সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৭২-৭৬ (পর্ব-১২)

সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৭২-৭৬ (পর্ব-১২)
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৭২ ও ৭৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالُوا لَنْ نُؤْثِرَكَ عَلَى مَا جَاءَنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالَّذِي فَطَرَنَا فَاقْضِ مَا أَنْتَ قَاضٍ إِنَّمَا تَقْضِي هَذِهِ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا (72) إِنَّا آَمَنَّا بِرَبِّنَا لِيَغْفِرَ لَنَا خَطَايَانَا وَمَا أَكْرَهْتَنَا عَلَيْهِ مِنَ السِّحْرِ وَاللَّهُ خَيْرٌ وَأَبْقَى (73)
“(জাদুকররা ফেরাউনকে) বলল- আমাদের কাছে যে স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে- তার পাশাপাশি যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন তার ওপর তোমাকে কিছুতেই প্রাধান্য দেব না। কাজেই তুমি খুশি করতে পার।” (২০:৭২)
“আমরা আমাদের প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি যাতে তিনি আমাদের অপরাধ ক্ষমা করেন এবং তুমি আমাদের যা করতে বাধ্য করেছিলে- সেই জাদু হতে ক্ষমা করবেন; আল্লাহই শ্রেষ্ঠতম ও স্থায়ী।” (২০:৭৩)
আগের পর্বে বলা হয়েছে, হযরত মুসা (আ.)’র প্রদর্শিত অলৌকিক নিদর্শন দেখে মিশরের শ্রেষ্ঠ জাদুকররা নিশ্চিত হয়ে যান, এটি কোনো মানুষের কাজ নয় এবং এ কাজ জাদুমন্ত্রের অনেক উর্ধ্বে। জাদুর মাধ্যমে একটি লাঠিকে এত বিশাল অজগরে রূপান্তর করা সম্ভব নয়। জাদুকরদের মধ্যে এ উপলব্ধি আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা ফেরাউন ও মিশরের হাজার হাজার মানুষের সামনে হযরত মুসাকে সিজদা করেন। তারা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে, তারা হযরত মুসার পালনকর্তার প্রতি ঈমান আনছেন। এ দৃশ্য সহ্য করা ফেরাউনের পক্ষে ছিল অসম্ভব। সে তাত্‌ক্ষণিকভাবে জাদুকরদের নির্মম শাস্তি দেয়ার হুমকি দেয়।
এরপর এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে, ফেরাউনের হুমকিতে নও মুসলিম জাদুকররা মোটেই ভয় পেলেন না। তারা উল্টো ফেরাউনকে কড়া জবাব দিলেন। তারা বললেন, আমরা এই বিশ্বজগতের প্রতিপালকের ওপরে তোমাকে স্থান দিতে পারি না এবং যে মুজিযা নিজেদের চোখে দেখেছি তাও অস্বীকার করতে পারি না। এখন তুমি যা খুশি তাই করতে পার। তোমার এই ক্ষমতা শুধুমাত্র ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতেই কার্যকর, আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনে আমরাই হব সফলকাম। কাজেই আমরা আশা করছি, মুসাকে জনগণের সামনে অপমান করার যে ষড়যন্ত্রে আমরা যোগ দিয়েছি, মহান আল্লাহ আমাদের সে অপরাধ মাফ করে দেবেন। কারণ, আমরা এ কাজ করতে চাইনি, তুমিই এ কাজে আমাদের বাধ্য করেছো।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল :
১. মানুষের মর্যাদা নির্ভর করে তার আকিদাগত বিশ্বাসের ওপর এবং হুমকি ও ভয় দেখিয়ে তার বিশ্বাসে পরিবর্তন আনা যায় না।
২. ধর্মীয় বিশ্বাস ও আল্লাহর নির্দেশ সমুন্নত রাখার জন্য মানুষ কতটা আত্মত্যাগ করতে পারে তার ওপর তার ঈমানের গভীরতা নির্ভর করে।
৩. আল্লাহর অসীম ক্ষমতার সামনে পৃথিবীর কথিত পরাশক্তিগুলোর ক্ষমতা অতি সামান্য। যিনি ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেন তিনি অন্য কোনো শক্তিকে ভয় পান না।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৭৪,৭৫ ও ৭৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
إِنَّهُ مَنْ يَأْتِ رَبَّهُ مُجْرِمًا فَإِنَّ لَهُ جَهَنَّمَ لَا يَمُوتُ فِيهَا وَلَا يَحْيَا (74) وَمَنْ يَأْتِهِ مُؤْمِنًا قَدْ عَمِلَ الصَّالِحَاتِ فَأُولَئِكَ لَهُمُ الدَّرَجَاتُ الْعُلَا (75) جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ جَزَاءُ مَنْ تَزَكَّى (76)
“যে তার প্রতিপালকের কাছে অপরাধী হয়ে উপস্থিত হবে তার জন্য তো জাহান্নাম আছে সেখানে সে মরবেও না বাঁচবেও না।” (২০:৭৪)
“এবং যারা তার কাছে বিশ্বাসী হয়ে ও সত্‌কাজ করে উপস্থিত হবে ওদের জন্য রয়েছে সমুচ্চ মর্যাদা ও জান্নাত।”(২০:৭৫)
“স্থায়ী জান্নাত যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং এই পুরস্কার তাদেরই প্রাপ্য যারা পবিত্র।” (২০:৭৬)
মিশরের অত্যাচারী শাসক ফেরাউন যে হুমকি ও লোভ দেখাচ্ছিল তার জবাবে এ আয়াতে আল্লাহর শাস্তি ও পুরস্কার বর্ণিত হয়েছে। ফেরাউন জাদুকরদের লোভ দেখিয়ে বলেছিল, মুসাকে জনসমক্ষে অপমান করতে পারলে তোমাদেরকে আমার দরবারে উচ্চ আসনে বসাব। অন্যদিকে আল্লাহ এ আয়াতে বলছেন, যে ব্যক্তি ঈমান আনবে ও সত্‌কাজ করবে তাকে আল্লাহ তার কাছে থাকা সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন করবেন। তাকে জান্নাতের অফুরন্ত আরাম-আয়েশ ও ভোগের সামগ্রী সরবরাহ করা হবে।
পরবর্তীতে ফেরাউন জাদুকরদের হুমকি দিয়ে বলেছিল, আমি তোমাদের ডান হাত ও বাম পা, অথবা বাম হাত ও ডান পা কেটে ফেলব। এরপর তোমাদেরকে শুলে চড়িয়ে কঠিন আযাবের মাধ্যমে মেরে ফেলব যাতে অন্য কেউ আমার অবাধ্য হওয়ার ধৃষ্ঠতা না দেখায়। এ হুমকির বিপরীতে আল্লাহ বলছেন, জাহান্নামের আযাব এত বেশি ভয়ানক হবে যে, যাদেরকে সেখানে নিক্ষেপ করা হবে তারা জীবনের কোনো স্বাদ পাবে না। তারা সেখানে মৃত্যু কামনা করবে যাতে এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু তারা মারা যাবে না বরং অসহনীয় কষ্টে কোনোমতে বেঁচে থাকবে।
অবশ্য এই তিন আয়াত ফেরাউনের বক্তব্যের জবাবে এসেছে নাকি স্বতন্ত্র আয়াত হিসেবে সার্বজনীন বক্তব্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে- তা নিয়ে মুফাসসিরদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে প্রথম ধারণাটির সত্য হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ, ঘটনাপ্রবাহে দেখা যাচ্ছে, ফেরাউনের হুমকির জবাবে তাত্‌ক্ষণিকভাবে জাদুকররা জান্নাত ও জাহান্নামের কথা উদ্ধৃত করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, এই তিন আয়াতের বক্তব্যগুলো সে মুহূর্তেই আল্লাহ হযরত মুসার মাধ্যমে জাদুকরদের জানিয়ে দিয়েছিলেন অথবা জাদুকরদের কাছে বিশেষ ব্যবস্থায় এ বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। তবে এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, প্রতিটি মানুষের অন্তরে আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি বিশ্বাস সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে সে অনুভূতি জাগ্রত হতে পারে এবং তখন তাকে কোনো হুমকি ধমকি দিয়ে আল্লাহর পথ থেকে ফেরানো সম্ভব নয়। আমাদের সমাজে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা হলো: পরিবেশ ও সমাজের প্রভাবে মানুষের জীবন গড়ে ওঠে এবং পরিবার ও সামাজিক গণ্ডির বাইরে গিয়ে অন্য কোনো জীবনব্যবস্থা মেনে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু জাদুকরদের ঈমান আনার ঘটনা এ ধারণার বিপরীত বক্তব্যকেই প্রতিষ্ঠা করে।
এ তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হল :
১. মানুষ কীভাবে এ পৃথিবীতে জীবনযাপন করলো তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কীভাবে তার মৃত্যু হল। বহু মানুষ জীবনের বেশিরভাগ সময় কাফের থাকার পর মৃত্যুর আগে ঈমানদার হয়েছেন। আবার ঈমানদার বহু মানুষ জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে কাফের হয়ে গেছেন।
৩. তাকওয়া বা পরহেজগারি হচ্ছে দুনিয়া ও আখেরাতে সাফল্য ও সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। অন্তর, চোখ ও জিহ্বাকে সংযত রাখতে পারলে মানুষ সব ধরনের পাপাচার থেকে মুক্ত থেকে পরকালে জান্নাতে যেতে পারবে।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন