রমজানের ক্ষতিকারক রঙ্গিন খাবার

রমজানের ক্ষতিকারক রঙ্গিন খাবার

যদিও রমজান মাসটি মানুষের সংযম পালন ও এবাদতের মাস, কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেক সচ্ছল মানুষ এ মাসে খাবারের পেছনে বেশি খরচ করে থাকেন। কারণ মুখরোচক খাবার। কিন্তু দুঃখজনক হলো যে এসব মুখরোচক খাবারের সবটুকুই স্বাস্থ্যকর ও ভেজালহীন নয়। ভেজালের পরিমাণ ও রকমফের বিশেষ করে ইফতারি সামগ্রীতেই বেশি দেখা যায়, এগুলোর মধ্যে ভেজাল তেল ও রং এর সমস্যাই বেশি। আজ আমরা রংএর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো।

ইফতারিতে হরেক রকম রং ব্যবহার করা হয়। সারাদিন রোজা রেখে মানুষ ইফতারিতে মুখরোচক খাবার পছন্দ করে। কিন্তু ইফতারির প্রায় সবগুলো সামগ্রী যেমন পেঁয়াজু, ছোলা, বেগুনি, আলুর চপ, মাংসের চপ, কাবাব, কাটলেট, তেহারি, হালিম, জিলিপি, বিভিন্ন সিরাপ বা পাউডার দিয়ে ঘরে তৈরি শরবত, বাজারে বিক্রিত প্যাকেটজাত হরেক নামের তথাকথিত আমের বা কমলার রস ইত্যাদি সবকিছুতেই থাকে কৃত্রিম বিষাক্ত রংএর উপস্থিতি। রোজার পরে আসে ঈদের উৎসব। তার খাদ্য-আয়োজনেও থাকে রংএর ব্যবহার। সেমাই, লাচ্ছা সেমাই, পোলাও ইত্যাদিতেও অনেকেই রং ব্যবহার করেন। জর্দাও তৈরি হয় প্রায় বাড়িতেই। নিজেদের খাওয়া এবং অন্যদেরকে খাওয়ানোর জন্য রঙিন খাবারের এই আয়োজন এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো ইফতারিসহ বিভিন্ন খাবার ও পানীয়কে আকর্ষণীয় করতে হলুদ, কমলা, লাল, সবুজ ইত্যাদি রংএর এই যে ব্যবহার তা নিরাপদ কিনা। বিজ্ঞানীরা কিছু রংকে খাদ্য ও পানীয়তে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছেন। এগুলোকে বলে পারমিটেড ফুড কালার। খাদ্য ও পানীয়ে ব্যবহৃত কৃত্রিম রংগুলো বিভিন্নভাবে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। পারমিটেড কালারগুলোও এ দোষ থেকে একেবারে মুক্ত নয়। ব্যতিক্রম কেবল অধিকাংশ প্রাকৃতিক রং, যেগুলো অধিকাংশই স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে না। কিন্তু প্রাকৃতিক রং সাধারণভাবে দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না। এগুলো থাকে বিভিন্ন ফল ও শাকসবজিতে।

তাই রং ব্যবহার করতে গেলে আমাদেরকে কৃত্রিম রং কিনতে হয়। যেহেতু কৃত্রিম রংগুলো স্বাস্থ্যের নানাবিধ ক্ষতি করে এবং খাদ্য ও পানীয়ে রং ব্যবহারে মানুষের আগ্রহ প্রবল, তাই তুলনামূলকভাবে নিরাপদ রংগুলোকে পারমিটেড কালার হিসাবে বিজ্ঞানীরা তালিকাভুক্ত করেছেন। কিন্তু আমার আশংকা, এবার রোজা ও ঈদের খাদ্য ও পানীয়তে আপনি যে রংগুলো ব্যবহার করতে যাচ্ছেন সেগুলো পারমিটেড কালার নয়। কারণ আপনি এ দেশের ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার লুটেরা অপ-বাণিজ্যের বৃত্তে আবদ্ধ। এখানে অন্য সব বিবেচনার চাইতে যেনতেন প্রকারে আহরিত মুনাফা বা ধনই মুখ্য। এ বৃত্ত থেকে বেরুনো আপনার জন্য সহজ কাজ নয়।

পারমিটেড কালারগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। আপনি যে দোকান থেকে খাদ্যে ব্যবহারের রং কেনেন সে দোকানি আবার আরেকজনের কাছ থেকে রং কেনে। এভাবে রং বেশ কয়েক হাত বদল হয়ে আপনার হাতে আসে। ফলে এর যে কোন এক স্তরের কোনো একজন যদি ভাবে যে রং যেহেতু সব দেখতে এক রকমই, সেহেতু অতি মুনাফার লোভে সে পারমিটেড কালারের বদলে একই রকম দেখতে কিন্তু অত্যন্ত ক্ষতিকর টেক্সটাইল কালার সেখানে বসিয়ে দেয়। বাণিজ্যের প্ররোচণার কারণে সরল বিশ্বাসে নিরাপদ মনে করে আপনি সে রং নিজে খাচ্ছেন, বাচ্চাদেরও মুখে তুলে দিচ্ছেন।

অথচ এই টেক্সটাইল কালার আপনার রান্নাঘরে প্রবেশের কথা ছিল না। কথা ছিল এগুলো কাপড়ের কারখানায় থাকার, সেভাবেই এদেশে এগুলোকে আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছিল। ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভ তাকে কাপড়ের কারখানা থেকে আপনার রান্নাঘরে নিয়ে এসেছে, কারণ টেক্সটাইল কালারগুলো দামে অত্যন্ত সস্তা।

শরীরে প্রবেশের পর টেক্সটাইল কালারগুলো যেসব ক্ষতি করে তার পুরো বিবরণ দেওয়া পত্রিকার পাতায় সম্ভব নয়। কারণ পত্রিকায় জায়গার সীমাবদ্ধতা আছে, বরং তার জন্য বড় আকারের বই লিখতে হবে। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, কাপড়ের কারখানার আশেপাশে নদী খাল বা অন্য জলাশয়গুলোর পানি রঙিন। এসব রং প্রকৃতিতে গিয়েও দীর্ঘদিন সহজে পরিবর্তিত হয় না অর্থাৎ এগুলোর অধিকাংশই বায়ো-ডিগ্রেডেবল নয়। ফলে কাপড়ের কারখানার রঙিন বর্জ্য যেসব নদী খাল বা জলাশয়ে নির্গত হয় সেগুলোর মাছ ও অন্যান্য কীট-পতঙ্গ মরে যায়, মরে যায় শৈবালসহ সব ধরনের জলজ উদ্ভিদ, অর্থাৎ জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ক্ষতি হয় মারাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী।

এই টেক্সটাইল কালারগুলো খাদ্য ও পানীয়ের সাথে মিশে শরীরে প্রবেশের পর এমন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যার ক্ষতি করে না। তবে সবচেয়ে বেশি ও দৃশ্যমান ক্ষতিগুলো হয় আমাদের লিভার, কিডনি, হৃদপিন্ড ও অস্থিমজ্জার। এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। বাচ্চা ও বৃদ্ধদের বেলায় নষ্ট হয় তাড়াতাড়ি, তরুণ-তরুণীদের কিছুটা দেরিতে। আজকাল আমাদের দেশে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেলিউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি এগুলো অত্যন্ত বেড়ে গেছে। সব বয়সী লোকজনই এতে আক্রান্ত হচ্ছে, তবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বাচ্চারা। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এর প্রধান কারণ আমাদের দেশের খাদ্যে ব্যাপক পরিমাণে নকল-ভেজাল ও রংএর ব্যবহার। বায়ো-ডিগ্রেডেবল নয় বলে এসব টেক্সটাইল কালার আমাদের শরীরের মেটাবোলিজম বা বিপাক ক্রিয়াতেও নষ্ট না হয়ে দীর্ঘদিন শরীরে থেকে প্রাণঘাতি ক্ষতি করতেই থাকে।

আমাদের বাজারে ভারতীয় অজস্র কো¤পানির পাশাপাশি আই সি আই, বায়ার, মার্ক, ডোলডার ইত্যাদি কো¤পানির রং খোলা বাজারে দেদার বিক্রি হয়। রং বিক্রির ওপরে এদেশে কোনো বিধিনিষেধ নেই। এই টেক্সটাইল কালারগুলো কোনো না কোনো কারখানা থেকে কালো পথে খোলা বাজারে চলে আসে এবং তা আসছে যুগের পর যুগ ধরে। ফলে এ অন্যায়টিকে মানুষ আর অন্যায় বলেই মনে করছে না। একজন সচেতন মানুষ হিসাবে আপনি দোকানদারের কাছ থেকে রং কেনার সময় লেবেল দেখে নিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কৌটার লেবেল ব্যবসায়ীরা রাখে না। তবে দোকানদার নেহাৎ বোকা হলে রংএর কৌটার গায়ে লেবেল থাকতেও পারে। লেবেলে রংএর নাম থাকবে, ফুড কালার কিনা তা ¯পষ্ট করে লেখা থাকবে, দাম লেখা থাকবে, উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখতো থাকবেই। উপরিউক্ত কো¤পানিগুলোই এদেশে ব্যবহৃত অধিকাংশ টেক্সটাইল কালারের উৎপাদক ও সরবরাহকারী।

বাংলাদেশে যেসব টেক্সটাইল কালার বিক্রি হয় তার তালিকা দীর্ঘ। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃতগুলো হলো অরামিন, অরেঞ্জ টু, মেটানিল ইয়েলো, রোডামিন বি, ব্লু ভিআরএস ইত্যাদি। আমাদের মিষ্টির দোকানগুলোর অধিকাংশ দই-মিষ্টি, কনফেকশনারির কেক বিস্কুট পেস্ট্রি টফি লজেন্স, কিংবা উৎপাদকদের চানাচুর জ্যাম জেলি জুস আচারে হলুদ রংএর জন্য মেটানিল ইয়েলো এবং লাল রংএর জন্য রোডামিন বি বেশি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া আরো যে টেক্সটাইল কালার ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্ল্যাক এসবি, সান ইয়েলো আরসিএইচ, স্কাই ইয়েলো এফবি, ইয়েলো ৩জিএক্স, অরেঞ্জ এসই, অরেঞ্জ জিআর পিওপি, স্কারলেট ৪বিএস, গ্রিন পিএলএস, বরদু বিডব্লিউ, ফাস্ট রেড ৫বি, টুর্ক ব্লু জিএল, ব্রাউন সিএন ইত্যাদি। আপনি আপনার দোকানির রংএর নামের সাথে এ তালিকা মিলিয়ে দেখতে পারেন।

বিজ্ঞানীদের অনুমোদিত রং বা পারমিটেড ফুড কালারগুলো নিয়েও সমস্যা আছে। আমাদের দেশে তহবিলের অভাবে সম্ভব না হলেও উন্নত দেশগুলোতে বিজ্ঞানীরা সবসময় বাজারের ওপর নজরদারি রাখেন। অনুমোদিত রংগুলো দিয়ে তৈরি পণ্য সেজন্য তারা নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করে থাকেন। বিজ্ঞান দিনকে দিন এগিয়ে যাচ্ছে, নতুন নতুন পরীক্ষা আবিষ্কৃত হচ্ছে, ফলে একসময় যে রংগুলোকে স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ মনে করে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল সেগুলোর কোনো কোনোটাতে এখন স্বাস্থ্যহানিকর বিরূপ-প্রতিক্রিয়া বা ঝুঁকি ধরা পড়ছে। ফলে সেগুলো এখন নিরাপদ বা অনুমোদিত তালিকা থেকে বাদ পড়ছে। অর্থাৎ মানুষ নিরাপদ মনে করে দীর্ঘদিন যে অনুমোদিত রংগুলো ব্যবহার করে এসেছে হঠাৎ আবিষ্কৃত হলো তার অনেকগুলোর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া। হয়তো ইতোমধ্যে অনেকের শরীরেই এ ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করেছে। এর জন্য যে বিজ্ঞানীরা আগে কিছু রংকে নিরাপদ ঘোষণা করেছিলেন তাদেরকে দোষারোপ করে লাভ নেই। তখন ধরা পড়েনি যে এটি ক্ষতিকর তাই তখন এটি অনুমোদন করা হয়েছিল, এখন ক্ষতি ধরা পড়েছে তাই এখন এটি বাদ দিতে হবে। এই হলো নিয়ম। কিন্তু যে মানুষের শরীরে ক্ষতি হয়ে গেল সেতো আর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারছে না।

সমস্যার কিন্তু এখানেই শেষ নয়। অনুমোদিত প্রতিটি রংএর আবার সর্বোচ্চ নিরাপদ মাত্রা-সীমা রয়েছে। অর্থাৎ এ নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি ব্যবহার করলে শরীরের ক্ষতি হবে। একেক দেশে এ মাত্রা-সীমা একেক রকম। তুলনামূলকভাবে কম প্রযুক্তিগত দক্ষতাস¤পন্ন দেশগুলোতে এ মাত্রা-সীমা বেশি, কিন্তু উন্নত প্রযুক্তিগত দক্ষতার দেশগুলোতে এটি কম। আমাদের মতো গরিব দেশে কোন খাদ্য ও পানীয় উৎপাদক এ মাত্রা-সীমা মেনে অনুমোদিত রং মেশাচ্ছে কিনা তা দেখার অর্থাৎ পরীক্ষা করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এখনো নেই। যে দেশে ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ দেখার জন্য এখনো কোনো উপযুক্ত আইন বা ল্যাব সুবিধা নেই, সে দেশে কোনো খাদ্য বা পানীয়তে ব্যবসায়ীর কথা অনুযায়ী অননুমোদিত রংএর বদলে অনুমোদিত রং মেশানো হয়েছে এটা জেনে তাই আশ্বস্ত হওয়ার কোনো কারণও নেই।

অনুমোদিত রং নিয়ে আরো একটা সমস্যা রয়েছে যে, অনুমোদিত রংকে অনুমোদিত সর্বোচ্চ মাত্রা-সীমার মধ্যে ব্যবহার করেও নিস্তার নেই। অনুমোদিত সীমার মধ্যে ব্যবহার করলেও সবগুলো অনুমোদিত রংএরই কমবেশি পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যেমন সানসেট ইয়েলো নামের রংটি আমাদের দেশে কনফেকশনারি, ফাস্ট ফুডের দোকান, মিষ্টির দোকান, আইসক্রিম, কোমল পানীয়, পটেটো চিপস্ ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়। এর ব্যবহারে আর্টিকেরিয়া ধরনের এলার্জি, নাক দিয়ে পানি পড়া, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, বমিভাব, বমি, পেটে ব্যথা, বদ্হজম, খাদ্যে অরুচি, কিডনিতে টিউমার, গর্ভবতী মায়েদের ভ্রƒণের ক্ষতি, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। যদি কোন ব্যবসায়ী বলেন যে তারা তাদের উৎপাদিত খাদ্যে সানসেট ইয়েলো নামের হলুদ রংটি ব্যবহার করেন না, তারা ব্যবহার করেন টারট্রাজিন, তাহলে এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াগুলোও দেখে নেওয়া যাক। এটি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে হাঁপানি তৈরি করে। এছাড়া অন্যান্য ক্ষতিকর লক্ষণগুলো আগেরটির মতোই, তবে পার্থক্য হলো এটি কিডনির বদলে গলার থায়রয়েড গ্রন্থিতে টিউমার বা ক্যান্সার তৈরি করে। এছাড়া যাদের এসপিরিন সহ্য হয় না তাদের বেলায় এ রংটি আরো ক্ষতি করে।

বাংলাদেশে ইদানীং বাচ্চাদের হাঁপানি অনেক বেড়ে গেছে। বাচ্চাদের কোমল পানীয়ে ব্যবহৃত আরেকটি অনুমোদিত হলুদ রং ইয়েলো ৭জি সহ বিভিন্ন খাদ্য ও পানীয়ে ব্যবহৃত রংগুলো এজন্য প্রধানত দায়ী। বিজ্ঞানীরা বাচ্চাদের হার্টের অসুখের সাথেও এখন এসব রংএর সম্ভাব্য স¤পর্ক খতিয়ে দেখছেন। অথচ দুঃখের কথা হচ্ছে যে আমাদের দেশে বাচ্চাদের খাদ্য ও পানীয়গুলোতেই রং বেশি বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো খেয়ে কত বাচ্চা যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা কে জানে।

এবিষয়ক সর্বশেষ সংবাদ হচ্ছে খাদ্যে ব্যবহারের জন্য এতকাল ধরে অনুমোদিত বা পারমিটেড ৮টি রংকে অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (এফ ডি এ) মানুষের যে কোনো খাদ্য ও পানীয়ে ব্যবহারের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। একসময় অনুমোদিত থাকলেও এখন এদের সৃষ্ট মারাত্মক ক্ষতি এতো বেশি ধরা পড়ছে যে এগুলো ব্যবহারের নিরাপদ সীমাকে কমিয়ে দেওয়া সংক্রান্ত ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব এফডিএ নাকচ করে দিয়ে এগুলোকে একবারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার স্বার্থে দোকান থেকে অনুমোদিত রং বা রং মেশানো খাদ্য/পানীয় কেনার সময় যাতে দেখে নিতে পারেন সে জন্য বাতিল করা রংগুলোর নাম এখানে উল্লেখ করা হলো - এফডিএন্ডসি অরেঞ্জ নং ১, এফডিএন্ডসি রেড নং ৪, এফডিএন্ডসি রেড নং ৩২, এফডিএন্ডসি ইয়েলো নং ১, এফডিএন্ডসি ইয়েলো নং ২, এফডিএন্ডসি ইয়েলো নং ৩, এফডিএন্ডসি ইয়েলো নং ৪ এবং এফডিএন্ডসি ভায়োলেট নং ১।

উপরিউক্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে আপনি নিশ্চয়ই আমাদের সাথে একমত হচ্ছেন যে, প্রথমত খাদ্য বা পানীয়ে অনুমোদিত রং ছাড়া অন্য কোনো রং থাকা অত্যন্ত ক্ষতিকর; দ্বিতীয়ত খাদ্য বা পানীয়ের অনুমোদিত রংগুলোও স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে বলে এগুলোর ব্যবহারও ঝুঁকিপূর্ণ। অতএব সবচেয়ে ভালো হলো আমাদের খাদ্য ও পানীয়ে কৃত্রিম রং একবারেই ব্যবহার না করা। নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরা রক্ষার এটি সবচেয়ে ভালো পথ।

যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন যে তাহলে নিরাপদ রং কোনটি? এর পরিষ্কার উত্তর হলো বিজ্ঞানীরা এখনো এমন কোনো রংএর দেখা পাননি। আমি কিন্তু বিনীতভাবে প্রশ্নকারীকে পাল্টা জিজ্ঞেস করতে চাই, খাদ্যে রং দিতে হবে কেন? এতে কি খাদ্যের স্বাদ বা পুষ্টিমান বাড়ে? আমি নিশ্চিতভাবে বলতে চাই, খাদ্যে বা পানীয়ে রং ব্যবহার করলে এর স্বাদ বা পুষ্টিমূল্য কোনোটাই বাড়ে না। তবে বাড়ে এর বাণিজ্যিক মূল্য, উৎপাদকরা রং মিশিয়ে আপনার পকেট কেটে তার বিনিময়ে আপনারই শরীরের ক্ষতি উপহার দেয়। এদের কাছে আজ আপনি আমিসহ পুরো জাতি জিম্মি হয়ে পড়েছি। আসুন সিদ্ধান্ত নেই আমরা আর এদের মোহনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে আটকা পড়বো না।

সেই সাথে আসুন সিদ্ধান্ত নেই, নিজেরাও ঘরে খাবার তৈরির সময় কোন কৃত্রিম রং মেশাবো না। আসুন, পরিবারের সদস্যদের বলি যে খাবারের প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক রং ছাড়া এগুলোতে অন্য যে কোন রং মেশানো ক্ষতিকর। আসুন এবারের রোজার মাসে ইফতারি থেকে শুরু করে ঈদের খাবারসহ পরবর্তীতেও বিষাক্ত রংবিরোধী এই নিরাপদ খাদ্য আন্দোলনটি নিজেরা যার যার বাড়িতে শুরু করি।

রোজার মাসে সরকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংস্থা, এমনকি কোনো কোনো ব্যক্তি ইফতার পার্টির আয়োজন করে থাকেন। বছর দশেক আগেও বর্তমানের মতো এমন ঘটা করে ইফতার পার্টির কালচার চালু ছিল না। এসব ইফতার পার্টিতে যেসব সামগ্রী পরিবেশিত হয় সেগুলোর অধিকাংশই থাকে বিষাক্ত রং মেশানো। দোকানে দোকানে ইফতার সামগ্রী তৈরিতে রংএর ব্যবহার যেন মোচ্ছবে পরিণত হয়। যারা ইফতার পার্টির আয়োজন করবেন, তাদের কাছে আবেদন জানাই, জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে সবরকম কৃত্রিম রংহীন ইফতার সামগ্রী পরিবেশন করুন। বঙ্গভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলসমূহ ও বিভিন্ন সংস্থা যদি কৃত্রিম রংহীন ইফতার সামগ্রী পরিবেশন করতে থাকেন তাহলে তা একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হবে। আমার মনে হয় এতে ইফতার পার্টিতে যোগ দেওয়া কোনো সচেতন মানুষই আপত্তি করবেন না, বরং খুশি হবেন। আম কমলার রস না দিয়েও যারা শুধু বিজ্ঞাপনের জোরে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে আমের বা কমলার ছবিওয়ালা সুদৃশ্য প্যাকেটগুলোতে সত্যিসত্যিই আম কমলার রস আছে তারা আর যাই হোক প্রতারণার অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে পারেন না। জনস্বাস্থ্য রক্ষার খাতিরে রাষ্ট্রীয় ইফতার পার্টিগুলোতো বটেই, বেসরকারি ছোট-বড় কোনো ইফতার পার্টিতেই এসব তথাকথিত জুসের প্যাকেট আর রঙিন ইফতার সামগ্রী বাংলাদেশের মানুষ আর দেখতে চায় না।

আসুন, এবারের রোজার মাস থেকেই আমরা এগুলো বর্জন করি এবং রোজার পরেও তা অব্যাহত রাখি। কারণ শরীরটা আপনার, এর ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব
আপনারও।
(বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য আন্দোলনের অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এ নিবন্ধটি লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক।)
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও।

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন