সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৮৫-৮৯ (পর্ব-১৫)
সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৮৫-৮৯ (পর্ব-১৫)
সূরা ত্বোয়া-হা'র ৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ فَإِنَّا قَدْ فَتَنَّا قَوْمَكَ مِنْ بَعْدِكَ وَأَضَلَّهُمُ السَّامِرِيُّ (85)
“আল্লাহ মুসাকে বললেন- তুমি চলে আসার পর আমি তোমার সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করেছি এবং সামেরি ওদের পথভ্রষ্ট করেছে।”(২০:৮৫)
আগের পর্বে বলা হয়েছিল, হযরত মুসা (আ.) তাওরাত গ্রন্থ লাভের জন্য ৪০ দিন তুর পাহাড়ে অবস্থান করেন। এই ৪০ দিন তিনি বনী ইসরাইল জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। ওই দিনগুলো শেষ হয়ে এলে আল্লাহ হযরত মুসাকে খবর দেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে সামেরি নামক এক ব্যক্তি বনী ইসরাইল জাতিকে আল্লাহর একত্ববাদের পথ থেকে বিচ্যুত করে মূর্তিপুজার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। মিশরের জনগণের মধ্যে আগে থেকেই মূর্তিপুজার প্রচলন ছিল। বনী ইসরাইলের একদল লোক একদিন নীলনদ পার হওয়ার সময় মূর্তিপুজক একটি জাতি দেখে আবার মূর্তি তৈরির বায়না দেয়। পাশাপাশি হযরত মুসা (আ.)এর অনুপস্থিতিতে সামেরি জনগণকে মূর্তিপুজায় উত্সাহিত করার সুযোগ পেয়ে যায়।
হযরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে যাওয়ার সময় তার ভাই হারুনকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান। কিন্তু আবার মূর্তিপুজায় ফিরে যাওয়ার সময় জনগণ হারুনের নিষেধ শোনেনি। এমনকি তারা হযরত হারুনকে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দেয়।
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হল:
১. আল্লাহ প্রেরিত পুরুষদের অনুপস্থিতিতে মানুষের ঈমানের পরীক্ষা হয়। এ সময়টিতে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা বহু মানুষ আবার পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে পারে।
২. মু'মিন ব্যক্তিরা সব সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষার সম্মুখীন হন। তারাও পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্ত নন।
সূরা ত্বোয়া-হা'র ৮৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَرَجَعَ مُوسَى إِلَى قَوْمِهِ غَضْبَانَ أَسِفًا قَالَ يَا قَوْمِ أَلَمْ يَعِدْكُمْ رَبُّكُمْ وَعْدًا حَسَنًا أَفَطَالَ عَلَيْكُمُ الْعَهْدُ أَمْ أَرَدْتُمْ أَنْ يَحِلَّ عَلَيْكُمْ غَضَبٌ مِنْ رَبِّكُمْ فَأَخْلَفْتُمْ مَوْعِدِي (86)
“এরপর মুসা তার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল ক্ষুব্ধ ও মর্মপীড়িত অবস্থায়; সে বলল- হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের প্রতিপালক কি তোমাদের (তাওরাত নাজিল করার ব্যাপারে) এক উত্তম প্রতিশ্রুতি দেননি? তবে কি তোমরা ভেবেছ সেই সময় পার হয়ে গেছে, অথবা তোমরা কি নিজেদের উপর তোমাদের প্রতিপালকের অভিশাপ নিপতিত করতে চাও? তোমরা তো আমাকে প্রদত্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছো।”(২০:৮৬)
হযরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে যাওয়ার আগে তাঁর জাতিকে জানিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর ওপর তাওরাত নাজিল হতে যাচ্ছে এবং তিনি তা আনতে যাচ্ছেন। এরপর তিনি বনী ইসরাইলের কাছ থেকে এ প্রতিশ্রুতি আদায় করেন যে, তাঁর অনুপস্থিতিতে জনগণ হযরত হারুনের দিক-নির্দেশনা মেনে চলবে এবং তার অবাধ্য হবে না। কিন্তু তারা নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে হারুনকে উপেক্ষা করতে থাকে। এ কারণে হযরত মুসা (আ.) তুর পাহাড় থেকে ফেরার সময় তাওরাত নাজিল হওয়ায় আনন্দিত ও উত্ফুল্ল থাকার পরিবর্তে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ ও মনোকষ্টে ভুগতে থাকেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হচ্ছে :
১. ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার কারণে এবং কুফরি ও গোমরাহির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হওয়া ছিল নবী-রাসূলদের বৈশিষ্ট্য।
২. নবী-রাসূল ও আউলিয়াদের ক্ষুব্ধ করলে তাতে আল্লাহ-তায়ালাও ক্ষুব্ধ হন।
৩. একটি সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যখন আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে তখন ওই সমাজের পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে ওঠে।
সূরা ত্বোয়া-হার ৮৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالُوا مَا أَخْلَفْنَا مَوْعِدَكَ بِمَلْكِنَا وَلَكِنَّا حُمِّلْنَا أَوْزَارًا مِنْ زِينَةِ الْقَوْمِ فَقَذَفْنَاهَا فَكَذَلِكَ أَلْقَى السَّامِرِيُّ (87)
“ওরা বলল- আমরা তোমার প্রতি করা অঙ্গীকার স্বেচ্ছায় ভঙ্গ করিনি, বরং আমরা ফেরাউনের সম্প্রদায়ের অলঙ্কারের ভার বহন করছিলাম, পরে আমরা তা আগুনে নিক্ষেপ করি, সামেরি এভাবেই আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল।”(২০:৮৭)
হযরত মুসাকে ক্ষুব্ধ অবস্থায় দেখে বনী ইসরাইলের লোকজন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করতে থাকে। তারা হযরত মুসার কাছে ক্ষমা চাইতে উদ্যত হয়। তারা বলতে থাকে, আমরা নিজেদের ইচ্ছায় এবং জেনেবুঝে এ কাজ করিনি; বরং সামেরি আমাদের যা বুঝিয়েছে সেইমতো কাজ করেছি। নিজেদের কাছে যে সোনাদানা ছিল তা সামেরিকে দিয়েছি এবং তার নিজের কাছে যত স্বর্ণ ছিল সব মিলিয়ে একটি স্বর্ণের গরু তৈরি করেছি।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১. পাপী ব্যক্তিরা সব সময় নিজেদের পাপের বোঝা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চায়। কিন্তু এর মাধ্যমে তারা নিজেদের পাপের শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে না।
২. মানুষের পথভ্রষ্টতার অন্যতম কারণ হচ্ছে সোনাদানা। ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদের পথভ্রষ্ট করার কাজে এই অলঙ্কারটিকে ব্যবহার করে।
এই সূরার ৮৮ ও ৮৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَأَخْرَجَ لَهُمْ عِجْلًا جَسَدًا لَهُ خُوَارٌ فَقَالُوا هَذَا إِلَهُكُمْ وَإِلَهُ مُوسَى فَنَسِيَ (88) أَفَلَا يَرَوْنَ أَلَّا يَرْجِعُ إِلَيْهِمْ قَوْلًا وَلَا يَمْلِكُ لَهُمْ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا (89)
“সামেরি (ওই সব স্বর্ণ দিয়ে) ওদের জন্য একটি বাছুরের মূর্তি তৈরি করে যা বাছুরের মতো শব্দ করত। এ সময় সে (ও তার অনুসারীরা) বলল- এই তোমাদের উপাস্য এবং মুসারও উপাস্য, কিন্তু মুসা তা ভুলে গেছে।”(২০:৮৮)
“তবে কি বাছুরপুজারিরা ভেবে দেখ না যে বাছুরটি তাদের কথায় সাড়া দেয় না এবং তাদের কোনো ক্ষতি বা উপকার করার ক্ষমতা রাখে না।”(২০:৮৯)
সামেরি জনগণের কাছ থেকে সংগৃহিত স্বর্ণ দিয়ে বাছুর আকৃতির একটি মূর্তি নির্মাণ করে। ওই বাছুরের ভেতর সে এমন ব্যবস্থা রেখে দেয় যাতে এটি ঠিক জীবন্ত গরুর মতো শব্দ করতে পারতো। জনগণ বাছুরের ডাক শুনে সামেরির মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস করতে শুরু করে। সামেরির ধৃষ্ঠতাও এই পর্যায়ে চলে যায় যে, সে বলতে শুরু করে, এই বাছুরই সব মানুষ এমনকি মুসারও সৃষ্টিকর্তা। তুর পাহাড়ে যাওয়ার পরিবর্তে মুসার উচিত ছিল এই বাছুরের কাছে এসে তার পুজা করা!
মহান আল্লাহ এই ধৃষ্ঠতাপূর্ণ কথার জবাবে বলেন, কীভাবে তারা একটি স্বর্ণের তৈরি বাছুরের ডাক শুনে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস থেকে দূরে সরে এসেছে? তারা কি দেখতে পায় না যে, এই বাছুরের কোনো ক্ষমতা নেই এবং এটি মানুষের কোনো ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না? অথচ প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা অন্তত মানুষের চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে।
এ দুই আয়াতের দু'টি শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :
১. ইসলামের শত্রুরা মুসলামনদের পথভ্রষ্ট করার লক্ষ্যে শিল্প-মাধ্যমকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে।
২. বহু মানুষ যা চোখে দেখে তার ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। আল্লাহকে চোখে দেখা যায় না বলে তারা তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে না।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন