।
অবস্থান:
নেকমরদ চৌরাস্তার পূর্ব পার্শে মাজার শরীফটির অবস্থান।
বাংলাগড়
কিভাবে যাওয়া যায়:
ঠাকুরগাও জেলা হতে পশ্চিমে ৪০কি:মি: পাকা রাস্তা রাণীশংকৈল উপজেলা, আবার রাণীশংকৈল উপজেলা হতে উত্তরে নেকমরদ ১০কি:মি:, নেকমরদ হতে বাংলাগড় ৭কি:মি: পুবে।
এখানে অনেক দিন আগে এক রাজা বসবাস করেছিলেন।উনার নাম ছিল চান্দু সওদাগর।তিনি বাড়িব চতুর পার্শে মাটিদিয়ে প্রায় ৩০ফিট উচু এক দেওয়াল তৈরী করেছিলেন।এখন সেটা বাংলাগড় নামে পরিচিত।
অবস্থান:
গ্রাম:বাংলাগড়, ডাক:বাংলাগড়, উপজেলা:রাণীশংকৈল, জেলা:ঠাকুরগাঁও
গোরকই মন্দির ।
কিভাবে যাওয়া যায়:
২)রাণীশংকৈল উপজেলা হইতে উত্তরে হাইওয়ে রাস্তা ৮কি:মি: কুমোড়গঞ্জ মোড়। কুমোড়গঞ্জ মোড় হতে পশ্চিমে কাঁচা রাস্তায় ৪কি:মি: দূরে গোরকই মন্দিরের অবস্থান।
অবস্থান:
২) নেকমরদ ইউপির ৯নং ওয়ার্ডে গোরকই গ্রামে মন্দিরটির অবস্থান।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন