সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৯৫-৯৮(পর্ব-১৭)
সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৯৫-৯৮(পর্ব-১৭)
সূরা ত্বোয়া-হা'র ৯৫ ও ৯৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ فَمَا خَطْبُكَ يَا سَامِرِيُّ (95) قَالَ بَصُرْتُ بِمَا لَمْ يَبْصُرُوا بِهِ فَقَبَضْتُ قَبْضَةً مِنْ أَثَرِ الرَّسُولِ فَنَبَذْتُهَا وَكَذَلِكَ سَوَّلَتْ لِي نَفْسِي (96)
“মুসা (সামেরিকে) বলল- হে সামেরি! তুমি এ কী কাজ করেছো?” (২০:৯৫)
“সামেরি বলল- আমি (যা কিছু সম্পর্কে) অবগত হয়েছিলাম তা ওরা বুঝতে পারেনি, এরপর আমি রাসূলের স্মৃতি থেকে কিছু (জিনিস) নিয়েছিলাম এবং তা আমি নিক্ষেপ করেছিলাম (অর্থাত সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে মূর্তিপুজায় লিপ্ত হয়েছিলাম), এভাবে আমার প্রবৃত্তি আমাকে (খারাপ কাজে) তৃপ্তি দিয়েছিল।” (২০:৯৬)
গত আসরে আমরা বলেছিলাম, হযরত মুসা (আ.) তুর পাহাড় থেকে ফিরে আসার পর দেখলেন তার জাতির বহু লোক মূর্তিপুজায় লিপ্ত হয়েছে। তারা একত্ববাদের পথ থেকে ফিরে গিয়ে আল্লাহর সঙ্গে স্বর্ণনির্মিত বাছুরকে শরীক করেছে। এ অবস্থা দেখে তিনি প্রথমে নিজের ভাই হারুনের সঙ্গে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে কথা বলেন এবং তার কাছে এর কারণ জানতে চান। হারুন তাঁকে জানান, তাঁর কথা বনী ইসরাইল জাতি শোনেনি এবং এমনকি তারা তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল।
এরপর হযরত মুসা বনী ইসরাইল জাতিকে পথভ্রষ্ট করার জন্য দায়ী মূল ব্যক্তি অর্থাত্ সামেরি'র কাছে যান। সামেরি স্বর্ণ দিয়ে নির্মিত একটি বাছুরকে মানুষের স্রষ্টা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাকে সিজদা করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। এ কারণে হযরত মুসা (আ.) সামেরি'র কাছে জানতে চান, কেন সে এ কাজ করেছে? সামেরি জবাব দেয়, আমি প্রথমে আল্লাহ এবং তার প্রেরিত পুরুষ হিসেবে তোমার প্রতি ঈমান এনেছিলাম। এমনকি এমন অনেক বাস্তবতা জেনে গিয়েছিলাম যা অন্য অনেকেই জানতো না। কিন্তু তোমার কাছে যা কিছু শিখেছিলাম পরবর্তীতে তা কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় ভুলে গিয়ে মূর্তিপুজায় লিপ্ত হলাম।
বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, একদিন হযরত আলী (আ.) বসরার জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তত্কালীন যুগের পণ্ডিত ব্যক্তি হাসান বসরি হযরত আলীর প্রতিটি কথা লিখে রাখছিল। এ সময় ইমাম উচ্চস্বরে বলে ওঠেন, এই ব্যক্তি শেষ নবীর উম্মতের সামেরি। সে আজ আমার বক্তব্য লিখে রাখছে কিন্তু একদিন সে আমার বিরুদ্ধে কথা বলবে এবং মানুষকে পথভ্রষ্ট করবে।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. সমাজের নেতাদের সব সময় সচেতন থাকতে হবে। কারণ, যে কোনো সময় সামেরি'র মতো বিভ্রান্ত লোকের আবির্ভাব ঘটতে এবং সাধারণ মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে পারে।
২. কুপ্রবৃত্তি অনেক সময় মানুষকে ঈমানের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে। কুপ্রবৃত্তির ডাকে সাড়া দিলে একটি গোত্র এমনকি একটি জাতিও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যে ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তির ধোঁকায় পড়ে তার পক্ষে অন্যকে ধোঁকা দেয়া অসম্ভব নয়।
সূরা ত্বোয়া-হা'র ৯৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ فَاذْهَبْ فَإِنَّ لَكَ فِي الْحَيَاةِ أَنْ تَقُولَ لَا مِسَاسَ وَإِنَّ لَكَ مَوْعِدًا لَنْ تُخْلَفَهُ وَانْظُرْ إِلَى إِلَهِكَ الَّذِي ظَلْتَ عَلَيْهِ عَاكِفًا لَنُحَرِّقَنَّهُ ثُمَّ لَنَنْسِفَنَّهُ فِي الْيَمِّ نَسْفًا (97)
“মুসা বলল- দূর হও, তোমার জীবদ্দশায় তোমার জন্য এই (শাস্তি) থাকল যে, তুমি (এমন এক মারাত্মক অসুখে ভুগবে যে কেউ কাছে আসলে) বলবে- ‘আমার শরীরে হাত দিও না’ এবং তোমার জন্য থাকল এক নির্দিষ্টকাল যার ব্যতিক্রম হবে না এবং তুমি তোমার সেই উপাস্যের প্রতি লক্ষ্য কর যার পূজায় তুমি রত ছিলে, আমরা ওকে জ্বালিয়ে দেবই এরপর ওকে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে নিক্ষেপ করবই।” (২০:৯৭)
সামেরির কথা শুনেই হযরত মুসা বুঝেছিলেন, সে মিথ্যা বলছে এবং মিথ্যা অজুহাত খাড়া করছে। তাই তিনি তার ক্ষমা প্রার্থনায় কান দিলেন না। তিনি সামেরিকে নির্বাসনে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে বলেন, এই দুনিয়ায় তোমার পাপের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তুমি এমন ভয়ঙ্কর রোগে আক্রান্ত হবে যে, অন্য মানুষের সঙ্গে বসবাস করতে পারবে না। তোমাকে সবাই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে। সেইসঙ্গে কিয়ামতের দিন কঠিন আযাব তোমার জন্য নির্ধারিত হয়ে রয়েছে। দুনিয়ার এই শাস্তি আখেরাতের শাস্তিকে মোটেও লাঘব করবে না।
সামেরির উদ্দেশে নিজের বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর হযরত মুসা স্বর্ণনির্মিত বাছুর সম্পর্কে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, এই বাছুরকে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে। তিনি সেটিকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)ও মক্কা বিজয়ের পর কাবাঘরসহ অন্যান্য জায়গায় স্থাপিত মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ সব মূর্তির অনেকগুলো মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরি ছিল। কিন্তু এগুলো শিরক ও কুফরির কাজে ব্যবহৃত হতো বলে সেগুলোকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবেও সংরক্ষণ জায়েজ ছিল না। কারণ, এগুলোকে অক্ষত রাখলে এক সময় আবার এগুলোর মাধ্যমে সমাজে শিরক ও মূর্তিপুজা শুরু হয়ে যেতে পারে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. সমাজ থেকে দুরাচার ও বিভ্রান্ত ব্যক্তিদের বহিস্কার অথবা বয়কট করা ছিল নবী-রাসূলদের অন্যতম দায়িত্ব।
২. পাপকাজের উপকরণ সবার আগে সমাজ থেকে ধুয়ে মছে ফেলতে হবে। এসব উপকরণ অনেক দামী হলেও তা অক্ষত রাখা যাবে না।
সূরা ত্বোয়া-হা'র ৯৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
إِنَّمَا إِلَهُكُمُ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَسِعَ كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا (98)
“তোমাদের উপাস্য তো কেবল আল্লাহই- যিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, এবং তার জ্ঞানের আয়ত্বের বাইরেও কেউ নেই।” (২০:৯৮)
হযরত মুসা (আ.) সামেরি ও তার হাতে তৈরি উপাস্যকে প্রত্যাখ্যানের পর নিজ জাতির উদ্দেশে বলেন, এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত কর না। অন্য কারো সামনে সিজদাবনত হয়ো না। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ইবাদতের যোগ্য নয়। সেই স্রষ্টার ইবাদত কর যিনি তোমাদের ভালো-মন্দ সবকিছু সম্পর্কে অবহিত; যিনি তোমাদের উপকার করতে এবং সব ধরনের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করতে পারেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দু'টি বিষয় হচ্ছে:
১. মিথ্যা প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে সঙ্গে সত্যের বাণী মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে- যাতে কোনো শূন্যতা সৃষ্টি না হয়।
২. এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত জানেন না। কাজেই ইবাদতের যোগ্য একমাত্র তিনিই এবং তাঁর সামনে আমাদের মাথা নত করে সিজদা করতে হবে।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন