সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৬৭-৭১ (পর্ব-১১)

সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৬৭-৭১ (পর্ব-১১)
সূরা ত্বোয়া-হার ৬৭, ৬৮ ও ৬৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
فَأَوْجَسَ فِي نَفْسِهِ خِيفَةً مُوسَى (67) قُلْنَا لَا تَخَفْ إِنَّكَ أَنْتَ الْأَعْلَى (68) وَأَلْقِ مَا فِي يَمِينِكَ تَلْقَفْ مَا صَنَعُوا إِنَّمَا صَنَعُوا كَيْدُ سَاحِرٍ وَلَا يُفْلِحُ السَّاحِرُ حَيْثُ أَتَى (69)
“(ওই অবস্থায়) মুসা তার অন্তরে কিছুটা ভয় অনুভব করল।”(২০:৬৭)
“আমি বললাম- ভয় কর না, (নিঃসন্দেহে) তুমি (ওদের তুলনায়) শক্তিশালী।”(২০:৬৮)
“তোমার ডান হাতে যা আছে তা ছুঁড়ে মারো, ওরা যা (তৈরি) করেছে, এটি তা গিলে ফেলবে। ওরা যা তৈরি করেছে তা তো কেবল জাদুকরের কৌশল এবং যেখান থেকেই জাদুকর আসুক, কখনই সে সফল হবে না।” (২০:৬৯)
আগের দুই আসরে আমরা বলেছি, মিশরের অত্যাচারী শাসক ফেরাউন জনগণের সামনে হযরত মুসা (আ.)কে অপমান করার জন্য সারাদেশ থেকে জাদুকরদের জড়ো করে। হযরত মুসা ফেরাউনের এ সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং নির্ধারিত উত্‌সবের দিন বিশাল প্রান্তরে হাজার হাজার মানুষের সামনে উপস্থিত হন। আল্লাহর নবী জাদুকরদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, আগে তোমাদের যার যার ঝুলিতে যা কিছু আছে তা বের কর এবং জাদুর খেলা শুরু কর।
জাদুকররা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল বলে তাদের সব আসবাব মাটিতে রাখলো। লাঠিসহ তাদের অন্যান্য সব সামগ্রী বড় বড় সাপ হয়ে নড়াচড়া করতে লাগল। এই তিন আয়াতে বলা হচ্ছে, অসংখ্য সাপ দেখে হযরত মুসা (আ.) ঘাবড়ে যান এই ভেবে যে, জনগণ তাঁর হাতে থাকা মুজিযার সঙ্গে হয়তো জাদুকরদের সাপকে গুলিয়ে ফেলবে। এ সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে এই মর্মে ওহি আসে যে, এই লড়াইয়ে তুমিই জয়ী হবে, কাজেই ভয় পেয়ো না। তোমার হাতের লাঠি নিক্ষেপ কর। এটি বিশাল অজগরে পরিণত হয়ে জাদুকরদের সব সাপকে গিলে ফেলবে।
এ তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. যখন আল্লাহর খাঁটি বান্দারা ঘাবড়ে যান ও শঙ্কিত হয়ে পড়নে তখন তাদেরকে নিজ সাহায্যের ব্যাপারে আশাবাদী করে তোলেন মহান আল্লাহ।
২. যখনই কোনো সমাজে মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য অসংখ্য উপকরণ থাকে তখন সেখানে আল্লাহর প্রতিনিধিরা উপযুক্ত হাতিয়ার দিয়ে সে সবের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেন। এর ফলে ধোঁকাবাজদের চেহারা উন্মোচিত হয়ে পড়ে এবং সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

সূরা ত্বোয়া-হা’র ৭০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَأُلْقِيَ السَّحَرَةُ سُجَّدًا قَالُوا آَمَنَّا بِرَبِّ هَارُونَ وَمُوسَى (70)
“এরপর জাদুকরেরা সেজদাবনত হল ও বলল- আমরা হারুন ও মুসার প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম।” (২০:৭০)
আল্লাহর নির্দেশে হযরত মুসা (আ.) হাতের লাঠি মাটিতে নিক্ষেপ করার পর সেটি বিশাল অজগরে পরিণত হয় এবং জাদুকরদের তৈরি করা সব সাপ খেয়ে ফেলে। এ দৃশ্য দেখে জাদুবিদ্যায় পারদর্শী জাদুকররা উপলব্ধি করে, মুসার লাঠি থেকে সাপ তৈরি হওয়ার ঘটনা মোটেই জাদুর খেলা নয়, বরং এটি সত্যি ঘটনা। কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়, এটি নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো কোনো অলৌকিক ক্ষমতা। কারণ, জাদুকরদের লাঠি দিয়ে তৈরি করা সাপ মানুষের চোখে আপাতদৃষ্টিতে সাপ মনে হলেও ওগুলোর পক্ষে কোনো কিছুকে গিলে ফেলা সম্ভব নয়। কিন্তু হযরত মুসার তৈরি সাপটি আসল সাপের মতোই সবকিছুকে গিলে খেয়েছে। এ উপলব্ধির কারণে সব জাদুকর হযরত মুসার সামনে এসে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনে। তারা সবাই হাজার হাজার মানুষের সামনে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার কথা ঘোষণা করে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১. মানুষ যে কোনো মুহূর্তে নিজের বিশ্বাস পরিবর্তন করতে পারে। বিশেষ কোনো বিষয় বা দৃশ্য দেখে কাফের ঈমানদারে আবার ঈমানদার কাফেরে পরিণত হতে পারে।
২. পথভ্রষ্টদের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে সব সময় আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমান আনার ব্যাপারে আশাবাদী থাকতে হবে।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৭১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ آَمَنْتُمْ لَهُ قَبْلَ أَنْ آَذَنَ لَكُمْ إِنَّهُ لَكَبِيرُكُمُ الَّذِي عَلَّمَكُمُ السِّحْرَ فَلَأُقَطِّعَنَّ أَيْدِيَكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ مِنْ خِلَافٍ وَلَأُصَلِّبَنَّكُمْ فِي جُذُوعِ النَّخْلِ وَلَتَعْلَمُنَّ أَيُّنَا أَشَدُّ عَذَابًا وَأَبْقَى (71)
“ফেরাউন বলল- আমি তোমাদের আদেশ করার আগেই কি তোমরা তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলে? নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রধান (জাদুকর)- যে তোমাদেরকে জাদু শিখিয়েছে। কাজেই আমি তোমাদের হাত ও পা-গুলোকে বিপরীতভাবে কেটে ফেলেবো এবং নিশ্চয়ই তোমাদের খেজুর গাছের সঙ্গে শুলে বিদ্ধ করব। তখন তোমারা জানতে পারবে, আমাদের মধ্যে কার শাস্তি কঠোরতর ও দীর্ঘস্থায়ী।” (২০:৭১)
জাদুকরদের ঈমান আনার দৃশ্য খুব স্বাভাবিকভাবেই ফেরাউনকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করে তোলে। কারণ, ফেরাউন চেয়েছিল এসব জাদুকর জনগণের সামনে হযরত মুসাকে অপমান করবে। কিন্তু উল্টো তারা হযরত মুসার প্রতি ঈমান এনে ফেরাউনকেই অপমান করে বসে। জাদুকররা মুসার ক্ষমতা উপলব্ধি করলেও ফেরাউন আল্লাহকে চিনতে পারেনি। ক্ষমতার দম্ভ তাকে অন্ধ করে রেখেছিল।
জাদুকররা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার কারণে নিজেকে অপমানের হাত থেকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নেয় ফেরাউন। সে তাদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে বলে, তোমরা মুসার কাছ থেকে জাদুমন্ত্র শিখেছো এবং আমাকে অপমান করার জন্য আগে থেকে এই ঘটনা সাজিয়ে রেখেছিলে। কাজেই এ অপরাধের শাস্তিস্বরূপ তোমাদের প্রত্যেকের হাত ও পা কেটে খেজুর গাছের সঙ্গে বিদ্ধ করে রাখবো যাতে ধীরে ধীরে তোমাদের মৃত্যু হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে কষ্ট পাও। কিন্তু ফেরাউনের হুমকিতে কোনো কাজ হয়নি। কারণ, জাদুকররা অন্তরের অন্তস্থল থেকে হযরত মুসা (আ.) ও আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল। কাজেই হত্যার হুমকিও তাদের ঈমান টলাতে পারেনি।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. ফেরাউনের মতো অত্যাচারী শাসকদের দেশের জনগণের মত প্রকাশের কোনো স্বাধীনতা নেই। কাজেই জনগণকে শাসকের কথামতো চলতে হয়।
২. এ ধরনের শাসক সত্যের অনুসারী ব্যক্তিদের যুগে যুগে অপবাদ ও হুমকি দিয়ে এসেছে।
৩. ফেরাউনি শাসন ব্যবস্থায় হত্যা ও নির্যাতন এত বেশি প্রচলিত হয়ে যায় যে, শাসকরা হত্যার হুমকি দেয়াকে তাদের অভ্যাসে পরিণত করে।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন