পারভীন এ‘তেসামী নারী জাগরণের কবি

পারভীন এ‘তেসামী নারী জাগরণের কবি
হতাশা-বঞ্চনার অমানিশার বৃত্ত ভেঙে হৃদয়ের সুকুমার বৃত্তিকে লালন করে যে ক’জন মহীয়সী নারী ইরানের সাহিত্যাকাশে স্থান করে নিয়েছেন, নারীকে তার স্বরূপে বিকশিত করেছেন এবং নারীর মানসপটে আত্ম-পরিচয়ের বীজ অঙ্কুরিত ও পত্র-পল্লবে সুশোভিত করেছেন তিনি হলেন কবি পারভীন এ‘তেসামী। ক্ষণজন্মা প্রথিতযশা কবি পারভীন এ‘তেসামীর জীবনকাল সমকালীন অন্য কবি-সাহিত্যিকদের তুলনায় ক্ষুদ্র ও সীমিত। তাঁর ৩৫ বছরের জীবনকাল সাহিত্য রচনার দিক থেকে অতটা বর্ণাঢ্য না হলেও তাঁর একমাত্র গ্রন্থ দীওয়ানে পারভীন এ‘তেসামী সাহিত্যের মাপকাঠিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। (গত ২৫শে ইসফান্দ ১৩৯১ মোতাবেক ১৫ই মার্চ ২০১৩ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে কবি পারভীন এ‘তেসামী স্মরণ দিবস উদযাপিত হয়েছে।)
জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষা
পারভীন এ‘তেসামী ইরানী বর্ষপঞ্জির ১২৮৫ সাল মোতাবেক ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর তাবরিযে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ইউসুফ এ‘তেসামী অশতিয়ানী – যিনি ‘এতেসামুল মূল্‌ক’ হিসাবে সমধিক পরিচিত ছিলেন। তাঁর পিতা একাধারে একজন মনীষী, পণ্ডিত, সাহিত্য-অনুবাদক, মৌলিক লেখক ও জ্ঞানী হিসাবে তৎকালীন সমাজে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী ছিলেন। তিনিই পারভীন এ‘তেসামীকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করেন এবং শৈশব থেকে স্বীয় কন্যাকে জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের অলঙ্কারে সুশোভিত করে তোলেন।
উচ্চ শিক্ষা ও কবিতা রচনায় হাতেখড়ি
পিতার হাত ধরে পারভীন এ‘তেসামী মাত্র ১২ বছর বয়সে উচ্চ শিক্ষার্থে তাবরিয থেকে রাজধানী তেহরানে পাড়ি জমান এবং ১৮ বছর বয়সে তেহরানস্থ তৎকালীন আমেরিকান উইমেন্‌স কলেজের পাঠ সমাপ্ত করেন। সর্বপ্রথম এ কলেজের সমাবর্তন ও পরীক্ষার্থী বিদায় অনুষ্ঠানে তিনি কয়েক ছত্রের একটি কবিতা পরিবেশন করেন এতেই কবিতা রচনায় তাঁর পারঙ্গমতা ফুটে ওঠে। সকলের প্রশংসা কুড়ানো তাঁর প্রথম কবিতার দু’টি পঙ্‌ক্তি এখানে তুলে ধরা হলো :
সুখী হও হে ইচ্ছার চারাগাছ; তুমি সুফল এনেছ বয়ে
সমীরণ বিনে কুঁড়ি আর বসন্ত বিনে কুসুম এনেছ বয়ে
যৌবনকাল ও কবিতার নব উন্মেষ
সমাজ বাস্তবতার কুসংস্কারাচ্ছন্ন স্রোতধারার বিপরীতে পারভীন এ‘তেসামী তাঁর নিপুণ কলমের আঁচড়ে তুলে ধরেন চলমান জীবনের নানা অসঙ্গতি। বিশেষতঃ বিবাহোত্তর কালে অন্তঃপুরে নারীর স্বপ্নের অকাল মৃত্যু এবং বিষিয়ে ওঠা সংসারে তার কী নিদারুণ সমাধি ঘটে তা তিনি সুনিপুণভাবে তুলে ধরেন তাঁর রচনায়। কবি তাঁর নিজের জীবনেই এ বাস্তবতার মুখোমুখি হন। সম্ভাবনার পথে এগিয়ে চলা পারভীন এ‘তেসামীর সাথে সেনাবাহিনীর চাকুরে স্বামীর সৈনিকসুলভ রূঢ় মানসিকতার অমিল ঘটায় বিয়ের তিন মাসের মাথায় স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে পুনরায় পিত্রালয়ে ফিরে আসেন। এ তিন মাসের বৈবাহিক অভিজ্ঞতার তিক্ততা পরবর্তীকালে তিনি এভাবে তুলে ধরেন :
ওহে ফুলকুমারী! ফুলের জলসায় গিয়ে তুমি কী পেয়েছ?
হুল ফুটানো কাঁটার ব্যথা আর যন্ত্রণা ছাড়া কী পেয়েছ?
ভাগ্যের পরিহাসে তৃণভূমিতে এসে খাঁচায় বন্দিনী হলে
তৃণভূমিতে এসে হে বন্দিনী পাখি তুমি আজ কী পেয়েছ?
একটি সম্ভাবনার অকাল মৃত্যু
মৃত্যু এক অমোঘ পরিণতি। কিন্তু পারভীন এ‘তেসামীর জন্য বড় অসময়ে আসে এ পরিণতি। তিনি যখন তাঁর যশ-খ্যাতির স্বর্ণযুগ অতিক্রম করছেন এবং শৃঙ্খলিত জীবনের সকল বেড়া ডিঙ্গিয়ে অসহায় শিশু, নারী, ইয়াতিম আর নিপীড়িতের আশার প্রতীক হয়ে ছন্দে-পঙ্‌ক্তিতে আর অপার ভালবাসার আবর্তে নারীর অনুভূতির দ্বার খুলে দিচ্ছিলেন ঠিক তখনি ইরানী বর্ষপঞ্জির ১৩২০ সাল মোতাবেক ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে কালাজ্বরে ভুগে তিনি ইন্তেকাল করেন। এখানে আমরা স্মরণ করতে পারি :
মৃত্যুতে মরে না কবি কোনদিন, মৃত্যু খোঁজে তাঁর নাম
আর নাম যখন অমর হয়ে যায় কোথায় মরণ হয় তার?
সাহিত্যকর্ম
ক্ষণজন্মা কবি পারভীন এ‘তেসামী ৩৫ বছরের জীবনকালে খুব বেশি সাহিত্য রচনা করতে পারেন নি। তাঁর রচিত সকল কবিতা ১৩১৪ ইরানী সালে কবি মালেকুশ্ শু‘আরায়ে বাহ্‌র (কবিসম্রাট বাহ্‌র)-এর ভূমিকাসহ দীওয়ানে পারভীন এ‘তেসামী শিরোনামে একটি গ্রন্থাকারে প্রথম বারের মতো প্রকাশিত হয়। এটি ফার্সী সাহিত্যের একটি বহুল পঠিত কাব্যগ্রন্থ। প্রায় ৫০ হাজারের অধিক পঙ্‌ক্তিসমৃদ্ধ এ গ্রন্থে ক্বাসীদাহ্, মুক্বাত্বত্বা‘আত্, খণ্ড কবিতা ও মাসনাভী সহ পারভীন এ‘তেসামী রচিত বিভিন্ন ধরনের কবিতার সন্নিবেশ ঘটেছে।
পারভীনের কবিতায় বিষয়বৈচিত্র্য
দেখতে, শুনতে, বলতে ও করতে যা কুৎসিত তা পরিহার করে চলা এবং নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিশ্বাসের মাপে যা অসত্য ও অসঙ্গত চিন্তা-কর্ম-আচরণে তা এড়িয়ে চলাই হওয়া উচিত একজন কবি ও লেখকের সংস্কৃতি। এদিক থেকে কবি পারভীন এ‘তেসামীর ভূমিকা অনন্য। পারভীনের কবিতার ভাষা ও অলঙ্কার মনুচেহরী, নাসের খসরু, সা‘দী, মৌলভী রূমী প্রমুখ ক্লাসিক কবিদের ভাষা ও শব্দ বিন্যাসের মতোই। তাই অনেকেই তাঁকে পূর্বসূরি মহান কবিদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। পারভীন তাঁর কবিতায় স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বীয় ভাব-বক্তব্য বোধগম্য করার জন্য উপমা ও গল্পের অবতারণা করেছেন। কবিতা রচনার ক্ষেত্রে এ রীতিটি আমরা সালজুকী যুগের কবি সানায়ী, গায্নাভী, ফরিদুদ্দীন ‘আত্তার, রূমী প্রমুখের কাব্যধারায় দেখতে পাই।
পারভীন মনে করেন সত্যবাদী মানুষকে সাহসী হতে হবে এবং সময়ানুযায়ী যথার্থ কথা বলতে হবে। তিনি বলেন :
সত্যভাষিণী হও হে পারভীন, তোমার কিসের এত ভয়
মিথ্যার বেসাতি দেখেও সত্য গোপন কখনো উচিত নয়
বলার সময় পেয়ো না ভয় যা বলার বলে ফেল অকাতরে
বড়ই লজ্জার যে তরবারি থাকে যদি কোষবদ্ধ যুদ্ধের দিনে
মানুষ মাত্রই শান্তি ও কল্যাণকামী। কিন্তু শান্তি ও কল্যাণের পথ চেনা নেই বলেই তারা শান্তির নামে ঘটায় অশান্তি, কল্যাণ কামনায় ডেকে আনে অকল্যাণ, প্রীতির নামে জাগায় গোষ্ঠীচেতনা। তাই আচারিক সামাজিক রীতি আর উগ্র রীতিবোধই মানবপ্রীতি ও মানবতাবোধ বিকাশের পথে বড় বাধা – যা আজ মানবজাতির সমস্যার মূল কারণ। প্রীতি বিনিময়ে কারো অনীহা নেই – এ বিশ্বাসে পারভীন এ‘তেসামী তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সংস্কারমুক্ত চেতনা, চিন্তা ও বুদ্ধি দিয়ে জগৎ ও জীবনকে প্রত্যক্ষ করার আহ্বান জানান। তিনি আশা করেন, বিবেক ও যুক্তি তাদের দিশারী হোক। তাদের চিত্তলোকে প্রীতি ও সহিষ্ণুতার চাষ হোক; এর ফসলে তাদের চিত্তলোক ভরে উঠুক। তিনি রূপকের আদলে ময়ূর-এর প্রতি কাকের তীর্যক উক্তির মাধ্যমে মানবমনস্তত্ত্বের একটি বিশেষ দিক তুলে ধরেছেন তাঁর সুনিপুণ লেখনীর মাধ্যমে :
কুঞ্জবনে চলার পথে কাক ময়ূরকে কটুক্তি করে বলে
কুৎসিত এ পাখিটি কতই না আত্মম্ভরী আর স্বার্থপর
পা দুটো তার বাঁকা তবু পথ চলে সে বাঁকা পা নিয়ে
শিয়াল পণ্ডিতের ন্যায় লেজখানা তার পীতবর্ণ দেহে
মূলত পারভীন এ‘তেসামীর কবিতায় রয়েছে নীতিবোধ এবং সৎকর্মের অনুপ্রেরণার বিপুল সমাহার। মানুষের জীবনযাত্রা ও সামাজিক ব্যবস্থার সূক্ষ্ম পর্যালোচনা করে বঞ্চিত, দলিত, মেহনতী ও দুঃখী মানুষের হৃদয়প্রকোষ্ঠে জমে ওঠা ব্যথাগুলোকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করে এবং এর প্রতিকারের নিমিত্তে পারভীন এ‘তেসামী স্বকীয় ভাব আর সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা সুচারুরূপে তুলে ধরেন তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে। পারভীন এ‘তেসামী ছিলেন এমন এক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্নদ্রষ্টা যে সমাজে থাকবে না অত্যাচারীর কালো হাত, মিথ্যাচারীর কপটতা, বৈষম্য আর প্রতারণার হঠকারিতা আর নারী ও ইয়াতিমের আহাজারি। ‘পিতৃহীন’ কবিতায় তাঁর ভাষা এমনই নিদারুণ ব্যথাকাতর :

পিতার কবরের শিয়রে বসে ছোট বালিকা এক
নখের ছোবলে করে মুখ আর বুক তার ক্ষত-বিক্ষত
আমার নেই কোন বন্ধন, নেই মায়ের মমতার পরশ
হায় মোর প্রাণপাখি যদি উড়ে যেত পিতার সন্নিধানে
পারভীন তাঁর সময়ে প্রচলিত সমাজের নানা কুসংস্কার, অবিচার ও কদর্যরূপের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে সমাজে মাতৃত্বের দায়িত্ব পালনকারী নারীর ভূমিকা ও মর্যাদা সম্পর্কে একটি চমৎকার কবিতা রচনা করেন যা ‘ ’ (মায়ার ফেরেশতা) হিসাবে পরিচিত। কবি এ কবিতায় নারীকে এমন এক মায়ার ফেরেশতা ও জাহায হিসেবে কল্পনা করেছেন যার কাপ্তান হচ্ছে পুরুষ। কবির ভাষায় :
প্রেম আর মায়া-মমতার চিহ্ন নেই সে ঘরে যে ঘরে নেই নারী
মনের মৃত্যু হয়েছে যে দেহে সে তো এক থেমে যাওয়া ঘড়ি
পারভীন এ‘তেসামী তৎকালীন ইরানের নারী জাগরণে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। তিনি সময় ও স্থানের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখেন নি তাঁর সাহসী উচ্চারণ। আর তাই ঘরে-বাইরে বদলাচ্ছে জীবনদৃষ্টি।
সূত্রঃ ইন্টারনেট

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন