সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৯০-৯৪ (পর্ব-১৬)
সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৯০-৯৪ (পর্ব-১৬)
সূরা ত্বোয়া-হা'র ৯০ ও ৯১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেছেন:
وَلَقَدْ قَالَ لَهُمْ هَارُونُ مِنْ قَبْلُ يَا قَوْمِ إِنَّمَا فُتِنْتُمْ بِهِ وَإِنَّ رَبَّكُمُ الرَّحْمَنُ فَاتَّبِعُونِي وَأَطِيعُوا أَمْرِي (90) قَالُوا لَنْ نَبْرَحَ عَلَيْهِ عَاكِفِينَ حَتَّى يَرْجِعَ إِلَيْنَا مُوسَى (91)
“হারুন ওদের আগেই বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায় এর দ্বারা তোমাদের কেবল পরীক্ষা করা হয়েছে। নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক দয়াময়, সুতরাং তোমরা আমায় অনুসরণ কর এবং আমার আদেশ মেনে চল।”(২০:৯০)
“ওরা বলল- আমাদের কাছে মুসা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা কিছুতেই এর পূজা থেকে বিরত হব না।” (২০:৯১)
আগের পর্বে বলা হয়েছে, হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হওয়া তাওরাত আনার জন্য যখন তুর পাহাড়ে চলে যান তখন তাঁর অনুপস্থিতিতে সামেরি নামক এক ব্যক্তি বনী ইসরাইলের বেশিরভাগ লোককে পথভ্রষ্ট করে তাদেরকে স্বর্ণনির্মিত একটি বাছুরপুজায় উদ্বুদ্ধ করে। এরপর এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে, হযরত মুসার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে বনী ইসরাইল জাতিকে সত্পথে ধরে রাখার জন্য নিযুক্ত হারুন (আ.) জনগণকে বাছুরপুজা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তোমরা আল্লাহকে ভুলে গিয়ে মানুষের নির্মিত একটি বাছুরের কৃত্রিম ডাক শুনে বিভ্রান্ত হয়ো না। এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের পরীক্ষা করছেন। তাঁর প্রতি তোমাদের কতখানি ঈমান রয়েছে- এই পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি তা দেখতে চান। তিনিই তোমাদের পালনকর্তা এবং সব নেয়ামত ও অনুগ্রহ তারই দান। সামেরি'র ভ্রান্ত কথাবার্তায় বিশ্বাস না করে আমার কথামতো চল। আমি তোমাদেরকে আসল সৃষ্টিকর্তার দিকে আহ্বান করছি। তোমরা কি ভুলে গেছ, হযরত মুসা তুর পাহাড়ে যাওয়ার আগে আমাকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে গেছেন এবং আমার নির্দেশ বাধ্যতামূলকভাবে পালন করার আদেশ দিয়ে গেছেন? কিন্তু হযরত হারুনের কথায় কান দেয়নি বিভ্রান্ত বনী ইসরাইল জাতি। তারা হযরত মুসার ফিরে আসা পর্যন্ত মূর্তিপুজা চালিয়ে যায়।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি মানুষের কতখানি ঈমান রয়েছে তা পরীক্ষা করার জন্য সব মুমিন বান্দাকে আল্লাহ পরীক্ষা করেন। তিনি দেখতে চান, ভ্রান্ত চিন্তাধারার সামনে তারা কতক্ষণ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে অটল থাকতে পারে।
২. এ ধরনের পরীক্ষা ও গোলযোগের সময় ধর্মীয় নেতা ও আউলিয়াদের দিক-নির্দেশনা মেনে চললে মানুষ বিভ্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।
সূরা ত্বোয়া-হা'র ৯২ ও ৯৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ يَا هَارُونُ مَا مَنَعَكَ إِذْ رَأَيْتَهُمْ ضَلُّوا (92) أَلَّا تَتَّبِعَنِ أَفَعَصَيْتَ أَمْرِي (93)
“মুসা (ফিরে এসে তার ভাইকে) বলল- হে হারুন! তুমি যখন দেখলে ওরা পথভ্রষ্ট হয়েছে, তখন কিসে তোমাকে নিবৃত্ত করল।”(২০:৯২)
“(পথভ্রষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে) আমার নির্দেশ মেনে চলতে? তবে কি তুমি আমার আদেশ অমান্য করেছ?” (২০:৯৩)
হযরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে যাওয়ার আগে নিজের ভাই হারুনকে জনগণের মাঝে থেকে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, সমাজকে যাতে ভ্রান্ত চিন্তা ও পথভ্রষ্টতায় পেয়ে না বসে সেদিকে যেন তিনি খেয়াল রাখেন। এ কারণে তিনি ফিরে এসে নিজ জাতির পথভ্রষ্টতা থেকে হারুনের কাছে জানতে চান, কেন তিনি হযরত মুসার কথামতো কাজ করেননি এবং জনগণকে বাছুরপুজা থেকে বিরত রাখেননি। কেন বাছুরপুজাকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি এবং কেন তিনি হযরত মুসার নির্দেশ অমান্য করেছেন? এখানে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি নিজ জাতির অটল থাকার ওপর হযরত মুসা এতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে, তাদের পথভ্রষ্টতা তাঁর মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। এ কারণে তিনি নিজের ভাই হারুনের প্রতি ক্ষুব্ধ হন এবং জনগণকে সঠিক পথে রাখতে না পারার কারণে সবার আগে হারুনকে দায়ী করেন।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. সমাজের মানুষের পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতাদেরও দায় রয়েছে। তারা চোখের সামনে খারাপ কাজ হতে দেখলে চুপ করে থাকতে পারেন না।
২. সব ঈমানদার ব্যক্তিরই পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার এবং পাপকাজে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সূরা ত্বোয়া-হা'র ৯৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেছেন:
قَالَ يَا ابْنَ أُمَّ لَا تَأْخُذْ بِلِحْيَتِي وَلَا بِرَأْسِي إِنِّي خَشِيتُ أَنْ تَقُولَ فَرَّقْتَ بَيْنَ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَلَمْ تَرْقُبْ قَوْلِي (94)
“হারুন বলল- হে আমার ভাই! তুমি আমার দাড়ি ও মাথা(র চুল) ধরে টানাটানি কর না, আমি আশঙ্কা করেছিলাম যে, তুমি বলবে- তুমি বনী ইসরাইলিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছো এবং (তাদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে) তুমি আমার নির্দেশ পালন করনি।” (২০:৯৪)
আগের আয়াতে বলা হয়েছে, হযরত মুসা অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে তার ভাই হারুনকে জবাবদিহি করতে বলেন। তিনি জানতে চান, তার অনুপস্থিতিতে কী করে বনী ইসরাইল জাতি একত্ববাদী জাতি থেকে বাছুরপুজক জাতিতে পরিণত হলো, তাও আবার মাত্র ৪০ দিনের মাথায়? এ আয়াতে হযরত মুসার এ প্রশ্নের জবাবে হযরত হারুনের জবাব তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি ও তুমি একই মায়ের সন্তান। কাজেই তুমি আমার ভাই এবং আমার সঙ্গে তোমার ব্যবহার দয়ালু হওয়া উচিত। কাজেই রাগের চোটে আমার দাড়ি বা চুল ধরে টানা তোমার উচিত নয়। জনগণের পথভ্রষ্ট আচরণের মোকাবিলায় আমি বসে ছিলাম না। আমি আমার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা আমার কথা শোনেনি এমনকি আমাকে মেরে ফেলতেও চেয়েছিল তারা।
হযরত হারুন আরো বলেন, এ অবস্থায় আমাদের সমাজ ঈমানদার ও বাছুরপুজক- এ দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। আমি বাছুরপুজকদের বিরুদ্ধে আরেকটু শক্ত হলে সমাজে এ দু'ভাগের মধ্যে সংঘর্ষ ও হানাহানি তৈরি হতো এবং বহু লোকের জীবনহানি ঘটতো। কাজেই আমি উপদেশ দেয়া বন্ধ করে দিলাম এই আশায় যে, তুমি এসে তাদেরকে পথভ্রষ্টতার হাত থেকে উদ্ধার করবে। কারণ, তুমি যাওয়ার সময় আমাকে বলে গিয়েছিলে, জনগণের সঙ্গে যেন আমি ভালো আচরণ করি এবং তাদের মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদ তৈরি হতে পারে এমন আচরণ থেকে বিরত থাকি।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. ভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতার ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ নবী-রাসূলদের বৈশিষ্ট্য এবং এ থেকে ধর্মের ব্যাপারে তাদের স্পর্শকাতরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
২. সমাজের ভ্রান্ত লোকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ঘটনা যেন বিশৃঙ্খলা ও সংঘর্ষের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। এর ফলে সমাজকে আরো বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হতে হয়।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন