সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ১০৫-১০৯ (পর্ব-১৯)

সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ১০৫-১০৯ (পর্ব-১৯)
সূরা ত্বোয়া-হা’র ১০৫ থেকে ১০৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْجِبَالِ فَقُلْ يَنْسِفُهَا رَبِّي نَسْفًا (105) فَيَذَرُهَا قَاعًا صَفْصَفًا (106) لَا تَرَى فِيهَا عِوَجًا وَلَا أَمْتًا (107)
“(হে রাসূল) ওরা তোমাকে পর্বতসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে (এবং জানতে চায় কিয়ামতের দিনে এগুলোর পরিণতি কী হবে?), বল- আমার প্রতিপালক ওদের সমূলে উত্‌পাটন করে বিক্ষিপ্ত করে দেবেন।”(২০:১০৫)
“এবং এরপর তিনি ভূমিকে উন্মুক্ত সমতল ভূমিতে পরিণত করবেন।”(২০:১০৬)
“যেখানে তুমি কোনো উঁচু-নিচু দেখবে না।” (২০:১০৭)
এর আগের কয়েকটি আয়াতে এ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে কিয়ামত শুরু হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছিল। আর এ আয়াতে কিয়ামতের দিন ভূপৃষ্ঠের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলছেন, কেউ কেউ এ প্রশ্ন করছে যে, এত বিশাল বিশাল পাহাড়-পর্বত কীভাবে কিয়ামতের দিন তাদের জায়গা থেকে সরে যাবে? তাদের প্রশ্নের উত্তরে এ আয়াতে বলা হচ্ছে: যে আল্লাহ এই মাটি ও পাহাড় সৃষ্টি করেছেন তিনিই কিয়ামতের দিন এসব পাহাড়কে নির্দেশ দেবেন ধুলিকণার মতো বাতাসে ভেসে বেড়াতে। এরপর ভূপৃষ্ঠ মসৃণ বিস্তীর্ণ প্রান্তরে পরিণত হবে এবং সেখানে টিলা নামক কোনো কিছুরও অস্তিত্ব থাকবে না। শক্তিশালী এক ভূমিকম্পের মাধ্যমে এই বিশাল পরিবর্তন সংঘটিত হবে। মৃত মানুষদের জীবিত করে আল্লাহর দরবারের হাজির করার জন্য যে কিয়ামত সংঘটিত হবে, এটি হচ্ছে তার প্রস্তুতি পর্ব।
এ তিন আয়াতের দু'টি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১. এ পৃথিবীতে বর্তমানে বিদ্যমান প্রাকৃতিক ব্যবস্থা কিয়ামতের দিন ধ্বংস হয়ে যাবে এবং আরেকটি ব্যবস্থা শুরু হবে।
২. পৃথিবীতে বিরাজমান প্রাকৃতিক ব্যবস্থা আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলে। তিনি এ ব্যবস্থার নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য নন।
এই সূরার ১০৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
يَوْمَئِذٍ يَتَّبِعُونَ الدَّاعِيَ لَا عِوَجَ لَهُ وَخَشَعَتِ الْأَصْوَاتُ لِلرَّحْمَنِ فَلَا تَسْمَعُ إِلَّا هَمْسًا (108)
“সেই দিন ওরা আহ্বানকারীর (ফেরেশতা) অনুসরণ করবে, এই ব্যাপারে এদিক ওদিক করতে পারবে না। দয়াময় (আল্লাহর) বিশালত্বের সামনে সব শব্দ স্তব্ধ হয়ে যাবে, সুতরাং মৃদু গুঞ্জন ছাড়া তুমি কিছুই শুনবে না।” (২০:১০৮)
কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, ইস্রাফিল নামক ফেরেশতা কিয়ামতের দিন মানুষকে জীবিত হয়ে আল্লাহর দরবারে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানাবেন। তিনি এ কাজ করবেন শিঙ্গায় ফুত্‌কার দেয়ার মাধ্যমে। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেদিনের দৃশ্য এত বেশি ভয়ঙ্কর হবে যে, সবার দম বন্ধ হয়ে আসবে এবং কেউ ‘টু’ শব্দটি করার সাহস করবে না। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর শক্তিমত্তা ও প্রতিপত্তি সেদিন এত বেশি দৃশ্যমান হয়ে মানুষের সামনে ধরা দেবে যে, তারা নিজেদেরকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও অস্তিত্বহীন মনে করবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:
১. কিয়ামতের দিন হচ্ছে আল্লাহর মহাপরাক্রম দৃশ্যমান হয়ে ফুটে ওঠার দিন এবং সেদিন সবাই তার সামনে অবনত মস্তকে উপস্থিত হবে।
২. কিয়ামতের দিন আল্লাহর নির্দেশের প্রতিবাদ করা বা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। সবাই নিজের পায়ে হেটে সেই ময়দানে উপস্থিত হবে।
এই সূরার ১০৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
يَوْمَئِذٍ لَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلًا (109)
“(সেদিন) দয়াময় (আল্লাহ) যাকে অনুমতি দেবেন ও যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট সে ছাড়া কারো শাফায়াত (বা সুপারিশ) সেদিন কোনো কাজে আসবে না।” (২০:১০৯)
খুব স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের একটি ভয়ানক ও ভীতিকর জায়গায় মানুষের করার কিছুই থাকবে না। তাদেরকে শুধুমাত্র আল্লাহর করুণার ওপর নির্ভর করতে হবে। এ অবস্থায় সব মানুষ তাদের মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে শাফায়াত বা সুপারিশকারীর সন্ধান করবে। কিন্তু এ আয়াতে বলা হচ্ছে: যাকে শাফায়াত করার মর্যাদা ও অনুমতি দেয়া হয়েছে সে ছাড়া সেদিন অন্য কেউ মানুষের মুক্তির জন্য শাফায়াত বা সুপারিশ করতে পারবে না। পৃথিবীতে যিনি নিজের ঈমান ও সত্‌কাজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছেন, তাকেই শাফায়াত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
আসলে আল্লাহ তায়ালা শাফায়াতের ব্যবস্থা এজন্য রেখেছেন যে, সত্‌পথে থাকার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানোর পরও যদি মানুষের কোনো কথা ও কাজে ছোটখাট ভুল-ত্রুটি থেকে গিয়ে থাকে, তাহলে সে যেন নিরাশ না হয়। কিয়ামতের দিন শাফায়াত অনেকটা পার্থিব জীবনের তওবা করার মতো বিষয়। সেদিন আল্লাহর অনুমোদনপ্রাপ্ত মহামানবরা কারো জন্য শাফায়াত করলে সে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করবে এবং সরাসরি জান্নাতে চলে যেতে পারবে।
শাফায়াতের এই ব্যবস্থা নবী-রাসূল এবং অলি-আউলিয়াদের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে গভীর করে দেয়। যারা কিয়ামতের দিন বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের (আ.) শাফায়াত পেতে চায়, তারা স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীতে এসব মহান ব্যক্তির রেখে যাওয়া আদর্শ অনুসরণ করে। এসব মহামানবের মাযার যিয়ারতের সময় তাদের সঙ্গে এই অঙ্গীকার করে যে, আর কখনো অতীতের অপরাধের পুনরাবৃত্তি করবে না এবং ভবিষ্যতে আল্লাহর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করবে।
কিয়ামতের দিন শাফায়াত পাওয়ার ভাগ্য তাদেরই হবে যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস হবে খাঁটি এবং দুনিয়াতে কাজেকর্মেও আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলেছে। কিন্তু তারপরও মাঝেমধ্যে ঘটে যাওয়া কিছু ভুল-ত্রুটির জন্য তওবা করতে ভুলে গেছে।
কিয়ামতের দিন মানুষের কৃতকর্মের গুরুত্ব শাফায়াতের চেয়ে বেশি হবে বলে কুরআনে প্রথমে শাফায়াতের বিষয়টিকে অস্বীকার করা হয়েছে। এরপর বলা হয়েছে, শাফায়াতের ভাগ্য সুনির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য নির্ধারিত থাকবে। সেদিন শাফায়াতকারী ব্যক্তি এবং যাদের জন্য শাফায়ত করা হবে তারা সবাই আল্লাহর নির্দেশে এ কাজটি আঞ্জাম দেবেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১. কিয়ামতের দিন শাফায়াত করা হবে আল্লাহরই ইচ্ছায়, তার বিরুদ্ধাচরণের মাধ্যমে নয়।
২. কিয়ামতের দিন আল্লাহর একটি প্রতিশ্রুত নিয়ম হচ্ছে শাফায়াত। এটি পাওয়ার জন্য পৃথিবীতে আল্লাহর রাসূল ও তার আহলে বাইতের (আ.) সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন