সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৬১-৬৬ (পর্ব-১০)

সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৬১-৬৬ (পর্ব-১০)
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৬১ ও ৬২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ لَهُمْ مُوسَى وَيْلَكُمْ لَا تَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ كَذِبًا فَيُسْحِتَكُمْ بِعَذَابٍ وَقَدْ خَابَ مَنِ افْتَرَى (61) فَتَنَازَعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ وَأَسَرُّوا النَّجْوَى (62)
“মুসা (ফেরাউন ও জাদুকরদের) বলল- দুর্ভোগ তোমাদের! আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করনা। করলে তিনি তোমাদের শাস্তি দিয়ে সমূলে ধ্বংস করবেন। যে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, সেই ব্যর্থ হয়েছে।”(২০:৬১)
“এরপর ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল এবং গোপনে পরামর্শ করল।” (২০:৬২)
আগের পর্বে বলা হয়েছে, মিশরের অত্যাচারী শাসক ফেরাউন আল্লাহর নবী হযরত মুসা (আ.)কে জনগণের সামনে অপমানিত করার জন্য দেশের সব বড় বড় জাদুকরকে সমবেত করেছিল। অন্যদিকে জনসমক্ষে এসব জাদুকরকে অপদস্থ করার উদ্দেশ্যে হযরত মুসা তাদেরকে উত্‌সবের দিন সকালে খোলা প্রান্তরে সমবেত হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। হযরত মুসা চেয়েছিলেন এর মাধ্যমে আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর নবুওয়াতের সত্যতা জনগণের সামনে প্রমাণ করতে। মোট কথা, ফেরাউনের হুমকিকে তিনি সুযোগে পরিণত করেন।
নির্ধারিত উত্‌সবের দিন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী যখন সবাই খোলা মাঠে সমবেত হয়, তখন হযরত মুসা (আ.) সব জাদুকর ও ফেরাউনের অনুগামীদের উদ্দেশ করে বলেন, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা ও তাঁর মুজিযাকে জাদুমন্ত্র বলা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপের সমান। এর পরিণাম মৃত্যু ও ধ্বংস। হযরত মুসা (আ.)’র এ বক্তব্যে জাদুকররা হতচকিত হয়ে গেল। তারা নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে এ বিষয়ে সলাপরামর্শ করতে লাগল।
এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল : হযরত মুসা জাদুকরদেরকে তাঁর সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে বলার পরিবর্তে তাদেরকে মূর্তিপুজা থেকে দূরে থেকে এক আল্লাহর ইবাদত করার আহ্বান জানান। তাঁর বক্তব্যের এ ধরন প্রমাণ করছিল যে, তিনি আল্লাহর নবী এবং এ কারণে জনগণের মধ্যে অনেকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে লাগলো। তারা মনে করলো, মুসা আল্লাহর নবী হতেও পারে এবং তার হুঁশিয়ারিগুলি ফলেও যেতে পারে।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হল:
১. মিথ্যা ও ধোঁকাবাজির মাধ্যমে কখনও কোনো ফল পাওয়া যায় না। মিথ্যা কেবল ব্যর্থতা ও হতাশারই জন্ম দেয়।
২. ইসলামের শত্রুদের মধ্যেও মতবিরোধ রয়েছে, কিন্তু তারা এ বিষয়টি মু’মিনদের বুঝতে দিতে চায় না।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৬৩ ও ৬৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالُوا إِنْ هَذَانِ لَسَاحِرَانِ يُرِيدَانِ أَنْ يُخْرِجَاكُمْ مِنْ أَرْضِكُمْ بِسِحْرِهِمَا وَيَذْهَبَا بِطَرِيقَتِكُمُ الْمُثْلَى (63) فَأَجْمِعُوا كَيْدَكُمْ ثُمَّ ائْتُوا صَفًّا وَقَدْ أَفْلَحَ الْيَوْمَ مَنِ اسْتَعْلَى (64)
“ফেরাউন ও তার অনুসারীরা বলল- এই দুইজন (অর্থাত মুসা ও হারুন) অবশ্যই জাদুকর, তারা চায় তাদের জাদু দিয়ে তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বের করে দিতে এবং তোমাদের পবিত্র ধর্মকে ধ্বংস করতে।”(২০:৬৩)
“কাজেই তোমরা তোমাদের জাদুক্রিয়া সংগ্রহ কর। তারপর (তাদের দুজনের মোকাবিলায়) সারিবদ্ধ হয়ে উপস্থিত হও এবং আজ যে জয়ী হবে, সেই সফলকাম।” (২০:৬৪)
হযরত মুসা (আ.)’র বক্তব্য কিছু মানুষের ওপর প্রভাব ফেলার পর ফেরাউন ও তার অনুগামীরা উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মুসা ও তাঁর ভাই হারুনের বিরুদ্ধে দু’টি মিথ্যা অপবাদ চাপিয়ে দিল। তারা চিতকার করে বলতে লাগল: মুসা ও হারুন তাদের এ বক্তব্যের মাধ্যমে মিশরের শাসনক্ষমতা দখল করে তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বনী ইসরাইল জাতিকে রাজকার্যে নিয়োগ দিতে চায়। সেইসঙ্গে পুরুষাণুক্রমিকভাবে তোমরা যে পবিত্র ধর্ম অনুসরণ ও মূর্তিপুজা করছো তার অবসান ঘটিয়ে এই দুই ভাই তোমাদেরকে তাদের ক্রীতদাস বানিয়ে রাখতে চায়।
দু’পক্ষের দুই ধরনের বক্তব্য শুনে স্বাভাবিকভাবেই জনগণ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ল এবং কারো কথা বিশ্বাস করাই তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ালো। এ সময় ফেরাউনের লোকজন জাদুকরদের বলল : তোমরা নিজেদের মধ্যে মতভেদ বাদ দিয়ে সব শক্তি দিয়ে দুই ভাই’র বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও। আজ যে পক্ষ জিতবে তাদের কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হবে।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
১. অত্যাচারী শাসকরা সব সময় নবী-রাসূলদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য তাদেরকে ক্ষমতালিপ্সু ও জাতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির বিরোধী বলে প্রচার চালায়।
২. ইসলামের শত্রুরা সত্য প্রতিহত করার লক্ষ্যে নিজেদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এবং মতভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় একত্ববাদে বিশ্বাসী মানুষ ঐক্যবদ্ধ না থাকলে শত্রুদের হাতে পরাজিত হতে হবে।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৬৫ ও ৬৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالُوا يَا مُوسَى إِمَّا أَنْ تُلْقِيَ وَإِمَّا أَنْ نَكُونَ أَوَّلَ مَنْ أَلْقَى (65) قَالَ بَلْ أَلْقُوا فَإِذَا حِبَالُهُمْ وَعِصِيُّهُمْ يُخَيَّلُ إِلَيْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ أَنَّهَا تَسْعَى (66)
“ওরা বলল- হে মুসা! হয় তুমি নিক্ষেপ কর অথবা প্রথমে আমরাই নিক্ষেপ করি।”(২০:৬৫)
“মুসা বলল- বরং তোমরাই নিক্ষেপ কর। ওদের জাদুর প্রভাবে অকস্মাত্‌ মুসার মনে হলো- ওদের দড়ি ও লাঠিগুলো ছুটাছুটি করছে।” (২০:৬৬)
জাদুকরদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সময় উপস্থিত হলে হযরত মুসা (আ.) তাদেরকে তাদের জাদুমন্ত্র প্রদর্শনের আহ্বান জানান। তিনি এমন কাজ করেন যাতে জাদুকররা তাদের ঝুলির সব জাদু একত্রে বের করে দেয় এবং তাদের হাতে নতুন করে দেখানোর মতো কোনো জাদু অবশিষ্ট না থাকে। জাদুরকরা তাদের সঙ্গে আনা লাঠিসহ অন্যান্য আসবাবপত্র মাটিতে ছুঁড়ে দিল এবং এসব জড় পদার্থ হযরত মুসা ও হারুনসহ উপস্থিত সবার কাছে জীবন্ত প্রাণী হয়ে দেখা দিল। তাদের কাছে মনে হতে লাগল, এসব বস্তুর প্রাণ আছে এবং এগুলো মাটিতে হেটে বেড়াচ্ছে।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :
১. সত্যের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে বিরুদ্ধবাদীদেরকে তাদের সব হাতিয়ার ব্যবহার করতে দেয়া উচিত। এরপর যুক্তিসঙ্গত ও দৃঢ়চেতা বক্তব্য ও কাজের মাধ্যমে তাদেরকে কাবু করে ফেলতে হবে।
২. জাদুমন্ত্র দিয়ে বস্তুর গঠনকে কখনো বদলানো যায় না। তবে মানুষের দৃষ্টিতে ভ্রম সৃষ্টি করে বস্তুটিকে অন্য কিছু হিসেবে তুলে ধরতে পারে জাদুকররা।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন