সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৭৭-৮০ (পর্ব-১৩)

সূরা ত্বোয়া-হা’র ৭৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন- وَلَقَدْ أَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى أَنْ أَسْرِ بِعِبَادِي فَاضْرِبْ لَهُمْ طَرِيقًا فِي الْبَحْرِ يَبَسًا لَا تَخَافُ دَرَكًا وَلَا تَخْشَى (77) “আমি মুসার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছিলাম এই মর্মে যে, আমার বা

সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৭৭-৮০ (পর্ব-১৩)
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৭৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَقَدْ أَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى أَنْ أَسْرِ بِعِبَادِي فَاضْرِبْ لَهُمْ طَرِيقًا فِي الْبَحْرِ يَبَسًا لَا تَخَافُ دَرَكًا وَلَا تَخْشَى (77)
“আমি মুসার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছিলাম এই মর্মে যে, আমার বান্দাদের নিয়ে (রাতের বেলায়) বেরিয়ে পড়ো এবং ওদের জন্য সমূদ্রের ভেতর দিয়ে একটি শুষ্ক পথ নির্মাণ কর। এমন আশঙ্কা কর না যে, শত্রুরা পেছন দিক দিয়ে এসে তোমাদের ধরে ফেলবে অথবা তোমরা সাগরে ডুবে যাবে।” (২০:৭৭)
আগে পর্বে হযরত মুসা (আ.) এর অলৌকিক ক্ষমতা দেখে মিশরের জাদুকরদের ঈমান আনার ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। ওই ঘটনাটি এখানেই শেষ হয়ে গেছে। আজকের আয়াতে বনী ইসরাইল জাতির অন্য একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
জাদুকরদের বিরুদ্ধে হযরত মুসার বিজয় লাভের পর থেকে দিন দিন তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরপর অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের অনুসারীদের সঙ্গে বনী ইসরাইল জাতির ঈমানদার লোকদের ছোটখাটো সংঘর্ষ লেগেই থাকে। এক পর্যায়ে মহান আল্লাহ হযরত মুসাকে নির্দেশ দেন, তিনি যেন বনী ইসরাইল জাতিকে সঙ্গে নিয়ে মিশর ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য বাইতুল মোকাদ্দাসে (বর্তমানে যাকে জেরুজালেমও বলা হয়, সেখানে) চলে যেতে।
এ আয়াত অনুযায়ী, আল্লাহর নির্দেশ ছিল শত্রুরা যাতে তাদের চলে যাওয়ার কথা জানতে না পারে সেজন্য রাতের বেলায় রওনা দিতে হবে। কিন্তু বাইতুল মোকাদ্দাসে যেতে হলে বিশাল নীল নদ পাড়ি দিতে হবে। তাই আল্লাহ হযরত মুসা (আ.)কে নির্দেশ দেন তিনি যেন তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে নদীর পানিতে সজোরে আঘাত করেন। এর ফলে নদীর ভেতরে শুকনো রাস্তা তৈরি হবে। এ সময় শত্রুকে বা নদীর পানিকে ভয় পেলে চলবে না।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
১. ধর্ম রক্ষার জন্য প্রয়োজনে মাতৃভূমি ত্যাগ করে অন্য কোনো দেশে চলে যেতে হবে। যদিও এ কাজ অনেক বিপদসঙ্কুল ও কষ্টসাধ্য।
২. অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করা ছিল নবী-রাসূলদের অন্যতম দায়িত্ব।

সূরা ত্বোয়া-হা’র ৭৮ ও ৭৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ بِجُنُودِهِ فَغَشِيَهُمْ مِنَ الْيَمِّ مَا غَشِيَهُمْ (78) وَأَضَلَّ فِرْعَوْنُ قَوْمَهُ وَمَا هَدَى (79)
“এরপর ফেরাউন তার সেনাবাহিনীসহ তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলে হঠাত সমূদ্রের ঢেউ ওদের সম্পূর্ণ গ্রাস করে নেয়।”(২০:৭৮)
“এবং (এভাবে) ফেরাউন তার সম্প্রদায়কে পথভ্রষ্ট করে, (সে তাদের) সত্‌পথ দেখায়নি।” (২০:৭৯)
বাইতুল মোকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে বনী ইসরাইল জাতির রওনা দেয়ার খবর গুপ্তচরদের মাধ্যমে ফেরাউনের কাছে পৌঁছে যায়। সে নিজে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে হযরত মুসা ও তার সঙ্গীদের পিছু নেয়। এক পর্যায়ে নীল নদের তীরে ফেরাউনের বাহিনী বনী ইসরাইল জাতিকে ঘিরে ফেলে। হযরত মুসার সঙ্গীরা দেখতে পান তাদের পেছন দিকে রয়েছে শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং সামনে রয়েছে বিশাল নীল নদ। তারা ভীষণ ভয় পেয়ে যান। এ অবস্থায় হযরত মুসা (আ.) এর লাঠির আঘাতে নীল নদের পানি দু’ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতাবলে নদীর তলদেশের মাটি শুকিয়ে যায় এবং শক্ত রাস্তা চোখে পড়ে। হযরত মুসার অনুসারীরা সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে যান। তারা নদী পেরিয়ে যাওয়ার পর যখন ফেরাউন ও তার বিশাল বাহিনী ওই রাস্তা ধরে নদীর মাঝখানে এসে পৌঁছায় তখনই নদীর বিভক্ত পানি এক হয়ে যায় এবং পানির প্রচণ্ড তোড়ে সবাই ভেসে যায়। ফলে ফেরাউনসহ তার বাহিনীর সব সৈন্যের সলিল সমাধি ঘটে।
আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে, ফেরাউন আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতা দেখার পরও নিজে যেমন ঈমান আনেনি তেমনি অন্য কাউকেও ঈমান আনতে দেয়নি। বরং আত্মম্ভরিতা ও গোয়ার্তুমি করে সাধারণ মানুষকে ঈমান আনতে বাধা দিয়েছে। সে নিজেকে মিশরের জনগণের পালনকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে এবং এক পর্যায়ে সঙ্গীসাথীসহ অথৈ পানিতে ডুবে মরেছে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. পানি ও সমুদ্র আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলে। কেউ এর মাধ্যমে আল্লাহর দয়া লাভ করেন আবার কেউ তাঁর ক্রোধের শিকার হন।
২. সমাজের শাসকশ্রেণী জনগণের হেদায়েত লাভ করা বা পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ قَدْ أَنْجَيْنَاكُمْ مِنْ عَدُوِّكُمْ وَوَاعَدْنَاكُمْ جَانِبَ الطُّورِ الْأَيْمَنَ وَنَزَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوَى (80)
“হে বনী ইসরাইল! নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে তোমাদের শত্রুর হাতথেকে উদ্ধার করেছিলাম, আমি তোমাদের তুর পর্বতের ডান পাশে (তাওরাত দানের) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম এবং তোমাদের কাছে (উত্তম খাধ্য হিসেবে) মান্না ও সালওয়া পাঠিয়েছিলাম।” (২০:৮০)
মহান আল্লাহ বনী ইসরাইল জাতির প্রতি যে দয়া দেখিয়েছিলেন- এই আয়াতে তার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, আল্লাহর অশেষ করুণায় এবং তারই অলৌকিক ক্ষমতাবলে তোমরা মুসার নেতৃত্বে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেয়েছো। এটি ছিল বনী ইসরাইল জাতির প্রতি আল্লাহর প্রথম উপহার।
তুর পাহাড় ছিল আল্লাহর সঙ্গে হযরত মুসাসহ বনী ইসরাইলের আরো কয়েক ব্যক্তির আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করার স্থান। এখানে পবিত্র গ্রন্থ তাওরাত হযরত মুসা (আ.)'র প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল। এখানে আল্লাহর হেদায়েত নাজিল হয়েছিল এবং আল্লাহর শক্তিমত্তার কিছু অংশ মানুষের জন্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল।
অবশ্য ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি এবং সঠিক পথ পাওয়ার পাশাপাশি বস্তুগত বিভিন্ন উপকরণও আল্লাহ বনী ইসরাইল জাতিকে দান করেছিলেন। যখন বনী ইসরাইল জাতি মরুভূমিতে দিগ্বিদিক হয়ে ছুটাছুটি করছিল তখন আল্লাহ পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে তাদেরকে মধুর সন্ধান দিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে আল্লাহ তাদের জন্য পাঠিয়েছিলেন সুস্বাদু গোশতসমৃদ্ধ পাখি। এই পাখির গোশত খেয়ে তারা ক্ষুধা মিটিয়েছিল।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. মুক্তি ও স্বাধীনতা আল্লাহ-তায়ালার একটি বড় নেয়ামত বা অনুগ্রহ। এর জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত।
২. নবী-রাসূলদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে মানুষকে সঠিক পথের দিকে হেদায়েত করা। কিন্তু হেদায়েতের বাণী পৌঁছে দেয়ার আগে তারা মানুষকে অত্যাচারী শাসকদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন।
৩. আল্লাহ-তায়ালা আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত দু'ধরনের নেয়ামতই মানুষকে দান করেন। তবে প্রতিদানে শুধু মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি চান।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন