সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ১২১-১২৬ পর্ব-২২
সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ১২১-১২৬ পর্ব-২২
সূরা ত্বোয়া-হা'র ১২১ ও ১২২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
فَأَكَلَا مِنْهَا فَبَدَتْ لَهُمَا سَوْآَتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَرَقِ الْجَنَّةِ وَعَصَى آَدَمُ رَبَّهُ فَغَوَى (121) ثُمَّ اجْتَبَاهُ رَبُّهُ فَتَابَ عَلَيْهِ وَهَدَى (122)
“এরপর তারা ওর ফল খেল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা উদ্যানের গাছের পাতা দিয়ে নিজেদের (লজ্জাস্থান) আবৃত করতে লাগল। আদম তার প্রতিপালকের অবাধ্য হওয়ার কারণে পথভ্রষ্ট হল।”(২০:১২১)
“এরপর তার প্রতিপালক তাকে মনোনীত করলেন, তার প্রতি ক্ষমাপরবশ হলেন ও তাকে পথনির্দেশ করলেন।” (২০:১২১)
আগের পর্বে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ আদম ও হাওয়াকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, তোমরা যেন শয়তানের ধোঁকায় না পড়। কারণ, সে তোমাদের শত্রু এবং সে তোমাদেরকে বেহেশত থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু তারপরও শয়তান তাদেরকে এত বেশি প্ররোচনা দেয় যে, তারা শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে ফেলেন। এ ফল খাওয়ার পর প্রথম যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো তাদের শরীর থেকে বেহেশতি পোশাক খুলে যায় এবং তারা নগ্ন হয়ে যান। এ অবস্থায় তারা গাছের পাতা দিয়ে লজ্জা নিবারণ করেন।
শয়তান তাদেরকে যে কথা বলে ওই নিষিদ্ধ গাছের ফল খেতে প্ররোচনা দিয়েছিল তা হলো, এ গাছের ফল খেলে তাদের মর্যাদা বেড়ে যাবে এবং তারা অমরত্ব লাভ করবেন। কিন্তু শয়তানের অন্য সব প্রতিশ্রুতির মতো এটিও ছিল মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে আদম ও হাওয়া যখন চরম বিপদে পড়ে যান তখন ইবলিস সেখান থেকে চম্পদ দেয়। আদম ও হাওয়া এ ঘটনায় শয়তানের ধোঁকাবাজির কাছে হেরে যাওয়ার পাশাপাশি আল্লাহর অবাধ্য হন এবং তাঁর সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে যান।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. আজ সারাবিশ্বে কাপড় খোলা ও নগ্নতার যে জোয়ার বইছে তা শয়তানের অনুসরণ ও আল্লাহর অবাধ্যতার ফল। সৃষ্টির আদি মাতা-পিতা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে শয়তানের কুমন্ত্রণায় কান দেয়ার কারণে নগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন।
২. আল্লাহর অবাধ্যতা মানুষকে সুখ ও সমৃদ্ধি থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং সে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।
৩. আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পথ সব সময় খোলা রয়েছে। মানুষ যে কোনো সময় তওবা করে তাঁর পথে ফিরে আসতে পারে।
সূরা ত্বোয়া-হা'র ১২৩ ও ১২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالَ اهْبِطَا مِنْهَا جَمِيعًا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَى (123) وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى (124)
"তিনি বললেন- তোমরা একে অপরের শত্রুরূপে একই সঙ্গে জান্নাত থেকে নেমে যাও। পরে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সত্পথের নির্দেশ এলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না, দুঃখ-কষ্টও পাবে না।”(২০:১২৩)
“যে আমার স্মরণে বিমুখ তার জীবনের ভোগ-সম্ভার হবে সঙ্কুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব।”(২০:১২৪)
আদম ও হাওয়া অনুশোচনা ও তওবা করার পর আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন ঠিকই কিন্তু তাদেরকে বেহেশত থেকে বের করে দেন। তাদের পাশাপাশি শয়তানকেও নির্দেশ দেন ধুলির ধরায় নেমে আসতে। কিন্তু এরপরও মানুষের সঙ্গে শয়তানের শত্রুতা চলতে থাকে।
এরপর মানুষকে সত্পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর রীতি ঘোষণা করে এই আয়াতে বলা হয়েছে: যখনই তোমাদের কাছে কোনো নবী-রাসূল পাঠাবো তখনই তাকে অনুসরণ করবে। কারণ তোমাদের সৌভাগ্য ও সফলতা নির্ভর করছে তাকে অনসরণের ওপর। কিন্তু তিনি যা বলেন তা উপেক্ষা করে যদি আল্লাহকে ভুলে যাও তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে কঠিন দুঃখ-দুর্দশা ও আজাবের সম্মুখীন হতে হবে। দুনিয়াতে দুঃখ-দুর্দশার পাশাপাশি আখেরাতে অন্ধ অবস্থায় আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে। মানুষের জন্য চূড়ান্ত সাফল্য অর্থাত্ জান্নাতে যাওয়ার সৌভাগ্য তার হবে না।
দুনিয়ার জীবনে দুঃখ-দুর্দশার অর্থ এই নয় যে, মানুষ চরম আর্থিক অটনটে থাকবে কিংবা অশিক্ষা-কুশিক্ষায় ভুগবে। যাদের অঢেল অর্থ-সম্পদ রয়েছে তারা যে সুখেই রয়েছে এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। পৃথিবীতে বহু সম্পদশালী লোক আছে যারা কৃপণতা, লোভ ও পরধনলিপ্সার কারণে সারাক্ষণ মানসিক অশান্তি ও উদ্বেগের মধ্যে থাকে। এ ছাড়া, দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনকারী ব্যক্তিরাও সব সময় বিবেকের দংশনে ভোগে।
যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভুলে গিয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে- দুনিয়ার সম্পদ ছাড়া তাদের আশা-ভরসার আর কোনো জায়গা থাকে না। তারা সম্পদ অর্জন ও তা জমিয়ে পাহাড় গড়াকেই ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত করে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে গিয়ে শুধু সম্পদ আহরণে ব্যস্ত থাকে। এ ধরনের মানুষ যত সম্পদের অধিকারী হয় ততই তার লোভ বাড়তে থাকে এবং সম্পদের বিশাল ভাণ্ডারও তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। সারাক্ষণ সে ‘আরো চাই’ রোগে ভুগতে থাকে এবং এভাবে অসন্তুষ্ট ও মনোকষ্ট নিয়েই সে একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।
এ দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১. আল্লাহ ও তাঁর পাঠানো নবী-রাসূলদের দিক-নির্দেশনা মেনে চলার ওপর দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য ও সৌভাগ্য নির্ভর করে।
২. আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরে গেলে মানুষের অঢেল টাকা-পয়সা থাকা সত্ত্বেও সে মানসিক অশান্তি, দুঃখ, ভয় ও উদ্বেগের মধ্যে থাকে।
৩. এ পৃথিবীতে যারা সঠিক পথের সন্ধান পেতে চায় না, কেয়ামতের দিন তারা অন্ধ অবস্থায় কবর থেকে উপরে উঠবে।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ১২৫ ও ১২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا (125) قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آَيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَى (126)
“সে বলল- হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলে? আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন!”(২০:১২৫)
“তিনি বললেন- তুমি এইরূপেই ছিলে, আমার নিদর্শনাবলী তোমার কাছে এসেছিল কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। সেইভাবে আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হবে।”(২০:১২৬)
আখেরাতের জীবন হবে মানুষের দুনিয়ার জীবনের কর্মফল। নবী-রাসূল ও আসমানি গ্রন্থের মাধ্যমে পাঠানো আল্লাহর বাণী অস্বীকার করলে মানুষ কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত হবে। সেদিন তার কোনো প্রতিবাদ আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। এ আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী শুধু কাফেররা নয় সেইসঙ্গে যেসব মুসলমান পবিত্র কুরআনকে অবজ্ঞা করেছে অথবা নামাজ-রোজার মতো অবশ্য পালনীয় কর্তব্যগুলো পালন করেনি কেয়ামতের দিন তাদের একই ধরনের পরিণতি হবে।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হল:
১. আল্লাহ মানুষকে তার কর্ম অনুযায়ী ফল দেন এবং এক্ষেত্রে তিনি বিন্দুমাত্র অবিচার করেন না।
২. দুনিয়ার জীবনে দৃষ্টিশক্তি গুরুত্বপূর্ণ হলেও কেয়ামতের দিন এ দৃষ্টিশক্তি আরো বেশি জরুরি হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, সেদিন বেহেশতের অফুরন্ত নেয়ামত হবে দর্শনীয় এবং তা দেখা থেকে বঞ্চিত মানুষের কষ্টের সীমা থাকবে না।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন