সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৫৫-৬০ (পর্ব-৯)
সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৫৫-৬০ (পর্ব-৯)
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৫৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَى (55)
“এই মাটি থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছি এবং এরই মধ্যে তোমাদের ফিরিয়ে দেব এবং এর থেকেই আবার তোমাদের বের করব।”(২০:৫৫)
আগের আসরে আমরা বলেছি, অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের দরবারে হযরত মুসা (আ.) যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তার ভেতরে এ জগত সৃষ্টি এবং তা পরিচালনার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর ক্ষমতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে কিছু উদাহরণও তুলে ধরা হয়েছে। এ আয়াতে কিয়ামতের কঠিন দিনের কথা উল্লেখ করে মাটির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, এই মাটি থেকে যেমন তোমাদের উত্পত্তি এবং এখান থেকেই যেমন তোমাদের জীবনধারণের সবকিছু সরবরাহ করা হয়, তেমনি মৃত্যুর পর এই মাটিই তোমাদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত বুকে ধারণ করে রাখবে। শেষ বিচারের দিন মাটি তোমাদেরকে আবার বের করে দেবে।
হযরত আলী (আ.) নামাজের সিজদাকে এই আয়াতের নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, প্রত্যেক রাকাতের প্রথম সিজদার অর্থ হচ্ছে, হে আল্লাহ! আমি আদিতে মাটি ছিলাম। প্রথম সিজদা থেকে উঠে বসার অর্থ হচ্ছে, হে প্রভু তুমি আমাকে এই মাটি থেকে সৃষ্টি করেছো। দ্বিতীয় সিজদায় যাওয়ার অর্থ, আমাকে আবার এই মাটিতে ফিরিয়ে নেয়া হবে এবং দ্বিতীয় সিজদা থেকে আবার ওঠার অর্থ, কিয়ামতের দিন আমি আবার এই মাটি থেকে ভূপৃষ্ঠে উঠে আসব।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :
১. পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে মাটি থেকে। তাহলে আমরা যে অহঙ্কার, গর্ব ও দম্ভ দেখাই তা কিসের জন্য? এ দম্ভের কোনো অর্থ হয় না।
২. মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায় না। মাটি আমাদের দেহকে কেয়ামত পর্যন্ত নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখবে।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৫৬ ও ৫৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَقَدْ أَرَيْنَاهُ آَيَاتِنَا كُلَّهَا فَكَذَّبَ وَأَبَى (56) قَالَ أَجِئْتَنَا لِتُخْرِجَنَا مِنْ أَرْضِنَا بِسِحْرِكَ يَا مُوسَى (57)
“আমি নিশ্চয়ই ফেরাউনকে আমার সব নিদর্শনাবলী দেখিয়েছিলাম, কিন্তু সে মিথ্যা আরোপ ও অমান্য করেছে।”(২০:৫৬)
“সে বলল- হে মুসা! তুমি কি তোমার জাদুর মাধ্যমে আমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বের করে দেয়ার জন্য আমাদের কাছে এসেছো?” (২০:৫৭)
এ দুই আয়াতে আবার ফেরাউন ও হযরত মুসা (আ.)’র মধ্যকার কথোপকথনে ফিরে আসা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ফেরাউন হযরত মুসার পক্ষ থেকে তার নবুওয়াতের নিদর্শনাবলী বিশেষ করে লাঠির সাপে রূপান্তরিত হওয়া এবং তার দেহের সাদা-শুভ্র হয়ে ওঠার ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু এগুলো দেখে হযরত মুসাকে নবুওয়াতের স্বীকৃতি দেয়ার পরিবর্তে এর সবকিছু অস্বীকার করে সে। ফেরাউন হযরত মুসাকে জাদুকর আখ্যা দিয়ে বলে, তুমি এসেছো আমার পতন ঘটিয়ে মিশরের শাসনক্ষমতা কেড়ে নিতে। ফেরাউনের দৃষ্টিতে আল্লাহর একত্ববাদের দিকে হযরত মুসার আহ্বান ছিল তার শাসনক্ষমতার প্রতি এক ধরনের হুমকি। কারণ, যে বনী-ইসরাইল জাতিকে ফেরাউন নিজের ক্রীতদাস পরিণত করেছিল তাদেরকে মুক্ত করে দেয়ার অর্থ ছিল, তার শাসনক্ষমতার ভিত নড়বড়ে হয়ে যাওয়া। এ কারণে ফেরাউন হযরত মুসা (আ.)কে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত করে।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
১. মানুষের কাছে আল্লাহর একত্ববাদের বাণী পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য নিদর্শন হিসেবে নবী-রাসূলরা মুজিযা বা অলৌকিক ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু মানুষ আত্মম্ভরিতা ও গোয়ার্তুমির কারণে তাকে জাদুমন্ত্র আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করে।
২. অত্যাচারী শাসকেরা সব সময় তাদের বিরোধী শক্তিকে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার দায়ে অভিযুক্ত করে।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৫৮, ৫৯ ও ৬০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
فَلَنَأْتِيَنَّكَ بِسِحْرٍ مِثْلِهِ فَاجْعَلْ بَيْنَنَا وَبَيْنَكَ مَوْعِدًا لَا نُخْلِفُهُ نَحْنُ وَلَا أَنْتَ مَكَانًا سُوًى (58) قَالَ مَوْعِدُكُمْ يَوْمُ الزِّينَةِ وَأَنْ يُحْشَرَ النَّاسُ ضُحًى (59) فَتَوَلَّى فِرْعَوْنُ فَجَمَعَ كَيْدَهُ ثُمَّ أَتَى (60)
“আমরা অবশ্যই তোমার কাছে এর অনুরূপ জাদু উপস্থিত করব, কাজেই আমাদের ও তোমার মধ্যে একটি দিন ও একটি মধ্যবর্তী স্থান নির্ধারণ কর, যার ব্যতিক্রম আমরাও করব না এবং তুমিও করবে না।”(২০:৫৮)
“মুসা বলল- তোমাদের নির্ধারিত সময় (হল) উতসবের দিন এবং সেদিন সকালে জনগণকে সমবেত করা হবে।” (২০:৫৯)
“এরপর ফেরাউন উঠে গেল, পরে তার ষড়যন্ত্র ও কৌশল (বা জাদুকরদের) একত্রিত করে উপস্থিত হল।” (২০:৬০)
এ আয়াতে একটি বিশাল প্রান্তরে ফেরাউনের নির্দেশে সব জাদুকরের একত্রিত হওয়ার ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সে দিনটি ছিল মিশরের একটি উতসবের দিন। রীতি অনুযায়ী, ওই দিন সকালে মিশরের সব মানুষ খোলা প্রান্তরগুলোতে সমবেত হয়ে আনন্দ-ফুর্তি করত। পবিত্র কুরআনের অন্য একটি আয়াতে এ দিনের ঘটনা আরো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
সূরা আ’রাফ ও সূরা শোয়ারা’র বিভিন্ন আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী, ফেরাউন হযরত মুসা ও হযরত হারুনের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর নিজের উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করে। সে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মিশরের সেরা জাদুকরদের উতসবের দিন রাজধানীতে সমবেত করতে হবে। এসব জাদুকরকে হুমকি প্রদর্শন ও প্রলোভন দেখিয়ে হযরত মুসার মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। ফেরাউন ভেবেছিল, সব জাদুকরের সম্মিলিত শক্তির কাছে মুসা হেরে যাবে। এর ফলে তার লাভ হবে দু’টি। এক, হযরত মুসা অপমানিত হবেন এবং আর কখনো বনী-ইসরাইল জাতির কাছে একত্ববাদের দাওয়াত নিয়ে আসবেন না।
দুই, ফেরাউন আরেকবার জনগণের সামনে নিজের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রমাণ দিতে পারবে।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ফেরাউন হযতর মুসা ও তার ভাইকে দাওয়াতি কাজ থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। এমন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজার শক্তিমত্তার সামনে দাঁড়ানোর মতো লোক খুঁজে পাওয়া সত্যিই বিরল। কিন্তু যারা নিজেদের সঠিক পথে থাকা এবং আল্লাহর ঐশী মদদে বিশ্বাসী তারা এতে ভয় পান না। তারা ওই প্রতাপের মোকাবিলা করার জন্য খালি হাতে ময়দানে আবির্ভূত হন। হযরত মুসা ও হারুন (আ.) ফেরাউনকে অবমাননা করে আল্লাহর একত্ববাদের সত্যতা জনগণের সামনে প্রমাণ করার জন্য এ বিষয়টিকে একটি উপযুক্ত সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন।
এ তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১. ঈদসহ অন্যান্য জাতীয় উতসবের দিনগুলোকে মানুষের কাছে আল্লাহর একত্ববাদের বাণী পৌঁছে দেয়ার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
২. ফেরাউনের সঙ্গে হযরত মুসার বাক্যালাপ অনুসরণ করে জনসমক্ষে ধর্মীয় আলোচনা করা যেতে পারে। এতে করে আলাপে অংশগ্রহণকারীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছেও সত্য উন্মোচিত হয়ে যায়।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন