রেনেসাঁর কবি ইকবাল -১৪
রেনেসাঁর কবি ইকবাল -১৪
আধুনিক যুগে ইসলামী জাগরণ ও মুসলিম সমাজ সংস্কারের অন্যতম পথিকৃৎ আল্লামা ইকবালের চিন্তাধারার অন্যতম প্রধান দিক ছিল পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও চিন্তাচেতনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ইকবালের কবিতা ও লেখনীর সর্বত্র ফুটে উঠেছে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের প্রদীপ্ত এবং সাহসী উচ্চারণ। ইকবালের কবিতার বিশ্লেষকদের মতে ইসলামের প্রতি গভীর ও অবিচল বিশ্বাসের কারণেই ইকবাল পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঝান্ডা নির্ভিক চিত্তে উঁচু করে তুলে ধরতে পেরেছিলেন।
আল্লামা ইকবাল বিভিন্ন উপলক্ষ্য বা প্রাসঙ্গিকতার সুযোগে তাঁর কবিতা ও লেখনীতে পাশ্চাত্যের প্রতি কষাঘাত হেনেছেন। এই কষাঘাত শুধু আধুনিক বা সমসাময়িক যুগের পাশ্চাত্যের ওপর হানা হয় নি। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের পাশ্চাত্যও ইকবালের যৌক্তিক ও ক্ষুরধার লেখনীর আঘাতে জর্জরিত হয়েছে। প্লেটো ও সক্রেটিসের দর্শন চিন্তার কঠোর সমালোচনা করে ইকবাল বলেছেন যে এই দুই গ্রীক দার্শনিকের দর্শন চিন্তাবিদদেরকে বিশ্বের বাস্তবতার উপলব্ধি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। অবশ্য প্লেটো ও সক্রেটিসের দর্শন শুধু যে ইকবালই প্রত্যাখ্যান করেছেন তা নয়। বিশ্বের সমস্যাগুলোর সমাধানে এবং বিশ্বের বাস্তবতা তথা সত্যগুলোর উন্মোচনে এ দুই গ্রীক দার্শনিকের দর্শনসহ গ্রীক দর্শনের ব্যর্থতার কথা আরো অনেক মনীষীও বলেছেন। প্রাচ্যের দর্শন এবং ইসলামী এরফান বা আধ্যাত্মিক রহস্যের জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত ব্যক্তিরা জানেন যে, সত্য বা বাস্তবতাকে পাবার একমাত্র পথ হলো আত্মশুদ্ধি। আরেফদের মতে, সত্যসন্ধানীর বা সত্যপিপাসুর পরিশুদ্ধ আত্মাতেই ঐশী বা খোদায়ী নূর প্রতিফলিত হয় এবং এর ফলে গুপ্ত জ্ঞান তাঁদের কাছে হয় প্রকাশিত । তাই এটা খুবই স্বাভাবিক যে, প্রাচ্যের দর্শন ও ইসলামী এরফান সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকায় ইকবালও গ্রীক দর্শনকে নাকচ করে দেবেন।
দার্শনিক ও মহাকবি ইকবালের দৃষ্টিতে কেবল মহান আল্লাহর বিধান অনুসরণ এবং নবী-রাসূলদের দেখানো পথ বা শরীয়তের পথ ধরেই সত্য বা বাস্তবতা উপলব্ধি করা সম্ভব। এ জন্যেই তিনি লিখেছেন,
আল্লাহর দাস কোনো পদের মুখাপেক্ষী নন
কেউ নয় তার দাস, তিনিও কারো দাস নন
আল্লাহর বান্দা মুক্ত-স্বাধীন, আর এটাই তো যথেষ্ট
তার রাজ্য ও বিধান খোদাদত্ত, আর এটাই তো যথেষ্ট
তার প্রথা, ধর্মমত ও বিবি-বিধান উৎসারিত আল্লাহ হতে
তার ভালো-মন্দ, তিক্ততা বা মিষ্টতা তাও আসে আল্লাহ হতে
স্বার্থপরের মনে অন্যের উন্নতির চিন্তা থাকে না
নিজের লাভ ছাড়া অন্যের লাভ বা কল্যাণ সে দেখে না
কিন্তু ঐশী প্রত্যাদেশ দেখে সবারই স্বার্থ ও প্রগতি
এই দৃষ্টিতে রয়েছে সকলেরই কল্যাণ ও উন্নতি
পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও চিন্তাচেতনার বিরুদ্ধে আল্লামা ইকবালের সংগ্রাম শুধু খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতক বা গ্রীসেই সীমিত নয়। তিনি প্রাচীন যুগের পাশ্চাত্যের চেয়েও সমসাময়িক যুগের পাশ্চাত্যেরই বেশী সমালোচনা করেছেন। তার মতে সমসাময়িক যুগের পশ্চিমা চিন্তাভাবনাই বিশ্বের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। দার্শনিক ইকবাল পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসরণকে হারাম বা অবৈধ বলে মনে করতেন এবং বিজ্ঞানের অপব্যবহারে অভ্যস্ত পাশ্চাত্যের কোনো কোনো অগ্রগতিকে প্রতারণা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন,
ফিরিঙ্গীরা গড়ে তুলেছে অনেক আজব শিল্প-সম্ভার
একটি ফোটা দিয়ে গড়ছে জ্ঞান-সাগর অকূল-পাথার
কিন্তু এসব জ্ঞানই সীমিত মানুষ মারার চিন্তায়
পাশ্চাত্যের সমস্ত জ্ঞান-কৌশল মৃত্যুর সেবক
পাশ্চাত্যের বন্দুকের প্রাণহরণের দক্ষতায়
মৃত্যুর ফেরেশতাও ভয়ে পালিয়ে বেড়ায়
মুসলমানদের মধ্যে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রচলন পাশ্চাত্যের বিরোধীতায় ইকবালের সোচ্চার হবার অন্যতম কারণ । তিনি বিভিন্ন উপলক্ষে ও সুযোগমত নানা পন্থায় পশ্চিমা সংস্কৃতির সর্বনাশা প্রভাব সম্পর্কে মুসলমানদের সতর্ক করার চেষ্টা কোরেছেন। পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতিরোধ ছিল তার অন্যতম উদাত্ত আহ্বান। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন,
ফিরিঙ্গীদের শক্তি তো জ্ঞান আর প্রযুক্তির
এ আগুনেই তাদের মশাল জ্বলজ্বল
জ্ঞান ও প্রযুক্তি মগজে ধারণ করো হে যুবক প্রাণোচ্ছল
হয়ো না অনুসারী পোশাকে-আশাকে ফিরিঙ্গির
মুসলিম দেশগুলোর শোচনীয় পরিস্থিতি এবং অনেক মুসলিম দেশে পাশ্চাত্যের উপনিবেশ পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও চিন্তা-চেতনার বিরুদ্ধে সংগ্রামী হতে ইকবালকে প্রেরণা যুগিয়েছে। উপনিবেশবাদীরা মুসলমানদের সাথে খারাপ ও নির্দয় আচরণ করতো এবং তাদেরকে অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতো। মুসলমানদের ওপর গণহত্যা ও তাদেরকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা এবং তাদের পবিত্র বিষয়গুলোর অবমাননা ছিল পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের নিয়মিত কর্মসূচী। অন্যান্য চিন্তাবিদদের মতো ইকবাল এসব দেখে-শুনে ক্ষুব্ধ ও ব্যাথিত হয়েছিলেন। তাঁর মতে, মুসলমানদেরকে এসব দূর্দশা থেকে মুক্ত করার একমাত্র পথ ছিল সারা বিশ্বের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করা। ইসলামের অনুসরণ থেকে দূরে সরে যাবার কারণেই মুসলমানদের এতো দূর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে বলে ইকবাল মনে করতেন। তিনি এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,
মুসলিম আজ চেনে না তার নবীকে
আল্লাহর ঘর আবার ভরে গেছে মূর্তিতে
ভরেছে লাত, মানাত, ওজ্জা আর হোবলে
ওরা আছে মুসলমানের বগলে
ইকবাল শুধু পাশ্চাত্যেরই সমালোচনা করেন নি। একইসাথে তিনি জুলুম মেনে নেয়ার জন্য প্রাচ্য এবং বিশ্বের উত্তর ও দক্ষিণাংশেরও সমালোচনা করেছেন। তবে তার মূল লড়াই ছিল পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে। কারণ, তার মতে পাশ্চাত্যই সারা বিশ্বে দূর্নীতি ও হানাহানি ছড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা ও দূর্বল বা বঞ্চিতের সহায়তায় এগিয়ে আসার লক্ষ্যে তিনি লিখেছেন,
ফেরাউনদের কাছে বলো সাহসী কথা মুসার মত
যাতে তোমার লাঠিও দরিয়াকে করে দ্বিখন্ডিত
এভাবে দেখা যায় মুসলিম জাহানের উন্নতিই ছিল ইকবালের প্রধান চিন্তা। তাঁর কবিতাতে সব মুসলিম দেশের নাম উচ্চারিত হয়েছে একান্তই নিজের দেশ হিসেবে। প্রত্যন্ত মুসলিম অঞ্চলের দুঃখ-বেদনাও ছিল যেন তাঁর নিজেরই দুঃখ-বেদনা। তিনি প্রত্যেক মুসলিম জনপদকেই পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন