জনস্বাস্থ্য এবং ধুমপান
জনস্বাস্থ্য এবং ধুমপান
‘ধুমপান বিষপান'- এ বাক্যটির সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। ধুমপান বিষপানের সমতুল্য-এ কথা জেনেও আমরা অনেকেই এখনও ধুমপান করে যাচ্ছি। এর ফলে ক্ষতি হচ্ছে নিজের দেহের, পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের এমনকি গোটা বিশ্বের। কাজেই যেসব বদঅভ্যাস এখনই ত্যাগ করা উচিত, তার মধ্যে অন্যতম হলো ধুমপান।
'বিড়ি খাবি খা, মারা যাবি যা'-এ কথাটি শুনে অনেককেই হাসতে দেখা যায়। আসলে কিন্তু তা অত্যন্ত সঠিক ও খাঁটি কথা। বিড়ি বা সিগারেটের কুফল সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলের দিকে একটু নজর দিলেই ওই কথার বাস্তবতা ফুটে ওঠে। বিড়ি বা সিগারেট যে মানুষকে ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, তা এখন প্রমাণিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু ১৯৮৭ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী তামাকমুক্ত দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। মানুষকে ধুমপানের কুফল সম্পর্কে সচেতন করে তোলাই ওই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে প্রতি বছর এ সংক্রান্ত শ্লোগান ঠিক করা হয়। এ বছরের শ্লোগানের মূল কথা হলো, বিড়ি-সিগারেট তথা তামাকের বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইনগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে, আর তা সম্ভব হলেই জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে। আমরাও আশাকরছি প্রতিটি দেশ এ সংক্রান্ত আইন বাস্তবায়নে আরও বেশি যত্মশীল হবে।
ধুমপান; মানুষের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, সংস্কৃতি তথা গোটা মানবজাতির জন্যেই এক বড় হুমকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু'র রিপোর্টে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় দেড়'শ কোটি মানুষ ধুমপান করে। এরমধ্যে ৮০ শতাংশেরই বসবাস উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এবং ধুমপায়ীদের গড় আয়ু অধুমপায়ীদের গড় আয়ুর চেয়ে ২০ বছর কম। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকেও এটা স্পষ্ট যে, ধুমপানের কারণে নানা জটিল রোগ দেখা দেয়। অপ্রাপ্ত বয়সে মৃত্যুর একটা বড় কারণও হলো ধুমপান। ধুমপানের কারণে প্রতি বছর পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ মারা যায়।
বিড়ি বা সিগারেটের ধোঁয়ায় চার হাজার রাসায়নিক ও বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে। এ কারণে ধুমপান জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। স্বাস্থ্য বিষয়ক এক গবেষেণায় দেখা গেছে, ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগসহ অন্তত: ২৫ ধরনের রোগের সঙ্গে ধুমপানের কোন না কোনভাবে সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এত সব অকাট্য প্রমাণ থাকার পরও আমরা অনেকেই ধুমপান ত্যাগ করতে প্রস্তুত নই। অনেকে আবার মনে করেন, ধুমপান ত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আসলে এমন ধারণা সঠিক নয়। আসুন আজই ধুমপান ত্যাগের পদক্ষেপ নেই। দেখবেন আপনিও অন্যদের মতো সফল হয়েছেন।
ধুমপান জাতীয় অর্থনীতির জন্য ক্ষতি বয়ে আনে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিড়ি ও সিগারেট কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ কর সরকারকে দেয় তার চেয়ে কয়েক গুন অর্থ সরকারকে খরচ করতে হয় ধুমপানের কারণে সৃষ্ট নানা রোগের চিকিৎসা করার জন্য। বিড়ি-সিগারেট কেনার অর্থ হলো কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে বিষ কিনে খাওয়া। বিড়ি -সিগারেটের ব্যবসায় যেহেতু লাভ অনেক বেশি সে কারণে বড় বড় কোম্পানিগুলো ধুমপায়ীর সংখ্যা বাড়াতে ব্যপক তৎপরতা চালাচ্ছে। এসব কোম্পানি প্রতি বছর ক্রেতা আকৃষ্ট করার জন্য এক হাজার কোটি ডলার ব্যয় করে থাকে। অবশ্য গত কয়েক দশক ধরে উন্নত দেশগুলো ধুমপান নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং ধুমপান নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
উন্নত দেশগুলোতে কড়াকড়ির কারণে মাদক উৎপাদন ও বিতরণের সঙ্গে জড়িত মাফিয়া চক্র আগের চেয়ে বেশি করে তৃতীয় বিশ্বকে টার্গেটে পরিণত করেছে এবং তাদের কারখানাগুলোকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে স্থানান্তর করছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তরুণদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হবার কারণে তা বিড়ি ও সিগারেটের লাভজনক বাজার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ধুমপান পরিবেশের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। প্রতিদিন কোটি কোটি সিগারেটের ধোঁয়ায় পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। সিগারেটের কাঁচামাল তামাকের চাষও পরিবেশের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। তামাক গাছ মাটির এমন কিছু উপাদানকে নষ্ট করে দেয় যা অন্যান্য ফসল ফলানোর ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। এছাড়া সিগারেটের ধোঁয়া কেবলমাত্র ধুমপায়ীর জন্যই স্বাস্থ্য হানিকর নয় তা তার আশেপাশের লোকজনের জন্যও মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুর বাবা-মা সিগারেট খান তারা অন্যদের তুলনায় দ্রুত রোগাক্রান্ত হয় এবং শারীরিকভাবে দুর্বল থাকে। এছাড়া, ধুমপায়ী মায়েদের সন্তানের ওজন জন্মের সময় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম বা বেশি হয়ে থাকে।
ধুমপান এক ধরনের নেশা। বিড়ি বা সিগারেটে রয়েছে মারাত্মক বিষাক্ত উপাদান নিকোটিন। যেমনটি আগেই বলেছি, সিগারেটের বিষাক্ত উপাদান নিকোটিনকে খুনির সঙ্গে তুলনা করা হয়। বিড়ি বা সিগারেট মানুষকে সাথে সাথে হত্যা না করে আস্তে আস্তে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
যারা সিগারেট খায় তাদের মাদকাসক্ত হবার আশংকা বেশি থাকে। কাজেই সন্তানকে বিড়ি বা সিগারেট থেকে দূরে রাখার অর্থ হলো মাদকের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা। তবে সন্তানরা তখনি ধুমপান না করার উপদেশ শুনবে যখন তার বাবা নিজে ধুমপান থেকে বিরত থাকবে। ধুমপান না করলে নানা সামাজিক সমস্যা থেকেও নিজেকে দূরে রাখা যায়।কাজেই নিজেদের স্বার্থেই আমাদেরকে সচেতন হতে হবে এবং যারা এখনও ধুমপানে আসক্ত হয়নি তাঁরা যাতে আর কখনো আসক্ত না হয়,সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ইরানেও প্রতিবছর আন্তর্জাতিক তামাকমুক্ত দিবস উদযাপিত হয়। ইরানে শুধু একদিন নয় এক সপ্তাহজুড়ে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হয়। অবশ্য ধুমপানের মতো মারাত্মক সমস্যা সমাধানের জন্য একদিন, দুইদিন বা এক সপ্তাহর কর্মসূচি যথেষ্ট নয়। এ জন্য বছরজুড়ে চেষ্টা চালাতে হবে। দেশ ও সমাজকে সচেতন করে তুলতে ধুমপানের কুফল সম্পর্কে হাতে কলমে শিক্ষা দিতে হবে। গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে আলোচনা হতে হবে। বিদ্যমান আইনগুলো কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে
ধুমপানমুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলতে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। আমরা নিজেরা যারা ধুমপান করছি তাদেরকে আগে ধুমপান ত্যাগ করতে হবে। ধুমপান ত্যাগ করা কঠিন কোন বিষয় নয়। এ জন্য নিজের ইচ্ছে শক্তিটাই যথেষ্ট। আসুন আজই ধুমপান ত্যাগে পদক্ষেপ নেই। মহতি এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে এক মুহুর্তও বিলম্ব করা উচিত হবে না।
সূত্রঃ ইন্টারনেট ৃ
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন