বৈচিত্র্যময় প্রদেশ হামেদান

বৈচিত্র্যময় প্রদেশ হামেদান
ইরানের হামেদান প্রদেশের আয়তন ১৯,৪৯৩ বর্গকিলোমিটার। হামেদানের উত্তরে যানজান ও কাজভীন প্রদেশ, দক্ষিণে লোরেস্তান প্রদেশ, পূর্বদিকে ওস্তানে মার্কাযী (মধ্য প্রদেশ), আর পশ্চিমে কুর্দিস্তান ও কেরমানশাহ প্রদেশ। ৩৩ ডিগ্রি ৫৯ মিনিট থেকে ৩৫ ডিগ্রি ৪৮ মিনিট উত্তর অক্ষাংশে এবং ৪৭ ডিগ্রি ৩৪ মিনিট হতে ৪৯ ডিগ্রি ৩৬ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মাঝে প্রদেশটির অবস্থান। ১৯৯৬ সালের প্রশাসনিক বিভাগ ও পরবর্তীকালের সংশোধনী অনুযায়ী হামেদান প্রদেশে ৮টি জেলা, ২১টি শহর, ২০টি থানা, ৭১টি ইউনিয়ন ও ১১২০টি গ্রাম রয়েছে। প্রদেশটির অন্তর্গত জেলাসমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।
হামেদান
হামেদান জেলার আয়তন ৪১১৮ বর্গকিলোমিটার। আলভান্দ পবর্তমালার শীর্ষরেখা হতে শুরু করে প্রদেশের পূর্ব সীমানা পর্যন্ত এ জেলার অবস্থান। হামেদানের উত্তরে রাযান ও কাবুদার অহাঙ্গ। দক্ষিণে তুয়েসেরকান ও মালায়ের জেলা, পূর্বে মধ্য প্রদেশ এবং পশ্চিমে বাহার জেলা অবিস্থত। হামেদান জেলার দক্ষিণে আলভান্দ পবর্তমালার মালভূমিসমূহ অবস্থিত। এ মালভূমিসমূহের শীর্ষরেখা হামেদান ও তুয়েসেরকান জেলার মধ্যে প্রাকৃতিক বিভাজন সৃষ্টি করেছে। হামেদানের প্রান্তর ভূমিসমূহ কাহাভান্দ, দাশতে নাশর এবং রাযান ফামেনীন প্রান্তরের অংশবিশেষ উপরিউক্ত মালভূমিগুলোর মাঝে মাঝে অবস্থিত।
হামেদান জেলার সর্বোচ্চ শৃঙ্গটির স্থান আলভান্দ পর্বতের শীর্ষদেশে; সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৩৫৮৪ মিটার। আর জেলার সর্বাধিক নিচু স্থান হচ্ছে ওমরাবাদ, সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ১৬০০ মিটার। এর মধ্য দিয়ে কারাহচায় নদী প্রবাহিত হয়েছে। জেলার গড়পড়তা উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ১৮২০ মিটার। ১৯৯৬ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জেলার লোকসংখ্যা ৫,৬৩,৪৬৬ জন এবং কিলোমিটার প্রতি গড় জনসংখ্যা ১৩৬৮ জন। জেলায় শহরের সংখ্যা ৫টি, শহরগুলো হচ্ছে : হামেদান, মারিয়ানজ, ফামেনীন, জুরক্বান ও কাহাভান্দ। এছাড়া তিনটি উপজেলা ও ১২টি ইউনিয়ন আছে। শহরাঞ্চলের লোকেরা ফারসিতে এবং গ্রামের লোকেরা প্রধানত তুর্কি ভাষায় কথা বলে।
মালায়ের
হামেদানের পর প্রদেশের বৃহত্তম জেলা মালারের আয়তন ৩২১০ বর্গকিলোমিটার। জিলার তিনটি শহর : মালায়ের, সামান ও আযান্দারিয়ান। তিনটি উপজেলা : কেন্দ্রীয়, সমান ও জুকার। এছাড়া ১৫টি ইউনিয়ন ও ২২১টি গ্রাম আছে।
মালায়ের জেলার উত্তরে হামেদান জেলা, পূর্বে আরাক প্রদেশ, দক্ষিণে বুরুজের্দ এবং পশ্চিমে তুয়েসেরকান ও নাহাভান্দ জেলা দ্বারা পরিবেষ্টিত। জেলাটির উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ১৭৮০ মিটার। তেহরান ও হামেদান থেকে মালায়েরের দূরত্ব যথাক্রমে ৩৯০ ও ৮৬ কিলোমিটার। আলভান্দ পবর্তমালা জেলার উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অংশ দিয়ে অগ্রসর হয়ে আরাকের সারবান্দ পর্বতমালার সাথে মিলিত হয়েছে। জেলার সর্বোচ্চ স্থান ইয়াযদেগার্দ, লাশকারদার শৃঙ্গ। বিখ্যাত পাহাড়টি সাসানী সম্রাট ইয়াযদেগার্দের কেল্লার ধ্বংসাবশেষ বুকে নিয়ে জেলার দক্ষিণাংশে দাঁড়িয়ে আছে। জেলার অন্য দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পাহাড় হচ্ছে কুহেগার্মে (উষ্ণ পর্বত)- উচ্চতা ২২০৬ মিটার এবং কুহে সার্দ (শীতল পর্বত)- উচ্চতা ২২৭৭ মিটার। জেলার গুরুত্বপূর্ণ নদী হেরমাবাদ; এতে সব মৌসুমে পানি থাকে না।
মালায়ের জেলার গাছপালা স্তেপ অঞ্চলের পবর্ত পাদদেশের অনুরূপ। মালায়ের জেলার আবহাওয়া পার্বত্যাঞ্চলীয় ভারসাম্যপূর্ণ আবহাওয়া এবং ইরানের আধা মরুময় আবহাওয়ার মাঝামাঝি। কাজেই এখানে উভয় ধরনের আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এখানে বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৪২.২ মিলিমিটার।
জেলার বাসিন্দাদের কথ্য ভাষা লোরী, কুর্দী ও ফারসির মিশ্রিত রূপ। সর্বশেষ আদমশুমারি মোতাবেক জেলার জনসংখ্যা ২,৯৭,০৬২ জন। অধিকাংশ লোক গ্রামে বাস করে এবং কৃষিকাজ তাদের প্রধান পেশা।
নাহাভান্দ
নাহাভান্দ জেলার আয়তন ১৪৬১ বর্গকিলোমিটার। হামেদান প্রদেশের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত। জাগরোস পবর্তমালার অংশবিশেষ ও ত্রিভুজাকৃতিক নাহাভান্দ প্রান্তর ভূমি নিয়ে এ জেলা গঠিত। ২টি উপজেলা, ৭টি ইউনিয়ন ও ৭টি ইউনিয়ন কেন্দ্রের ক্ষুদ্র শহর ও অপর দুটি শহর নিয়ে এই জেলা গঠিত। এ জেলার উত্তরে তুয়েসেরকান, দক্ষিণে লোরেস্তান প্রদেশ, আলশেতার ও নূরা আবাদ শহর, পূর্বে মালায়ের ও বুরুজের্দ আর পশ্চিমে কাঙ্গাভার ও ছাহনে এবং কেরমানশাহ প্রদেশ অবস্থিত। আকাশ পথে তেহরান থেকে নাহাভান্দের দূরত্ব ৩১৩ কিলোমিটার এবং সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ১৬৬০ মিটার। ১৯৯৬ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জেলার জনসংখ্যা ৬৫,১৬৪ জন। জাগরোস পবর্তমালার অবস্থান এবং ভূগর্ভস্থ পানির বিপুল মজুদের কারণে জেলায় ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু বিদ্যমান। নাহাভান্দ জেলার উত্তরাঞ্চলীয় মালভূমি জাগরোস পবর্তমালা বরাবর প্রলম্বিত। নাহাভান্দ শহরের উত্তর পশ্চিমে ২৫৩৩ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট আর্দেশান পাহাড় অবস্থিত। অন্যদিকে জেলার দক্ষিণে অবস্থিত গিরীন পর্বত বা গারি পর্বত এর উত্তর-পশ্চিমের শীর্ষরেখা নাহাভান্দ জেলা ও খোররামাবাদ জেলার মাঝে প্রাকৃতিক বিভাজন রচনা করেছে। জেলার সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গের উচ্চতা ৩১৮৮ মিটার যার পাদদেশে রয়েছে গামাসিয়াব ঝরনা। গামাসিয়াব, গিয়ান, ফারসিবান, মালুসান, গোম্বাদে কাবুদ, পুরনো কাঙ্গাভার, গার্দেকানে, বানাফশে ও রাযানে প্রভৃতি ঝরনা ও মরুদ্যানের প্রাচুর্য এলাকাটিকে শস্যশ্যামল ও কৃষিপ্রধান অঞ্চলে পরিণত করেছে।
তুয়েসেরকান
জেলার সর্বনিম্নভূমির নাম কারখানে গ্রাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে জেলার উচ্চতা ১৫৫৫ মিটার। পর্বত ও উচ্চভূমি অধ্যুষিত হওয়ায় জেলায় অধিকাংশ সময় পাহাড়ি জলবায়ু বিদ্যমান থাকে। প্রধান প্রধান নদী কালকাল, কারযান, সরকান ও সারাবী। কৃষিক্ষেত্রে সেচকর্মের মধ্য দিয়ে এসব নদীর অতিরিক্ত পানি গামাসিয়াব নদীতে পতিত হয়। তুয়েসেরকান জেলার আয়তন ১৫৫৬ বর্গমিটার। জেলায় ৩টি শহর তুয়েসেরকান, সেরকান ও ফারসাফাজ, ২টি উপজেলা, ৭টি ইউনিয়ন ও ১১১টি গ্রাম রয়েছে। এখানকার জনসাধারণ মুসলমান। তাদের ভাষা ফারসি। তবে কেরমানশাহ প্রদেশ এবং নাহাভান্দ ও মালায়ের জেলা সন্নিহিত এলাকার লোকেরা কুর্দী ও লোর ভাষায় এবং সীমিত সংখ্যক তুর্কি ভাষায় কথা বলে।
আসাদাবাদ
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬০৭ মিটার উঁচু আসাদাবাদ জেলার অবস্থান হামেদান প্রদেশের পশ্চিমে। তার উত্তরে কুর্দিস্তান প্রদেশের অংশবিশেষ এবং দক্ষিণ ও পশ্চিমে কেরমানশাহ প্রদেশের অংশবিশেষ। পূর্বে বাহার জেলা এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তুয়েসেরকান জেলা অবস্থিত।
কাবুদার অহাঙ্গ
অনুমানিক ৩৮১৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কাবুদার অহাঙ্গ জেলার অবস্থান হামেদান প্রদেশের উত্তর-পশ্চিমে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড় উচ্চতা ১৬৭৫ মিটার। উত্তরে খোদাবান্দ জেলা, পশ্চিমে বীজার ও কারভে, পূর্বে রাযান জেলা এবং দক্ষিণে হামেদান জেলা। বিশাল সমতল ভূমি ও প্রান্তর নিয়ে গঠিত এই জেলাটি আয়তনে হামেদানের পর প্রদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা। জেলাটি তিনটি উপজেলা শিরীন সু, কেন্দ্রীয় ও গুলতাপ্পে (পুষ্পটিলা) ও ১১টি গ্রামে বিভক্ত। জেলার গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ের মধ্যে আছে বুগাতী, গারাদাগ, কালিয়াবাদ সারিগীহ ও সুবাশী। আবহাওয়া প্রধানত ঠাণ্ডা ও শুষ্ক। পুরো প্রদেশের মধ্যে গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ও শীতকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এ জেলাতেই বিরাজ করে।
বাহার
হামেদানের উত্তর-পশ্চিমে বাহার জেলার চৌহদ্দিতে আছে উত্তরে কাবুদার অহাঙ্গ জেলা, পূর্বে হামেদান, দক্ষিণে হামেদান ও তুয়েসেরকান জেলা এবং পশ্চিমে আসাদাবাদ ও কুর্দিস্তানের গারভে। ১৩২৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বাহার জেলার তিনটি প্রধান শহরের নাম বাহার, লালজীন ও সালেহাবাদ। জেলা শহরকে কেন্দ্র করে ৭২০টি বসতি, ৫টি গ্রাম ও দু’টি উপজেলা আছে। ভূগর্ভস্থ পানি, সমতলভূমি ও উর্বরা জমির কারণে কৃষিব্যবস্থা খুবই উন্নত। লালজীন উপজেলায় হস্তশিল্পের বিস্তার উল্লেখ করার মতো। সাধারণ লোকদের ভাষা ফারসি ও তুর্কি। স্বল্পসংখ্যক লোক লোর ও কুর্দি ভাষায় কথা বলে। উপত্যকাসমূহের চারণভূমি সুপ্রাচীনকাল থেকেই লোরেস্তান ও কেরমানশাহ প্রদেশের যাযাবর উপজাতীয়দের আকৃষ্ট করে আসছে। প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, প্রাক-ঐতিহাসিক ও ঐতিহাসিক যুগে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দ থেকে এই ভূখণ্ডে বিভিন্ন জাতির, বিশেষ করে মাদদের বসতি ছিল। ইসলামী যুগের ইতিহাস গ্রন্থে বাহার জেলার কেন্দ্রীয় গুরুত্বের কথা উল্লেখ আছে। হিজরি পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীর ইতিহাসে বাহারকে চামান; কিল্লাবাহার, মোরগজারে গারাতকীম প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সাফাভী আমল থেকে গারাগুজলো সম্প্রদায়ের আগমন হয়েছে এবং পুরো জেলায় তারা জমিদারি প্রথা প্রবর্তন করেছে।
রাযান জেলা
রাযান জেলা বিস্তীর্ণ সমতলভূমি ও প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি নিয়ে হামেদান-তেহরান মহাসড়ক বরাবর এবং হামেদান শহর থেকে ৮১ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। প্রায় ২৭২৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জেলায় রয়েছে তিনটি প্রধান শহর : রাযান, গারভে দারজেযীন ও দামাগ। তিনটি উপজেলার নাম কেন্দ্রীয়, সারদরুদ গারভে, দারজেযীন। এছাড়া রয়েছে ৭টি ইউনিয়ন ও ১৩০টি গ্রাম। অধিকাংশ লোক তুর্কি ভাষায় কথা বলে, তবে ফারসি ভাষার প্রচলনও তাদের মধ্যে আছে। ১৯৮৯ সালে রাযান উপজেলা থেকে শহরে এবং ১৯৯৪ সালে জেলা শহরে উন্নীত হয়েছে। এ জেলার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে কাজভীন প্রদেশ, দক্ষিণে হামেদান জেলা, পূর্বে মধ্য প্রদেশ ও পশ্চিমে কাবুদার অহাঙ্গ। জেলার উত্তর-পূর্বাংশে খারাগান পবর্তমালা অবস্থিত এবং রাযান জেলায় এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৬৩০ মিটার।
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন