সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৯৯-১০৪ (পর্ব-১৮)
সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৯৯-১০৪ (পর্ব-১৮)
সূরা ত্বোয়া-হা'র ৯৯ নম্বর আয়াতের মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেছেন:
كَذَلِكَ نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنْبَاءِ مَا قَدْ سَبَقَ وَقَدْ آَتَيْنَاكَ مِنْ لَدُنَّا ذِكْرًا (99)
“(হে রাসূল) পূর্বে যা ঘটেছে তার সংবাদ আমি এইভাবে তোমার কাছে বর্ণনা করি এবং নিশ্চয়ই আমি তোমাকে আমার পক্ষ থেকে স্মৃতিগ্রন্থ কুরআন দান করেছি।” (২০:৯৯)
আগের প্রায় ৯০টি আয়াতে হযরত মুসা (আ.) এর জীবনের ঘটনা বর্ণনা করার পর আল্লাহ-তায়ালা এই আয়াতে বিশ্বনবীকে উদ্দেশ করে বলছেন, অতীত জাতিগুলোর পাশাপাশি তাদের নবী-রাসূলদের ঘটনা ওহীর মাধ্যমে আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি যাতে মানুষ এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষকে সুপথে ফিরিয়ে আনার একটি উত্তম পন্থা হচ্ছে অতীতের সত্য ঘটনা বর্ণনা করা। এর ফলে এ পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া মানুষের কর্মতত্পরতা এবং তাদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ নিজের জীবনচলার জন্য সঠিক পথ বেছে নিতে পারে।
অতীত জাতিগুলোর ঘটনা আসলে আজকের জীবন চলার পাথেয়। বর্তমান বিশ্বের সব দেশ ও জাতি তাদের অতীত ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে বর্তমানকে সাজিয়েছে। অন্য কথায়, পৃথিবীর খুব কম সংখ্যক মানুষই যুক্তি-তর্ক এবং বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে তাদের জীবন সাজায়। বেশিরভাগ মানুষই তাদের পূর্বপুরুষদের কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে এবং তাদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. পবিত্র কুরআনের ঘটনাবলী সর্বোত্তম শিক্ষণীয় ঘটনা। কারণ, এর বর্ণনাকারী হচ্ছেন স্বয়ং বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ এবং তিনি এটি প্রথম জানিয়েছেন সেই বিশ্বনবীকে যাকে সৃষ্টি করা না হলে জগতের কোনো কিছুই সৃষ্টি হতো না। সেইসঙ্গে এসব গল্পের প্রতিটি ঘটনা সত্য, কাল্পনিক কোনো বিষয়বস্তুর অস্তিত্ব এতে নেই।
২. পবিত্র কুরআন অতীত নবী-রাসূলদের ঘটনা বর্ণনা করে সেসব ঘটনাকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করেছে।
সূরা ত্বোয়া-হার ১০০ ও ১০১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
مَنْ أَعْرَضَ عَنْهُ فَإِنَّهُ يَحْمِلُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وِزْرًا (100) خَالِدِينَ فِيهِ وَسَاءَ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حِمْلًا (101)
“যে কেউ কুরআন থেকে মুখ ফেরাবে, সে কিয়ামতের দিন (মহাপাপের) ভার বহন করবে।” (২০:১০০)
“ওখানে তারা স্থায়ী হবে এবং কিয়ামতের দিন এই বোঝা ওদের জন্য হবে কতই না খারাপ।” (২০:১০১)
পবিত্র কুরআন অতীতের বহু ঘটনাকে সহজবোধ্য ভাষায় বর্ণনা করে মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধ করার জন্য নাজিল হলেও কাফেরদের পাশাপাশি কিছু পাপী মুসলমান এই মহাগ্রন্থের সতর্কতাকে গুরুত্ব দেয় না। তারা কুরআন থেকে শিক্ষা নেয় না। পার্থিব ও পরকালীন জীবনে এ কাজের পরিণতি ভালো নয়। এই পৃথিবীর জীবন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং আজ না হোক কাল আমাদের মারা যেতেই হবে। কিন্তু পরকালীন জীবনের কোনো শেষ নেই এবং সেখান থেকে পালিয়েও বাঁচা সম্ভব হবে না। সেখান থেকে কাউকে আবার এই পৃথিবীর জীবনে ফিরে এসে অতীতের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দেয়া হবে না।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. গোনাহ বা পাপকাজের ওজন অত্যন্ত ভারী যা কেয়ামতের দিন দৃশ্যমান হয়ে উঠবে এবং পাপী ব্যক্তির পক্ষে সে ভার বহন করা সম্ভব হবে না।
২. পাপের প্রভাব নষ্ট হয়ে যায় না। এটি পাপী ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুনে পৌঁছে দেয়।
সূরা ত্বোয়া-হা'র ১০২ ও ১০৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ وَنَحْشُرُ الْمُجْرِمِينَ يَوْمَئِذٍ زُرْقًا (102) يَتَخَافَتُونَ بَيْنَهُمْ إِنْ لَبِثْتُمْ إِلَّا عَشْرًا (103)
“যেদিন শিঙ্গায় ফুত্কার দেয়া হবে, সেদিন আমি অপরাধীদের নীলচক্ষুবিশিষ্ট (বা দৃষ্টিহীন) অবস্থায় সমবেত করব।”(২০:১০২)
“ওরা নিজেদের মধ্যে চুপি চুপি বলাবলি করবে- তোমরা পৃথিবীতে ১০ দিনের বেশি অবস্থান করোনি।” (২০:১০৩)
এ আয়াতে কিয়ামতের কঠিন দিনে পাপী ব্যক্তিদের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ বলছেন, শিঙ্গায় ফুত্কার দেয়ার মাধ্যমে কিয়ামতের দিন শুরু হবে। পবিত্র কুরআনের অন্যান্য জায়গায় বলা হয়েছে, পৃথিবীর সমাপ্তি ও কিয়ামতের শুরু হবে দু'টি মহাপ্রলয়ের মাধ্যমে যার সঙ্গে থাকবে প্রচণ্ড শব্দ। শিঙ্গায় ফুত্কারের মাধ্যমে এ ঘটনা সংঘটিত হবে বলে বলা হয়েছে।
এই পৃথিবীতে যারা বিশালকায় দেহের অধিকারী ও দম্ভে যাদের পা মাটিতে পড়ে না এবং যাদেরকে দেখলে অন্যরা ভয় পেয়ে যায় তারা কিয়ামতের দিন অত্যন্ত কৃশকায় এবং অন্ধ ও দুর্বল আকৃতি নিয়ে উপস্থিত হবে। পৃথিবীর জীবনের পাশাপাশি মৃত্যু পরবর্তী কবরের দিনগুলো তাদের কাছে এত কম মনে হবে যে, তারা আপন মনে বলে উঠবে, ওই সময়গুলো ১০ দিনের বেশি ছিল না। এখান থেকে কিয়ামতের দিনের বিশালত্ব ও ভয়াবহতা ফুটে ওঠে।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
১. যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে পৃথিবীর জীবনের তুলনায় আখেরাতের জীবনকে প্রাধান্য দিতে হবে। ক্ষণস্থায়ী জীবনের স্বার্থসিদ্ধির জন্য চিরস্থায়ী পরকালকে হাতছাড়া করা যাবে না।
২.পাপী ও দাম্ভিক ব্যক্তিদের সামনে নিজেদের দুর্বল মনে না করে বরং তাদেরকে করুণা করতে হবে। পার্থিব জীবনে তারা দম্ভ দেখালেও শেষ বিচারের দিনে তারা থাকবে অসহায় ও নিরুপায়।
সূরা ত্বোয়া-হা'র ১০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَقُولُونَ إِذْ يَقُولُ أَمْثَلُهُمْ طَرِيقَةً إِنْ لَبِثْتُمْ إِلَّا يَوْمًا (104)
“ওরা কি বলবে তা আমি ভালোভাবে জানি, ওদের মধ্যে যে অপেক্ষাকৃত সত্পথে ছিল সে বলবে, তোমরা (পৃথিবীতে) মাত্র একদিন অবস্থান করেছিলে।” (২০:১০৪)
যারা কিয়ামতের দিন বলবে পৃথিবীর জীবন ছিল ১০ দিনের তাদের জবাবে এই আয়াতে বলা হচ্ছে: পৃথিবী ও পরকাল সম্পর্কে আল্লাহর চেয়ে বেশি কেউ জানে না। যারা পৃথিবীর জীবনকে কিয়ামতের সময়ের তুলনায় ১০ দিন বলেছে তারা ভুল করে দুনিয়ার জীবনকে অনেক বেশি দীর্ঘায়িত করে দেখতে চেয়েছে। কিন্তু যারা বিচার-বুদ্ধিসম্পন্নও ও যুক্তি-বুদ্ধি মেনে চলে তারা বলবে, পৃথিবীর জীবন ছিল মাত্র একদিনের। সত্যিই, পরকালীন জীবনের তুলনায় পৃথিবীর জীবন কোনো অবস্থায়ই একদিনের বেশি নয়।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. যার বিচার-বুদ্ধি যত বেশি সে পৃথিবীর জীবনকে তত কম সময়ের বলে গণ্য করে।
২. সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক পার্থিব জীবনকে ক্ষণস্থায়ী এবং এর প্রতি লোভকে ক্ষতিকর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বাস্তবদর্শী প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব ধারণক্ষমতা অনুযায়ী এ বিষয়টিকে উপলব্ধি করে।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিওৃ
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন