সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ১১০-১১৪ পর্ব-২০ 

সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ১১০-১১৪ (পর্ব-২০)
সূরা ত্বোয়া-হা'র ১১০ ও ১১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا (110) وَعَنَتِ الْوُجُوهُ لِلْحَيِّ الْقَيُّومِ وَقَدْ خَابَ مَنْ حَمَلَ ظُلْمًا (111)
“আল্লাহ মানুষের অতীত ও ভবিষ্যত সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত,কিন্তু মানুষ (তাদের সীমিত) জ্ঞান দিয়ে আল্লাহর জ্ঞান আয়ত্ব করতে পারবে না।” (২০:১১০)
“এবং (কিয়ামতের দিন) চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী বিধাতার সামনে তাদের মস্তক হবে অবনত এবং যে জুলুমের ভার বহন করবে সে হবে ব্যর্থ।” (২০:১১১)
আগের কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা বলেছি, কিয়ামতের দিন বিশ্বের সব মানুষ মহান ন্যায়বিচারক আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে এবং তাদের প্রত্যেকের কর্মফলের ভিত্তিতে বিচার করা হবে। এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: অপরাধীরা অতীতে দুনিয়ায় কী করেছে এবং তাদের ভবিষ্যত কী হবে- সে সম্পর্কে মহান আল্লাহ খুব ভালোভাবেই জানেন। মানুষের প্রতিটি কার্যকলাপ এমনকি মনের খবরও আল্লাহর অগোচরে নয়। কিন্তু আল্লাহর কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে মানুষের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। এ কারণে মানুষ কিয়ামতের দিন অবনত মস্তকে আল্লাহর সামনে হাজির হবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই যারা অন্যের ওপর জুলুম করেছে, নবী-রাসূলদের কথা মেনে নিয়ে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করেনি, আল্লাহর রহমত লাভ করার কোনো আশাই তাদের মনে থাকবে না। সেদিন তারা চরম হতাশ হয়ে পড়বে।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১. পার্থিব জীবনে মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তিতে যেমন মানুষের ব্যক্তিত্ব ও পরিচয় ফুটে ওঠে তেমনি কিয়ামতের দিনও মুখমণ্ডল দেখেই বোঝা যাবে, কে জান্নাতবাসী হচ্ছে আর কে জাহান্নামে যাচ্ছে।
২. তওবা করে অতীতের ভুল শুধরে নেয়ার স্থান হচ্ছে পৃথিবী। কিন্তু কিয়ামতের দিন এ ধরনের কোনো সুযোগ নেই। তবে সেদিন নবী-রাসূল ও আউলিয়ারা অনেক মানুষকে শাফায়াত করবেন। তবে সে শাফায়াত হবে তাদের প্রাপ্য আল্লাহর প্রতি যাদের অগাধ বিশ্বাস থাকলেও ভুল করে ছোটখাটো পাপকাজ করে বসেছে। গুনাহগার ও পাপী বান্দারা শাফায়াত পাবে না।
সূরা ত্বোয়া-হা'র ১১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَا يَخَافُ ظُلْمًا وَلَا هَضْمًا (112)
“এবং যে বিশ্বাসী হয়ে সত্‌কাজ করে, সে কোনো অবিচার ও ক্ষতির আশঙ্কা করে না।” (২০:১১২)
আগের আয়াতে কিয়ামতের কঠিন দিনে পাপী বান্দাদের অবস্থা বর্ণনা করে বলা হয়েছে, তারা সেদিন থাকবে অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত এবং হতাশ। আর এ আয়াতে কিয়ামতের দিন মুমিন বান্দাদের অবস্থা বর্ণনা করে বলা হচ্ছে: আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী যেসব মানুষ সত্‌কাজ করেছে এবং অসত্‌কাজ থেকে বিরত থেকেছে, তারা তাদের পুরস্কার পূর্ণাঙ্গভাবে বুঝে পাবে এবং তাদেরকে সামান্য পরিমাণও কম দেয়া হবে না।
ইসলামী সংস্কৃতিতে ঈমান বা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সত্‌কাজ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ দু’টি বিষয়কে একটি গাছের ফল ও শেকড়ের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। আমল বা সত্‌কাজ ছাড়া ঈমান ফলবিহীন গাছের মতো এবং ঈমানবিহীন আমল যেন একটি শেকড়বিহীন গাছ।
সত্যি কথা বলতে কী, আল্লাহ ও কিয়ামতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস না থাকলে মানুষ সত্‌কাজ করতে পারে না। যদি কোনো অবিশ্বাসী লোক ভালোকাজ করে তাহলে বুঝতে হবে মহান আল্লাহ তার ভেতরে যে পবিত্র সত্ত্বা দিয়েছিলেন, তার সদ্ব্যবহার করে সে ভালো কাজ করছে। সে মুখে আল্লাহকে অস্বীকার করলেও তার ভেতরে আল্লাহর প্রতি সুপ্তভাবে একটি বিশ্বাস রয়েই গেছে। সেই বিশ্বাস তাকে সত্‌কাজে উতসাহিত করছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের ভালো কাজের প্রতিদান মানুষ এ পৃথিবীতেই পায় এবং তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন সুখী ও সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু যারা কিয়ামতকে অস্বীকার করেছে তারা শেষ বিচারের দিন আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার আশা করতে পারে না। এ ছাড়া, যে ব্যক্তি শুধুমাত্র পৃথিবীতে সুখী ও সমৃদ্ধশালী হওয়ার জন্য কাজ করেছে, আল্লাহ বা পরকালে যার কোনো বিশ্বাস ছিল না, আল্লাহর কাছ থেকে পরকালীন জীবনে সে পুরস্কার পেতে পারে না।
অবশ্য মহান আল্লাহর দয়া ও রহমতের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যেসব ভালো কাজ সত্‌ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে সে কাজের পুরস্কার তিনি দিতে ভুল করেন না। তবে যাকে পুরস্কার দেয়া হলো সে এ পুরস্কারের প্রাপ্য ছিল না কারণ, আল্লাহ বা কিয়ামতের ওপর সে বিশ্বাস আনেনি।
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১. যেসব মানুষ তাদের যোগ্যতা ও প্রতিভা অনুযায়ী ভালো কাজ করবে তারা সে কাজের পুরস্কার পাবে। কাজটি বড় কিংবা ছোট হোক তা বিবেচ্য বিষয় নয়।
২. ভালো কাজের জন্য পরকালে পুরস্কার পাওয়ার শর্ত হচ্ছে তা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে করতে হবে
এই সূরার ১১৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَكَذَلِكَ أَنْزَلْنَاهُ قُرْآَنًا عَرَبِيًّا وَصَرَّفْنَا فِيهِ مِنَ الْوَعِيدِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ أَوْ يُحْدِثُ لَهُمْ ذِكْرًا (113)
“এবং এভাবেই আমি কুরআনকে শুদ্ধ আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছি এবং ওতে বিভিন্নভাবে (মানুষকে খারাপ কাজের পরিণতি সম্পর্কে) সতর্ক করেছি, যাতে ওরা ভয় করে অথবা (অন্তত) উপদেশ হিসেবে গ্রহণ করে।” (২০:১১৩)
কিয়ামত সংক্রান্ত আলোচনা এবং মুমিন ও পাপী বান্দাদের পরিণতির কথা উল্লেখের পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, পবিত্র কুরআন নাজিলের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে সব কারণে মানুষ জাহান্নামে যায় সে সব কারণ তাদের সামনে তুল ধরা। আল্লাহ বলছেন, কুরআনে আমি দুনিয়া ও আখেরাতে বিভিন্ন জাতির পরিণতি তুলে ধরেছি যাতে ঈমানদার ব্যক্তিরা তা থেকে শিক্ষা নিয়ে খারাপ ও নোংরা কাজ থেকে বিরত থাকে।
বিশ্বনবী (সা.) এরও দায়িত্ব ছিল প্রতিনিয়ত মানুষকে সতর্ক করে দেয়া যাতে মানুষ সঠিক ও সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গভীর খাদে পড়ে না যায়।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দু'টি দিক হচ্ছে:
১. পবিত্র কুরআন মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে। সম্ভাব্য বিপদাপদ থেকে মুক্ত থাকার লক্ষ্যে মানুষকে ভয় দেখানো এবং সতর্ক করা দাওয়াতি কাজের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
২. মানুষকে প্রতিনিয়ত সতর্ক করতে হয়। এর ফলে তার সত্‌পথে ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
সূরা ত্বোয়া-হা'র ১১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَتَعَالَى اللَّهُ الْمَلِكُ الْحَقُّ وَلَا تَعْجَلْ بِالْقُرْآَنِ مِنْ قَبْلِ أَنْ يُقْضَى إِلَيْكَ وَحْيُهُ وَقُلْ رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا (114)
“আল্লাহ অতি মহান, প্রকৃত অধীশ্বর। (হে রাসূল!) তোমার প্রতি আল্লাহর ওহী সম্পূর্ণ হওয়ার আগে তুমি কুরআন পাঠে তাড়াহুড়া কর না এবং বল- হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও।” (২০:১১৪)
কিয়ামতের বিচার দিবসের ব্যাপারে আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে বলা হচ্ছে: কিয়ামতের দিন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী থাকবেন একমাত্র আল্লাহ। তবে সেদিন তিনি প্রতিটি নির্দেশ দেবেন ন্যায়বিচারের মাধ্যমে। মানুষ ও জ্বীন তার নিজের সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও সেদিন তিনি তাদের ওপর কোনো ধরনের জুলুম করবেন না।
আয়াতের পরবর্তী অংশে কুরআন নাজিলের পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। হাদিসে এসেছে, পবিত্র কুরআন দুই ধাপে বিশ্বনবীর উপর নাজিল হয়েছে। একবার শবে কদরের রাতে পূর্ণাঙ্গ কুরআন নাজিল হয়েছে। আরেকবার দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে মক্কা ও মদীনায় ধাপে ধাপে তা রাসূলের কাছে অবতীর্ণ হয়েছে। এ কারণে প্রতিবার হযরত জিব্রাইল যখনই বিশ্বনবীর কাছে ঔশী বাণী নিয়ে আসতেন তখনই রাসুলুল্লাহ তা পড়ার জন্য তাড়াহুড়া করতেন এবং এসব আয়াত তার আগে থেকে জানা ছিল বলে জিব্রাইল কোনো আয়াত বলতে গেলেই তিনি নিজে থেকেই তা আবৃত্তি করতে শুরু করতেন। পবিত্র কুরআনে এ কাজ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে আল্লাহ বলেন: এমনকি ওহী গ্রহণের ক্ষেত্রেও তাড়াহুড়া করবেন না।
তবে এখানে বলতে হয়, সাধারণ মানুষ অধৈর্য হয়ে পড়ার কারণে বা অন্যের সামনে নিজেকে জাহির করার উদ্দেশ্যে অনেক সময় তাড়াহুড়া করে। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.) ওহী পড়ায় তাড়াহুড়া করতেন মহান আল্লাহর বাণীর প্রতি গভীর ভালোবাসার জন্য। সূরা কিয়ামাহ’র ১৬ নম্বর আয়াতেও এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. আগে কি শিখেছিলাম তার ওপর নির্ভর না করে প্রতি মুহূর্তে আমাদেরকে নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করতে হবে। এমনকি যে বিশ্বনবী আল্লাহর ওহী সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত ছিলেন তাকেও তা মনে করে আবৃত্তি করার পরিবর্তে নতুন করে শোনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
২. জানার কোনো শেষ নেই। কাজেই দুনিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থায় গ্রাজুয়েশনের যে পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে তার কোনো অর্থ হয় না।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন